দেবাঞ্জন মহাপাত্র
একটু আগে ফেসবুকের যে কমিক মতন ছবিটায় হাহা দিয়ে আসলেন, যেটা শেয়ার করলেন বন্ধুদের সাথে, কিংবা মেনশন করলেন আপনার প্রিয় বন্ধুকে মজাদার ছবিটির নিচে; সেটিকে যে মিম বলে সেটা নিশ্চয় আপনার অজানা নেই। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখতে পাওয়া যাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা একাধিক মিম পেজ; আর তার সাথে সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা মধ্যবিত্ত হিউমারের আস্ফালন। কিন্তু কী এই মিম? কোত্থেকে এল? কেনই বা মিমের এত রমরমা? সেই বিষয় নিয়েই এই প্রবন্ধটি লেখার প্রয়াস।
রিচার্ড ডকিন্স তার “দ্য সেলফিশ জিন” বইতে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তার মতে, মিম শব্দটি মানুষের কিছু আপাত ছন্নছাড়া অথচ খুব সাধারণ কিছু ব্যবহারকে নির্দেশ করে, যা বিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যদিও আজকে আমরা মিম বলতে যা বুঝি তা একমাত্র একটি ভাবেই এর সাথে মিলে যেতে পারে, সেটি হল বিবর্তন। হ্যাঁ, মিমের বিবর্তন। যেকোনও আর্ট ফর্মের মতোই মিমও বিবর্তিত হয়, যদিও তার নিজের ধারায়। অনেকেই এখন যদিও তেড়ে আসবেন এই বলে যে, মিম আদপে কোনও আর্ট ফর্ম নয়। মিম আদৌ আর্ট ফর্ম কিনা তা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, আগে দেখে নিতে হবে এই মিম শব্দটির উৎপত্তি কোথা থেকে। গ্রিক শব্দ “mimemma” থেকে মিম (meme)-এর উৎপত্তি, যার আক্ষরিক অর্থ হল “to imitate”।
গ্রাফিত্তির কথা আমরা প্রত্যেকে কমবেশি জানি, দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা রংবেরঙের ছবি যা মূলত প্রতিবাদের একটা ধারা হিসাবে পরিচিত। ডিজিটাল যুগে মিমকেও এরকমই একপ্রকার গ্রাফিত্তি বলা যায়, যা আসল দেওয়ালের পরিবর্তে ফেসবুকের দেওয়ালে ছাপ রেখে যায়। তাই মিম আর্টের যে একটি বিশেষ মাধ্যম তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না, কিন্তু এই মিম কি অন্যান্য আর্ট ফর্মের মত অরিজিনাল? বোধহয় না। কারণ মিম একটি নির্দিষ্ট ছাঁচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যে ছাঁচের মধ্যে থেকেই মিমের বক্তব্য প্রকাশ পায়। এই ছাঁচ সংখ্যায় বিপুল হলেও এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ছাঁচের আগমন ঘটলেও দিনের শেষে মিম একটা কাঠামোয় বাঁধা পড়ে। আর এখানেই তার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। অন্যান্য ভিসুয়াল আর্টের তুলনায় এখানেই সে ব্রাত্য হয়ে পড়ে। ‘কুলীন’ তকমা পায় না। পাশাপাশি কোনও নির্দিষ্ট মিমের স্রষ্টা কে তা জানা যায় না; রেডিট বা ফোরচানে জন্ম, ফেসবুকে ভাইরাল আর তারপর অন্য ছাঁচ চলে এলে পুরোনো ছাঁচের মৃত্যু। সংক্ষেপে দেখতে গেলে এই হল মিমের জীবনচক্র। তবে বায়োলজির নিয়ম মেনে মিমের জনন ও বিবর্তনও ঘটে বৈকি। কোনও একটা ফর্মা অন্য ফর্মার সাথে মিশিয়ে তৈরি হয়ে যায় নতুন কোনও ফর্মা। তারপর আবার ভাইরাল ও মৃত্যু। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও মিমই মৌলিক থাকে না। তাই অনেকে মিমকে আর্টের ‘বাস্টার্ড চাইল্ড’ও বলে থাকেন, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভুল কিছু নেই।
মিমের বিবর্তনের কথা বলতে গেলে শুরু করতে হবে বেশ খানিকটা আগে থেকে, যখন মিম ঠিক বাজারে আসেনি। তখন যুগ ছিল ট্রোলের। ইংরাজিতে ট্রোল বলতে বোঝায় মাথামোটা দৈত্য, আর ট্রোলও আসলে একপ্রকার বোকা বোকা হাসির উদ্রেক ঘটায়, অনেকটা সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর মতো। পুরোনো জোকসের পাঞ্চলাইন নেড়ে-ঘেঁটে কমিক্সের মতন রূপ দিয়ে রেজফেস জুড়ে দিলেই হয়ে গেল তোফা ট্রোল। যদিও ধীরে ধীরে এই ট্রোল উন্নত হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে নতুন নতুন গল্প ও কমিকস বানানো শুরু হয় রেজফেসকে ব্যবহার করে এবং অচিরেই ট্রোল হয়ে ওঠে ইন্টারনেট সেনসেশন। কিন্তু একই জিনিস মানুষের কাঁহাতকই বা ভালো লাগে। আস্তে আস্তে একঘেয়ে হয়ে উঠতে থাকে ট্রোল। ট্রোলের গ্রাফ যখন নিম্নমুখী তখনই বাজারে আসে গ্রাম্পি ক্যাট আর ওভারলি অ্যাটাচড গার্লফেন্ড।
এগুলো প্রথম দিকের কিছু উল্লেখযোগ্য মিম। খুব অল্প সময়েই এই দুটি ভাইরাল হয়ে যায়। তারপর মিমকে আর পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। একের পর এক নতুন ফরম্যাট এসেছে। 2012-2015 পর্যন্ত সময়কালকে মিমের ক্ষেত্রে সুবর্ণযুগ বলা যেতে পারে।
মিম আর ট্রোলের মধ্যে একটা সাধারণ পার্থক্য হল মিম ট্রোলের তুলনায় বুদ্ধিদীপ্ত ও মিমের একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ আছে। ট্রোলের ক্ষেত্রে অভিমুখের অনুপস্থিতির কারণেই ট্রোলকে উচ্চমানের হিউমর হিসাবে গণ্য করা হয় না। একইভাবে মিম ভীষণরকমের রাজনৈতিক এবং এর নির্দিষ্ট বক্তব্য আছে। গত কয়েকমাসে বারবার নানা রকম বিতর্কের শিরোনামে এসেছে মিম। খবরের চ্যানেলে চ্যানেলে তরজা থেকে শুরু করে মাঝারি মানের দাঙ্গা পরিস্থিতি: সবকিছুই হয়েছে নাকি মিমের জন্য। কিন্তু এই প্রেক্ষিতেই মিম আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। একটা হিউমারাস এলিমেন্ট যার ভার্চুয়ালের বাইরে কোনও অস্তিত্ব নেই, সেটা কীভাবে এইরকম কাণ্ডকারখানা ঘটাতে পারে? নাকি মানুষের অপরিণত বোধই তাকে বাধ্য করছে নিজের দোষের দায় অন্য কিছুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিষয়গতভাবে ভালো বা খারাপ মিম বলে কিছুই নেই। গুণগত মানের ভিত্তিতে ভালো বা খারাপ বলা গেলেও সেটা ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু আমরা দেখব প্রতিনিয়তই কোনও না কোনও মিমকে কেন্দ্র করে চলে সোশ্যাল মিডিয়ায় হপ্তাব্যাপী রঙচঙে প্রহসন। আসলে, কোনও মিমকে পড়তে গেলে কিছু ব্যাপার মাথায় রাখা খুব জরুরি। কোনও ভালো জোকের দু’টি বিশেষত্ব আছে, অতিরঞ্জন ও সরলীকরণ। এই দুইয়ের ভারসাম্যের সহাবস্থানের ফলেই জোকটা ভালো হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, মিমে এর সাথে সাথে আরও একটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়; যাকে মিমের ভাষায় বলা হয় আয়রনি। এই আয়রনির সাথে ইংরেজি আয়রনির কিছু তফাত আছে। এই আয়রনি আসলে একপ্রকার শ্লেষ বা ব্যঙ্গ। আয়রনি বলার কারণ, এর কারণে বিভিন্ন মিমে যা বলা হয়, তার উল্টোটাকেই বোঝানো হয়।
উপরের মিমটা আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে, চূড়ান্ত সেক্সিস্ট ও রেসিস্ট। ফেসবুকের বিপ্লবীরাও নিজেদের প্রতিস্পর্ধা দেখাতে রিপোর্ট করে বসবেন। কিন্তু এখানেও সেই আয়রনি। মিমটাতে ঐ টার্মগুলোর ওপরচালাকি ও সেগুলোর মধ্যে দিয়ে মানুষজনের যে হিপোক্রেসি তা ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এইখানেই আয়রনি। এবং আয়রনির এই সাটল প্রকাশেই মিমের সার্থকতা। এইভাবে নানারকম সামাজিক স্টিগমা ও কুরুচিকর চিন্তাধারাকে আয়রনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় একটা মিমে। উদাহরণস্বরূপ, পেডোফিলিয়া, নেক্রোফিলিয়া, ইসলামোফোবিয়া, হলোকস্ট, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রেসিজম, সেক্সিজম ইত্যাদির প্রতি শ্লেষ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। আবার সরলীকরণের ধারায়, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রূপ আছে। উল্লেখ্য যে ভারতের রূপ ভারতের বাইরের মিম দুনিয়ায় একেবারেই ভালো নয়। সারা বিশ্বে ভারতীয়= street shitter এবং ভারতীয় পুরুষ= pervert, rapist হিসাবেই পরিচিত। মূলত মহিলাদের “send bob and vagena pix” বলায় ভারতীয়দের জুড়ি মেলা ভার। বাঙালিদের পরিচয়ও বাংলার বাইরে খুব সুন্দর নয়। ভারতীয় মিম দুনিয়ায় বাঙালিদের সরলীকরণ করা হয় মিমের রিপোর্টার হিসাবে। কারণ ধন্যবাদ আমাদের বিপ্লবীদের, অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যবাসীদের তুলনায় বাঙালিরাই সবচেয়ে বেশি মিম রিপোর্ট করে। একই ভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতীয়রা কুকুরখেকো, নেপালিরা দারোয়ান, সিন্ধিরা কিপটে, বিহারীরা অশিক্ষিত, দক্ষিণী মানুষজন ইডলি ও ধোসাখেকো, গুজরাটিরা ব্যবসায়ী, পাকিস্তানিরা বকরিচোদ, মুসলিমরা পেডোফিল, নিগ্রোরা চাকর, সাদা চামড়ার মানুষজন মাত্রই সুপ্রিমেসিস্ট এইভাবে নানা সরলীকরণ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর প্রতিটিই আসলে এই গড়ে ওঠা ধারণার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া একটা শ্লেষ।
মিম শুধু যে এই কিছু সীমিত ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ তা ভাবা মারাত্মক ভুল হবে। সোজাসাপ্টা ঘটনা থেকে ভারি দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা অঙ্কের জটিল সূত্র সবকিছুকেই প্রকাশ করা হয় মিমের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রলি প্রবলেম মিমস বা এক্সিসটেনসিয়াল মিমের কথা বলা যায়।
পাশাপাশি রাজনীতির ক্ষেত্রেও বিশেষ এক ধারার সৃষ্টি করছে এই মিম, রাজনৈতিক সীমারেখাগুলোকে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। সম্প্রতি স্কুপহুপ চ্যানেলটিকে বন্ধ করার জন্য মিম-ওয়ারকে হাতিয়ার করা এরই একটা পদ্ধতি বলা যায়। এইভাবেই মিম হয়ে ওঠে অত্যন্ত রাজনৈতিক ও প্রাসঙ্গিক। আজকের পোস্ট-ট্রুথ যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেখানে খবর হয়ে গেছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, উঠে ধেয়ে এসে তারপর নেমে যায়। সেখানে মিম ভবিষ্যতে হয়তো ইতিহাস নির্মাণের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে কাজ করবে। আর সেখানেই প্রমাণিত হয়ে যাবে “আইডিয়ার মৃত্যু নেই” নামক ধ্রুবসত্যটি।
শেষ করব একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মিমের উদাহরণ দিয়ে। এই ধরনের মিমের পোশাকী নাম “সারিয়েল মিম”। মিমের সমস্ত পূর্ববর্তী ধারা ও ছাঁচকে প্রশ্ন করতেই এর উৎপত্তি। এর কোনও ছাঁচ নেই, নির্দিষ্ট বক্তব্য নেই এবং এগুলো ঝুড়ি-কোদাল দিয়ে লোককে বোঝানোর মতোও নয়। এগুলো শুধু উপলব্ধি করার আর দেখে নিজের মত করে ভেবে নিয়ে মুগ্ধ হওয়ার। ধীরে ধীরে এগুলি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতের মিম জগতে সারিয়েল মিমের নতুন তুফান এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। নিচে দুটি উদাহরণ দেওয়া হল, নিজেরাই দেখে উপলব্ধি করে নিন।