অশোক মুখোপাধ্যায়
[১৩]
তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, নৃবিজ্ঞানী, গবেষক, লেখক এবং পাশাপাশি বিপ্লবী কর্মী। তিনি হয়ে উঠলেন আরও অনেক কিছু। তিনি দীর্ঘদিন নারদনিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সেই মতো কাজ করেছেন। সেই তিনিই একদিন হয়ে উঠলেন মার্ক্সবাদী এবং বলশেভিক কর্মী। অবশেষে একদিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞান সংস্কৃতির একজন বড় মাপের সংগঠক। আর তাঁর এই ক্রমাগত বড় হয়ে ওঠার পেছনেও ছিল বয়সে ছোট কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বহু দিনের হাতের চারুকলা, নিরন্তর এক নেতৃত্বকারী সাংগঠনিক তুলির টান। চলুন, আজ এই বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লবীর সঙ্গে পরিচিত হই। যদি এইভাবে পরোক্ষে হলেও লেনিনের হস্তশিল্প আমাদের উপরও কিছু প্রভাব ফেলে!
বিস্মৃতপ্রায় বলছি কেন? আজকের দিনে, উইকিপিডিয়ার যুগে…?
বেশ তাহলে একবার জাল ফেলে দেখেই নিন। সেখানে বাবা মা-র খবর ছাড়া ১৯২০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনের আর কোনও তথ্যই নেই। নিশ্চয়ই পায়নি বলেই দিতে পারেনি।
ফেলিক্স কন (১৮৬৪-১৯৪১)। পোল্যান্ডের মানুষ। বাবা পোলিশ হলেও মা ছিলেন জর্জিয়ান ইহুদি। জিনের এই বহুজাতিক মিশ্রণ থেকে যে কীভাবে একদিন তাঁর মনেও আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের বীজ উপ্ত হয়েছিল তা বলা শক্ত। পোল্যান্ড তখন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত অধীনস্থ রাজ্য। পোলিশদের মনে তখন রুশি জারের বিরুদ্ধে প্রবল ধূমায়মান বিক্ষোভ। জাতীয় স্বাধীনতার ধিকি ধিকি আকাঙ্ক্ষার আগুন জ্বলছে দিকে দিকে। সেই আগুনে একদিন হাত পুড়িয়ে ফেলিক্সও দীক্ষা নিলেন। জড়িয়ে পড়লেন প্রলেতারিয়েত সোস্যাল-রেভল্যুশনারি পার্টি (পিএসপি)-র সঙ্গে। রাশিয়ার নারদনিকদের সঙ্গেই যাদের মতের মিল। ১৮৮৩ সাল থেকে। যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল “violent overthrow of the existing state, social and economic order in Russia.” কোনও “যদি” “তবে” শব্দভূষণ ব্যবহার না করেই।
সেই দলের কাজ করতে গিয়ে ১৮৮৫ সালে তিনি ধরা পড়েন জারের সামরিক পুলিশের হাতে। ওয়ারশতে এক বিশেষ ট্রাইবুন্যালে অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে তাঁরও বিচার হয়। ১৮৮৬ সালে জারীয় কাজিদের রায়ে চারজনের মৃত্যুদণ্ড হয়; বাকি অভিযুক্তদের দীর্ঘ দিনের মেয়াদি সশ্রম কারাদণ্ড ও নির্বাসন হয়। ফেলিক্সও ছিলেন দশ বছরের নির্বাসন ও কঠোর শ্রমের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি।
তাঁর স্ত্রী ক্রিশ্চিনাও ছিলেন জেলফেরত রাজনৈতিক কর্মী। ফেলিক্স যখন কারার (কারা একটি জায়গার নাম) জেলে বন্দি তখন তিনি ছাড়া পেয়ে তিন সন্তানকে নিয়ে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে অতি কষ্টে দিন পার করছিলেন। জারের জেলগুলিতে তখন রাজনৈতিক বন্দিদের উপর নিয়মিতভাবে নানা অছিলায় বীভৎস দৈহিক নির্যাতন করা হত। এর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিবিধ: শুধু জেলের ভেতরে নয়, বাইরেও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা, যাতে তারা বুঝেশুনে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে নামে; আর জেলের ভেতরেও কারারক্ষীদের নানা রকম জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেন বন্দিরা মুখ না খোলে। প্রতিবাদ না করে।
কারা জেলে থাকার সময় ১৮৮৯ সালে একবার স্থানীয় প্রশাসক হুকুম দিল, সাধারণ অপরাধীদের মতো রাজনৈতিক কয়েদিদের উপরও ইচ্ছা মতো দৈহিক শাস্তি দেওয়া যাবে। হুকুম আসতে না আসতেই কাজ শুরু হয়ে গেল। রাজবন্দিরা তখন ঠিক করলেন, তাঁরা প্রতিবাদ করবেন। সে সম্পর্কে নানারকম প্রস্তাব এল। মন্ত্রীকে চিঠি লিখে আবেদন করা, বাইরে একটা লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করা, ইত্যাদি। চেনাজানা নানা পদ্ধতি। ফেলিক্স কন বললেন, না, খুব কঠোর, আরও নির্মম হতে হবে সেই প্রতিবাদ। আমরা ব্যাচ বাই ব্যাচ কয়েকজন আত্মহত্যা করব। তাতে জেলের বাইরে হইচই পড়ে যাবে। কনের স্বভাবের একটুখানি আন্দাজ পাঠক পাবেন এইখানে।
তারও প্রতিবাদ হল। প্রচুর তর্কাতর্কি হল জেলের মধ্যে। বাঁচামরার সার্থকতা নিয়ে অনেক দার্শনিক বাতচিতও হল। তবে শেষ অবধি কনের প্রস্তাবই গুরু সংখ্যার ভোটে গৃহীত হল। তালিকাও তৈরি হয়ে গেল, কারা কারা পর পর কারাগারে বিষ খেয়ে প্রাণ বিসর্জন দেবে।
কিন্তু তালিকাকে হার মানিয়ে প্রথম প্রাণ দিলেন এক মহিলা বন্দি। সেও এক অদ্ভুত কায়দায়। কারাধ্যক্ষকে কানে কানে কিছু বলার অছিলায় কাছে যেয়ে তাকে কষিয়ে এক থাপ্পড় মারেন সেই যুবতী। পরে তাঁকে পিটিয়েই মেরে ফেলা হয়। আর তারপরই তিন জন নারী বিষ পান করলেন।
মেয়েরা এগিয়ে গেলে বাকিরা কী করে পিছিয়ে থাকে? চোদ্দ জন বন্দি মরার লাইনে দাঁড়িয়ে গেল— তার মধ্যে আবার নজনই ছাত্র, খারকভ, মস্কো, কিয়েভ, ওয়ারশ এবং পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের। ফেলিক্সও তখন ছাত্রই। তিনি তো আগে থেকেই লাইনের পুরোভাগে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অন্য কয়েকজন মরে গেলেও বিষের ক্রিয়া তাঁর শরীরের উপর সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই জেলের ডাক্তার তাঁকে কায়দাকানুন করে বাঁচিয়ে তুললেন। ভাগ্যিস তুলেছিলেন! নইলে আমরা আজ লেখার জন্য এই চরিত্রটিকে পেতাম না।
সেই মারণ প্রতিবাদে কাজ হল। রাজবন্দিদের উপর দৈহিক নির্যাতনের নির্দেশ প্রত্যাহৃত হল। কিছু দিন পরে, দশ বছরের মেয়াদ শেষে, ফেলিক্স কারাগারের বাইরে নির্বাসিত হলেন। তুন্দ্রা অঞ্চলের নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পৌঁছলেন মিনুসিনস্কে। সায়ান পর্বতের সানুদেশে।
আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হল কমরেড লেনিনের। ১৮৯৭ সালে। তিনিও তখন সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। উলিয়ানভ উকিলের পরিচয়ে।
লেনিন কিন্তু প্রথম আলাপেই জমিয়ে ফেললেন সম্পর্ক। এক আজীবন ঘনিষ্ঠতা ঘনিয়ে উঠল এই দুই অসমবয়সী বন্ধুর মধ্যে। দুজনেই আগে থেকে দুজনের সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছিলেন। যেমনটা রাজনীতিতে হয়ে থাকে আর কি! আর, জারের রাশিয়ায় তখন কারাগারের ঘটনাবলিই প্রধান এবং সংখ্যাগুরু সংবাদ। উলিয়ানভও তখন সামারা অঞ্চলে তাঁর সাংগঠনিক কাজের জন্য যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে ফেলেছিলেন। ফলে উভয়েরই আগ্রহ ছিল অপর জনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং এক সঙ্গে দু-চার পা ফেলা যায় কিনা দেখার। দুজনেই পরস্পর সম্পর্কে কিছু আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে ফেললেন অচিরেই। যা একে অপরকে প্রভূত সাহায্য করতে পারে।
লেনিন প্রথম আলাপে নারদনিক মতাদর্শের ভুলভ্রান্তি নিয়ে একটা কথাও তুললেন না। নারদনিক বিপ্লবীদের সংগ্রাম, জেলখানায় তাঁদের উপর নির্যাতন— এসব নিয়েই তিনি কথা বললেন বেশি। খোঁজখবর নিলেন নানা জনের। ফেলিক্স জানতেন, লেনিনের বড় ভাইও একই সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছেন, ফাঁসি হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু ইনি সেই পথে নেই, অন্য পথ অবলম্বন করেছেন। মার্ক্সবাদী পথ।
লেনিন স্থানীয় সংগ্রহশালায় যাবেন, কন তাঁর সঙ্গী। স্থানীয় গ্রন্থাগারে কিছু বইপত্তর আছে কিনা জানতে হবে এবং থাকলে সেগুলো তুলে আনতে হবে। কন সেই ব্যাপারে খুব নির্ভরযোগ্য সহকারী। লেনিনকে শীতের জন্য ফেল্ট জুতো, হ্যারিকেন এবং একটা অ্যালার্ম ক্লক কিনতে হবে। মিনুসিনস্কের গ্রামীন দোকানপাটে কোথায় কী পাওয়া যাবে? কন সব যোগাড় করে দিলেন।
অ্যালার্ম ক্লক কেন? কন একটু অবাক।
“আর বলবেন না, সারা দিনে প্রচুর কাজ এবং রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক রকম চিন্তা মাথায় থাকলেও ঘুমটা আমার বড্ড জেদি। নিজে থেকে ভাঙে না। ভাঙাতে হয়।”
লেনিন সবচাইতে চমৎকৃত হলেন সংগ্রহশালায় গিয়ে। সেখানে হেন জিনিস নেই যার সম্বন্ধে ফেলিক্স কনের জ্ঞানের অভাব দেখা গেল। বিশেষ করে রাশিয়ার বিভিন্ন জনজাতির ব্যবহৃত সাংস্কৃতিক দ্রব্য সম্পর্কে। “আপনার নৃজাতিবিদ্যায় খুব আগ্রহ দেখছি”, লেনিন বলে ফেললেন।
“এই নিয়েই তো আছি এখানে। ছোট জায়গা। বাকি যা দুদিনেই সব জানা হয়ে যায়।”
“তাই নাকি? সে কী?”
“আর বলবেন না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এর চাইতে জেলের কুঠুরিই যেন ভালো ছিল। রোজই কিছু না কিছু ঘটত। এখানে সব যেন একরকম অবস্থায় থেমে আছে।”
“আপনি এই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখছেন না কিছু?”
“হ্যাঁ, লিখছি”, কন জবাব দিলেন, “আমি গত বছর নামস্ক উলুস অঞ্চলে খাতিন-আরিনস্ক স্কপৎসি লোকজনদের নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিলাম। এছাড়া স্থানীয় ইয়াকুত জনজাতির জীবনযাত্রা এবং চাষবাসের পদ্ধতি নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করেছি। গত বছরই তার একটা অংশ Proceedings of the East-Siberian Department of the Geographical Society–তে ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলাম।”
“সেই প্রবন্ধে সাড়া পেয়েছেন কেমন?”
“মোটামুটি। কিছু কিছু নৃতত্ত্ববিদ আমার কাজের উল্লেখ করেছেন তাঁদের পেপারে।”
“বাঃ, সামনে কী নিয়ে কাজ করতে চান?” লেনিন জানতে চাইলেন।
“আমি আর একটা কাজ প্রায় করে এনেছি: Physiological and biological data on the Yakuts; হয়ত ছাপাতেও পারব। সাইবেরিয়ার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখি।” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “জানেন ইলিচ, এই সব জনজাতির সদস্যরা সংখ্যায় বেশ কমে আসছে। এদের চাষের জমি, এদের ভোগের জঙ্গল— সব স্থানীয় জমিদাররা নিয়ে নিচ্ছে। প্রত্যেক বছর শীতের কামড়ে এদের কিছু লোক নিকেশ হয়ে যায়। আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরম করার এদের সামর্থ্য নেই যে। উপর থেকে না দেখলে এরা বোধ হয় নিঃশেষ হয়েই যাবে।”
লেনিনও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কথাটা যেন ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “আপনি মানবেন কিনা জানি না, মানবজাতির এই দুর্বল সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যও জারতন্ত্র জমিদারতন্ত্রের অবসান চাই। চাই সমাজতন্ত্র। শ্রমিকশ্রেণির শাসন। শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী। বিপ্লবই এদের একমাত্র বাঁচাতে পারবে। রাষ্ট্রের সুরক্ষা দিয়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
কন উত্তর দিলেন, “আমি একটু একটু আপনার কথা বুঝতে পারছি, কমরেড ইলিচ।”
সেই বছর আর একবার লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ফেলিক্স কনের। পরের সাক্ষাৎ ঘটে আরও প্রায় দশ বছর পরে। মাঝখানে ১৮৯৮ সালে আসেন নাদেজদা ক্রুপস্কায়া এবং তাঁর মা। সুশনস্কি-তে লেনিনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। পথে মিনুসিনস্কে তাঁরা কদিনের জন্য থেমে ছিলেন। কিছু কেনাকাটা করার জন্য। স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকে পার্সেলে আসা কয়েকটা বইয়ের প্যাকেটও তোলার ছিল। সেখানেই ফেলিক্সের সঙ্গে তাঁদের আলাপ পরিচয় হয়। তিনি ওঁদের নানা ভাবে সাহায্য করলেন। শেষে যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করে দিলেন এবং একজন কমরেডকে সঙ্গে দিলেন। নিজে যেতে পারলেন না, কেন না, তাতে এলাকার নারদনিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেত।
লেনিন ১৯০০ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে কয়েকবার মিনুসিনস্কে ঘুরে গেছেন নানা কাজে। কন তখন সেখানে ছিলেন না। তিনি আবার এক তথ্য সন্ধান ও সংগ্রহ অভিযানে বেরিয়ে যান ১৮৯৮ সালে এবং ফেরেন প্রায় চার বছর পর। ইতিমধ্যে চিঠি চালাচালিই ছিল পরস্পরের একমাত্র যোগসূত্র।
১৯০৭ সালে আবার তাঁরা মিলিত হলেন। জার্মানির স্টুটগার্টে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এক কংগ্রেসে। লেনিনের এটাই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক সভায় যোগদান। ফেলিক্স কন এলেন পিএসপি-র বামপন্থী শাখার পক্ষ থেকে। সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলের পক্ষ থেকে এলেন রোজা লুক্সেমবুর্গ। আন্তর্জাতিকের সংগঠনের নেতৃত্বে তখন অউগুস্ট বেবেলকে বাদ দিলে সংশোধনবাদীদেরই ভিড়। লেনিন “যুদ্ধবাজি এবং আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ” বিষয়ক একটা প্রস্তাব মুসাবিদা করার কমিশনে অংশগ্রহণ ব্যতীত আর কিছুই বলতে বা করতে পারেননি। ফেলিক্স আর রোজাই ছিলেন তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী এবং ভরসা। আর ছিলেন সুইজারল্যান্ডের সিনিয়র নেত্রী ক্লারা ৎসেটকিন।
লেনিন আর কন ন্যুরেনবার্গ পর্যন্ত একই ট্রেনে ওঠেন যাঁর যাঁর গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। লেনিন যাবেন ফিনল্যান্ড, কন গেলেন ক্র্যাকাওয়ের দিকে। গাড়িতে বসে দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয় বর্তমান ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে। এর পর কন আরও অনেক বার সুইজারল্যান্ডে এসে লেনিন ও ক্রুপস্কায়ার সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে (রুশি ও পোলিশ) প্রবাসীদের জন্য যে সহায়তা ব্যুরো স্থাপিত হয়, কন ছিলেন তাঁর সভাপতি এবং ক্রুপস্কায়া সম্পাদক। সুইজারল্যান্ডের ৎসিমারহ্বাল্ড (১৯১৫) ও কিয়েনঠাল (১৯১৬) আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়ে লেনিনের পাশে দাঁড়ান। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ এবং কাউটস্কিদের আত্মসমর্পণ নীতির বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রামের প্রস্তুতির সপক্ষে জোর আওয়াজ তোলেন।
লেনিনের এই সুদীর্ঘ অধ্যবসায়, প্রতীক্ষা ও দীক্ষা প্রদান প্রক্রিয়ার শেষে ১৯১৮ সালে ফেলিক্স কন বলশেভিক দলের সদস্য হন। পোল্যান্ডের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিরুদ্ধে চোদ্দ দেশের সম্মিলিত যুদ্ধে যোগ দিলে তিনি লেনিনীয় শিক্ষার ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য কলম ধরেন। পোলিশ সৈন্যদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ভাবধারা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে প্রচার করেন। পোলিশ ভাষায় একটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। কলমই তখন ধীরে ধীরে তাঁর ধারালো বেয়নেট হয়ে উঠেছে।
তারপর তিনি কিছু দিন ইউক্রেনে থাকলেন। সেখানে গৃহযুদ্ধের মধ্যে নতুন গঠিত বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। ১৯২২ সালে কমরেড লেনিনের আহ্বানে সেই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলেন মস্কোয় এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী পরিষদের সদস্য মনোনীত হলেন। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্বে থেকে কাজ করে যান।
লেনিন অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় শুয়েও দল ও রাষ্ট্রের তরফে ফেলিক্স কনের উপর দায়িত্ব বণ্টনের দিকে নজর রেখেছেন। তিনি এই প্রৌঢ় কমরেডকে চেনেন সেই নির্বাসন আমল থেকে। তিনি জানতেন, কন কী প্রতিভার অধিকারী এবং কতরকম কাজের দক্ষতা নিয়ে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে এবং সমাজতন্ত্রের নির্মাণ কাণ্ডে যোগ দিয়েছেন। এই ক্ষমতার আন্দাজ পেতে, ১৯২৪ সালে, যে বছরটায় লেনিনের মৃত্যু হয়, আর কনের বয়স ৬০, তখন তিনি যে সমস্ত বিভাগীয় দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন, তার একটা তালিকা দিলাম:
- কলা বিভাগ
- রুশ সোভিয়েত সোস্যালিস্ট ফেডারেটেড রিপাব্লিকের শিক্ষা কমিশারিয়েত
- সংগ্রহশালা বিভাগ, ওই শিক্ষা কমিশারিয়েত
- সারা ইউনিয়ন বেতার পরিচালনা কমিটি (১৯৩১ সালে তিনি সারা দেশে বেতারকেন্দ্র স্থাপনের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন)
- বিপ্লবী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের স্মৃতিরক্ষা কমিটি
- রাজনৈতিক বন্দিদের তত্ত্বাবধায়ক সমিতি
- আন্তর্জাতিক বিপ্লবীদের সহায়তা সমিতি; ইত্যাদি।
এছাড়া বহু পত্রপত্রিকার তিনি সম্পাদনা ও পরিচালনা করেছেন। ১৯২৮ সালে যখন সিপিএসইউ (বি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র রাবোচায়া গেজেতা-র দ্বিসহস্রতম সংখ্যাটি বেরোয়, তখন থেকে ফেলিক্স কন তার সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। সেই সঙ্গে তিনি সারা বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চাদপদ অঞ্চলগুলিতে ঘুরতে যেতেন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য কাজ করতেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর কখনও বোধ হয় মনে হয়েছিল, মানুষ বুঝি তার পুরনো সমাজের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও মানসিক পিছুটান সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। এ নিয়ে অনুযোগ করলে কমরেড লেনিন তাঁকে যা বলেছিলেন, আজ আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষিতেও সেই বাক্যগুলো বামপন্থী কর্মীদের স্মরণে রাখতে পারলে ভালো হয়:
রাজনৈতিক এবং সামরিক সমস্যার মতো করে সাংস্কৃতিক সমস্যার কোনও চটজলদি সমাধান করা যায় না। … একটা যুদ্ধে হয়ত কয়েক মাসের মধ্যেই জয়লাভ সম্ভব হতে পারে, কিন্তু এত কম সময়ে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করা কার্যত অসম্ভব। এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই এতে অনেক সময় লাগে; আমাদের নিজেদের মানসিকতাকে সেইভাবে প্রস্তুত করতে হবে, কাজের পরিকল্পনাও সেইভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। …
সেই শিক্ষার ভিত্তিতেই তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
৭৭ বছর বয়সেও ১৯৪১ সালে জার্মান আগ্রাসনের সময় তিনি ফ্রন্টে গিয়ে রেডিও সম্প্রচারের কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। সোভিয়েত সেনাদল উদ্দীপিত হয়, শত্রুপক্ষের মাথায় অতিরিক্ত কিছু কামানের গোলাও হয়ত নিক্ষিপ্ত হতে থাকে; কিন্তু ফেলিক্স কন-এর শরীর আর সেই ধকল নিতে পারেনি। ফ্রন্টেই তিনি শেষ শয্যায় শায়িত হলেন। যুদ্ধের ময়দানেই তাঁর জীবনযুদ্ধের অবসান হল।
তাঁর কলম দিয়ে অনেক লেখা বেরিয়েছে। মস্কো থেকে ইংরেজিতে বা আমাদের বোধগম্য ভাষায় অনুদিত হয়ে বিশেষ কিছু এদেশে আসেনি। অন্তত চার খণ্ডে লেখা তাঁর স্মৃতিচারণ— “বিগত পঞ্চাশ বছরের কথা”-ও যদি হাতে পেতাম, হয়ত এই মহান বিপ্লবীর এবং সেই সঙ্গে তাঁর স্রষ্টা-শিল্পী লেনিনের সম্পর্কে আরও অনেক অমূল্য তথ্যের সন্ধান পাওয়া যেত।
চিত্র পরিচিতি:
১। ফেলিক্স কন (১৯২০);
২। ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলনের (১৯১৫) প্রতিনিধিবৃন্দ;
৩। যে বাড়িতে কিয়েনঠাল সম্মেলন (১৯১৬) অনুষ্ঠিত হয়েছিল।