সত্যব্রত ঘোষ
লেখক চলচ্চিত্রবেত্তা, প্রাবন্ধিক
চলে যে যাবেন তার মানসিক প্রস্তুতি হয়তো ছিল৷ তবুও ক্ষিদ্দার তিনটি অমোঘ শব্দ বুকের ভিতরে বারবার অনুরণন তুলছিল: ফাইট, কোনি ফাইট! দীর্ঘ সময় ধরে প্রাণপনে লড়াইয়ের পর সব যখন শেষ, তখন হৃদয়ে যে শূন্যতা তা থেকেই শ্রদ্ধার্ঘের ভাষা খুঁজছি৷
সৌমিত্র চট্বোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বাংলা চলচ্চিত্র আরও রিক্ত হল— এটুকু বললেই ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণাটি প্রতীত হয় না। অভিভাবকসম বটবৃক্ষের মতো যে মানুষটি বাংলার সৃজনশীলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁর অনুপস্থিতির বিষণ্ণতা রয়েই যাবে।
এর একটি বড় কারণ হল, বাংলা চলচ্চিত্রের যে গৌরবজনক অধ্যায় গত শতাব্দীর পাঁচ, ছয় এবং সাতের দশকে রচিত হয়েছিল, যে অধ্যায়টিতে বাংলা সিনেমা আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে পৌঁছায়, সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ৷ সত্যি কথা বলতে কি, এযাবৎ তিনিই ছিলেন সেই ফলপ্রসু সময়ের সঙ্গে আমাদের অমলিন এক যোগসূত্র৷ অথচ নিজেকে বিশ্বমানের এক অভিনেতার প্রতিরূপটিতে আবদ্ধ না রেখে উনি বরাবর প্রবীণ ও নবীনদের পাশে থেকে মান উন্নয়নের প্রেরণা দিয়েছেন৷
দীর্ঘ ৬০ বছর পরেও অধিকাংশ বাঙালির মনে উনি ‘অপু’। বাঙালির আটপৌরে জীবনের আনন্দ, দুঃখ, রাগ, হতাশা, আর স্বপ্নকে নিজের বোধ ও মেধায় তীক্ষ্ণতর হয়ে গহীনে প্রবেশের সাধনাকে স্বভাবসিদ্ধ করে ফেলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়৷ সংবেদনশীল এক অভিনেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিতে তুষ্ট না থেকে কবিতা, প্রবন্ধ এবং নাটক রচনার মধ্যেও নিজেকে অনবরত আবিষ্কারে ব্যস্ত রেখেছেন। অবিচ্ছিন্ন এই নিবিড় প্রক্রিয়াগুলিতে রত থেকেও মানুষদের আপন করে নিতে কখনও বিরক্ত হননি উনি।
চলচ্চিত্রের মতো একটি ব্যয়বহুল পেশাদারি ক্ষেত্রটিতে, যেখানে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের চাপে কাজের প্রতিটি বিভাগ সর্বক্ষণ তটস্থ, সেখানে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলাটাকে অনায়াস করে তুলেছিলেন উনি৷ অভিজ্ঞ মানুষদের মতে, রাধামোহন ভট্টাচার্য এবং বসন্ত চৌধুরী— বিগত যুগের দুই ক্ষমতাবান অভিনেতা এবং মননশীল ব্যক্তিত্বদের মতো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার সংস্কৃতিতে বহুমুখী অবদান রেখে শুধু সমীহই নয়, মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসাও আদায় করেছেন৷
যে বাণিজ্যিক প্রকরণে চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতাদের কাজ করতে হয়, তাতে সাধারণ দর্শকের ভিড় বাড়ানোর প্রত্যাশা অতিরিক্ত। ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে পর্দায় আবির্ভূত হওয়ার পর যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে বাণিজ্যিক বাংলা ছবির পরিচালকদেরও পরম আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন, তা শুধুমাত্র ওনার অভিনয়ের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠার জন্যেই নয়৷ আন্তরিক ব্যবহার এবং ইতিবাচক মানসিকতার জন্যেও প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতারা বারবার ওনার সান্নিধ্য চেয়েছেন৷ এর ফলে ‘অপুর সংসার’ পরবর্তী এক দশকে উনি সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং তপন সিংহ-র পাশাপাশি অজয় কর, অসিত সেন, তরুণ মজুমদারের ছবিগুলিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করে সাফল্য অর্জন করছেন৷
এর পরের দুটি দশকে মননশীল এবং বাণিজ্যিক— দুই ধারাতে সাবলীলভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ১৯৭৮ সালে উনি আবার মঞ্চাভিনয়ে ফিরে এলেন৷ এবং বাংলার দর্শক ওনার মধ্যে ক্ষমতাবান এক নাট্যকার, নির্দেশক এবং অভিনেতাকে নতুনরূপে আবিষ্কার করবার উদযাপনের সুযোগ পায়৷ অন্যদিকে, নিয়মনিষ্ঠ অভিনয়ের প্রতি অটুট আস্থার কারণে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে বাংলা সিনেমার অন্যতম এক চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ওনাকে আটের দশকে নতুন করে আবিষ্কার করি সরোজ দে-র ‘কোনি’ এবং রাজা মিত্র-র ‘একটি জীবন’ ছবিতে৷ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও নিজের অভিনয়কে বারবার ভাঙতে চেয়েছেন উনি। পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অগ্রদানী’, তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’, ‘অন্তর্ধান’ এবং ‘হুইলচেয়ার’-এ তা স্পষ্ট। গৌতম ঘোষের ‘দেখা’য় তিনি আবার নভুন গভীরতায় নিজেকে প্রকাশ করেন৷ এবং গৌতম ঘোষেরই ‘আবার অরণ্যে’-তে প্রৌঢ় অসীম হিসেবে ১৯৭০-এ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র স্মৃতিকে যখন উনি ফিরিয়ে আনেন, তখন অপূর্ব এক বৃত্ত আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।
তবে চলচ্চিত্রই তো নিজের অভিব্যক্তির একমাত্র পরিসর ছিল না ওনার৷ নাটক ও কবিতা রচনা, আবৃত্তি এবং পরবর্তীকালে চিত্রাঙ্কনেও নিজের ভাবনাগুলিকে পরম উৎসাহে পল্লবিত করতে সমর্থ ছিলেন উনি। হয়তো তাই হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করবার বিশেষ তাগিদ উনি অনুভব করেননি৷ নায়কসুলভ আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না উনি। তাই পেশাদার অভিনেতা হিসেবে আরও অর্থকরী পথে নিজের ভাগ্যান্বেষণ না করে উনি বাংলার শিল্পমাধ্যমগুলিতে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন৷ এবং আদ্যোপান্ত মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে পরম যত্নে সমৃদ্ধ করেছেন সেই সৃজনশীল ক্ষেত্রগুলিকে।
নাট্যচর্চার প্রতি ওনার আগ্রহ তো ছাত্রাবস্থা থেকেই ছিল, যা নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির সংস্পর্শে আরও শাণিত হয়। কিন্তু তারই একটি শাখা হিসেবে বাচিক শিল্পটিকে দেখতে পারি৷ মনে আছে, আটের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’-র শ্রুতিনাটকটির কথা৷ বিকাশ রায়ের পরিচালনায় উপন্যাসের নায়ক অমিত রায়-কে কন্ঠস্বরে মূর্ত করে তুলেছিলেন উনি৷ লিলি চক্রবর্তী, নীলিমা দাশ, শ্রাবন্তী মজুমদারের কণ্ঠসহযোগিতায় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শিলং-কে কাছে এনেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ কণ্ঠস্বরের সুনিয়ন্ত্রিত ওঠানামা দিয়ে তৈরি নাট্যমুহূর্তগুলিকে সাধারণ মানুষের মনে সাবলীলভাবেই সঞ্চারিত করা গেছিল৷
জনপ্রিয় এক চলচ্চিত্র তারকার পরিচিতিকে অতিক্রম করে নিজের শৈল্পিক অভিব্যক্তি এবং জ্ঞানচর্চাকে সম্পুর্ণ অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ যা তিনি এর আগে (১৯৬৪) থেকে ‘এক্ষণ’ নামের পত্রিকাটির যৌথ সম্পাদক হিসেবে ইতিমধ্যেই করেছেন৷ এখানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ব্যাক্তিগত সম্পর্কটিকে তিনি সদর্থকভাবে ব্যবহার করে ‘এক্ষণ’-এ এমন মূল্যসংযোজন করেছিলেন যা বিকল্প মননশীল সাহিত্যসম্ভারে চিরসম্পদ হয়ে রয়ে যাবে।
বস্তুত, এখন ডিজিটাল যুগে কলম দিয়ে লেখার অভ্যাসটি কিবোর্ডে ঝড় তোলায় বিবর্তিত হয়েছে৷ এতে দক্ষতা অর্জন করা তুলনামূলকভাবে কঠিন নয় বটে৷ কিন্তু কাগজ, কলম বর্জিত এই যন্ত্রনির্ভরতায় লেখা ও ছাপার সৌষ্ঠব বাড়লেও উষ্ণতাটুকু বাদ রয়ে যায়, যার মধ্যে ছিল প্রাণবন্ত মানবিক স্পর্শ। সুলভতা এখন আধুনিকতার অন্যতম দাবী হওয়ায় অল্প সময়ে কাজ সমাপনের শর্তটি মুখ্য হয়ে উঠছে৷ এর বিপ্রতীপে সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা এমন এক জগতের সন্ধান পাচ্ছি যেখানে সদর্থক চিন্তনগুলিকে নিখুঁত কাজে পরিণত করবার জন্য সংঘবদ্ধ এবং ব্যক্তিগত আন্তরিক সাধনার কোনও পরিপূরক ছিল না। বাংলার সেই সাম্প্রতিক ইতিহাসের সঙ্গে আজকের ডিজিটাল হাইওয়ের মধ্যে যে সেতু, তার অন্যতম এক স্তম্ভ হিসেবে আমরা সৌমিত্র চট্টৌপাধ্যায়কে ক্রমশ চিনেছি৷
ওনার সুঠাম চেহারা, সারল্যভরা গভীর কণ্ঠস্বর, নিষ্ঠাভরা মেধা এবং বন্ধুসুলভ আচরণ আজ স্মৃতি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অবসান মানে আমাদের জীবনচর্চা থেকে বাংলার নিজস্ব সৌজন্যমূলক সংস্কৃতি অনেকটাই অবসৃত হল। নতুনত্বের পিপাসু আমরা হয়তো আধুনিকতর অভিব্যক্তির জন্যে অন্য এক পরিসর খুঁজে যাব। কিন্তু মধ্যবিত্ত মানদণ্ডে যা ধীশক্তির আলোকে উজ্জ্বল, সেই নিয়মনিষ্ঠ মার্জিত সৌন্দর্যের প্রতি মর্যাদায় যেন আমরা কার্পণ্য না করি, যার শেষ প্রতিভূ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷