পল রোমেরো
পল রোমেরো কলম্বিয়ার অন্যতম পুরনো (স্থাপিত ১৯১১) ও জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘এল টিয়েম্পো’র সম্পাদক। লেখাটি গত ২৫ নভেম্বর এল টিয়েম্পোয় স্প্যানিশে প্রকাশিত হয়।
ফিদেল, শাভেজ এবং চে-র বিপুল প্রভাব
দিয়েগো মারাদোনার ডান কাঁধ দেখলে সেখানে দেখা যেত চে গুয়েভারার মুখ জ্বলজ্বল করছে। যদি তিনি তাঁর বাঁ পা-টা— লা ম্যাজিকা— দেখাতেন, সেখানে তাঁর কাফ থেকে মুখ দেখাতেন ফিদেল কাস্ত্রো। চে-কে মারাদোনা তাঁর শহীদ বলতেন, ফিদেলকে বলতেন তাঁর মহান বন্ধু। আর তাঁদের তিনি এঁকে রাখলেন নিজের শরীরে। এই আঁকার অর্থ কিন্তু সুদূরপ্রসারী। ক্ষমতার প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধা; তাঁর বিদ্রোহী সত্তা— যে সত্তা তাঁকে বারংবার ক্ষমতার কাছে অস্বস্তিকর করেছে, ক্ষমতাকে তাঁকে দমন করতে উৎসাহী করেছে; ফিফার প্রতি তাঁর সুপরিচিত বিষোদ্গার— এই সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় এই ছবিগুলি। মারাদোনা— নিজের বলদৃপ্ত ঘোষণায় যিনি আকাশ ছুঁয়েছিলেন— রাজনৈতিক সক্রিয়তার ক্ষেত্রে তিনি কখনওই পিছপা হননি।
যখনও মারাদোনা হয়ে ওঠেননি, অর্থাৎ খুব ছোট বয়স থেকেই দিয়েগো বেপরোয়া। নিজে যেটা ভাবছেন সেটাকে গোপন রাখার কোনও চেষ্টা করতেন না। হয়তো বুয়েন্স এয়ার্সের ভিলা ফিওরিতোর সেই ঘিঞ্জি বস্তির পরিবেশ, যেখানে মারাদোনা বেড়ে উঠেছেন, সেটাই এর জন্য দায়ী। সেই পরিবেশই লালন করে গড়ে তুলেছে বিদ্রোহী দিয়েগোকে। মারাদোনা বলেছিলেন “ফিওরিতোতে তুমি খেতে পেলে খাবে, না পেলে খাবে না।”
বিশ্ব ফুটবলের তারকা হয়ে ওঠার পর তার পক্ষে নিজের মতামত এবং বিতর্কিত সমালোচনাগুলো প্রকাশ করা আরও সহজ হয়ে গেছিল। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে “খুনি” বলেছেন; সংখ্যালঘু এবং সামাজিক আন্দোলনগুলোর প্রতি নির্দ্বিধায় তাঁর সমর্থন জানিয়েছেন; এবং এমনকি চার্চকেও আক্রমণ করতে ছাড়েননি।
ভ্যাটিকানকে করা তাঁর সমালোচনার কথা তো সবাই জানেন। দ্বিতীয় জন পল তখন পোপ। আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম দিয়েগো’-তে মারাদোনা লিখেছিলেন:
গিয়ে দেখি এক প্রকাণ্ড সোনায় মোড়া ছাদ! তা দেখে নিজেকে মনে মনে বলি, ‘একটা লোক এত বড় কুত্তার বাচ্চা কী করে হতে পারে, যে একদিকে থাকে এইরকম সোনার ছাদের নিচে, আর গরিব দেশগুলোতে গিয়ে ওইরকম একটা পেটমোটা চেহারা নিয়ে বাচ্চাগুলোর মুখে চুমো খায়! সেইদিন থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেল। আমি সত্যিটাকে দেখতে শুরু করলাম।
বহু বছর পরে আর্জেন্টিনার পোপ ফ্রান্সিসকোর সময়ে মারাদোনা আবার চার্চের অনুগামী হন। ঘোষণা করেছিলেন, “এখন থেকে আমি ফ্রান্সিসকোর টিমের ক্যাপ্টেন।” তখন থেকে ‘পার্টি ফর পিস’-এর মতো বিভিন্ন মানবিক উদ্যোগে তাকে অংশ নিতে দেখা যেত। এই ‘পার্টি ফর পিস’-এর হয়েই ২০১৫-তে তিনি কলম্বিয়ায় এসে বলেন:
এই পার্টি ফর পিস সত্যিই শান্তির জন্য হোক। যে ফুটবল নিয়ে আমি গর্ববোধ করি, কলম্বিয়া তার মধ্যে দিয়েই শান্তিতে পৌঁছনোর একটা রাস্তা খুঁজে বের করুক। শান্তি কলম্বিয়ার প্রাপ্য। তাই, দোহাই আর হিংসা নয়, শান্তি সমাগত। কলম্বিয়ায় গুরুতর কিছু ঘটলে আমরা সবাই সেটার আঁচ পাই। তাই কলম্বিয়ানদের কাছে আমার আহ্বান— আপনারা এবার শান্তির জন্য কাঁদুন!
বাম অভিমুখে যাত্রা
ফ্রেমটা ভোলা যাবে না। ২০০১। কিউবার প্যালেস অফ দ্য রেভোলিউশন। কালো পোশাক পরিহিত মারাদোনা দোভাষীকে তাঁর বাঁ পায়ের ট্যাটু দেখাচ্ছেন। দোভাষীর পরনে চিরাচরিত জলপাই স্যুট, মুখে সেই একটু বেরিয়ে থাকা সাদা দাড়ি। দুই ফিদেল। পায়ে যাঁর ছবি এবং যিনি সেই ছবি দেখছেন।
দিয়েগো তাঁর ড্রাগের নেশা থেকে মুক্তি পাওয়ার চিকিৎসার জন্য ২০০০-এ হাভানা পৌছন, এবং সেখানেই ফিদেলের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য তৈরি হয়। তিনি ফিদেলকে হিরো বলতেন। বলতেন মানবতার এক দৃষ্টান্ত।
ফিদেলের ধ্যানধারণার জন্য তাঁর প্রতি সমর্থন মারাদোনা কখনও গোপন করেননি। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত এবং নির্দেশিত করার জন্য আরও কিছু বন্ধুত্বের ভূমিকা ছিল। ফিদেল এবং চে-র প্রতি তাঁর যে অনুরাগ সেই একই অনুরাগ আমরা দেখেছি ভেনিজুয়েলার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুগো শাভেজের প্রতিও। ‘শাভিসমো’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে ২০১৩ সালে শাভেজের সমাধিতে গিয়ে মারাদোনা বলেছিলেন:
হুগো আমার জন্য একটা দুর্ধর্ষ বন্ধুত্ব আর একটা অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান রেখে গেলেন। হুগো শাভেজ লাতিন আমেরিকানদের চিন্তাভাবনাটাকেই বদলে দিয়েছিলেন। আগে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতাম। হুগোই আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন যে আমরা নিজেদের ক্ষমতায় চলতে পারি।
রাষ্ট্রীয় চ্যানেল টেলিসুরে মারাদোনা এই কথাগুলো বলেছিলেন এবং ভেনিজুয়েলাবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ভোটে জেতানোর জন্য।
রাজনীতি এবং ফুটবল
মারাদোনা ফুটবল নিয়ে যেমন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারতেন তেমনি রাজনীতি নিয়েও পারতেন। ব্রাজিল বিশ্বকাপ চলাকালীন সাংবাদিক ভিক্টর হুগো মোরালেসের সঙ্গে টেলসুর-এ করা প্রোগ্রাম ‘দে জুরদা’য় এটি খুব ভালো দেখা গেছিল। এই প্রোগ্রামে যেমন ফুটবলের বড় বড় ব্যক্তিত্বদের সামিল করা হয়েছিল তেমনি লাতিন আমেরিকান রাজনীতির বড় বড় নেতারাও ছিলেন। যেমন উরুগুয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পেপে মুখিকা, ইকুয়েডরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরিয়া, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস…।
এই টেলিভিশন শোটিতে দিয়েগো হুগো শ্যাভেজকে স্মরণ করেছিলেন, ফিদেলের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্র আদানপ্রদানের কথা জানিয়েছিলেন, এবং তার মাধ্যমেই তার মৃত্যু সংক্রান্ত যাবতীয় গুজব অন্তর্হিত হয়েছিল। আর এখন দুই বন্ধু একই দিনে এই ২৫ নভেম্বর পৃথিবী ছাড়া মনস্থ করলেন। ফিদেল বছর চারেক আগে গেছিলেন।
মারাদোনার ফুটবল এবং রাজনৈতিক জীবনে এই ‘দে জুরদা’ ছিল আরও একটা মঞ্চ। তিনি আর্জেন্টিনার পিয়াজা দে মায়োতে মায়েদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন; কিউবার সিলভিও রদরিগেজ-এর মতো সামাজিক এবং প্রতিবাদী গীতিকার এবং গায়কদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল; প্যালেস্তিনীয়দের সংগ্রামের পক্ষে তিনি স্লোগান দিয়েছিলেন— ভিভা প্যালেস্তিনা; আবার বলিভিয়াতে সামাজিক আন্দোলনগুলির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছিলেন। ফুটবলের ভগবান সবসময়েই তার বাঁ হাতের কাজগুলি চালিয়ে গেছেন।