কয়েকটি কবিতা
১
আর সেই দিন আমি একটুর জন্য সন্তু হয়ে গেলাম— সন্তু, সন্তু দাস
অথচ আমার মা-বাবা রাতের অন্ধকারে মহাভারত থেকে যখন তুলে নিয়ে
এসেছিল তাদের সংসারে তখন আমার গায়ে বর্ম হাতে তলোয়ার
পরে বাবা আমার বর্ম বন্ধক দিয়ে কিনেছিল চাল-ডাল আর বিড়ি
মা আমার তলোয়ার বেচে কিনেছিল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড রেডিও
এখন
আমি দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রেডিও শুনি—
অনুরোধের আসর, স্বর্ণযুগের গান
গান বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ কোনও কোনও দিন
শুরু হয় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বাংলা ধারাবিবরণী
ছুটিতে থাকা সৈনিকদের সত্বর যুদ্ধে যোগ দেবার
ঘোষণা হতে থাকে, হতেই থাকে—
২
অন্ধকার ফাঁক করে হাত গলিয়ে দিই
কিলবিল করে ওঠে চারামাছের ঝাঁক
আমি জল থাবড়াই জল থাবড়াই
তারপর ফেনা— নখের খোঁচায় ফেটে পড়ে বুদ্বুদ
ভেসে ওঠা ভিতরের ফেনা আর আর বুদ্বুদের কথা
তুমি কোনওদিনই জানলে না মেছোহাঁড়ি?
শুধু কলকল ছরছর আর ছলাৎ ছলাৎ-এর অবয়বহীনতায় বুঁদ হয়ে রইলে
ধাতব নিশ্ছিদ্রতাই বুঝলে আজীবন
বুঝলে না আসলে আমি তো নিজেকেই
পৌঁছে দিতে চেয়েছি নব জলাধারের শ্বাসরুদ্ধ গভীরতায়
মনমরা একটি ফড়িং উড়ে এসে বসল ছিপের উপর
তার জলবিম্বের দিকে ধেয়ে আসছে শিকারিমাছের বিশাল এক হাঁ
তা তোমার থেকে কিছু কম উজ্জ্বল নয়
৩
বারো বছরের পুরনো অসম্পূর্ণ কবিতার ভেতর ঝুঁকে দেখি
টেবিল ল্যাম্পটি এখনও জ্বলছে
জলে ডুবে যাওয়া একটা ঘর
দৃশ্যরা ভেসে যাচ্ছে
আমি নীচে নামার সিঁড়ি খুঁজছি
দু-টি শব্দের ফাঁকের চোরাদরজাটি খুঁজছি
চোখে জড়িয়ে আছে জলজ শ্যাওলার মতো ঘুম
খোলা খাতার ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছেন কবি
আমরা কে কাকে স্বপ্নে দেখছি বুঝতে পারছি না
৪
খাঁচার নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে একদিন
ঈশ্বর বানিয়েছিলেন পাখি
তার রক্তে ছুটিয়ে দিয়েছিলেন
ডানাওলা ধাতবকণিকা
মাংসে দিয়েছিলেন সবুজ স্নেহপদার্থ আর
ক্ষতের সম্ভাবনা
সেখানেই খুঁজে পাবে
শিকারিদের ব্যবহৃত কাঠের উনোন,
চামড়ার জলপাত্র, আর আদিম হাতিয়ার
গভীরে গেলে পাবে ঈশ্বরের জন্মভিটা
আরও গভীরে আছে শুধু বালি—
তখনও খাঁচার জন্ম হয়নি
তখনও জন্মায়নি মৃত্যুভয় অথবা উড়ান
৫
রাত একেবারে শব্দহীন হয়ে গেলে
একে একে খুলে দেওয়া হবে তোমার সব বাঁধন
আড়াল থেকে লক্ষ করা হবে
কাঠের মেঝেতে তোমার কাঠের পায়ের একটানা চলাফেরার শব্দ
তুমি আদৌ সহ্য করতে পারছ কি না
যতক্ষণ না তুমি তোমার নিশ্বাসের শব্দকে
পূর্ববর্তী নিশ্বাসের প্রতিধ্বনি বলে ভুল না করছ
ততক্ষণ তুমি কোনও দীর্ঘশ্বাসে পৌঁছোতে পারবে না মনে রেখো
৬
প্রতিধ্বনিকেই গান মনে হতে থাকলে
নিজেই কাঁধে চড়ে তুমি ক্রমশ উঁচু হতে থাকবে
উচ্চতাজনিত কারণে সৃষ্ট উপত্যকা ভরে উঠবে একসময়
সবুজে, ফুলে ও ফলে
রঙিন ডানাকেই প্রজাপতি ভেবে
তুমি ঝাঁপিয়ে পড়বে শূন্য
প্রজাপতি ধরার জাল আনতে ভুলে গেছে বলে
তখন আর তোমার কোনও অনুতাপ থাকবে না
৭
নিঃশব্দে আলো জ্বালি
দেখি বিশাল এক ময়ূর পেখম মেলে বসে আছে খাটের কিনারে
ছুঁয়ে দিতেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল সে
ভাঁজে ভাঁজে জমে উঠল কবেকার ধুলো ময়লা
শুধু তার ঠোঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে থাকা সাপের লেজটা
নড়তে থাকল গূঢ় কোনও সঙ্কেতের মতো
৮
এরপর আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না
এইখানে আমি মুখ থুবড়ে পড়ব কাদায়
সুটকেসটা যথেষ্ট ভারী মনে হওয়ায়
এইখানে আমি সেটা ছুড়ে ফেলব জলে
এইখানে হোঁচট খাব
এইখানে এসে আমি দেখতে পাব
দূরে জ্বলতে থাকা লণ্ঠনটিকে, আর ছুটতে শুরু করব
এইখানে, স্টেশনের গেটে সিগারেট ধরিয়ে
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব একটি রিকশার জন্য
শেষ ট্রেন ঢুকছে ওই
ওই তো আমি নামছি সুটকেস হাতে