পাঁচটি কবিতা
অলোকরঞ্জন
আমি যারে ঈর্ষা করি তার নাম অলোকরঞ্জন
তিনি বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে বেরিয়ে পড়েন
আর নিরীশ্বর পৃথিবীতে কাব্যি করেন।
তিনি একাধারে প্রেমিক এবং পাখির ভাষা অনুবাদক
রক্ষিতার চরণমূলে রেখে বেড়ান গঙ্গাজল।
আমি তারে ঈর্ষা করি বিবিধ ঋতুর চক্রে
দিনান্তের সত্যি মতো সান্ধ্যপ্রদীপ যখন জ্বলে
একার পৃথিবীতে যদি শোনাতে যাই কবিতাকীর্তন
দেখি আমার গলা ছিঁড়ে আসছে পাপে অনুতাপে।
আর তিনি দুঃখ পোশাক ছুঁড়ে ফেলে উদাস কণ্ঠে
এক পৃথিবীতে স্তব্ধতা নামিয়ে বেড়ান।
আমি যারে ঈর্ষা করি তার নাম অলোকরঞ্জন
কবিতার অধিক যিনি বাজান বাঁশি, খুঁজে বেড়ান হ্যামিলন
সূর্যাস্ত দৃশ্যে
প্রতিটা সূর্যাস্ত দৃশ্যের পাশে দৌড়ে যায় আমার প্রাচীন আত্মারা
যেন ডুবে যেতে হবে তখনি বারো আউলিয়ার গর্ভস্থ গভীরে
আমি সেই কবে থেকে বিনম্র বাসনা নিয়ে বসে থাকি দেখা পাব
পূর্বজ হে, প্রতিপদক্ষেপ আর জীবদ্দশার সমস্ত চালচিত্র ঘিরে
কিন্তু হায়, বিহঙ্গ আমার, উদাসীন এক ছায়া পড়ে আর অন্ধকার,
আমি কিছুতেই দেখি না কেমন মুক্তপ্রাণ আশ্চর্যে তাদের বিশ্বাস
অদূরে কোথাও ভিখিরির ঝলমলে হাড়ি নিয়ে সকৌতুকে অধীশ্বর
পাখি এক উড়ে চলেছে অনন্ত আকাশে, মেঘে তার জলছায়া
প্রতিটা সূর্যাস্ত দৃশ্যের থেকে জন্মায় সন্দেহবোধ, চতুর্মাত্রিকতা
যতদিন আমি মিলিত না হই নিজেরই আত্মার সাথে ততদিন খেলা
কণ্ঠনালী অবধি যতই ঠেসে দাও বচসার জয়, বঁড়শি ঠিক পাগলকরা
ইশারা কিংবা সংযুক্তিকরণ
তবে কি সংঘবদ্ধ বৃক্ষের ইশারাই জীবন,
সংরক্ষিত শাখায় পাতাদের বাহবা নিয়ে
মেকি এক কোলাহল ঘিরেই সামগ্রিকতা!
চারদিকে প্রচণ্ড শূন্যতায় ভুখা আর্তনাদ
মিলিয়ে গেলেই মনে হয় কখনও ছিল না
কঙ্কালসার, শলার মতো জীর্ণ দেহ
আগুনে নিভেছে, অন্য শব্দ, আষাঢ়ের!
অলৌকিক বৃষ্টিতে মুছে যাচ্ছে পরিপার্শ্ব চিহ্ন
মনে পড়ার মতো
ক্রমে তোমাকে উপলব্ধি করি,
নাই হয়ে যাওয়া কৈশোরের মতো
হাওয়ার তোরঙ্গে মিশে গেছে
ব্যথা বেদনাহীন যত মফস্বলি দিন
সব যেন হৃদয়ে দলা হয়ে বসে
হিম খণ্ডের থেকে ভাসায় নৌকো
দিশাহীন তোমাকে ফেলে এসেছি
আকাশ নীল আত্মার কাছে আর
ফিরে গিয়ে দেখেছি অজস্র জট
বিবিধ জীবন হয়ে মিশে আছে,
তুমি নাই, শুধু নীল সঞ্চিত আত্মা
ঢেউয়ে নেচে ওঠা তরীতে করে
চলে গেছ কোন সুগন্ধের দেশে…
ভাইঝির বাড়ি
সেই কবে, প্রথম ও শেষবার গিয়েছি ভাইঝির বাড়ি
মনে নেই, শুধু এক পাহাড়ের ঘুম কেটে নির্মিত গ্রাম
সেখানে নিভৃত পল্লী, সাপের শুয়ে পড়া মতো রাস্তা
এই দৃশ্য অবিকল মনে রেখে মুহূর্তের যোগবিয়োগ;
সেখানে সীমান্ত, বিভেদের কাটাতার গলে মানুষের
ভাষা ও বিবিধ সংযোগের এক খেলা দেখে আনমন
এক বিকেল আমি কাটিয়েছি পাথুরে টিলায়, তার
আরোহন পথ বৃষ্টিজলের স্রোত নির্মিত, ভয় আঁকা;
এত সবুজ আমি কখনও দেখিনি আর, দু পার ভরে
পাখিদের গভীরদেশ, অখণ্ড বাতাসের নিচে বিকেল,
আমি একবারই দেখেছি নিবিড়, দেখেছি ছিন্নমূলে
মানুষের গায়ের রং এক, ধূসর হয়েও কেমন প্রসন্ন;
আমি একবারই গিয়েছি ভাইঝির বাড়ি, জয়নগরে
নৈঃশব্দ্যে হারানো সে গ্রামে ঝিঁঝিরা রাগিনি বাজায়।