শঙ্কর রায়
লেখক প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবন্ধকার
I’m convinced that capitalism is the worst enemy of humanity and the environment, enemy of the entire planet. — Evo Morales
ক্ষণস্থায়ী অমানিশার প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ফেলে সাইমন বলিভারের প্রেরণার অনিবাত দীপশিখায় আবার ঝলসে উঠেছে এক কোটি মানুষের দেশ বলিভিয়া। এত ষড়যন্ত্র করে, খোলাখুলি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মদত সত্ত্বেও বলিভিয়ার বামপন্থীদের রোখা গেল না। গত ১৮ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতে সমাজতন্ত্রীরা আবার ক্ষমতায় ফিরে এল। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুয়ান ইভো মোরালেস আয়মা-র নেতৃত্বাধীন মুভিমিয়েন্তো এ সোশ্যালিজমো (ম্যাস বা সমাজতন্ত্র অভিমুখী আন্দোলন) প্রার্থী ও মোরালেস সরকারের অর্থমন্ত্রী ৫৭ বৎসর বয়স্ক লুইস আর্সে (লুই আলবের্তো ‘লুচো আর্স কাটাচোরা)— চলতি নাম লুচো— প্রায় ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম দক্ষিণপন্থী জোট ইউনিদাদ ন্যাশিওনাল জোটের প্রার্থী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-অনুগত ব্যবসায়ী কার্লোস মেসা ২৯ শতাংশ ভোটও পাননি। দেশের সুপ্রিম ইলেকশন ট্রাইবুনাল ২৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে। নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের প্রধান সালভাদোর রোমেরো ফল ঘোষণারকালে বলেন, ‘করোনা সত্ত্বেও ৮৮.৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকায় ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ ভোটদান।’ জাতীয় আইনসভা হাউস অফ কংগ্রেসেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে ম্যাস।
আবার মুক্তির গন্ধবহে উদ্বেল আন্দেজ পাহাড়ঘেরা দেশে। ম্যাস-এর বিপুল বিজয়ের পর থেকেই রাজধানী লা পাজ আতসবাজির আলোকে প্রোজ্জ্বল। প্রায় এক বছর ধরে ম্যাস-এর পালটা অতি-দক্ষিণপন্থী নয়া–উদারনীতি অনুসারী দলটি রাজনৈতিক দমন ও দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে জড়িত হুকমতে উত্যক্ত বলিভিয়ার জনগণের পদ-ভোটে প্রত্যাখ্যাত। এবারের নির্বাচনের ফলাফল এক জাতীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক অভ্যুত্থানের মত, যাতে জনমতের বিপ্লবী মেজাজ প্রতিফলিত। আরেকদিকে মোরালেস-এর সুশাসনের প্রতি প্রবল আস্থাসূচক সঙ্কেত। মোরালেসের আমলে বলিভিয়া থেকে মার্কিন সরকারকে সমস্ত সামরিক ঘাঁটিগুলি তুলে দিতে হয়েছিল। তিরিশ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে জীবনধারণের বিভীষিকা-মুক্ত হয়েছিলেন। তেরো বছরের শাসনে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিচারে মোরালেস শাসনের সবচেয়ে বড় অবদান আইএমএফ-এর ঋণ শোধ, যা আমরা ভাবতেই পারি না। দ্বিতীয়, অর্থনৈতিক উল্লম্ফন— মুদ্রাস্ফীতির হার কমানো— ২০০৮-এ ছিল ১৪ শতাংশ, ২০০৯ ও ২০১০-এ যথাক্রমে ৩.৩ শতাংশ ও ২.৫ শতাংশ। একবারই ৯.৯ শতাংশ হয়েছিল, নচেৎ ৬ শতাংশের মধ্যেই ছিল। লাতিন আম্রেরিকায় এটা অভাবনীয়। উগো শ্যাভেজের আমলে ভেনেজুয়েলার মুদ্রাস্ফীতি হার ২৯ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল— বিশ্বের সর্বোচ্চ। এখন ৬০০ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি হার ৬ শতাংশ ছুঁয়েছিল। জাতীয় অর্থব্যবস্থার গতিমুখ ছিল আর্থ-সামাজিক অসাম্যের বিপ্রতীপ। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) ১১০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৪৩০০ কোটি ডলারে বেড়েছিল।
ফিরে এসেছেন মানুষী-মানুষের প্রিয় মোরালেস। প্রায় এক বছর তিনি মেক্সিকোয় রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। বাধ্য হয়েই তাঁকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। নচেৎ তিনি বাঁচতেন কি না সন্দেহ। বলিভিয়ার আপামর জনগণ তা সইতে পারতেন না। মোরালেস দেশে ফিরে সটান চলে গেলেন, কোকো-উৎপাদনকারী শ্রমিক-অধ্যুষিত কোচাবাম্বায়, সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুইস আর্স এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড চোকুয়ুঙ্কা, মোরালেসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শহরের উপকণ্ঠে একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত জাতীয় সভায়। উপস্থিত ছিলেন ম্যাস-এর ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ, কৃষক এবং আদিবাসীরা। মোরালেস কোকালোরাস (বলিভিয়া ও পেরুর কোকোপাতার চাষি) আদিবাসীদের মধ্যে একজন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। গড়ে তোলেন ম্যাস, যার গণভিত্তি খনিশ্রমিক ও কৃষক জনতা। কিন্তু তাঁদেরকে ‘সরকারি মার্কসবাদীরা’ (লেনিনবাদী-স্টালিনবাদী-মাওবাদী) দূরে ঠেলে রেখেছিলেন। ট্রটস্কিবাদীরাও একই ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু আদিবাসীদের সঙ্গে ম্যাসের যোগসূত্র গভীর ছিল।
আর্স তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন তিনি ম্যাসের জাতীয় সভায় অংশ নিতে পেরে তৃপ্ত। দুর্দান্ত প্রত্যাশা তৈরি করেছে ম্যাস। ম্যাস এমন একটি দল যাকে “দেশ তার প্রথম শক্তি বলে মনে করেছিল। আমরা সামাজিক সংগঠনের প্রস্তাবগুলি শুনলাম, বিশ্লেষণ করলাম তাদের অবদানের সঙ্গে,… আমরা বলিভিয়ার জনগণের মঙ্গলার্থে পরিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে আরও গভীরতর করে চলব।” আর্স টুইট করে যা স্প্যানিশ ভাষায় বলেন, তার সার-ভাষান্তর: ‘আমরা ম্যাসের জাতীয় সম্প্রসারণ চর্চায় অংশ নিই, সামাজিক সংগঠনের প্রস্তাবগুলি শুনি এবং বিশ্লেষণ করি। আপনার (অর্থাৎ মোরালেসের) অবদানের সঙ্গে আমরা বলিভিয়ার মানুষের ভালোর জন্য পরিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে আরও গভীরতর করব।’ সমবেত মানুষী-মানুষ জবাবে বলেছেন: ‘আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ! আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি লুচোর যত্ন নেওয়া। তার জন্য অনেক প্রচেষ্টা এবং ত্যাগের প্রয়োজন। আদর্শগত ও কর্মসূচিভিত্তিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ ও রূপায়ণ। মোরালেস পরবর্তীকালে কার্যত অভ্যুত্থানে গড়া সরকারের ১১ মাস জনসাধারণের আর্থিক দুর্গতির জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। “আমাদের দুর্ভাগ্য সে সরকার আমাদের দিয়েছে এক ভাঙাচোরা অর্থব্যবস্থা। আমরা ভাই লুচোর কাছ থেকে এ নিয়ে কিছু কথা শুনলাম।”
ইতিমধ্যে মোরালেস ম্যাসের জাতীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
বলিভিয়ার বিদেশমন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে বলিভিয়া সরকারিভাবে আবার অ্যালায়েন্স ফর দি পিপলস অফ আওয়ার অ্যামেরিকা-পিপলস ট্রেড ট্রিটি বা অ্যাল্বা-টিসিপি, কমিউনিটি অফ ল্যাটিন অ্যামেরিকান অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান স্টেটস বা সেলাক ও ইউনিয়ন অফ সাউথ অ্যামেরিকান নেশান্স বা ইউনাসুর=এর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্স্থাপিত করল, যা পূর্বতন মার্কিন তাঁবেদার সরকার ছিন্ন করেছিল।
মোরালেসের অনুপ্রেরণায় আবার জেগে উঠেছে সমাজতন্ত্রমুখী ম্যাস-নেতৃত্বাধীন বলিভিয়া। মোরালেসের থেকে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে গেলেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর প্রাক্তনী ডঃ স্ভেন হার্টেন। অধ্যাপক কোচাবাম্বার কোকো উৎপাদকদের ফেডারেশনের অফিসের সামনে কাকভোরে পৌঁছে শুরু করেন সাক্ষাৎকার। তিনি পেরুতে বিশ্বব্যাঙ্কের হয়ে কাজ করেছেন, বর্তমানে ‘জার্মান ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইভ্যালুইয়েশন’-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। ট্রেড ইউনিয়ন অফিস থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় নিজে গাড়ি চালাতে চালাতে মোরালেস তাঁর জীবনকথা শোনান। ছোটবেলার কথা টেনে এনে ইভো বললেন তাঁর বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক, তবে ছেলেকে পড়াশোনা করানোর প্রতি তাঁর চিরকালই আগ্রহ ছিল। কিন্তু ছিল না আর্থিক সঙ্গতি। লামা পালন করা থেকে ক্ষেতের কাজ— এতেই অধিক সময় চল্র যেত ইভোর। বিনোদন বলতে শুধু ছিল ফুটবল। দক্ষিণ আমেরিকার বহু ছেলের মতোই মোরালেস ছিলেন ফুটবলপাগল। লামা চরানোর ফাঁকে ফাঁকেই ছেঁড়াখোড়া চামড়ার বল নিয়েই খেলতেন। পাঁচ বছর বয়সে ইসালওই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলে, এরপর একে একে মাধ্যমিক স্কুল আর কলেজের পড়াশোনাও শেষ করেন। ভালো ছাত্র হলেও উচ্চশিক্ষার শেষে ডিগ্রি পেতে তখনকার বলিভিয়ায় যে পয়সা লাগত তা দেওয়ার ক্ষমতা তার পরিবারের ছিল না, তাই পরীক্ষায় পাস করেও ডিগ্রি পাননি।
রাজনীতি নিয়ে প্রথম দিকে তেমন মাথা ঘামাতেন না, তাঁর পরিবারের লোকেদের দিন চালাতেই সময় কেটে যেত— রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় ছিল না, পনেরো বছর বয়সে জ্ঞাতিভ্রাতা মার্সিয়াল মোরালেস আয়ামার কাছে চে গেভারার কথা শোনেন। চে তখন বলিভিয়ায় সক্রিয়। তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন ইভো। তখন থেকেই তিনি কমিউনিস্ট। বলিভিয়ায় খনিশ্রমিকদের মধ্যে চে কাজ করতেন। তিনিই ইভোকে প্রথম সমাজতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে পরিচয় ঘটান। পড়েছিলেন ফাউস্টো রেইনাগার ‘লা রেভোলিউসিওন ইন্ডিয়া’— ক্যাথলিক ধর্ম আর স্প্যানিশ সংস্কৃতির চাপে বলিভিয়ার আন্দিয়ান জনজাতি যে নিজের ভাষা-সংস্কৃতি ভুলে যেতে বসেছিল, তা ফেরত পাওয়া কতটা জরুরি এই বইটি থেকেই জানেন ইভো।
হার্টেনকে শোনালেন কোকো চাষিদের সিন্ডিকেটের মিটিং-এর মাঝে ফুটবল খেলার গল্প, কোচাবাম্বার জল বেসরকারিকরণের প্রতিবাদ আন্দোলনের কাহিনি, দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জোরালো সংগ্রামের কথা। তাঁর নিজের কথার চেয়ে সাহসী কমরেডদের কথাই বেশি বলছিলেন।
শান্তিপূর্ণ পথে সমাজ পরিবর্তনের আরেক এক নতুন সম্ভাবনা আজ লাতিন আমেরিকায় জায়মান, যার সূচনা হয়েছিল ১৯৭০ সালে চিলিতে প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দের নেতৃত্বাধীন ইউনিদাদ পপুলার সরকারের আমলে। সিআইএ ও মার্কিন বহুজাতিক কর্পোরেশনের যৌথ চক্রান্তে এক প্রতিবিপ্লবী ক্যু-দে-তা সেই নিরীক্ষাকে আপাত চোখে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছিল, পারেনি। তার প্রমাণ বলিভিয়ার জাগরণ। চিলিতেও গণতান্ত্রিক মেজাজ পুরোমাত্রায় ফিরে আসছে।
এ বছর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা এঙ্গেলসের জন্মদ্বিশতবর্ষপূর্তি (২৮ নভেম্বর)। ‘ডায়ালেক্টিক্স অফ নেচার’ (যা তিনি পুরো লিখে যেতে পারেননি)-এ এঙ্গেলস বলেছিলেন দ্বন্দ্বতত্ত্বে অবিসংবাদী বা নিরঙ্কুশ বলে কিছু নেই। যাঁরা বলে এসেছেন বা বলছেন যে সমাজতান্ত্রিক (মার্ক্স-এঙ্গেলসের মতে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সমার্থক। তাঁরা কোথাও বলেননি, সাম্যবাদের প্রথম বা পূর্বস্তর সমাজতন্ত্র) বিপ্লব কেবল সশস্ত্র পথেই সম্ভব, তাঁরা বিষয়টিকে নিরঙ্কুশতায় পর্যবসিত করেন। আবার এও নয় যে শান্তিপূর্ণ পথেই কেবল বিপ্লব সম্ভব। দুই পথই খোলা। তবে মার্ক্স-এঙ্গেলসপন্থীরা সব সময়েই শান্তিপূর্ণ পথে সমাজবদলপ্রত্যাশী। তাঁরা অ-শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নেন কেবলমাত্র বাধ্য হয়েই। লাতিন আমেরিকার প্রায় সর্বত্র সেই নিরীক্ষা জায়মান।