নীলাঞ্জন হাজরা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ঠিক ভোর পৌনে পাঁচটায় আমার ঘরে রিসেপশন থেকে ফোন— স্যার লবিতে আপনার গেস্ট অপেক্ষা করছেন৷ আমি ততক্ষণে তৈরি৷ ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ছুট৷
আজমল বলে, ‘একটু হাঁটতে হবে৷’ বাইরে তখন ঘুটঘুট্টি অন্ধকার৷
আমি বলি, ‘কেন? গাড়ি কই?’
‘আরে আমার গাড়ির যা দশা, তোমার এ হোটেলে ঢুকতে গেলে সিকিউরিটি গার্ড হইচই জুড়ে তোমার যাওয়াটাই পণ্ড করে দেবে৷’
হোটেল থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়ি৷ যথারীতি গেটে আটকায়৷ আজমাল দেমাকে উত্তর দেয়— ‘হিন্দুস্তানি মেহমান৷ ক্লিফটন বিচ-এ সানরাইজ দেখতে যাচ্ছি৷’ আমার গলায় ঝোলানো ক্যামেরা তার অকাট্য প্রমাণ৷
তারপরেই এক গোলমেলে কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আজমল৷ গোলমাল অবিশ্যি কিছু হয়নি৷ কিন্তু আমার মনে বেশ একটা সিরসিরে ভয়ের হিম ধরে গিয়েছিল কিছুক্ষণ৷ যদ্দূর মনে পড়ছে মহম্মদ আলি জিন্নাহ্-র সমাধির পাশে এটা ঝাপঝুপো গাছে ভরা জায়গায় আমায় নামিয়ে দিয়ে আজমল জানাল, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও৷ কবি সয়ীদউদ্দিন তোমাকে এখান থেকে তুলে নেবেন৷ এই এলেন বলে৷ আমাকে একজনের কাছে যেতে হবে একটা বই দিতে, এ পাড়াতেই৷ আমি সেরে আসছি৷’
কিছু বলার আগেই দেখি তার ছোট্ট লজ্ঝড়ে সুজুকি ৮০০-র একদিক ভাঙা টেল-লাইট অন্ধকারে মিলিয়ে গেল৷ সাবাশ৷ ‘দুনিয়ার সব থেকে বিপজ্জনক শহরের’ ভোর-রাতে সম্পূর্ণ জনহীন এক রাস্তায় একা আমি৷ এমনতরো পরিস্থিতিতে কেমন সব ভাবনা খেলে যায় মাথার মধ্যে তাও মনে আছে৷ তীর গতিতে একটা বাইক আসছে৷ এদিকেই৷ বাইকে করেই তো হামলা চালায় সন্ত্রাসবাদীরা! দূর থেকে আলো আর শব্দটা বাড়তে বাড়তে শীতল নিশ্চুপ তখনও-পাখি-না-ডাকা রাতকে থরথর করে কাঁপিয়ে ফের মিলিয়ে গেল৷ বুক কেঁপে ওঠে কয়েক মুহূর্ত৷ দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি৷ একটা গাড়ি আসছে৷ দূর থেকে৷ বেশ জোরে৷ এবার গতি কমল৷ হেড লাইট সোজা আমার ওপর৷ পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিই— পাসপোর্টটা সঙ্গে এনেছি তো?
সাদা সুজুকি৷ ত্যারছাভাবে গাড়িটি রেখেই বেরিয়ে আসেন এক ভদ্রলোক৷ গাড়ির হেডলাইট জ্বলতে থাকে৷ একগাল হাসি৷ সয়ীদউদ্দিন৷ মধ্যবয়স্ক৷ পরিচয় বিনিময় হয়৷ আমার হাত দু হাত দিয়ে চেপে ধরেন৷ আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি৷ সেই ছায়া লম্বা হয়ে মাটি দিয়ে বহু দূর গড়িয়ে যায়৷ করাচির একটি কলেজে উর্দুর অধ্যাপক৷ কবি৷ তাঁর আশ্চর্য বহু কবিতার বহু পঙ্ক্তি আমার মুখস্ত৷ হবে নাই বা কেন? পড়ে আসছি যে সেই ২০০০ সাল থেকে৷ এক মুহূর্তের জন্য মাথার ভিতরটা কেমন ঘেঁটে যায়— আমি, নীলাঞ্জন হাজরা৷ সুদূর বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের মানুষ৷ দাঁড়িয়ে আছি করাচির এক জন্যশূন্য রাস্তায়৷ শেষ রাতে৷ আমার মুখোমুখি এক অসামান্য উর্দু কবি৷
সেই সব কবিদের একজন, যিনি উর্দুর দীর্ঘ সাবেকি ঘরানা, সেই মীর তাকি মীর থেকে মির্জা গালিব হয়ে মহম্মদ ইকবাল হয়ে এই সেদিন ১৯৮৪-তে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর মৃত্যু পর্যন্ত যা চলে এসেছে, তাকে চুরমার করে, নিজেকে মুক্ত করে লিখছেন এক নয়া দিগন্তের কবিতা৷ কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি লিখছেন না৷ অতি মিতবাক এই কবি৷ এ পর্যন্ত তাঁর কবিতার সঙ্কলন একটিই মাত্র— রাত৷ উর্দু নামও তাই৷ ৯০টি কবিতার চটি সঙ্কলন৷ ১৯৯৭-এ প্রকাশিত৷ পরবর্তী সাত বছরে কোনও বই নেই কেন? মনে মনে ঠিক করেই রেখেছি, এ প্রশ্নটা করব তাঁর গাড়িতে উঠেই৷ দরজা খুলে বসতে যাব, ডাক পড়ে— নীলাঞ্জন, আমার নতুন কবিতার বই৷ সবে বেরিয়েছে৷ আপনার জন্য এক কপি এনেছি! গাড়ির আলোতেই দেখি— সাদা মলাট৷ আপনা পানি৷ নিজের জল৷ কী অপূর্ব নাম৷ জলের মতো সহজ৷ জলের মতো গভীর৷ পাতা উল্টাই গোটা গোটা হরফে লেখা উর্দুতে— ‘নীলাঞ্জন হাজরা কে নাম৷ মুহব্বৎ কে সাথ৷’ এইভাবেই পথেপ্রান্তরে অপরিচিত অন্ধকার রাস্তায় ভালোবাসার ছোট ছোট ধারায় আমার মুসাফির মনের তৃষ্ণা চিরকাল মিটিয়ে এসেছেন জীবনদেবতা৷ ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহর’ তকমা সেঁটে দেওয়া এক শহরে, প্রিয়তম এক কবির সাহচর্যে অন্ধকার থেকে এক আশ্চর্য ভোরের আলোয় প্রবেশ করি৷
পশ্চিম আকাশে তখন অস্তমিত চাঁদ৷ দেখতে দেখতে দূর আকাশে চিলের নিঃশব্দ উড়ানের মতো সহজে আলো এসে পড়ে ক্লিফটন বিচের মৃদু আরব সাগরে, ক্লিফটন অঞ্চলের মাল্টিস্টোরি বাড়িগুলোর ওপর৷ মনে মনে আউড়াতে থাকি সয়ীদউদ্দিনের কবিতা, যার নাম— মুহব্বৎ৷
ও ঘরে যেও না
ভালোবাসা কাপড় ছাড়ছে ওখানে
তুমি দেখে ফেলবে ভালোবাসার দেহ
আর তার পরেই ফাঁস করে দেবে সক্কলের কাছে—
ভালোবাসার দেহ ভর্তি ফোস্কা
চামড়া
খসে খসে পড়ছে এখানে সেখানে
নাঁক সিঁটকে তুমি বর্ণনা দেবে
সে সব ক্ষতের কী দুর্গন্ধ
ভালোবাসা
এর আগে তুমি দেখোনি কোনও দিন
ভালোবাসা এমনই চিরকাল
ক্ষতবিক্ষত
পোড়া
ভালোবাসার ঘা সারে না কখনওই
যদি দেখ পুঁজ গড়াচ্ছে সেই ক্ষত থেকে
যদি ফোস্কাগুলো থেকে দুর্গন্ধ আসে
যেও না ভালোবাসার কাছে৷
ভালোবাসায় আমার গা গুলোয় না কখনও
আমি তো ছুঁয়েও দেখি
ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি
একটা একটা করে ক্ষত
তুলে নিই ঠোঁটে
রাখি নিজের দেহ ভরে
আর দাঁড়িয়ে পড়ি আয়নার সামনে
কী স্বাভাবিক সুন্দর দেখায় আমায়
ভালোবাসার ক্ষত
আসলে আমারই ক্ষত
আমি তা কাউকে ধার দিতে রাজি নই
আয়নাকেও না
বুক ভরে শ্বাস নিই
সেই ক্ষতের গন্ধে
দূরে বসে
ভালোবাসা দ্যাখে এই সব
কাছে আসে
ছোঁয়
কল্পনাও করতে পারবে না তুমি
কোথায় সে স্পর্শ করে আমায়, কোন তলে
যদি পেতে ভালোবাসার ছোঁয়া, একবারও যদি পেতে
আর কোনও কিচ্ছুকে কোনও দিন
ছুঁতেই দিতে না নিজের দেহ
ভালোবাসা ছাড়া
এইবার হয়ে উঠেছি বর্ণহীন
গন্ধহীন
ছোঁয়া তো দূরের কথা
দেয়ালের ওই একচিলতে ফাটল দিয়ে আসা
ভালোবাসা
প্রতিফলিত না হলে আমার দেহে
দেখতে পর্যন্ত পাবে না আমায়
ক্লিফটন বিচের সেই প্রথম নরম ভোরেই আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন অফজ়াল আহমেদ সৈয়দ৷ যাঁর অনেক কবিতার মধ্যে একটা কবিতা আমার মুখস্থ৷ আর তারও নাম ‘মুহব্বৎ’! ‘এ তো প্রেমের কবিতা,’ বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়৷ তারপর পড়লেন, জোরে জোরে একটি টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্যে পড়লেন, একটি গোটা কবিতা৷
ভালোবাসা চোখে পড়ার মতো কোনও চিহ্ন নয়
যা দিয়ে সহজেই লাশ শনাক্ত করা যায়
নানা তদন্ত করে তুমি যতক্ষণে ভালোবাসার খোঁজ পাবে
হয়তো ততক্ষণে রওনা দিয়েছে সেই ভ্যান
যাতে নিয়ে যাওয়া হয় সেই সব লাশ
যাদের ওপর কারও কোনও দাবি নেই
পথিমধ্যে হয়তো তোমার গাড়ির
পাশ দিয়েই তা চলে গেছে
কিংবা হয়তো তুমি যে পথে আসোইনি
সে পথেই ভালোবাসার মৃতদের নিয়ে যাওয়া হয়
ভালোবাসা খোঁজার তদন্তে যে সময় লাগে
তা হয়তো তুমি দিয়েছ
কোনও ধরাবাঁধা কাজে
পাথরের শানের ওপর শায়িত সময়
আর প্রতীক্ষার শেষ সীমা অবধি টানা
ধবধবে চাদর
বদলে ফেলা হয়েছে তোমার সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই
হয়তো তোমার হাতে ছিল না
কোনও ক্যাজুয়্যাল লিভ
ছিল না ভালোবাসা শনাক্ত করার মতো
কোনও স্বপ্ন
ভালোবাসা তোমার ওই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আগেই
হয়তো বা রওনা হয়ে গিয়ে থাকবে সেই ভ্যান
যা তুলে নিয়ে যায় সেই সব স্বপ্ন
যার কোনও ওয়ারিশ নেই
২০১০৷ ফেব্রুয়ারি৷ বইমেলা৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে আমার অনুবাদ করা বই— কেড়ে নেওয়া ইতিহাস৷ অফজ়াল আহমেদ সৈয়দ৷ তাঁর পাশে বসে কবি স্বয়ং৷ আমার অনূদিত বইটি প্রকাশ করতে করাচি থেকে কলকাতায় উড়ে এসেছেন অফজ়াল সাহেব৷ তখনও করাচি থেকে মুম্বই বিমান পরিষেবা হয় চালু হয়নি, কিংবা বন্ধ আছে৷ কাজেই করাচি থেকে দুবাই৷ সেখান থেকে রাত্রি এগারোটায় কলকাতা৷ সেই আমার প্রথম পরিচয়৷
আমি তাঁকে নিতে গিয়েছি কলকাতা এয়ারপোর্টে৷ মাথায় সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা৷ অফজ়াল সাহেবের বিমান যাতায়াতের খরচ দিয়েছিলেন সমর নাগ৷ আমার দাদার মতো বন্ধু, শুভাশিস মৈত্র খুব সাহায্য করেছিলেন সে ব্যাপারে৷ আর এক পরিচিত রফিক আনোয়ার আমাকে আশ্বস্ত করলেন— আরে কোনও চিন্তা করবেন না পার্ক সার্কাসের কাছে একটা বেশ ভালো হোটেল আছে৷ আমার দারুণ বন্ধু তার মালিক৷ ওকে বলে দেব, দিন পাঁচেক ফ্রি রুম দেওয়া কোনও সমস্যাই নয়৷ অফজ়াল সাহেব যে দিন আসবেন তার আগের দিনও কথা হল৷ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ৷ সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে৷ কাল সকালে আমরা দুজনে গিয়ে রুম দেখে আসব,’ জনাব আনোয়ার আমায় জানালেন৷ পরের দিন সকাল থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ৷ পাগলের মতো একে তাকে জিজ্ঞেস করে রফিকের খোঁজ করছি৷ কেউ জানে না৷ স্রেফ পালিয়ে গিয়েছেন৷ কিন্তু তাতে দুশ্চিন্তার কী আছে? এই আছে যে, ভারতে আসা পাকিস্তানিদের ভিসা অ্যাপ্লিকেশনে জানাতে হয় তিনি কোন ঠিকানায় থাকবেন৷ পুলিশকে না জানিয়ে সে ঠিকানা বদল করা যায় না৷ সে স্বাধীনতা নেই৷
এখন উপায়? সব শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, যিনি নিজেও কবি৷ তখন তিনি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর চেয়ারম্যান৷ বললেন, ‘আমাদের খুব ভালো গেস্ট হাউস আছে আন্তর্জাতিক অতিথিদের জন্য৷ তুমি নিয়ে এসো ওঁকে৷ ওখানেই উনি থাকুন যে কদিন আছেন কলকাতায়৷ কাল গিয়ে পুলিশকে জানিয়ে আসবে ঠিকানা বদলের কথা৷ কিছু সমস্যা হলে আমি বুঝে নেব৷’ তবু চিন্তাটা মাথায় থেকেই গিয়েছে৷
দুবাইয়ের প্লেন এসে গেল৷ এসে গেলেন অফজ়াল সাহেব৷ ‘চলুন আমার গাড়ি রেডি আছে,’ রাত হয়ে গিয়েছে, তিনি নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত, এই ভেবে আমি তাড়াহুড়ো করি৷ ‘দাঁড়াও৷ আমাকে দু’মিনিট দাও,’ বলতে বলতেই একটা সিগারেট ধরালেন পাকিস্তানের এই মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কবি৷ আমি মনে করি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ারও৷ পর পর তিনটে সিগারেট একটা থেকে আর একটা ধরিয়ে খেয়ে গেলেন৷ তারপর আমরা রওনা দিলাম৷ তখন ঘড়িতে প্রায় বারোটা৷ ঠিক সায়েন্স সিটি পেরিয়েছি, সাংঘাতিক শব্দ করে আর ধোঁয়া উগরে আমার গাড়িটি দেহ রাখল৷ স্পষ্টতই নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কবি৷ একে ভুল ঠিকানা৷ তারপর রাত সাড়ে বারোটায় শুনশান অপরিচিত রাস্তায় দাঁড়িয়ে৷ অবশেষে একটা ৪০৭ মিনি ট্রাক যাচ্ছিল তাকে হৈ হৈ করে থামানো হল৷ কপাল ভালো তার কাছে একটা মোটা দড়ি ছিল৷ কপাল আরও ভালো, একটু টাকা বেশি দেওয়ার প্রস্তাবে সে গাড়ি টেনে নিয়ে যেতে রাজি হয়ে গেল৷ এইভাবে পৌঁছলাম এসআরএফটিআই-তে৷ গেটে বুদ্ধদা বলেই রেখেছিলেন এক অতিথি আসবেন৷ কিন্তু আসার পন্থা দেখে তাঁরা স্তম্ভিত! তবে কোনও ঝামেলা হয়নি৷
ঝামেলা হয়নি ঠিকানা বদল নিয়েও৷ পরের দিন লর্ড সিনহা রোডে কবিকে নিয়ে গেলাম৷ সারা রাত ঘুমাননি তিনি৷ চিন্তায়৷ সে দিনই আমার মনে হল, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে৷ আমি যত তাঁকে বোঝাই— এটা কলকাতা৷ আপনার মতো একজন কবিকে এখানে পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে চব্বিশবার ভাববে৷ কারণ তা হলে বিদ্বৎসমাজ এমন হৈ চৈ জুড়বে যে সরকারই অস্বস্তিতে পড়ে যাবে৷ কোনও চিন্তা করবেন না৷ উনি মাথা নাড়লেন৷ মুখ দেখে বুঝলাম— দুশ্চিন্তা যায়নি৷ পুলিশের কাছে যাচ্ছি শুনে যেন সেই টেনশন আরও বাড়ল৷ আশ্চর্য ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসাররা৷ মনে আছে একজন মহিলা অফিসার ছিলেন, বললেন, ‘আপনি কেন চিন্তা করছেন৷ এমন তো হতেই পারে৷ আমরা লিখে-টিখে নিচ্ছি৷ আপনি ওই চেয়ারটিতে বসে থাকুন৷ নীলাঞ্জনবাবুই যা করার করবেন৷’ সে পর্ব শেষ হওয়ার পরে তাঁর মুখে হাসি ফিরল৷ বুঝলাম, পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকারের সেই কনফিডেন্সটাই নেই, যে অধিকারে আমরা চেঁচিয়ে বলতে পারি— চলবে না৷ এটা সরকারি জুলুম৷ চলবে না৷ সত্যি বলতে কী, এই ঘটনাটাই আজকের ভারতে ঘটলে আমি হয়তো সে দিনের মতো অতটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম না৷
কিন্তু সেই পাকিস্তানে দাঁড়িয়েই অফজ়াল সাহেব যে কবিতা লিখে চলেছেন, তা বদলে দিয়েছে উর্দু কবিতার গোটা ঘরানাটাই৷ পাকিস্তানের সেরা উর্দু কবিতা বলতে এতকাল প্রবাদপ্রতিম কবি ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর কবিতাই পড়তাম৷ তার পরে হঠাৎ যখন পড়লাম— ‘ভালোবাসা চোখে পড়ার মতো কোনও চিহ্ন নয়/ যা দিয়ে লাশ শনাক্ত করা সহজ হতে পারে’— শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ চলে গেল৷ এর ভাষা অন্য৷ এর গঠনটাই অন্য৷
পুলিশের ঝামেলা মিটে গেছে৷ এবার একটা বড় কাজ৷ শঙ্খবাবুর বাড়ি যাওয়া আছে৷ শঙ্খ ঘোষ৷ এত শ্রদ্ধা খুব মানুষকেই করি৷ বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে উনি আসতে পারবেন না৷ কিন্তু অফজ়ালের কবিতা পড়ে মুগ্ধ৷ বলেছেন— অবশ্যই বাড়িতে নিয়ে এসো৷ যাই৷ সেই আশ্চর্য এক মুহূর্তের সাক্ষী আমি৷ দক্ষিণ এশিয়ার দুই সেরা কবি৷ লোকচক্ষুর আড়ালে৷ এক কবির অতি অনাড়ম্বর বই-ঘেরা-বৈঠকখানায় মুখোমুখি৷ কথোপকথন হয় কিছুক্ষণ৷ তারপর সেই আশ্চর্য মুহূর্ত— অফজ়াল সাহেব অনুরোধ করেন— ‘আমি অনেক দিন ঢাকায় ছিলাম৷ সামান্য বাংলা বুঝি৷ আপনি আপনার একটা কবিতা পড়ে শোনাবেন৷’ আমি জানি শঙ্খবাবু এ অনুরোধ স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ে প্রত্যাখ্যান করবেন৷ করবেনই৷ নিজেকে জাহির করছেন, ভুল করেও ঘুণাক্ষরে এমন ধারণা কারও মনে তৈরি হতে পারে, তেমন কোনও কিছু থেকে তিনি শত হস্ত দূরে৷ কাজেই জানি, না-ই বলবেন৷ ভুল জানি৷ নীরবে উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসেন নিজের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’৷ একটি কবিতা পড়া শুরু করেন৷ কোনটা, আজ আর মনে নেই৷ শঙ্খ ঘোষ পড়ছেন, সমস্ত একাগ্রতা কেন্দ্রীভূত করে শুনছেন অফজ়াল আহমেদ সৈয়দ, এ দৃশ্য আমি দেখেছি৷
তার পরে ক্লিফ্টন বিচ থেকে আমরা জড়ো হই করাচির এক বিখ্যাত গলির এক বিখ্যাত ঘুপচি রেস্তোরাঁয়৷ সেই কবি-সাহিত্যিকের দল৷ নেহারির হাঁড়ি মাটিতে পুঁতে রাখাটা সেই প্রাচীন কালের রেওয়াজ৷ কেন কেউ জানে না৷ বোধহয় যাতে শ্রমিকরা হাঁড়ি শুদ্ধু ছিনিয়ে না নিয়ে যেতে পারে৷
এই দোকানে ঢুকেই দেখি সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে! আর এই গলির পাশের রাস্তাতেই আমায় আজমল দেখায় একটা দোকানের ওপর উর্দুতে লেখা অসাধারণ একটা সাইনবোর্ড— দেহলি-কে মশহুর পাকিস্তানি দিলবহার দহিবড়ে! দিল্লির বিখ্যাত পাকিস্তানি মন-মাতানো দইবড়া!
সেখান থেকে অফজ়াল সাহেবের বাড়ি৷ বড়লোক পাড়ায়, পেল্লায় না হলেও, বেশ বড় ফ্ল্যাট৷ ঢুকেই বুঝি দুই কবির বাড়ি৷ চরম অগোছালো কিন্তু নোংরা নয়৷ আমি আর আজমল এসেছি৷ অফজাল আর আজমল ভদকা নিয়ে বসেন৷ আমি রিফিউজ করি৷ কলকাতা থেকে দার্জিলিং চা নিয়ে গিয়েছিলাম— তা উপহার দিই৷ সেটাই বানানো হয় আমার জন্য৷
সে আড্ডা ঘণ্টা খানেকের বেশি চলতে পারে না, কারণ আমাকে হোটেলে ফিরে, চান-টান করে সরকারি প্রোগ্রামে যোগ দিতে হবে৷
(আবার আগামী সংখ্যায়)
মুসাফির এ মন-এর সবগুলি পর্বের জন্য ডিসট্যান্ট সিগনাল দেখুন