অমর্ত্য সেন
১৮ই অক্টোবর 'পিস প্রাইজ অফ জার্মান বুক ট্রেড' সম্মানে ভূষিত হন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন৷ কোভিভ-১৯ অতিমারির কারণে ফ্রাঙ্কফুর্টে দর্শকবিহীন একটি অনুষ্ঠানে ভিডিও সম্প্রসারণের মাধ্যমে লন্ডন থেকে অংশগ্রহণ করেন তিনি৷ সেই উপলক্ষে নিজের বক্তব্যে মতপ্রকাশের গুরুত্বকে তুলে ধরে তিনি স্বাধীনতা, শান্তি এবং প্রগতির স্বার্থে তর্কের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন৷ তাঁর মতে, এই মূল্যবোধগুলির জন্য মানুষকে এখন হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ আলোচনা এবং তর্কের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে লালনের জন্য তিনি 'বই পড়া'-র গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন৷ চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য রইল বক্তৃতাটির অংশবিশেষ৷ ওনার সম্পূর্ণ বক্তৃতার লিঙ্কটি দেওয়া হল তর্জমার শেষে৷ তর্জমা করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।
পিস প্রাইজ-টির সঙ্গে বই পড়া ও লেখার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে৷ তাই এর প্রতি আমি বিশেষভাবে আকর্ষিত৷ বই পড়ার আবেগটি ছোটবেলা থেকে অনুভব না করলে— তা সে যে বইই হোক, ভালো বা মন্দ, এবং যে কোনও ভাবনা মাথায় এলে তা লিখে ফেলার ইচ্ছা না থাকলে আমার জীবন অনেকটাই নিঃস্ব হত৷ আমার আশ্রয়দাতারা বইয়ের জগতের এক কোণে আমাকে জায়গা করে দিয়েছেন বলে আমি অত্যন্ত খুশি৷
বই পড়া এবং সেগুলি নিয়ে কথা বলে আমরা আনন্দ এবং উত্তেজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারি৷ অন্যের সঙ্গে তর্ক চালিয়ে জন্যেও বই আমাদের সহায় হতে পারে৷ এবং আমি বিশ্বাস করি, যে বিষয়গুলিতে আমাদের মতের অমিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই৷ তবে দুর্ভাগ্যবশত, দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট-এর ভাষায় বললে, আমাদের সমাজ প্রায়শই তর্ক করবার সুযোগ ছাঁটাই করে৷ অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট নির্দয় হয়ে৷
অবশ্য আমি সর্বত্র সোচ্চারে নিষেধটা শুনতে পাই: তর্ক না করে, কুচকাওয়াজে সামিল হন! শুল্ককর্তারা বলেন: তর্ক না করে টাকাটা দিন! পুরোহিতরা বলেন: বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর৷ অর্থাৎ, স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা সর্বত্রই৷
তর্ক করাটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে দার্শনিক কান্ট আলোচনা করেছেন৷ আমাদের জীবনকেই আমরা অর্থময় করতে পারি, যদি তার সার্থকতা যাচাই করি৷ ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই যখন খর্ব করা হয় এবং নিজের মনের কথা বলবার জন্য মানুষদের শাস্তি পেতে হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের জীবন কতটা ক্ষতির সম্মুখীন৷
দুর্ভাগ্যবশত, তর্ক করার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটা অতীতের ঘটনা নয়৷ এখন এমন দেশগুলির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে যেখানে স্বৈরাচারিতার কারণে মতবিভেদের স্বাধীনতা বজায় রাখাটাই কঠিন হয়ে উঠছে৷ আগেকার দিনে যতটা কঠিন ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন৷ বিভিন্ন দেশে বেড়ে চলা এই দমনমূলক প্রবণতার জন্যে ভয়ও বাড়ছে সারা বিশ্বে— এশিয়ায়, ইউরোপে, লাটিন আমেরিকায়, আফ্রিকায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তঃস্থলে৷
এই দুর্ভাগ্যে আমার দেশ ভারতকেও আমি সামিল করতে পারি৷ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হবার পরে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার এক উৎকৃষ্ট ইতিহাস ছিল৷ স্বাধীনতার প্রতি তখন দায়বদ্ধ ছিলেন মানুষ৷ সিদ্ধান্তমূলক বিভিন্ন সর্বজনীন কাজে যুক্ত হয়ে স্বৈরাচারী সরকারকে হঠিয়ে দিতে তাঁরা যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন৷ যেমন, ১৯৭৭ সালে সাধারন নির্বাচনে সরকার-প্রযুক্ত ‘জরুরি অবস্থা’-তে লাগু স্বৈরাচারী বিধিনিষেধগুলিকে বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্রত্যাখান করেছিলেন মানুষ৷
তবে, ইদানিং কালে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই মতবিরোধকে অত্যন্ত কড়া হাতে দমন করা হচ্ছে৷ সরকার-বিরোধী বক্তব্যগুলির কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে৷ আশ্চর্যজনকভাবে সরকার সেই বক্তব্যগুলিকে “দেশদ্রোহিতা” হিসেবে দেখছে, যাতে বক্তাদের গ্রেপ্তার করার দোহাই দেওয়া যেতে পারে৷ রোগনির্ণয়ের এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বিরোধী নেতাদের কারারুদ্ধ করা হচ্ছে৷ স্বৈরাচার ছাড়াও এই পদ্ধতিতে চিন্তার বিভ্রান্তিও যথেষ্ট, কারণ সরকারের সঙ্গে একমত না হলেই যে তা রাষ্ট্রবিরোধী বিদ্রোহ অথবা রাষ্ট্রবাদিতাকে নাশ করবার প্রয়াস (যার ভিত্তিতে দেশদ্রোহিতার চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে) হতে হবে, তার কোনও মানে নেই৷
শুধুমাত্র ভারতেই যে এমন বিভ্রান্তি রয়েছে তা নয়৷ বস্তুত, সারা পৃথিবী জুড়ে এমন অপব্যবহার বাড়ছে৷ তবে ভারতের এক গর্বিত নাগরিক হিসেবে আমার দেশের সরকার কেমন স্বেচ্ছাচারী হয়েছে, তা নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে আমাকে এখানে আলোচনা করতে হবে৷
ব্রিটিশশাসিত ঔপনিবেশিক ভারতে যখন আমি স্কুলের ছাত্র, তখন আমার পরিজনদের অনেকেই দেশের স্বাধীনতার জন্য মহাত্মা গান্ধি এবং অন্যদের দেখানো অহিংস উপায়ে আন্দোলন করার অপরাধে জেলবন্দি ছিলেন, সরকারি ভাষায় যাকে “প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে কোনওরকম হিংসামূলক কাজ থেকে ওনাদের আটকানো যায়, যদিও ওনারা তেমন কিছু করেননি৷
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের নামে জেলবন্দি করবার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করা হয়৷ কিন্তু কংগ্রেস সরকার তা মৃদুভাবে হলেও আবার চালু করে৷ ব্যাপারটি যথেষ্ট খারাপ হলেও হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-র আমলে প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের ভূমিকা আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে৷ যার ফলে বিরোধী নেতাদের সহজেই গ্রেপ্তার করে আইনের বিচার ছাড়াই কারারুদ্ধের ঘটনা বেড়েই চলে৷
অবশ্য গত বছর UAPA অর্থাৎ Unlawful Activities (Prevention) Act-এর নতুন সংশোধনী চালু হওয়ায় রাষ্ট্র একতরফাভাবে কোনও একজনকে “আতঙ্কবাদী” ঘোষণা করতে পারে যাতে সেই অভিযুক্ত আতঙ্কবাদীকে বিনা বিচারে জেলবন্দি করতে অসুবিধা না হয়৷ ইতিমধ্যেই বহু মানবাধিকার কর্মীদেরকে “আতঙ্কবাদী” ঘোষণা করে জেলে পাঠানো হয়েছে এই সরকারের ব্যবস্থাপনায়৷ অনেককে সতর্কও করা হয়েছে, যদি তাঁরা কর্তৃপক্ষের কথা না শুনে সরকার-বিরোধিতা চালিয়ে যান, তাঁদের বিরুদ্ধেও UAPA ব্যবহার করা হবে৷
যখন কাউকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়, দার্শনিক দিক থেকে তা অত্যন্ত নিন্দার বটে৷ তবে আজকের ভারতে তাতে শুধু বোঝায় ব্যক্তিটি ক্ষমতায় থাকা সরকারের সম্পর্কে সমালোচনামূলক কিছু মন্তব্য করেছেন৷ “সরকার-বিরোধী” আর “রাষ্ট্রদ্রোহী” শব্দদুটি নিয়ে তাই বিভ্রান্তি রয়েছে৷
আদালতগুলি মাঝে মধ্যে এই আপত্তিজনক রীতিকে আটকাতে পেরেছে বটে৷ তবে আদালতের শ্লথতা এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মধ্যেই মতদ্বৈধতা থাকার ফলে আইনের এই উপায়টি সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রতিকার ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারেনি৷ ভারতে ব্যক্তির মানবাধিকারগুলি বিভিন্নভাবে সীমাবদ্ধ৷ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক যে প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তির অধিকার রক্ষার জন্যে লড়ছে, তাদের উপর ক্রমশ চাপ বাড়ানো হচ্ছে৷ Amnesty International-কে সরকারি হস্তক্ষেপে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, এমনকি এই দেশে তাদের ব্যাঙ্ক account-ও বন্ধ করা হয়েছে৷
সাধারণত, স্বৈরাচারের সাধনার সঙ্গে রাষ্ট্রের বিশেষ একটি অংশের উপর নিপীড়নও যুক্ত হয়৷ মানুষের জাতি, বর্ণ, ধর্ম অথবা তাঁদের অভিবাসনের অবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে বেছে বেছে তাঁদের সঙ্গে অসম ব্যবহার চলতে থাকে৷
যাদের আগে অচ্ছুৎ বলা হত, এখন দলিত বলা হয়— সেই নীচু জাতির কৃষকরা ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে শুরু শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের শুভ প্রয়াসগুলির সুবিধা পেয়ে থাকেন বটে৷ তবে তাঁদের জীবন চরমভাবে অবহেলিতই রয়ে গেছে৷ সামাজিক সম্পর্কের দিক থেকে দেখলে, তাঁদের সঙ্গে প্রায়শই রূঢ় ব্যবহার করা হয়৷ এবং তার সঙ্গে উঁচু জাতির পুরুষদের দ্বারা দলিত মেয়েদের ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনা এখন এতটাই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার তা প্রায়ই অগ্রাহ্য করে, নয়তো ধামাচাপা দেয়৷
বর্তমান শাসকদের কালে এই ধরনের অসম ব্যবহার হতাশাজনকভাবে অবিরাম চললেও বলতে হবে শুধু ভারতেই এমনটা ঘটে না৷ কিন্তু ভারতে তা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে, কারণ এই দেশের ইতিহাসে গান্ধি, আম্বেদকর এবং অন্য রাজনৈতিক নেতাদের জাতিভিত্তিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়বার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে৷
তবে তা অভূতপূর্ব বলা যায় না৷ যেমন, ব্যক্তির অধিকার, বিশেষ করে মানবাধিকার নিয়ে চর্চাতে পথিকৃতের ভূমিকায় রয়েছে আমেরিকা৷ কিন্তু সেই দেশে সাদা আর কালোর শ্রেণিকরণ সেই ক্রীতদাস প্রথার সময় থেকে এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের প্রতি অবহেলা এবং বঞ্চনার ধারা অবিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে৷
তবে সম্প্রতি আমেরিকায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’-এর মতো যে প্রতিবাদী আন্দোলনগুলি প্রসারিত হচ্ছে, তাতে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল যে সেগুলিতে সমর্থন বাড়ছে (তা না হয়ে উপায় নেই)৷ কিন্তু বাস্তবে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সমান চোখে দেখার বিষয়টি ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের তীব্রতা সত্ত্বেও বড়ই ঢিমে গতিতে স্বীকৃতি পাচ্ছে৷
আনন্দের বিষয় যে এখন আমেরিকাতে জাতিগত সাম্যতার প্রয়োজনটিতে যথেষ্ট পরিমাণে নজর দেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু তাতেও যে পরিমাণ প্রতিরোধ এবং বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পরোক্ষে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে, তা অবাক করে৷
আবার ভারতে ফেরা যাক৷ এখানে অসাম্যের প্রকৃতিটা আলাদা৷ বিশেষ করে মুসলমানদের অধিকার বিষয়ে বর্তমান কতৃপক্ষ যথেষ্ট কড়া৷ এমনকি, তুলনামূলকভাবে তাঁদের নাগরিক অধিকারকেও খর্ব করা চলছে৷ বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু ও মুসলমানেরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সত্ত্বেও বিগত কিছু বছর ধরে চরমপন্থী হিন্দু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি আঘাত হেনে দেশীয় মুসলমানেদের বহিরাগত প্রতিপন্ন করে বোঝাতে চাইছে এরা রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারে৷ চরমপন্থী হিন্দু রাজনীতি এতটা শক্তিশালী হবার আগে অবধি ভারতে এমন বিদ্বেষ ছিল না৷
মহাত্মা গান্ধি হিন্দু ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাই৷ এর সঙ্গে যোগ করতে পারি, আমিও তাই। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক মুহূর্তে এনারা কেউই হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ করেননি৷ অক্সফোর্ডে হিবার্ট লেকচার দেওয়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি এসেছেন তিনটি সংস্কৃতির সঙ্গমক্ষেত্র থেকে, যেখানে পাশ্চাত্য প্রভাবের পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামের সংমিশ্রণ ঘটেছে৷
ভারতীয় সংস্কৃতি প্রকৃত অর্থেই সংমিশ্রণ, যেখানে নানান ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের সম্মিলিত প্রয়াস রূপ পেয়েছে৷ সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা দেখা যায়— সঙ্গীত থেকে সাহিত্য, অঙ্কন থেকে স্থাপত্যে৷ এমন কি উপনিষদের মতো হিন্দু দর্শন গ্রন্থকে ভারতের বাইরে প্রচলিত করেছিলেন দারা শিকোহ— মুঘল সম্রাট শাজাহান যার স্মৃতিতে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন, সেই মমতাজ বেগমের জ্যেষ্ঠ পুত্র৷
হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সত্যিগুলিকে চেপে রাখবার জন্যে জোর চেষ্টা চালিয়েছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা৷ তাতে ভারতের সম্মানহানি ঘটেছে৷ আদর্শগত দিক থেকে সরকারের এখনকার অগ্রাধিকারগুলির কারণে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলিকে অনেক ক্ষেত্রে নতুনভাবে রচনার মাধ্যমে সংশোধনবাদী এমন এক ইতিহাস উপস্থাপন করা হচ্ছে যাতে মুসলমানদের অবদানকে খর্ব অথবা সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা হচ্ছে৷
সরকারি ক্ষমতাবলে কোনও ব্যক্তিকে UAPA-র সাহায্যে উগ্রবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে যে আরোপিত ব্যক্তিটি সাধারণভাবে মহাত্মা গান্ধি সমর্থিত অহিংস প্রতিবাদে দায়বদ্ধ৷ বিশেষ করে নতুনভাবে মাথা তোলা ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিরোধগুলির ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা ছাত্রনেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ উদাহরণস্বরূপ, উমর খালিদ নামে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্বান এবং একজন প্রমুখ ছাত্রনেতা, যিনি হিন্দু, মুসলমান প্রত্যেকের প্রশংসার পাত্র, তাঁকে UAPA ব্যবহার করে “আতঙ্কবাদী” অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর জেলে বন্দি রাখা হল৷ অথচ যে ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রতি নিজের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে তিনি এমন বাগ্মিতায় প্রকাশ করেছেন:
“হিংসার জবাব আমরা হিংসা দিয়ে দেব না৷ ঘৃণার উত্তরে আমরা হিংসা ছড়াব না৷ যদি ওরা ঘৃণা ছড়ায়, আমরা প্রত্যুত্তরে ভালোবাসা ছড়াব৷ যদি ওরা লাঠি দিয়ে আঘাত করে, আমরা ভারতের তেরঙা পতাকা তুলব৷ যদি ওরা গুলি মারে, আমরা ভারতীয় সংবিধান নিয়ে হাত তুলে দাঁড়াব।”
দেশ ও বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা পর্যবেক্ষণ করে বলছেন খালিদ এবং অন্য ছাত্রনেতারা সরকারকে এমন কোনও সুযোগ দেননি যার জন্যে তাঁদেরকে “আতঙ্কবাদী” বলা হবে৷ সরকার নিজেকে হর্তাকর্তা ভেবে যাকে যা ইচ্ছে বললেও খালিদদের মতো নেতাদের জেলে বন্দি করে রাখতে পারে না৷
যখন স্কুলে পড়তাম, কাকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মনে আছে, ব্রিটিশরাজের প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনে কাকে বন্দি করা হয়? আর কতদিন ওদের ইচ্ছেমতো জেলবন্দি করার অবিচার চলতে থাকবে? উত্তরে নৈরাশ্যভরে তিনি বলেছিলেন, “যতদিন না ব্রিটিশ শাসন শেয হয়, ততদিন চলবে৷” এখন মনে হচ্ছে, হায় ব্রিটিশ শাসনের অবসানও যথেষ্ট নয়৷ আজ সংবাদপত্রে পড়লাম সরকার এই ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
আধুনিক বিশ্বও যে স্বৈরাচার আর অসাম্যের কবলে রয়েছে তা দেখাতে প্রধানত ভারত এবং আমেরিকা নিয়ে কথা বলছিলাম৷ তবে আরও অন্তত কুড়ি-ত্রিশটি নিয়েও কথা বলতে পারি৷ স্বৈরাচার কীভাবে আরোপিত হয়েছে এবং তা লাগু করার জন্যে ঠিক যে কারণগুলি দেওয়া হয়েছে, তা দেশবিশেষে অন্য হতে পারে৷ তবে ফলশ্রুতি হিসেবে যা রয়েছে তাতে মিল যথেষ্ট৷
উদাহরণস্বরূপ, এশিয়া থেকে শুরু করা যেতে পারে৷ ফিলিপিনসের শাসক সরকার মাদক ব্যবসা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কাজগুলি থামাতে স্বৈরাচারকে তুলে ধরছে৷ সেই ক্ষমতাবলে বহু মানুষকে বিনা বিচারে মেরে ফেলা হয়েছে৷
ইউরোপের বাইরে থেকে উদ্বাস্তুদের আসা আটকাতে হাঙ্গেরিতে সরকার স্বৈরাচারকে আঁকড়ে রয়েছে৷ এবং অভিযোগ অনুযায়ী সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধী দলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্যে বলা হচ্ছে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে শাসন চালানোর জন্যে স্বৈরাচার জরুরি৷
সমকামীদের শাস্তির জন্যে সরকারি নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পোল্যান্ডে অনেকগুলি ব্যক্তিগত অধিকারকে পরিত্যাগ করা হয়েছে৷ এমনকি যেখানে বিশেষ অঞ্চলকে তৈরি করা হয়েছে, যেগুলিকে “LGBT free zones” হিসেবে রাখা হবে৷
লাটিন আমেরিকার উদাহরণ যোগ করলে বলতে হয়, অভিযোগ অনুযায়ী ব্রাজিলে সেনাবাহিনীর মাইনে বাড়ানোর জিগির তুলে এখনকার অসহনশীল সরকার ক্ষমতায় এসেছিল৷ সেই প্রতিশ্রুতি রেখে সেনাবাহিনীর সাহায্যে দেশকে এখন রক্ষণশীল দুঃস্বপ্নে পরিণত করা হয়েছে সমলিঙ্গে বিয়ে, সমকামিতা, গর্ভপাত, ইতিবাচক পদক্ষেপ, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা থামিয়ে এবং মাদকব্যবসার উদারীকরণ ঘটিয়ে৷ স্বৈরাচারের সাধনায় সত্যিই জাঁকজমক কম নয়৷
স্বৈরাচার সরাসরি মানুষকে শাস্তি দেয়৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে৷ মানুষের পারস্পরিক সহায়তার উপর সামাজিক প্রগতির অনেকটাই নির্ভর করে৷ স্বৈরাচার সেই সমাজটাকেই টুকরো টুকরো করে দেয়৷ যে দলগুলি স্বৈরাচারীদের পছন্দের তালিকায় নেই, তাদেরকে শাস্তি দিয়ে বাকিদের সহযোগী হতে বাধ্য করা হয়৷ সমাজের অগ্রগতি এভাবেই আরও অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে৷
স্বৈরাচারী একটি ব্যবস্থাপনায় সামাজিক প্রগতি হতে পারে কি না, তা নিয়ে আজ আমার তর্ক তোলার কোনও উদ্দেশ্য নেই৷ এমনটা হয়তো কোনও সময় ঘটবে৷ তবে তর্ক আর সমালোচনা নিষিদ্ধ করলে এবং কিছু মানুষের স্বার্থ নিরবচ্ছিন্নভাবে অবহেলা করলে প্রগতির পথে তা বড় বাধা হওয়ার প্রবণতা রয়েই যায়৷
এখন বিশ্ব একটি রোগের অতিমারির পাশাপাশি স্বৈরাচারিতার এক অতিমারিরও সম্মুখীন৷ যা মানুষের জীবনকে স্পষ্টতই নির্বল করছে এমন কিছু উপায়ে যাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে৷ আমাদের বৈশ্বিক সংযোগ এবং মানবিকতার অংশীদারিত্বের কথা ধরে নিলে দেখা যাবে যে শুধু আমাদের নিজের নিজের দেশ নিয়ে চিন্তিত না থেকে অন্যদের কথা ভাবার এবং পৃথিবী জুড়ে তৈরি হওয়া নানান সমস্যা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠার গুরুতর কারণ রয়েছে৷
১৯৬৩ সালে হত্যার কিছু দিন আগে বার্মিংহাম জেল থেকে একটি চিঠিতে ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র লিখেছিলেন: “অবিচার যেখানেই ঘটুক না কেন, তা সর্বত্রই বিচারব্যবস্থার জন্যে বিপজ্জনক৷” আজকে সারা বিশ্ব জুড়ে বেড়ে চলা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সামাজিক প্রয়োজনীয়তা এর থেকে বেশি কিছু হতে পারে না৷
প্রতিরোধ অনেক উপায়েই গড়ে তোলা যেতে পারে৷ তবে বই পড়া, কথা বলা এবং তর্ক করাকে ব্যবহারের সুযোগ নিঃসন্দেহে এখন তার অংশ হতে পারে যাকে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট দেখেছিলেন “সব বিষয়ে সর্বসাধারণের যুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতা” হিসেবে৷
বই এবং বিভিন্ন বিষয়ে ধারণাগুলি রাজনৈতিক স্বৈরাচারের বিরোধিতা করবার অনুপ্রেরণা দেয়৷ মার্টিন লুথার কিং-এর মতো এখনকার যুব ছাত্রনেতাদের কাছেও এই প্রতিরোধ একটি অহিংস প্রক্রিয়া৷ একই সঙ্গে এটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দিকে যাত্রাও বটে৷
অমর্ত্য সেন-এর সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি