সুরজিৎ সেনগুপ্ত
লেখক প্রখ্যাত ফুটবলার
মারাদোনার এই আকস্মিক মৃত্যু সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমত আজকাল ষাট বছর বয়সে কেউ মারা গেলে তাকে অকালমৃত্যু-ই বলা যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে মানুষটি যখন মারাদোনা, তাঁর এত কম বয়সে চলে যাওয়া অস্বাভাবিক না হলেও অভাবনীয়। আমার কাছে, সারা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমী মানুষের কাছে এই মৃত্যু এক বিরাট ধাক্কা। এই ধাক্কা সামলানো খুব মুশকিল। ফুটবল জগতের একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। যেভাবে মারাদোনা নিজের জীবনকে পরিচালনা করেছেন, সেটা সবসময় তাঁর শরীরের পক্ষে যায়নি। তিনি তাঁর শরীরের প্রতি যথেচ্ছ অত্যাচার করেছেন। তাঁর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া হয়তো সেই কারণেই।
কিন্তু তাঁর খেলার কথা যখন মনে পড়ে, যখন তাঁর ড্রিবলগুলো, দৌড়গুলো, গোলগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন আর অন্য কিছু মনে থাকে না। শুধু মনে হয়, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর আমাদের সামনে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন।
মারাদোনা নাপোলি শহরটাকে বিশ্বের মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ করে দিয়েছেন। মারাদোনা নাপোলির হয়ে খেলেছেন, বার্সেলোনার হয়েও খেলেছেন। ক্লাব ফুটবলে মারাদোনা যে চূড়ান্ত সফল এটা যেমন সত্যি, তেমনিভাবে পরপর তিনটে বিশ্বকাপে তাঁর পারফরমেন্স মনে রাখার মতো। এর মধ্যে একটি বিশ্বকাপে (১৯৮৬) তিনি সাফল্য পেয়েছেন, বাকি দুটো বিশ্বকাপে সাফল্য আসেনি, কিন্তু মারাদোনা নামটার মহিমা সেই সময় টের পাওয়া গেছে।
ছিয়াশি, নব্বই ও চুরানব্বই— এই তিনটি বিশ্বকাপেই মারাদোনাকে তীব্র মার্কিং-এর শিকার। বিরাশি সালে বিশ্বকাপে আমি প্রথমবার মারাদোনাকে দেখি। সেখানে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে মারাদোনার খেলা ভুলতে পারা যায় না। একটা সময় তাঁর একটার পর একটা সাজিয়ে দেওয়া বল যখন সতীর্থরা মিস করছে, মারাদোনার মধ্যে একটা হতাশা কাজ করতে থাকে। ঠিক তখনই ব্রাজিলের বাতিস্তাকে মারাদোনা একটা শক্ত ফাউল করে ফেলেন। রেফারি ছুটে এসে মারাদোনাকে একটা লাল কার্ড দেখান এবং মারাদোনা তা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়েন। চোখ বুজলেই সেই দৃশ্যটা আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এরপর ছিয়াশির বিশ্বকোপে মারাদোনার খেলা তো স্বপ্নের মতো। মারাদোনা একজন আবেগ-তাড়িত মানুষ। আমরা ছিয়াশির বিশ্বকাপ জয়ের পর মারাদোনাকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। আবার নব্বই সালে ট্রফি মিস করেও মারাদোনা কেঁদেছেন, কিন্তু এই দুটো কান্নার মধ্যে কিছু তফাত আছে। একটা আনন্দের কান্না, একটা হতাশার কান্না। ছিয়াশির আগে অবধি সারা বিশ্বে ব্রাজিলের সমর্থক অনেক বেশি ছিল। ছিয়াশিতে মারাদোনাকে দেখার পরে ব্রাজিলের সমর্থকদের একটা বড় অংশ আর্জেন্টিনার দিকে চলে আসে। সারা বিশ্বের বেশ কিছু মানুষকে পুরোপুরি নিজের সমর্থনে নিয়ে চলে আসা— একমাত্র মারাদোনা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
নব্বই সালেও দেখেছি কীরকম একটা অতি সাধারণ আর্জেন্টিনা টিম নিয়ে মারদোনা কি অসামান্য খেলছেন। শুধু খেলছেন তাই নয়, মারাদোনা টিমটাকে ফাইনালেও তুলেছেন৷ এই অবস্থায় জার্মানির মত একটা শক্তিশালী দল একটা বিতর্কিত পেনাল্টি থেকে গোল পেয়ে এগিয়ে যায়। এটা মারাদোনাকে খুব হতাশ করে দেয়। দেখা যায় যে তিনি এমনভাবে কাঁদছেন যেন বাচ্চার হাত থেকে কোনও খেলনা কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷
চুরানব্বই-এ আমরা দেখলাম মারাদোনার অনেক শত্রু তৈরি হয়েছে৷ যাঁরা জিনিয়াস হয়, তাদের চারপাশে অনেক শত্রু তৈরি হয়। শত্রু মারাদোনার চারপাশেও ছিল। চুরানব্বইতে আমরা দেখতে পাই আমেরিকায় মাফিয়াদের দাপট এবং শেষে মারাদোনার ডোপ টেস্টে ধরা পড়া। যে ডাক্তার মারাদোনাকে ওষুধ খাইয়েছিল, সেই ওষুধের মধ্যে একটু এফিড্রিন ছিল, ওষুধে এফিড্রিন থাকার কথা মারাদোনার জানা ছিল না। এই এফিড্রিন এক নিষিদ্ধ ওষুধ। এছাড়াও মারাদোনা একটা মাদকাসক্তির ইতিহাস আছে, এককালে কোকেনও নিয়েছেন তাই সেই ইতিহাস মারাদোনার বিরুদ্ধে গেল।
আজ মারাদোনা চলে যাওয়ার পর পেলে বড় ফুটবলার না মারাদোনা— এই তর্কটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। প্রথমত, পেলে ও মারাদোনা দুজনে দু-সময়ে খেলেছেন, তাই এই তুলনামূলক আলোচনায় যাওয়া কোনও বুদ্ধিমান কাজ নয়। তবে তর্কের খাতিরে যদি বলতেই হয়, তবে আমি মারাদোনাকে পেলের চেয়ে খানিক এগিয়ে রাখব। পেলে তিনটে বিশ্বকাপ জিতেছেন, এটা নিঃসন্দেহে তাঁর মুকুটের ত্রিবর্ণ পালক। কিন্তু এটা দেখতে হবে বাষট্টিতে প্রথম ম্যাচেই পেলেকে চোটের কারণে বসে যেতে হয়। তাই বাষট্টির বিশ্বকাপ ব্রাজিলকে যিনি জিতিয়েছেন তাঁর নাম গ্যারিঞ্চা। ছেষট্টিতেও মার খেয়ে পেলেকে বসে যেতে হয়েছিল। বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। সত্তরে গিয়ে ব্রাজিল আবার চাম্পিয়ন হয়। ৫৮ ও ৭০, এই দুটো বিশ্বকাপে পেলে ঠিকঠাক খেলেছেন, কিন্তু তাঁর চারপাশে তাঁকে সাহায্য করার জন্য সেসব ফুটবলাররা ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান ও বিরাট মাপের ফুটবলার৷। সেই সুবিধে মারাদোনা পাননি। মারাদোনা একটা অতিসাধারণ দল নিয়ে বিশ্বকাপে খেলেছেন। ছিয়াশিতে আর্জেন্টিনা টিম আহামরি কিছু ছিল না। নব্বইতে তো ছিলই না। এরকম একটা অত্যন্ত সাধারণ টিম নিয়ে বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠা এবং চাম্পিয়ন হওয়া— অত্যন্ত কৃতিত্বের কাজ। পেলে এটা করতে পারেননি। তার ওপর মারাদোনা একটা পা সর্বস্ব ফুটবল। সেটা অনেকের কাছে সমালোচনার বস্তু হতে পারত। কিন্তু তাঁর এই একটা পা-ই এত সক্ষম, এই একটা পা-ই এমন ম্যাজিক দেখাতে পারত, যে আর কিছু দরকার হয়নি। অন্যদিকে, পেলে ভালো হেড দিতে পারতেন। দু পায়ে শট মারতে পারতেন। ড্রিবল করতে পারতেন। মারাদোনা একটা পা দিয়ে ফুটবল খেলেও যা যা অর্জন করতে পেরেছে, পেলে সর্বাঙ্গ দিয়ে ফুটবল খেলে তা করেছেন। তাই জোর করে তুলনামূলক আলোচনা যদি করতেই হয়, আমি মারাদোনাকেই কিছুটা এগিয়ে রাখব।
একইরকমভাবে মেসি ও মারাদোনারও তুলনা সম্ভব নয়। যদি বা তুলনা করতেই হয়, একটা কথাই বলা যায়। মারাদোনা বিশ্বকাপ ঘরে এনেছেন, মেসি বিশ্বকাপ জেতেননি। মারাদোনা একটা বিশ্বকাপ জিতেছেন, আর দলকে আরেকটি বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন। অন্যদিকে মেসি দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন, তবে জিততে পারেননি। এখন রেফারিদের হাতে অনেক ক্ষমতা, আজ যেকোনও স্কিলড প্লেয়ারের পক্ষে সারভাইভ করার সুযোগ আরও অনেক বেশি, মারাদোনার সময় তা হয়নি। মারাদোনা দিনের পর দিন মার খেয়েছেন, তাঁকে মেরে মেরে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাও তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। মারাদোনা নিজের মহিমায় বেরিয়ে এসেছেন। সব মিলিয়ে তর্কের খাতিরে তুলনা করলে, মেসির চেয়ে মারাদোনা অনেকখানি এগিয়ে থাকবেন।
মারাদোনার প্রসঙ্গে কথা বললে ‘হ্যান্ড অফ গড’ প্রসঙ্গ নিয়ে কটি কথা বলতেই হয়। এই ঘটনা মারাদোনার সততা প্রমাণ করে। আর কেউ না জানুক, মারাদোনা তো জানতেন যে গোলটা হাত লেগে হয়েছিল। আর হাত দিয়ে করা গোলটার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তিনি দ্বিতীয় গোলটা করেন যেটা শতাব্দীর অন্যতম সেরা গোল হিসেবে পরিচিত।
তখন নিয়ম ছিল প্রতিটি খেলার শেষে দুটি টিমের ক্যাপ্টেন ও কোচ প্রেস কনফারেন্স করতে হত। সেদিন প্রেস কনফারেন্সে এসে মারাদোনা দেখেন যে সাংবাদিকদের সব প্রশ্নই ওই বিতর্কিত গোলটি নিয়ে। পরের অত সুন্দর গোলটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। মারাদোনা একটু সময় চেয়ে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে যান। টিভি রুমে গিয়ে তিনি বারবার টিভি চালিয়ে দেখেন যে প্রথম গোলটা স্পষ্ট নয়, অর্থাৎ হাতে বল লেগেই গোল হয়েছে তা ছবি দেখে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মারাদোনা আবার প্রেস কনফারেন্সে ফিরলে তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করা হল যে তিনি হাত দিয়ে গোলটা করেছেন কিনা। মারাদোনা হ্যাঁ বা না যেকোনও কিছুই বলতে পারতেন। বলতে পারতেন, না তিনি হাত দিয়ে গোল করেননি। অথবা বলতে পারতেন যে হ্যাঁ তিনি হাত দিয়েই গোল করেছেন, কিন্তু রেফারি যখন গোল দিয়ে দিয়েছেন আর তো কিছু করার নেই। এই দুইয়ের মধ্যে একটি উত্তর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মারাদোনা একজন পোড়খাওয়া ডিপ্লোম্যাটের মতো চমৎকার একখানা উত্তর দিলেন— ইট ওয়াজ হ্যান্ড অফ গড। সেইসময় ফকল্যান্ড ইস্যু নিয়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সম্পর্কটা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। ফলে স্বীকার করে নেওয়াটায় হয়তো একটু অসুবিধে ছিল। মারাদোনা যদি সত্যি কথাটা বলে দিতেন, তাহলে সেই পরিস্থিতিতে তাঁর দেশের মানুষ খেপে যেতে পারত। সেই অবস্থায় ‘হ্যান্ড অফ গড’ উক্তি এক তুখোড় কূটনৈতিক উক্তি বলেই আমার মনে হয়।
মারাদোনা কলকাতায় এসেছিলেন। কিন্তু মারাদোনার সঙ্গে আমার বা আমার মতো প্রাক্তন ফুটবলারদের সাক্ষাৎ হয়নি। আসলে মারাদোনার মতো মানুষদের আমাদের দেশে আনতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। সেই টাকা কে জোগাড় করবে? তাই রাজনীতির লোকেরা তার মধ্যে থাকে, রাজনীতির লোকেরাই অর্থ সংগ্রহ করে এঁদের আনতে সাহায্য করে। তারাই মারাদোনাকে এনেছিল, পেলেকে এনেছিল, এবং তারাই চারিদিক থেকে এঁদের ঘিরে ছিল। তখন দেশের প্রাক্তন ফুটবলারদের কথা কারও মনে পড়েনি। পেলে বা মারাদোনার সঙ্গে প্রাক্তন ফুটবলারদের একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, বা ফুটবলারদের মাঠে আমন্ত্রণ করা যায়, এসব কথা সংগঠকদের সেদিন মনেই পড়েনি।
শ্রীজাত লিখেছেন, এই ধরনের বড় মানুষেরা যেদিন মারা যান সেদিন থেকেই তাঁর অমরত্ব শুরু হয়। মারাদোনার জন্যও এটা সত্যি। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন, তাঁর খেলা পূজিত হয়েছে। পাশাপাশি সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। তাঁর জীবনটা তো তেমন সাজানো গোছানো ছিল না। আর এখন যখন অল্প বয়সে তিনি মারা যাচ্ছেন, মানুষ তাঁর মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছে আর অমরত্বের দিকে মারাদোনার যাত্রা সবেমাত্র শুরু হল। তাঁর কাজ আমরা টেলিভিশনে, ইন্টারনেটে, ইউটিউবে ক্লিক করে দেখে নিতে পারব। যতদিন এই গ্রহে ফুটবল থাকবে, দিয়েগো মারাদোনাও চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যাবেন।