বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
Wren House
১
হীরক আর জিনির বিয়ের বছর দুয়েক হয়েছে তখন। হীরক পিএইচডি করছে, জিনি তখনও বাড়িতেই।
বিকেল পাঁচটা, হীরকের আসার সময় হয়ে গেল প্রায়। তবু খটখটে রোদ। এখানে গোধূলিবেলা দেখতে হলে রাত নটা। ভেবেই আবার হাসল মঞ্জিনি। গরু নেই তার গোধূলি।
সত্যি গরু নেই, কাক নেই, শালিখ নেই…
শুনলে হীরক রেগে যায়। এই যে সেদিন পথে হাঁস পার হচ্ছিল আর সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছিল, তখন তো খুব বিরক্ত হচ্ছিলে! আর যেদিন হুরনের ধারে গাড়ির সামনে একটা হরিণ লাফিয়ে চলে এল, তখন তো নিজেকে শকুন্তলা ভেবে মনে মনে হরিণের গলা জড়িয়ে বসতে চেয়েছিলে। তার বেলা?
সে যা আছে, সেটা আছে। কিন্তু যেটা নেই, সেটা তো নেই। বলব না? ছোটবেলা থেকে মেথি দিয়ে মুসুরির ডাল আর পোস্তর বড়া তৃপ্তি করে খেলাম, চারবেলা দিলে এখনও খেতে পারি। তার বদলে যদি আমাকে চিজবার্গার দেওয়া হয়, একবার খাব, দুবার খাব ব্যাস! জিভ আবার ওই ডাল পোস্তই চাইবে। এতসব কথা মঞ্জিনি হীরককে রাগাবার জন্যই বলে। কারণ এইবার হীরক ওর প্রিয় বিষয়ে চলে যাবে। রাগত গলায় বলবে, তা এত যখন নেই নেই, দেশে ফিরে গেলেই তো হয়। কোনওও রামচন্দ্রের বনবাসে আসিনি, যে চোদ্দ বছর পার করে তবেই ফিরতে পারব।
অথচ বনবাস কথাটা হীরক নিজেই বলে। চোদ্দ বছর ব্যস, তারপর নিজের দেশে ফিরব। মোটে এদেশে এসেছে চার বছর, তাহলে কেন চোদ্দ বছরের কথা? ইচ্ছা আছে অথচ সেই ইচ্ছাটাকে কোনও দূর ভবিষ্যতে ঠেলে রেখে মনকে এ কেমন সান্ত্বনা দেওয়া মঞ্জিনি সেটা বোঝে না। হয়তো হীরক দেশে ফিরতে পারলে সত্যি খুশি হবে। কিন্তু মঞ্জিনি হবে কি? মাঝেমাঝে ভাবে না তা নয়, কিন্তু এদেশে থেকে একটা সুখভোগের অভ্যাস হয়ে গেছে কেমন। বাসে ট্রেনে ঝোলা নেই, রাস্তাঘাটে ধুলোবালি নেই। খাবার জিনিস অফুরান আর রকমারি। জামাকাপড় এদেশেই যেন কম দাম, অবাক কান্ড!আবার উল্টো পাল্লায় ঘর সামলানোর খাটনিটা ষোল আনা। কাজের লোক তো নেই কোনওও। কিন্তু ধুলোবালি না থাকলে ঝাড়াপোঁছা অত দরকার কী?
তবু সুখ সনাতনতলায়! তাদের পাড়ার পড়ন্ত বিকেল ডুবসাঁতার কাটে মঞ্জিনির মনে। এখন বর্ষাকালের ঘ্রাণে ভরে উঠছে কি ছাতাগলি, ডোলেপাড়া, ঝাঁকিমাঝি লেন— জল জমলেই আবার জেঁকে উঠবে কাঁচা পাকের গন্ধ। জিনি থাকুক বা না থাকুক ঘণ্টা তো বেজেই চলেছে দয়াময়ী মন্দিরে নিত্যদিন। নিত্যদিন।
চুঁচুড়ায় তাদের বাড়ির শ্যাওলাধরা জলছাঁদ ঘিরে নীচু পাঁচিলের আড়াল তোলা ছোটবেলার এক ফালি খেলার জায়গা, সকালবেলার রোদ। সত্যনারায়ণের বোঁদে— বেশিটা হলুদ আর একটু লাল, ছড়িয়ে মুড়িতে মেখে দিত দিদা। ছুটির দিনে বাবু বাজার ফেরত সত্যনারায়ন মিষ্টান্নের বোঁদে আনবেই আনবে। খানিক বাদে খালি গায়ে বাগানে উবু হয়ে বসে সাধের গোলাপ গাছের গোড়ায় খুরপি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে জানলার দিকে তাকিয়ে বাবুর হাঁক পাড়া, ও জিনি, আমার পিঠটা একটু পাখার ডাঁট দিয়ে ঘষে দেতো রে মা, মশাগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে। বাবুর খোলা পিঠ ছুঁয়ে দেবার ইচ্ছায় হঠাত হঠাত হু হু করে ওঠে জিনির মন।
দাদু বেঁচে থাকতে রবিবারের সকালে খাওয়ার পাট চুকলেই জিনি আর রিনি চলে যেত লঞ্চঘাটে। বুড়ো বুড়ো গাছের স্তব্ধতা ঘেরা গঙ্গার গা বেয়ে একের পর এক ঘাট। এইরকম এক একটা ঘাটের সিঁড়িতে ওরা বসে থাকত দাদুর কোল ঘেঁষে। স্নান করতে আসা ধুতি গুটোনো দাদুর খালি গা নরম। পাথরের মত শীতল। তেমনি শীতল গঙ্গার বাতাস। শহরের সিঁথি কেটে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যেত সেকেলে জানালা পেরিয়ে ভগ্নপ্রায় দরজায়। সেই হাওয়ার স্পর্শ পেতে মাঝে মাঝেই আকুল হয়ে ওঠে মিশিগানের একেকটা সন্ধে!
লঞ্চঘাটের দিকটা পুরনো চুঁচুড়া। শহরের অন্যদিকটা, স্টেশনের কাছাকাছি তুলনায় নতুন। অপরিসর রাস্তার দুইধারে ফ্ল্যাটবাড়িগুলো সদ্য যৌবনা। তবু সাউথ উইন্ড, গ্রিন ভ্যালি নামগুলোর সঙ্গে অসমঞ্জস সন্ধিতে গ্রিল ঘেরা বারান্দায় তারে মেলা শাড়ি, বারমুডা, টেপজামা। হরেনজেঠুর রিক্সা চেপে এই পথেই বাণীমন্দির স্কুলে যেত জিনি আর রিনিরা।
আর একটু বড় হতে জিনির প্রিয় জায়গা ছিল ঘড়ির মোড়। ঘড়িটা ওলন্দাজি সময়ের, কোনও এক রাজার উপহার। ইয়া লম্বা, ইউরোপিয়ান কারুকাজ করা। টাইম ঠিক দিত, দেয় কি এখনও? সিনেমা দেখতে যাওয়ার তাড়া নিয়ে সুমি, কাকলিদের আসার অপেক্ষায় বারবার ওই ঘড়ি দেখেছে জিনি।
সুখেন্দু স্যারের বাড়ি থেকে ফেরার পথে পড়ত ওলন্দাজি গোরস্থান। শঙ্কু আকৃতির প্রাচীন কবর স্মারকগুলো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। কাছে কোথাও থেকে কামিনী ফুলের চড়া সুবাস গড়াত তরল মধুর মত। গোরস্থান ঘিরে শোনা ভৌতিক গল্পের দৌলতে রিক্সার হাতলবদ্ধ করতালু আপনিই দৃঢ় হয়ে যেত জিনির। অ্যান আরবারের ফরেস্ট হিল সেমেট্রির পাশ দিয়ে তো যায় মাঝেমাঝেই, তার ছোটবেলাটা ওখানে জমা নেই বলেই হয়তো মনে ওঠে না ভয়ের শিরশিরানি।
এমনি কত কথা মিশিগানের নিঃসঙ্গ নিঃশব্দ দুপুরে মনের মধ্যে নাছোড়বান্দা মশার মত বিনবিন করে। মন খারাপ হয়ে যায়। বাবু এখন কী করছে, মা এখন কার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়, রিনিকে কি শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়মিত বাপের বাড়ি আসতে দেয়— এইসব সাতসতেরো ভাবনা নিয়ে।
কিন্তু দুটো কথা বলে যে মনটা শান্ত করবে সেটাও অত সহজ নাকি? অত ঘন ঘন কথা বলা যায় না এদেশ থেকে। কলিং কার্ড হয়েছে আজকাল, কিন্তু ফোনের কথা হিসেব করে খরচ করতে হয়। কথা বলতে পারে না যদি, বসে বসে বাবুর চিঠি পড়ে। পুরনোগুলোই বারবার। বাবু এত ভালো চিঠি লেখে! বাবুর লেখায় তাদের বাড়িটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাগানের প্রতিটা ফুল মঞ্জিনির সঙ্গে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলে। মোহিনীপিসির বাড়ি্তে খেয়ে আসা কিসমিস আর কড়াইশুঁটি ছড়ানো আলুরদম ফুলকো লুচি সমেত হাতছানি দেয় চিঠির পাতা থেকে। বাবু মাছ থেকে খুব ভালোবাসে। খুঁটিয়ে খুটিয়ে কবে কী মাছ খেল জানাবেই জানাবে। তাদের এখানে সেই মাছ পাওয়া যায় কিনা, সব জিজ্ঞেস করে চিঠিতে।
মার চিঠির আবার অন্য ধারা। প্রতিটাতে প্রশ্ন এটা করেছ, ওটা করোনি তো? জামাইয়ের খেয়াল রাখছ কি? মঞ্জিনি মাথার চুলের যত্ন নেয় তো? এখানে কি রিঠা পাওয়া যায়, তাহলে অন্তত মাসে একবার যেন রিঠা দিয়ে চুল ঘষে। বেশি রাত করে ঘুমায় না তো? তাহলে চোখের কোনে কালি পড়ে যাবে, আর কম বয়সে চামড়া কুঁচকে যাবে। এমনি নানান ভয় দেখিয়ে মঞ্জিনিকে এখনও ছোট্ট মেয়ের মত শাসায় মা। খুব মজা লাগে ওর। অবশ্য মার কী দোষ! বিয়ের পরে পরেই হীরকের সঙ্গে চলে আসা। মাঝখানে শুধু রিনির বিয়ের সময়ে যেতে পেরেছিল। তাও একা। অত কাজের মধ্যে মাও কি ছাই বুঝতে পেরেছে যে তার ছোট্ট জিনি আসলে অনেক বড় হয়ে গেছে! বিজ্ঞাপন, স্লোগান আর পতাকার ঘরবাড়ির আড়াল খোঁজা গ্রিলে ঘেরা ওলন্দাজি ঘড়ির মত জিনির জীবনটাও যে চলে গেছে মার ধরাছোঁয়ার বাইরে!
মা-বাবার কথায় মনে হল আজকে কোনওও চিঠি এসেছে কি বাবুর? কিংবা মার? মঞ্জিনি যখন ফিরেছে ডাকবাক্স খুলে দেখেনি তো! মনে হতেই দরজা খুলে অস্থির পায়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেবে এল মঞ্জিনি। লেটার বক্সে এত বাজে কাগজ থাকে! অর্ধেকের বেশি বিজ্ঞাপনের কিংবা জবরদস্তি ক্রেডিট কার্ড গছানোর চিঠি। ওতেই চিঠির বাক্স ঠাসা। চিঠির গোছা বের করে প্রথমে আলাদা করতে শুরু করল মঞ্জিনি। ব্যাঙ্কের চিঠি, মিশিগান মেডিসিনের দুটো। দেশ থেকে শুধু একটা। বাকি সব বাজে কাগজ। বিভিন্ন দোকানের কুপন, বেশিরভাগই রেস্টুরেন্টের, কিন্তু কোথায় আর বাইরে খাওয়া হয় ফাস্ট ফুড ছাড়া! একটাই শুধু দেশ থেকে আসা চিঠি আজ। বাবুর বা মায়ের চিঠি, কিংবা হীরকের বাড়ির— সব আসে হাতে লেখা ঠিকানা নিয়ে। নীল অ্যারোগ্রাম। কিন্তু আজকের চিঠিটা অন্যরকম। ঠিকানা সব ছাপানো, হীরক দের নামে। বেশ বড় লেফাফা টাইপের। কে পাঠাল? সেই ঠিকানাটা দেখেই বুকটা কেমন ধক করে উঠল মঞ্জিনির। সিএমআইআর, দুর্গাপুর। সাধারণত হীরকের নামে হলে খোলে না, কিন্তু আজ খুলল। ফট করে চিঠিটা খুলে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না মঞ্জিনি। চাকরির চিঠি, জুনিয়ার সায়ান্টিস্ট হিসেবে ওখানে চাকরি পেয়েছে হীরক। কবে অ্যাপ্লাই করল? ইন্টারভিউ হল না কোনও? বিয়ের পর সেই যে এসেছে, হীরক তো মাঝখানে যায়নি আর দেশে।
তাকে একবারও বলল না! অভিমানে থরথর করে কাঁপছিল মঞ্জিনির ঠোঁট, টপ করে জলের ফোঁটা গাল বেয়ে গলায় নেবে এল। হাতের চেটোতে চোখ মুছতে মুছতে রাগের শিখাটা দপদপ করে বাড়ছিল এবার। এতদূর এগিয়ে গেছে অথচ মঞ্জিনিকে জানায়নি? কেন, তার মতামতের কোনওও দাম নেই? রাগলে তার নাকের পাটা ফুলে যায়। হীরু বলে সেই সময় তার সামনে আসলে নাকি নারদমুনিও ভস্ম হয়ে যাবে। একবার খুব রেগে গিয়ে চায়ের কাপ ছুঁড়ে মেরেছিল হীরককে। সে আবার এমন লোক, ধরে নিয়ে ফিচেল হেসে বলল, ছোটবেলা থেকে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ ধরে অনেক ছক্কাকে পক্কা করে দিয়েছি। আজ সেই অভ্যাসটা নিজের মাথা বাঁচাতে কাজে লাগল। এমন অসভ্য ছেলেটা যে ওর উপর খুব বেশিক্ষণ রেগেও থাকতে পারে না মঞ্জিনি। কিন্তু আজ শক্ত থাকতে হবে, ওর মিষ্টি কথায় যেন গলে না যায়। ওর সেই রাগ রাগ মন বলল এখুনি ছিঁড়ে ফেল চিঠিটা। আর একটা শান্ত মন বলল, না। একটা ছিঁড়ে ফেললে এমন আর একটা আসতে পারে। তার বদলে মুখোমুখি কথা বলবে মঞ্জিনি। যদি দুজনে মিলে ঠিক করে ফিরে যাবে, সেটাই ভালো, যাবেই না হয়। সে বেশ বাপের বাড়ি ঘনঘন পালিয়ে যাবে, তখন সে বুঝুক মজা। কিন্তু হীরক একা একা কেন ঠিক করবে?
ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল মঞ্জিনি। চোখ জানালার দিকে, কখন ফেরে হীরক। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল মঞ্জিনির। তাদের হ্যাপি হোম অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাইরের রাস্তায় সার দিয়ে মেপল, হেমলক আর অ্যাস্পেন— সেপ্টেম্বারের শেষ এখন। রং ধরতে শুরু করেছে। যেন হীরকের সঙ্গে এই দেশে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের রং জমিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পাতায় পাতায়। ছবির মত এই শহর, হুরনের কোলে কায়াক নিয়ে হীরকের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেয়ে বেড়ানো, মিশিগান লেকের টলটলে জল আর ফটফটে সাদা বিচ— তার গত আড়াই বছরের জীবনের সমস্ত আনন্দঘন মুহূর্ত এক লহমায় পুরু সরের আস্তরণ ছড়াল চুঁচুড়ার জন্য বিষাদঘন সন্ধ্যায়। এইসব ছেড়ে চলে যেতে হবে? দুর্গাপুরে? সত্যিই কি দেশে থাকাটা অত কিছু ভালোবাসে মঞ্জিনি? সব তালগোল পাকাতে থাকে ওর মনে। একটু আগেই চুঁচুড়ায় নিজেদের বাড়িটার কথা ভেবে মনটা হু হু করে উঠছিল, কিন্তু এখন নিজের এই দু কামরার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দুর্গাপুরে যেতে হবে ভেবে মনে হাহুতাশ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। না, কক্ষনও যাবে না মঞ্জিনি। ব্যস!
পুরনো ক্যাডিলাকটা মাত্র দুশো ডলার দিয়ে কিনেছিল হীরক। পনেরো বছরের বেশি পুরনো, কিন্তু চলে মন্দ না। তবে মাঝে মাঝে রাস্তায় বিগড়েও যায়। সেই জন্য যেদিন বিনা উপদ্রবে বাড়ি পৌঁছাতে পারে মনটা প্রসন্ন থাকে হীরকের। তার ওপর আজকে খবর পেয়েছে পাশের সাব ডিভিশনে গ্যারাজ সেল হচ্ছে, সস্তায় বেশ ভালো শীতের পোশাকও পাওয়া যাচ্ছে নাকি। মঞ্জিনি গত শীতে নতুন জ্যাকেটের কথা বলছিল, তখন কিনতে না পেরে সারা শীত মঞ্জিনির গোমড়া মুখ দেখতে হয়েছে। গ্যারেজ সেলে সব কিছু খুব কম দামে পাওয়া যায়, হোক না আগে অন্য কারও পরা। এদেশে মানুষ কেনার আনন্দে কেনে, তাই পুরনো জিনিস সত্যিকারের পুরনো নাও হতে পারে। একবার হীরক নিজে একটা জামা কিনেছিল স্যালভেশন আর্মি থেকে, তার আসল ট্যাগটাও ছেঁড়া হয়নি। হীরক আর মঞ্জিনি তাই গ্যারেজ সেলের জন্য অপেক্ষা করে। কম পয়সায় অনেক জিনিস কিনতে পারবে সেই আনন্দে ঠোঁটের কোনায় আলগা হাসি ঝুলিয়ে বাড়ি ঢুকছিল।
দেখে মঞ্জিনির রাগটা আর বেড়ে গেল। ও কি কলকাতার চাকরির খবর পেয়ে গেছে? তাই এত হাসি হাসি মুখ? টুপ করে দরজাটা খুলে হাতে চিঠিটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল।
জিনি! জিনি! করতে করতে হীরক দুটো বেডরুমে ঘুরে গেল। লিভিং রুম থেকে বারান্দায় বসা মঞ্জিনি নজরে এল। রংবাহার গাছের ব্যাকড্রপে মঞ্জিনির এই উদাস বসে থাকাটা একটা দুর্দান্ত ছবি হতে পারে। মাঝে মাঝেই ভাবে ছবি আঁকার অভ্যাসটা আবার চাগিয়ে তুলতে হবে, হয়ে ওঠেনি এখনও। মুখে বলল, বাব্বা! আজ দেখি প্রকৃতির রূপে এমন ডুবে গেছো, আমি বাড়ি ফিরলাম কি ফিরলাম না তারও খেয়াল নেই। মনের মধ্যে জমে থাকা হাসিটা এখনও হীরকের গলায় খেলা করছিল। পিছন থেকে এসে গলা জড়িয়ে ধরল মঞ্জিনির, তাতেও সাড়া নেই। তখনই চোখ গেল হাতে ধরা চিঠিটায়।
বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকলে চিঠি, টেলিগ্রাম বা ট্রাঙ্ককল শুনলেই বুকের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে। এই জন্যেই কি জিনি এত চুপচাপ? মা বলেছিল বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কিছু হল না তো? খপ করে জিনির হাত থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল হীরক। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। এটা ঠিক মাস দুয়েক আগে দুর্গাপুরের সিএমআইআর থেকে ডক্টর অমিয়রঞ্জন বসাক এসেছিলেন। তাদের কয়েকজনের কাছে জানতেও চেয়েছিলেন কেউ দেশে ফিরতে চায় কিনা। ওনার বক্তব্য, ব্রেন ড্রেনের মুখটা উল্টোদিকে ফেরানো যায় কিনা সেটা দেখতেই উনি আমেরিকায় এসেছেন। বাজারি অর্থনীতি একটু খোলামুখ দেখানোয় এখন নাকি অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে, গবেষণাতেও বেশ টাকা এখন। কেউ ভালো কাজ করতে চাইলে তার ঢালাও সুযোগ।
দুর্গাপুরে বা কলকাতায় ফিরবে কি না সেটা অত গভীর করে কখনও ভাবেনি হীরক। বাবা মায়ের বয়েস বাড়ছে। দেশে সুযোগসুবিধা বাড়ছিল ওর আমেরিকা পাড়ি দেবার পরে পরেই। তবে যা শুনেছে সেটা পশ্চিমবঙ্গে মোটেই নয়। বম্বে আর ব্যাঙ্গালোরেই মূলত। তাই দেশে ফিরলেও বাড়ির কাছে থাকবে সেই সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই দেশে থেকে ভিসা, কবে পাকাপাকি একটা পদে যেতে পারবে সেইসব ভাবনাগুলোও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাকে। রিসার্চ ফেলো হয়ে অত টাকাই বা কোথায়? চলে যায়, তবে বিলাসবহুল কিছু নয়। তার ওপর কাজের ভিসা না থাকায় জিনিও কিছু করতে পারে না। তাই জীবনটা বেশ অনিশ্চিত। এর থেকে যদি দেশে কোনওও ভালো সুযোগ পাওয়া যায়, নিজের দেশে নিজের লোকেদের মাঝখানে, তা হলে মন্দ কী! এমন একটা ভাবনা মাথায় ঘাই মারত হীরকের। কিন্তু খুব গা লাগিয়ে কোনও চেষ্টাও করেনি। ডঃ বসাক সেধে এসে যখন বললেন, নিজের নামটাও জুড়ে দিয়েছিল। কথা হয়েছিল খানিক। তারপর দু মাসের উপর হয়ে গেছে, কোনওও সাড়াশব্দ ছিল না। ভুলেও গেছিল। আর এখন একেবারে অ্যাপয়েন্টমেন্টের চিঠি!
নিজেই এত অবাক না হয়ে পড়লে হীরক বুঝতে পারত যে মঞ্জিনি খুব রেগে আছে। মাইনের অঙ্কটা দেখে বোকার মত মঞ্জিনির হাত ধরে টানল, দেখেছ এটা? জানো আমার প্রথম চাকরিতে কত পেতাম? মাস গেলে সাকুল্যে হাজার দুয়েক। আর এখানে গবেষণার কাজে মাসে ষোল হাজার দেবে বলছে! সে তো অনেক রে! এই ক বছরে এত চেঞ্জ? চলো, বেশ রাজার হালে থাকা যাবে মনে হচ্ছে!
আগুনে ঘি পড়ল।
–কী ভেবেছ তুমি নিজেকে? আমার জীবনের মালিক তুমি? নিজে সব ঠিকঠাক করে যেই বলবে ওমনি পাততাড়ি গুটিয়ে তোমার সঙ্গে হাঁটা মারব?
প্রথমে একটু থতমত খেলেও সামলে নিল হীরক। আহ্লাদের সময়ে জিনির বড় বড় চোখে ভালোবাসা যেমন চলকে পড়ে, তেমনি ঝড় উঠলে কালো আষাঢ়ের মেঘ হয়ে ছড়িয়ে যায় চোখের কোনায় কোনায়। হীরক এবার প্রমাদ গুনল। আরে, আরে আমি কী ঠিক করেছি! আমি তো জানতামও না, তুমিই তো এই চিঠি হাতে করে বরান্দায় বসে আছ। টেকনিক্যালি আমার আগে তুমিই জেনেছ।
–ও, আমাকে কি মনে করেছ বলো তো? কচি খুকি? শব্দগুলো হালকা হলেও, জিনির বলার মেজাজে জলে ভেজা তুলোর মত ভারী।
–খুকিই তো তুমি। বুড়ি হতে দেব অত সহজে? আর একটা কথা জানো, রাগলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়। এখনও পরিবেশ হালকা রাখার চেষ্টায় হীরক হাত ধরে মঞ্জিনিকে কাছে টানার চেষ্টা করল। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল মঞ্জিনি। আমার সঙ্গে ন্যাকামি করতে এসো না। আগে বলো কবে ইন্টারভিউ দিলে আর আমাকে কিছু জানাওনি কেন?
–আরে বাবা, আমার কথা শোনো তো আগে। আমি নিজেও কি কিছু জানতাম, না কোনওও ইন্টারভিউ দিয়েছি কোথাও! এদের এক ডিরেক্টার এখানে এসেছিলেন মাস তিনেক আগে। কেউ দেশে ফিরে কাজ করতে চায় কিনা জানতে চেয়েছিলেন। আমি অন্য সবার সঙ্গে আমার নামটাও জুড়ে দিয়েছিলাম। দিয়ে দেখতে দোষ কী, তাই না?
হীরকের গলার কাতর মিনতিতেও ভুলল না মঞ্জিনি। তুমি এত কিছু শাহেনশা খাঞ্জা খাঁ নও, যে শুধু তোমার নাম দেখেই সবাই চাকরি দেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করবে। তুমি তোমার সিভি দিয়েছ, আমি নিশ্চিত উনি যখন এখানে ছিলেন কোনওও ইন্টারভিউও দিয়ে থাকতে পারো। সব করেছ চুপিচুপি, আমাকে কিচ্ছু না জানিয়ে। এমনি আরও কত কিছু করছ আমাকে না জানিয়ে তার আমি কী জানি?
হীরক এদেশে যখন এসেছিল কাউকে আগে থেকে বলার দরকার হয়নি। আসার খবর জানাতে বাবা, মা— সবাই খুব উচ্ছসিত হয়েছিল। কিন্তু এখন ফেরার পথের চাবিকাঠি তার হাতে নেই, একইরকম প্রতিক্রিয়া আশা করা ভুল। অবস্থা সামলাতে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকা মঞ্জিনির পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, দ্যাখো, তুমি যেভাবে বললে সেভাবে যদি কিছু ঘটে থাকত তাহলে তোমার রাগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আদতে এমন কিছুই হয়নি। ডঃ বসাক শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন। কেবলমাত্র আমাকে নয়, আরও অনেককে। আমি ভাবলাম দিয়ে দেখতে দোষ কী, তাই নিজের একটা সিভি এদিকওদিক পালিশ করে দিয়ে দিলাম। কিছু হবে এরকম কোনওও আশাও করিনি। এখানেও তো কত চাকরির জন্য এমনি অ্যাপ্লাই করে থাকি, সব নিয়ে কি আমাদের কথা হয়? বলো?
হীরকের গলা দিয়ে অনুনয় গলে গলে পড়ছিল, কিন্তু মঞ্জিনির তরফ থেকে তবু কোনওও সাড়া নেই। অন্তত রাগ করে আবার মুখ তো ফেরায়নি, এই ভেবে মন শক্ত করে হীরক সন্ধির প্রস্তাব দিল। দেখো যাব বললেই তো যাওয়া হয় না। অনেক রকম ভাবনা ভাবতে হয়। এসো ঝগড়া না করে আমরা দুজনে মিলে কোনওটা আমাদের জন্য ঠিক, আর কোনওটা আমাদের জন্য ভুল সেটা ভাবি। এখানে থাকার যেমন সুবিধা আছে, তেমনি দেখো সবার থেকে এত দূরে থাকা! বাবা মায়েরও তো বয়েস হচ্ছে, না কি? তোমার, আমার দুজনকারই। ওদের তো দরকার বুড়ো বয়সে ছেলে মেয়েদের পাশে পাওয়ার।
–আমি এখুনি দেশে ফিরতে চাই না হীরু। তাছাড়া আমাদের কারও বাবা মায়েরই বয়েস অত বেশি কিছু হয়নি। তোমার বাবা এখনও রিটায়ার করেননি। বাবুরও রিটায়ারমেন্টের এখনও বছর দুয়েক। আমার বোন কলকাতাতেই থাকে। তোমার দিদি, ভাই এরাও অন্তত দেশেই আছে। দরকার পড়লে বাবা মায়ের কাছে একছুটে এসে যাবে। আসেও। তাহলে ওদের দোহাই দিয়ে লাভ কী?
–বাবা মা এখনও অত বুড়ো হয়নি, সেটা মানছি। কিন্তু যখন চাইব, তখনই যে দেশে ফিরে চাকরির সুযোগ পেয়ে যাব তা তো হয় না। তারপর দেখো আমাদের এখানের অবস্থাটা। পরের দেশে ভিসার ভরসায় কাজ করা। তুমিও তো নিজে কিছু করতে পারছ না। কদিন আর এরকমভাবে থাকা যায়? এ যেন দু নৌকায় পা দিয়ে চলা, কোথায় পৌঁছাব তার ঠিক নেই, আদৌ কোনওও ভদ্রস্থ পদে যেতে পারব, না কি এমনি না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে হবে! এগুলোও তো ভাবা দরকার, না কি?
–তার জন্য এই দেশটার দোষ দিও না, অভাব তোমার চেষ্টার। ব্রতীনদা কিভাবে গ্রিনকার্ড পেয়ে গেল? সুমনাদি এখন ভালো চাকরি পেয়ে গেছে নিজেও। তুমি কাউকে কিছু বলবে না, আর সব কিছু এমনি এমনি তোমার হাতে এসে পড়বে সেটা কখনও হয় না কি?
–এই দ্যাখো পড়ল তো। ঠিক যেমন তুমিও আমার হাতে টুপ করে এসে খসে পড়েছিলে। আবহাওয়া একটু হালকা করার চেষ্টা করে হীরক। কিন্তু মঞ্জিনি অত সহজে কথা ঘোরাতে দেবে না। বলো কালকেই তুমি কথা বলবে তোমার জেনকিনের সঙ্গে?
রব জেনকিন হীরকের রিসার্চ লিড। লোক অত কিছু মন্দ নয়, কিন্তু কতটা কী করবে বলা মুশকিল। তবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দিল। যদি ও কোনওওভাবে হেল্প করতে রাজি না হয়? তখন? যদি বলে ওর পক্ষে এখন কিছু করা সম্ভব নয়?
–আগে থেকে কেন না ভাবছ? বরং ভাবো যদি বলে হ্যাঁ, হীরক। আমরা তোমার গ্রিন কার্ড স্পনসর করব। তখন?
এখনও কথা হয়নি। কিন্তু মঞ্জিনির এই কথায় মনে হল তার ভবিষ্যৎটা কেমন নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। গ্রিন কার্ড পাওয়া, তার কিছু বছর বাদে এই দেশের নাগরিক হয়ে যাওয়া। এদেশে জমিয়ে বসা। আর সবার মতো সেও ওই ছকে পড়ে যাচ্ছে। ভুলভুলাইয়া, যার ঢোকার রাস্তা ছিল, কিন্তু বেরোবার পথে পদে পদে দিকভ্রষ্ট। কিন্তু হীরক সেটা চায় না তো। পথ খুঁজে পেতে চায়। এদেশে এসেছে, ভালোই আছে। কিন্তু চিরদিনের জন্য কখনওই আসেনি সে। সব সময়েই জানত কবছরের জন্য আসা, পিএইচডি করে হয়তো কবছর এখানে কাজ করল, ততদিনে কিছু টাকা জমিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাবে। জালে পড়া মাছের মত হীরকের মনটা ছটফট করে উঠল। ওরকম একটা ভবিষ্যতের জন্য ওর মন পুরোপুরি সায় দিতে পারছিল না। নিরুপায় হয়ে বলল, জিনি, আমি কিন্তু সারাটা জীবন এই দেশে কাটিয়ে দিতে চাই না সোনা। আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, থাকতে ইচ্ছে করে নিজের লোকেদের মাঝখানে। এখুনি না হলেও, একদিন। কোনওও একদিন।
–সেটা আমিও চাই হয়তো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নয়। আগে বলো তুমি কালকেই জেনকিনের সঙ্গে কথা বলবে? বলবে তো হানি? বলবে না হীরুবাবু? মঞ্জিনির স্বাদু ঠোঁট হীরকের ঘ্রাণ নেওয়ার দূরত্বে উন্মুক্তদ্বার হয়। তার সুগন্ধি বুক টানটান উষ্ণতায় হীরকের আঙুলের সঙ্গে খেলতে আসে। অন্তর্বাসের ভিতরে নরম সুখ খুঁজে বেড়ানো হীরকের হাতের চাপকে সম্মতি মেনে নিয়ে মঞ্জিনির মুখে এবার হলদে কুসুম ভোর হল। দুধে আলতা রঙে রাঙানো শব্দেরা ফিসফাস গুঞ্জনে ঝরে পড়ছিল শরীরের আনাচেকানাচে। বলে দ্যাখো কী হয় আগে। যদি হয়ে যায় থাকব আর কটা বছর। বাবু আর মাকে একবার এই দেশে ঘুরতে নিয়ে আসব। তোমার বাবা মাকেও। রামচন্দ্রের চোদ্দ বছর বনবাস মনে করেই থাকো না হয় আর কটা বছর, সীতা তো সঙ্গেই আছে! তারপর না হয় দেশে ফেরার কথা ভেব। কি, তাতে খুশি তো?
এখনকার মত ফিরে যাবার চেষ্টাটা আটকানো গেছে, সেই বিজয়ের নিশানা হিসাবে হীরককে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে কার্পেটে পিঠ ঠেকাল মঞ্জিনি।
মঞ্জিনির বাড়িয়ে দেওয়া সুখ আঁজলা ভরা জলের মত গ্রহণ করতে করতে হীরকের হঠাৎ মনে হল, মঞ্জিনির জায়গায় রেখা হলেও কি এইভাবেই ভাবত? পরক্ষণেই সেই ভাবনাটাকে মনের অতলে ঠেলে মঞ্জিনিকে জড়িয়ে গলায় বেশি বেশি জোর এনে হীরক বলল, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জিনি, তোমার যাতে সুখ তাতেই…
২
রক্তক্ষরণের মত সারা রাস্তা এই একটা ভাবনাই চুঁয়ে চুঁয়ে গড়াচ্ছিল বুদ্ধর মনে। চিন্তাটা নতুন নয়। গত দুবছর ধরে শুধু এটাই তো তাড়া করে বেড়াচ্ছে বুদ্ধকে। এখন মৌমি সঙ্গে নেই, সেই প্রশ্ন আরও জাঁকিয়ে চেপে ধরেছে। একই প্রশ্নের কুড়ে কুড়ে খাওয়া— কেন দেশে ফিরেছিল, কিসের খোঁজে? উত্তরটাও তার জানা। সে আমেরিকায় ভালো ছিল, ভালোই তো ছিল। কিন্তু সেই ভালো থাকার ইমারতে বুনেছিল অপূর্ণতার বীজ! নিরন্তর। নিজের দেশে কাজ করার তাগিদ পিছু ছাড়েনি কখনও। অবশেষে নিশির ডাকে সাড়া দেওয়ার মত হেঁটেছিল উল্টোপথে।
এখন আবার অন্য ফেরা। নিজের মনেই হাসল বুদ্ধ। আগেরটা যদি নিজের দেশে ফেরা হয়, তাহলে এবারের আমেরিকা যাত্রাটাকেও কি ফেরা বলা উচিত? তবে গমন হোক কিংবা প্রত্যাগমন, এবার আর কোনওও দ্বিধা নেই। এবার যৌবনের আদর্শ আর স্বপ্ন চিরগচ্ছিত রেখে চলে আসা।
প্রথমবার যখন আমেরিকায় গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট হয়ে এল, স্পষ্ট মনে আছে সেদিনকার কথা। সেবার আসবার সময় বাবা, মা, ভাই, দুইকাকু— সবাই এসেছিল কলকাতা এয়ারপোর্টে। কী যে কষ্ট হয়েছিল সবাইকে ছেড়ে আসতে! কলকাতায় বড় হয়েছে। সারাজীবন একান্নবর্তী পরিবারের ছত্রছায়ায়। মুখ ফুটে চাইবার আগেই সবকিছু হাতের কাছে হাজির। রাতে পড়তে পড়তে চোখ লেগে গেলে কেউ এসে টুপ করে আলো নিভিয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠেই মুখের সামনে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। নিজের পড়ার ঘর থেকে বেরোলেই কেউ না কেউ কথা বলার জন্য। একা বাইরে কোথাও গেলে কেমন নেই নেই ভাব। হস্টেলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দু-এক রাত কাটিয়ে থাকবে। ব্যস! তা বাদে জীবনটা পরিবারেই ভরাট। সেই সুখনীড় থেকে বেরিয়ে দূর দেশের যাত্রা! বাইশ বছর বয়সেও চোখ ফেটে জল এসেছিল বুদ্ধর। নামজাদা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ। মাথা গোঁজার জায়গাও হয়ে রয়েছে। কোনওও অকূলপাথার নয়। তবু তার কাছে সেটা অনিশ্চিতের যাত্রা ছিল।
সব কিছু ছক বেঁধেই হয়েছিল। প্লেন থেকে নাবতেই যাদবপুরের সিনিয়ার রাহুলদা। রাহুলদার সঙ্গে ওর অ্যাপার্টমেন্টেই গিয়ে ওঠা। এক সঙ্গে ছিল এক বছরের বেশি। যতদিন রাহুলদা বিয়ে করেনি। ওকে ছাড়াও বার্কলেতে যাদবপুরেরই আগের বছরের দুজন। রণেন আর সুরজিৎ। শিবপুর, প্রেসিডেন্সি সব মিলিয়ে বাঙালিই জনা দশেক। আশির দশকে বার্কলেতে ভারতীয় ছাত্র কি কিছু কম! মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। রাতে আলো জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়লে নিভিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। কিন্তু সেইভাবে একাকিত্ব বোধ করতে হয়নি বুদ্ধকে। নিজের হাতে অনেক কিছু করে নিতে হত। প্রথম প্রথম সেটা নিয়ে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু মানুষের অভ্যাস বদলায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখেও নিল সবকিছু।
তবুও মনের কোণায় দেশে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মরেনি। বুদ্ধ বরাবরই উচ্চাশী। ছোটবেলায় দাদু যখন বড় হয়ে দেশের দশের একজন হওয়ার কথা বলত সেই দেশ তো আমেরিকা ছিল না। দাদুর সঙ্গে ছোটবেলার অনেক ছুটির দুপুর কেটেছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দাদু। স্বাধীনতার পরে নেহেরুর দেশ গড়ার ডাক কেমনভাবে সড়ক, ব্রিজ আর ড্যাম বানাবার কাজে দেশের হয়ে লড়াই করার উদ্দীপনা এনে দিয়েছিল শুনে শুনে অন্য ধরনের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল। যাদবপুরে পড়ার সময়ে সন্তর্পণে নিজেকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে সরিয়ে নিলেও নিজের দেশ, দেশের মানুষ তার ভাবনায় থাকত।
দেশে ফেরার কথা সবাই ভাবত নিজের নিজের মত করে। আড্ডার একটা মূল টপিকই ছিল এটা। সবার ফিরে যাওয়ার আলাদা আলাদা কারণ ছিল। কিন্তু ফিরলে যাবে কোথায়? দেশে এমন কোনওও কাজ ছিল না যেখানে জব স্যাটিসফ্যাকশান পেতে পারে। বাড়িতে মা বাবাকে চিঠি লিখত। সেখানেও ঘুরেফিরে আসত এই কথা। মা চাইত বুদ্ধ ফিরে যাক। বড় ছেলেকে হাতের কাছে না পেয়ে ছটফট করত মায়ের মন। বাবা চায়নি। বলত, কী করবি দেশে ফিরে? অন্তত কিছুদিন কাজ করে আয়, মার্কিন দেশের কাজের ধারাটা দ্যাখ। দেখতে দেখতে বুদ্ধ বার্কলেতে বেশ থিতু হয়ে যাচ্ছিল। আড্ডার মধ্যে শুনত যে দেশে একটা বদল হচ্ছে। রাজীব গান্ধি আসার পর টেকনোলজি নিয়ে নানান কথা হচ্ছিল সেটা দেখেই এসেছিল। কিন্তু ইন্ডিয়ায় কথা আর কাহিনির দুস্তর ব্যবধান। সব দিক ভেবে উৎসাহ সেরকম দানা বেঁধে ওঠেনি আর।
বাবার হার্ট অ্যাটাক হল ঠিক এই সময়েই। চারপাশের পৃথিবীটা কেমন ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। কোনওও দিকে না তাকিয়ে দুই সপ্তাহের জন্য বাড়ি ফিরেছিল। এসে মাকে পেল একদম দিশেহারা। কাকারা আছে, ছোট ভাই গৌতম আছে তবু মা তার বড় ছেলেকে চাইছিল। দিন সাতেকের মধ্যে বাবা অনেকটা সামলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে বকাঝকা শুরু। ক্লাস মিস করছিস, এক্ষুনি ফিরে যা। আমার অ্যাটাক মাইল্ড, ওয়ার্নিং সিগন্যাল পেয়ে গেলাম। এবার সাবধানে থাকব, নিয়মের মধ্যে। ওষুধ চলতে থাকবে। তুই থেকে কী করবি? তুই কি ডাক্তার না নার্স? মার চোখ বলছিল— না। বুদ্ধ বুঝতে পারছিল না সত্যিই কি করা উচিত। এই কদিন বাড়িতে থেকে তরোয়াল খাপে ঢুকে যাবার স্বস্তি ছেয়ে যাচ্ছিল মনে। আবার কেন তবে রণাঙ্গনে? বিছানা থেকে আধশোয়া উঠে বাবা বলেছিল, এই দেশে এমন কি চাকরি আছে যেখানে কাজ করে আনন্দ পাবি? আমাকে দেখিসনি? দাদুর সেন্টিমেন্টের একেবারে অন্য জায়গায় বাবা। পাবলিক সেক্টরে কাজ করে বীতশ্রদ্ধ সারাজীবন। তাই বাবার চাপে ভাবনাটা আবার অন্যদিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল। ভাবছিল। নিমরাজি হয়ে গেছিল। আমেরিকা ফিরে আসবে, পিএইচডি করবে।
এমন সময়ে পাড়ার বন্ধু নীলেশের সঙ্গে দেখা। বুদ্ধর থেকে এক বছরের ছোট। কানপুর আইআইটিতে ছিল। এখন চাকরিতে। ওর কাছ থেকেই সি ডটের কথা জানল। বলতে বলতে উত্তেজনায় চোখ জ্বলজ্বল করছিল নিলেশের। সি ডট নাকি মডার্ন ইলেকট্রনিক এক্সচেঞ্জ বানাচ্ছে। তাও আবার তিন বছরের মধ্যে। নীলেশ পাশ করে বিদেশে যাওয়ার অফার ছেড়ে ওখানেই জয়েন করেছে। ওর কথা শুনে মনে হল চাকরি নয়, যেন ওর একটা মিশন। ইন্ডিয়াতেও এসব হয়? কাগজে কাগজে এই আলোচনা দেখেছে। ভেবেছে যতই হোক সরকারের একটা ইনিশিয়েটিভ, কত আর আলাদা হবে? তার নিজের মামাই বার্কে আছে। সরকারি গয়ংগচ্ছতায় কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু নীলেশের মুখে শুনল এক অন্য গল্প, যেন রূপকথা। স্যাম পিত্রোদা নাকি দারুণ একজন লোক। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই তো সদ্য ভালো ভালো কলেজ থেকে পাশ করে জয়েন করেছে ওখানে। স্যামের কথায় এমন জাদু, কিছু করার জন্য বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ওই ভদ্রলোক নাকি সরকারি সব তকমা হঠিয়ে একটা অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি করেছেন।
আমেরিকা থেকে বাড়িতে ফোন করতে কী অসুবিধা হত সেটা ফেস করেছে বুদ্ধ। শুধু তাই কেন, দেশের মধ্যেও তো এক অবস্থা। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ফোন করতে ট্র্যাঙ্ক কল ভরসা। সব নাকি বদলে যাবে। বদলে দেবে নীলেশরা। যেন এক প্রযুক্তিগত বিপ্লব শুরু হয়েছে। বলতে বলতে ছোঁয়াচে উত্তেজনায় ভরে যাচ্ছিল ওর চোখ। ও বলল বুদ্ধদা চলে এসো এখানে। তোমার টেলিম্যাটিক্স ব্যাকগ্রাউন্ড, বার্কলেতে মাস্টার্স করেছ। বুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল। দাঁড়া, দাঁড়া এখনও কমপ্লিট করিনি। নীলেশ উড়িয়ে দিল। তাতে কী হয়? তুমি বললে ফিরেই আমার বসের সঙ্গে কথা বলে তোমায় জানাচ্ছি। এখানে এখন অনেক কাজ, ইন্ডিয়ার অন্য সব কাজের জায়গার সঙ্গে এর তুলনা করতে পারবে না। দুদিন বাদেই আবার কথা। নীলেশ বলল তুমি তো ফিরছ দিল্লি হয়ে। একটা স্টপ ওভার নাও। একদিন থাকো। আমি তোমার কথা বলেছি। প্রোফাইলটা সঙ্গে রেখো। আমার বস তোমার ইন্টারভিউ করবে। তাছাড়া স্যাম নিজেও তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারে।
কীরকম অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল বুদ্ধর। স্যাম পিত্রোদাকে নিউজ চ্যানেলে এই কদিনে বেশ কয়েকবার দেখেছে। ডাইনামিক পারসোনালিটি। রাজীব গান্ধির সঙ্গে ওঠাবসা। সে তার মত একজন চুনোপুঁটির সঙ্গে দেখা করবে? বুকটা ঢিবঢিব করে উঠল, আর নিজেকে হঠাত অন্যরকম লাগল। সেকি এর যোগ্য? একসময় দেশের কাজের কথা ভেবেছে। যাদবপুরের প্রথম এক দুই বছর একটু রাজনীতির কাছাকাছি চলে এসেছিল। তীর্থদা যখন বলত, কী লাভ বল তো আমাদের শিক্ষার যদি দেশের লোকের কাজে না লাগাতে পারিস? দিয়েছে তোদের দেশ সেই সুযোগ? যাবি তো মাল্টিন্যাশানালে আর নিজের ঠান্ডা ঘর থেকে দেশকে দেখবি।
–আর কী করতে পারব তীর্থদা?
–সেটাই তো কথা। ভাবতে হবে তোদের। এটাই কি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য? আমাদের সমাজব্যবস্থার ওইটাই আসল গলতা।
অনুরণন হত তার মনে। দাদুও যে এমনিধারা কথা বলত। অন্যভাবে, দেশকে ফিরিয়ে দেবার দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে। কে জানে তীর্থদা এখন কোথায়। দাদু চলে গেছে তারপর অনেকগুলো বছর গড়িয়েছে। কিন্তু কানের কাছে দাদু যেন ফিসফিস করে বলল এই তোর সুযোগ রে বুদ্ধ। এভাবেও দেশের জন্য কিছু করা যায়।
বাড়িতে কিছু জানায়নি, শুধু প্লেনের টিকেটটা অদল বদল করে নিয়েছিল। Worth the trip! অন্তত সেদিন তাই মনে হয়েছিল। স্যাম নিজেও দুই মিনিটের জন্য দেখা করেছিলেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, নীল রঙের স্যুট, লাল চেক টাই। একটা পারসুয়েসিভ প্রেসেন্স। অথচ কোনওও ভনিতা নেই, হাত বাড়িয়ে নিজের মুঠোয় বুদ্ধর হাত নিয়েছিলেন সজোরে। আর প্রথমেই একদম সোজা কথায়। আমি তোমার কথা শুনেছি। তোমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাইন্টিস্ট আমাদের দরকার। তখনও ধরে থাকা হাতের চাপটা এবার একটু বাড়ল। Buddha, we need you guys back. I left that country too. And believe me, I am not regretting. This country needs us. অনেকটা পিকে ব্যানার্জীর ভোকাল টনিকের মত। উত্তেজনার গনগনে আগুনে সেঁকে দিয়েছিল বুদ্ধকে।
ওইভাবেই বুদ্ধ ফেঁসে গেল। অথবা তখনও পুরো ফাঁসেনি। দানা তুলেছে মুখে। বার্কলেতে ফিরতে সুরজিৎ, রণেনদা ওদের সবার সঙ্গে কথা বলল। ওরা অবশ্য সেরকম টগবগিয়ে উঠল না। রণেনদা বলল, কত কোটি মানুষের দেশ আমাদের জানিস তো? আমরা কাঁকড়ার জাত। মানলাম নয় স্যাম ইম্প্রেসিভ। কিন্তু একা স্যাম কী করবে? একজন উঠতে চাইলে দশজন পা টেনে নাবিয়ে আনে।
সুরজিতের সাদাসাপটা কথা। গুরু, অনেক কষ্ট করে এসেছি। গ্রিন মানি চাই। আমি গিয়ে ওই রকম পাঁচ হাজার টাকার চাকরি করার কথা ভাবতেও পারি না।
আস্তে আস্তে দমে যাচ্ছিল বুদ্ধ। যদিও স্যামের কথা তখনও ওর কানে বাজছিল। করমর্দনের উষ্ণতা তখনও হাতে লেগে। ফিরবে কি ফিরবে না, এই ভাবনায় দুলছিল। সব উল্টে দিল গ্যাভ্রিল।
গ্যাভ্রিল আতানাসভ। বুদ্ধের বড় প্রিয় প্রফেসার। ওকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। গ্যাভ্রিল যুগোস্লাভিয়ার লোক। কিন্তু নিজেকে ম্যাসিডোনিয়ান বলে। স্লাভদের অত্যাচারে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম নিয়ে আমেরিকায় চলে এসেছিল। আলেকজান্ডারকে বাদ দিলে এই শুধু একজনকে বুদ্ধ দেখেছে ম্যাসিডোনিয়ার লোক বলে।
ওর দ্বিধার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ ওর ছায়াঘেরা নীল চোখ মেলে বুদ্ধকে দেখল। জানো আমি কেন এই দেশে আছি? আমার দেশ গরীব বলে না। আসলে আমার কোনওও দেশ নেই। স্লাভেরা কেড়ে নিয়েছে। বলতে বলতে ঘৃণায় মুখ বেঁকে যাচ্ছিল গ্যাভ্রিলের। কিন্তু আজ যদি তোমার মত জলজ্যান্ত একটা নিজের দেশ থাকত আমার, আমি এই দেশে পড়ে থাকতাম না বুদ্ধা। কোনও ডলারের লোভ, আরামের হাতছানি আমাকে আটকে রাখতে পারত না। Go, Buddha go. Don’t think twice. Don’t be a coward.
স্যামের কথায় যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে, গ্যাভ্রিল যেন ওকে সজোরে ঘাড়ধাক্কা দিয়েছিল। সি ডটের যে চিঠিটা উত্তরের অপেক্ষায় ডেস্কে রাখা ছিল, তার জবাব রওয়ানা হয়েছিল ঠিক পরের দিন। দুমাস বাদে মাস্টার্স শেষ করে সব পাততাড়ি গুটিয়ে বুদ্ধ নিজেও।
বাবা ওকে ফিরতে দেখে খুশি হয়নি। এমন গোঁয়ার্তুমি করার আগে আমার সঙ্গে একবার কথা বললি না? যাক বড় হয়েছ, যা ভালো বুঝবে করবে। বাবা রাগ করলেই তুই থেকে তুমিতে চলে যায়। চুপচাপ উঠে সেদিনের খবরের কাগজটা ওর সামনে রেখে দিয়েছিল। বাবা ভারী পায়ে চলে যেতে আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় চোখ বুলাল। প্রথম পাতা জুড়ে শুধু বোফর্স আর বোফর্স। রাজীব গান্ধি একেবারে কোণঠাসা। কদিন চলবে এই সরকার? দুয়ে দুয়ে চার করে বুক কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু তখন আর ভাবার কিছু ছিল না। ফিরে যখন এসেছে যা হবে দেখা যাবে। দুদিন বাদেই দিল্লি। সি ডট।
গিয়েই নীলেশের সঙ্গে দেখা। ওর সঙ্গে কথা বলে কিছুটা ভরসা হয়েছিল। ফুঁ ফুঁ করে উড়িয়ে দিল নীলেশ। ওসব বাইরে বুদ্ধদা। আমরা ঠিক আছি বুদ্ধদা। সি ডট এসব ছুটকো রাজনীতির বাইরে। স্যাম নিজেও বলেছে সেই কথা।
কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছিল। সেটা অবশ্য শুরু থেকেই বুঝেছিল। অস্বীকার করবে না তখন কাজ করে চুটিয়ে আনন্দ পেয়েছে। কাজের আনন্দ, উত্তেজনা ওর সব ভয়কে ধুয়ে মুছে দিয়েছিল। এর জন্যেই তো পড়াশোনা। দেশে যদি এমন কাজ করা যায় বিদেশে কেন পড়ে থাকব বাবা? প্রথমবার দিল্লি থেকে ফিরে বাবাকে এই কথাই বলেছিল।
ও খুশি আছে জেনে বাবাও কিছুটা নিশ্চিন্ত। ওর দুই কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিল আমি কি আমার জন্য বলছি রে পাগল। তুই যদি এই দেশে কাজ করে জব স্যাটিসফ্যাকশান পাস, আর কী চাই? কলকাতায় না হলেও দিল্লিতে আছিস। ঘনঘন দেখতে পাই। আমার কি তাতে কম সুখ? কিন্তু আমার অসুখের জন্য তুই তোর ভবিষ্যৎকে বিসর্জন দিবি সেটা আমি চাইনি।
মা এমনিতেই খুব খুশি ছিল। ছেলে অন্তত হাতের কাছে আছে। কিন্তু বুদ্ধ একা একা থাকে, সব নিজের হাতে করতে হয়, সারাদিন সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরে পরমা। তাই ছেলের বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিল।
সি ডটের প্রথম সাফল্য এল গ্রামীণ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। বুদ্ধ আসার কদিনের মধ্যেই লঞ্চ করল। প্রত্যন্ত গ্রামের গরম আর ধুলোতেও কাজ ভালো করছিল। সি ডটের সুনাম ছড়াচ্ছিল। অফিসে তখন খুব অনুকূল পরিবেশ, হাওয়া সরগরম। বুদ্ধ আর সব চিন্তা ভুলে গেছিল। সামনে নতুন প্রোডাক্ট ডিজাইনের কাজ। মেইন অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশানের সঙ্গে বিরোধ তখন তুঙ্গে। বুদ্ধ ডিজাইনে ছিল। ডিওটির দেওয়া অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী স্পেসিফিকেশান নিয়ে হাঁফিয়ে উঠছিল ওরা। যেন সি ডটের কাজ আটকে দেওয়াটাই ওদের মূল উদ্দেশ্য। এদিকে ওরাই তো সি ডটের একমাত্র কাস্টমার! কাজ হবে কী করে? এইসব থামাতে স্যামকে ডিওটির চেয়ারম্যান করে দেওয়া হল। অন্তত কাজের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাধা সরতে থাকল। বুদ্ধরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
বেশ ভালো চলেছিল বছর খানেক। ততদিনে পরমা মেয়ে দেখায় অনেকদূর এগিয়েছে। মায়ের পছন্দের মৌমিতাকে বুদ্ধর ভালোই লাগল। কলকাতার মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেল। দিল্লির এই বছরটা নিয়ে সত্যিই কোনও অনুযোগ করতে পারবে না বুদ্ধ। কাজে আনন্দ। মৌমির সঙ্গে নতুন জীবনের স্বাদ। কখনও প্রেম করেনি, এইবার বিয়ে করে প্রেমে ভেসেছিল। জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তে আনন্দের বীজ বোনা চলছিল।
মৌমি খুব সমঝদার মেয়ে। বুদ্ধ যে অগোছালো, ওকে আগলে রাখা দরকার সেটা বুঝতে একদিনের বেশি লাগেনি ওর। তবে মায়ের খোকা হয়ে থাকলে চলবে না বুঝেছ? হাসতে হাসতেই বলেছিল। মৌমির মুখে হাসির একটা বড় জায়গা সবসময়ে। দরকারি কথা হাসির ছলে জানাতে ভোলে না। শক্ত রুটি গরম দুধে ভিজিয়ে খাওয়ার মত। এই যুগে সবাইকে বাড়ির কথা ভাবতে হয়। ভাবনাটা না হয় আমি নিয়ে নিলাম, কিন্তু সব কাজ নয় তাই বলে।
মৌমির কর্তালিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল খুব সহজেই। সে খুব মজার মেয়েও। পাঞ্জাবি কামওয়ালির সঙ্গে ওর কথাবার্তা রসিয়ে রসিয়ে বলত বুদ্ধ বাড়িতে ফিরলে আর হাসিতে ফেটে পড়ত বুদ্ধ। রবিবার করে কনট প্লেসে হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, গয়নার দোকানে কানে ঝুমকো লাগিয়ে বুদ্ধর পছন্দ জানতে চাওয়া, পথের ধারে গোলগাপ্পা খেতে খেতে কলকাতার ফুচকা মিস করা অথচ কলকাতার জীবনটা সত্যিই অতটা মিস না করার মধ্যে দিয়ে ওদের ভালোবাসাটা দিনে দিনে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল।
কিন্তু সুখ বেশিদিন রইল না। অন্তত কাজের সুখ। একদিন সব তাসের ঘরের মত ভেঙে গেল। রাজীব গান্ধি চলে গেল। স্যাম ভাবেনি যে ওর উপরে হাত পড়বে। সব সময়ে বলত, আমার কাজ আর রাজনীতি আলাদা আলাদা জায়গায়। আমি যে কাজটা করছি, ওটা করার দরকার ছিল। প্রধানমন্ত্রী কে, তাতে কিছু যায় আসে না।
কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে এরকম হয় না। রাজা গেলে তার পাত্রমিত্রঅমাত্যকেও রেয়াত করা হয় না। স্যাম পিত্রোদাকে যেতে হল। খুব দ্রুত সবকিছু একটা চিরাচরিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যাচ্ছিল। নীলেশ নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে পাড়ি দিল।
বুদ্ধ আরও এক বছর তবু মাটি কামড়ে পড়েছিল। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরলে মৌমির সান্নিধ্যে সারাদিনের মনঃকষ্ট ভুলে যেত। কিন্তু এক সময় সেটাও আর সম্ভব হল না। কপালে হাত রাখা চিন্তামগ্ন বুদ্ধকে মৌমি বলল, তোমার যদি এখানে ভালো না লাগে, ছেড়ে দাও। চলে যাব অন্য কোথাও।
–কোথায়?
–কেন আমেরিকায়!
–সেটা হেরে গিয়ে ফিরে যাওয়া হবে। রণেন, সুরজিৎ সবাই নিজের নিজের কাজে এই তিন বছরে এগিয়ে গেছে কত।
–আচ্ছা, আর তুমি এগোওনি? ওরা যে দেশে এখন অনেক সহজে ফোন করতে পারছে, তাতে তোমার হাত নেই? তাছাড়া আছে ওদের তোমার মত বউ? ধপ করে বুদ্ধর কোলে বসে গলা জড়িয়ে বলেছিল মৌমি। মনে রেখো আমরা যতদিন একসঙ্গে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাব, এই পথ যতই কাঁটা ছড়াক, ক্যাঁচকলা হবে আমাদের।
মৌমির মুখের দিকে হাঁ করে চেয়েছিল বুদ্ধ। আরেকবার ক্যাঁচকলা দেখাও প্লিজ।
–ইয়ার্কি হচ্ছে? আমার কাজ নেই কোনও যে তোমার জন্য ফ্লোর শো করব এখন?
কিন্তু সব ব্যাপারে বুদ্ধর খেয়ালও রাখত। রান্না করতে করতে চিন্তামগ্ন বুদ্ধর জন্য ওর হাতে গরম চা। ওটা বুদ্ধর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল একদিন, তোমার ওই গ্যাভ্রিলের সঙ্গে যোগাযোগ করছ না কেন? ও তো তোমাকে খুব পছন্দ করত, আবার জোর করে দেশে ফেরতও পাঠিয়েছে। করবে না কিছু?
আসলে গত কয়েক বছরে পৃথিবীটা বদলেও গেছে। জার্মান প্রাচীর ধসে পড়েছে। ম্যাসিডোনিয়া স্বাধীন দেশ এখন। গ্যাভ্রিল কথা রেখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে গেছেন কুড়ি বছরের বাস তুলে দিয়ে। তাই বলে আর কেউ নেই সেটা নয়। কিন্তু যেখানেই যাক, মৌমিকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিজের ব্যবস্থা করতে হবে। ওর ভিসাও। কী করে থাকব তোমায় ছেড়ে?
মৌমি ছদ্মকোপে বুকের উপর খেলে বেড়ানো বুদ্ধের হাতে চাপড় মেরেছিল। রান্নাঘরে ফিরে যেতে যেতে বিধান দিয়েছিল, পঁচিশটা বছর আমাকে ছেড়ে থেকেছ। ছটা মাস থাকবে আরও। আমি কারও সঙ্গে ইলোপ করে নিচ্ছি না।
আজকে দিল্লি এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে ছিল শুধু মৌমি। জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু যেতে তো হবেই। মৌমির চোখে কিন্তু জল নেই। আসছি তো আমি, আর কয়েক মাসের মধ্যে। আর ভেব না, আমি কোনও নেকুপুষুমনু নই। নিজের দেখভাল আমি নিজেই করতে পারি।
সত্যিই তাই। দিল্লির পাট চুকিয়ে কলকাতা যাওয়াটা সম্পূর্ণ নিজের মাথায় নিয়ে নিয়েছিল। এর জন্য দিন নষ্ট করে লাভ নেই তোমার। যত তাড়াতাড়ি যাবে, সব কিছু তেমনি এগিয়ে যাবে।
–তুমি সঙ্গে থাকলে আমার এগোনো কে আটকায় মৌমি। অস্ফূটে নিজেকেই শুনিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল বুদ্ধ।
৩
–বুদ্ধ? What a surprise! কবে ফিরলি তুই? আসবি বলিসনি তো? হীরক খুব অবাক হল। কিচ্ছু জানত না। অবশ্য জানা অত সহজ নয়। বন্ধুদের সঙ্গে চিঠিপত্র লেখালেখি আর কবে হয়।
–আসলাম তো। এসে গেলাম। ফোনের অন্যপ্রান্তে একটা লজ্জা জড়ানো হাসি বুদ্ধর।
–একবারে? এখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না হীরক। কিংবা চাইছিল না।
–সেরকমই তো ইচ্ছা। দেখি কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়।
–কিন্তু কেন বুদ্ধ? তুই দেশে ফিরে এত ভালো কাজ করছিলি। I mean we all acknowledge C DOT has changed India’s communication landscape. মনে আছে এখান থেকে বাড়িতে ফোন করতে কীভাবে একদিন আগে থেকে কল বুক করে রাখতে হত। তোরা তো সব বদলে দিলি। Such an achievement!
হঠাত বুদ্ধর মনে হল তাহলে ও সত্যি এতগুলো বছর বরবাদ করে দেয়নি। কিছু একটা ভালো কাজ করেছে, ইম্প্যাক্টফুল। আসলে দেশের পরিস্থিতি বদলে গেছে রে গত দুই বছরে। বুদ্ধ কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলে। অনিশ্চয়তা বেড়ে যাচ্ছে। মণ্ডল, মন্দির, মসজিদ সব খেয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া সি ডটের মধ্যেও অনেক রদবদল।
সব কিছু খুলে বলতে ইচ্ছাও করছিল না বুদ্ধর। স্বপ্নভঙ্গের কীর্তন করতে কার ভালো লাগে! কথা ঘোরাল। তোরা কেমন আছিস বল। মঞ্জিনি? হীরকের বিয়েতে বুদ্ধ আর মৌমিতা দুজনেই দিল্লি থেকে এসেছিল। তখনই একবার দেখেছে মঞ্জিনিকে।
–আগে বল তুই কোথায় আছিস এখন? মৌমিতা এসেছে?
–আমি বার্কলেতে ফিরে এসেছি। পিএইচডিটা করে ফেলব এবার। মৌমির ভিসা হব হব করছে। ব্যস চলে আসবে। বলতে বলতেও বুকে একটা ঘাই মারে বুদ্ধর। একা থাকার দিনগুলো যেন কাটতে চাইছে না। দিন গুনছে শুধু।
–দারুণ, দারুণ। ও এলেই চল একটা গেট টুগেদার করি। মণীশ আর বিজুকেও হুস্টন থেকে ডেকে নেব। অনেকদিন দেখা হয়নি। সবাই মিলে হইচই করা যাবে।
বুদ্ধর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে ফোন রাখতেই মঞ্জিনি। মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি। চোখ ঘুরিয়ে বলল, দেখেছেন মশাই, এই শর্মা যা বলে তা তেতো হলেও সত্যি। শুনলে তো দেশে গেলে কী হয়? তোমাকে না আটকালে ওই ভুলটাই করতে যাচ্ছিলে।
–তুমি কি আমাদের কথা শুনছিলে এতক্ষণ? বিরক্ত হল হীরক।
–একদিকটা শুনেছি। সেটাই যথেষ্ট বুঝতে যে বুদ্ধদা দেশের চাকরি পছন্দ না হওয়ায় ফিরে এসেছে। অথচ তুমি ওই ভুলটাই করার জন্য নিশপিশ করছ।
–কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক সেটা তো সময়ই বলবে, জিনি।
মঞ্জিনি হীরকের দার্শনিকতাকে পাত্তা দিল না। যেটা এখন ভুল জানি সেটা না করাই ভালো। আমি না বললে তো মুখ গোঁজ করে বসে শুধু ভাবতে, এগোতে পারতে না এক পাও।
সেটা ঠিক। মঞ্জিনি হাত ধুয়ে পিছনে পড়েছিল হীরকের। হীরক একটু খোঁজ খবর নিয়ে এগোচ্ছিল। প্রথমেই কথা বলেছিল শুভঙ্করদার সঙ্গে। শুভঙ্করদা প্রায় পাঁচ বছর ধরে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করছে। হীরক আর ও প্রায়ই একসঙ্গে সিগারেট খেতে বেরোয়। ওইদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা শুভঙ্করদা পোস্ট ডক তো করছি, এর পর কী করা উচিত? তুমি কী ভাবছ?
শুভঙ্কর প্রথমে কোনও উত্তর দিল না। একটা চিন্তার মেঘ ওর মুখে ভেসে বেড়াতে থাকল। সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে বলল, আমি নিজেই জানি না, তোকে আর কী বলি। দেখিস তো ল্যাবে কীভাবে প্রাণ দিয়ে কাজ করি। আমার বস ক্যাথি বহু জায়গায় পেপার পাবলিশ করে। আমি তার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করি। ক্যাথি আমার কাজে খুশি, স্যালারিও বাড়ায়। কিন্তু কোনও পার্মানেন্ট জবের ব্যবস্থা করছে না। কেনই বা করবে? সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কে জবাই করে? গেলে আমার হেল্পটা পাবে না তো আর। শব্দের পিছনে জমে থাকা রাগ ঠেলে ঠেলে মাথা চাড়া দিচ্ছিল।
–তুমি তো ফ্যাকাল্টি পজিশনে অ্যাপ্লাই করতে পারো। পারো না?
–অনেক করেছি। নো লাক। আসলে এটা অত সোজা নয় রে। স্ট্রং নেটওয়ার্ক থাকাটা খুব দরকার।
–তাহলে এইভাবেই কি চলতে থাকবে তোমার? বছর বছর ভিসা রিনিউ করানো?
শুভঙ্কর কথা ঘোরাল। তুই তোর বসকে জিজ্ঞেস করেছিস, তোকে স্পন্সর করবে কি না?
–ওটাই করব, তার আগে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে নিচ্ছি। কিন্তু তাহলে তোমার কী প্ল্যান শুভঙ্করদা? দেশে ফিরে যাবে? জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগছিল হীরকের। শুভঙ্করদা আর রানিদি ওদের জন্য তো কম করেনি। ওদের এমন টেনশানের সময়, তার কিছু করার নেই। কিন্তু জানাটাও দরকার, নিজের পথগুলো বোঝার জন্য।
–সেই চেষ্টাও করেছি, কিন্তু কোথায় যাব? অ্যাকাডেমিক পজিশনে যাওয়ার সেরকম সোজা পথ নেই। মোদ্দা কথা তোকে লোক চিনতে হবে। তাছাড়া রিসার্চ আর কত হয় আমাদের দেশে?
তাহলে কী করবে ওরা? হীরক ভাবছিল এ কিরকম গোলকধাঁধা! যেদিন এদেশে আসার ছাড়পত্র হাতে পেয়েছিল মনে হয়েছিল স্বর্গে যাওয়ার টিকিট। কিন্তু এমন প্রতিটা ধাপে ঠোক্কর খেতে হবে ভাবেনি। ইমিগ্র্যন্টের জীবন কি শুধু ভিসার রংমিলান্তি খেলা!
–সেরকমই বলতে পারিস। অন্য দেশে এসে কলকে পেতে সময় লাগে। সেটা দেশে থেকে বোঝা যায় না। আসলে যতদিন সিটিজেন না হতে পারছিস, তুই একটা ছায়া মানুষ। আছিস, আবার সবসময় নেই নেই ভাব। নিজেকে এস্টাবলিশ করার স্ট্রাগল চলতেই থাকবে।
এই ভাবনাটাকে নিয়ে ওরা অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সিগারেটের ভগ্নাংশটা ছুঁড়ে ফেলে শুভঙ্করদা বলল, ইন্ডাস্ট্রিতেও দেখছি। রিসার্চ করা হবে না, কিন্তু খালি হাতে দেশে ফেরার চাইতে এটা ভালো।
–খালি হাতে? শব্দটার মধ্যে একটা শূন্যতা আছে, হেরে যাওয়ার বেদনা।
–হ্যাঁ, কোথাও কোনও চাকরি না পেয়েই ধর দেশে ফিরে গেলি। তারপর ওখানে গিয়ে খুঁজলি। যায় এমন লোকে। ওই তো পান্ডাই যাচ্ছে।
–পান্ডাদা? মানে অরুণ পান্ডা?
–আর কটা পান্ডা আছে এখানে? ওকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবি। নিজের ল্যাবের দিকে হাঁটা লাগাতে লাগাতে বলল শুভঙ্কর।
হীরকের মনে হল ও অনেক ভালো অবস্থায় আছে। অন্তত ওর কাছে ইন্ডিয়া থেকে আসা একটা অফার আছে। মঞ্জিনির আপত্তি থাকলেও এখনও না বলে দেয়নি হীরক।
পরদিন করিডরে দেখা হতেই ও পান্ডাদাকে ধরল। তুমি নাকি ফিরে যাচ্ছ? কোথায় জয়েন করছ?
অরুণ পান্ডা মানুষটি খুব শান্ত। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় মাথা নীচু করে কিসব ভাবতে ভাবতে চলেছে। কথা খুব কম বলে। হীরকের কথায় মুখটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। না রে, আমি তো কোনও চাকরি পাইনি এখনও।
–তাও ফিরে যাচ্ছ? খুব রিস্কি হয়ে যাবে না?
–কোনও চয়েস ছিল না যে।
–কেন?
–আমার ভিসা এক্সপায়ার করবে। বস এক্সটেন্ড করবে না। কী করব! সাধারণত চোখ নিচু করে কথা বলা শান্তস্বভাবের পান্ডাদা সোজা চোখে তাকিয়েই বলল কথাটা। হীরকের মনে হল যেন নিজের ভিতরটা দেখানোর চেষ্টা করছে লোকটা।
–তাহলে অন্য জায়গায় অ্যাপ্লাই করো। পেয়ে যাবে ঠিক।
–বসের রেকমেন্ডেশান ছাড়া কে দেবে আমায় চাকরি? এটা একটা ভিসিয়াস সাইকেল হীরক। ব্রেন্ট আমাকে এই দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য যেন উঠেপড়ে লেগেছে। একটা অবধারিত ভবিষ্যৎকে মেনে নেওয়ার নির্লিপ্ততা আনার চেষ্টা গলায়।
–দেখো, দেশে সবার মাঝখানে ফিরে যাবে। সেটাও কিছু কম আনন্দের নয়। উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করল হীরক।
–হেরো সৈনিক হয়ে। সবাই এই প্রশ্ন করবে, কেন ফিরলাম। এদেশে সবাই আসে, নিজের একটা জীবন গড়ে নেয়। আর আমি কিচ্ছু না করেতে পেরে চলে যাচ্ছি। হেরে গেলাম, একদম হেরে গেলাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল অরুণ। মনে হল এখানে থাকতে না পারার দুঃখের থেকেও, দেশে ফিরে লোকের দশটা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চিন্তাটাই বেশি ভাবাচ্ছে অরুণ পান্ডাকে।
হীরকের খারাপ লাগছিল। এমন প্রশ্ন না করলেও চলত। বুকেও কাঁপুনি ধরল। তারও তো এমনি দশা হতে পারে। কী বলবে বুঝতে না পেরে পান্ডাদার কাঁধে আলগা হাত রাখল হীরক। কিছু সাহায্য লাগলে বলো আমায়।
সে কি বা সাহায্য করতে পারে! কিন্তু এইসব কথায় অন্তত নিজের ভবিষ্যৎটা স্পষ্ট করার তাগিদটা বাড়ল। মঞ্জিনি রোজই তাড়া দিচ্ছিল। তাই একদিন সাহস করে রবকে বলেই ফেলল। অনেকবার ভেবেছে, কীভাবে বলবে। রব কী উত্তর দিতে পারে। না করে দিলে সে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে। আসলে ভেবেছিল এক কথায় নাকচ হয়ে যাবে। কিন্তু তার বদলে রব যখন বলল, ওকে। অবশ্যই। আমার নতুন একটা ফান্ডিং এসেছে। একটা সুপারভাইসারি পজিশান ওপেন হচ্ছে। আমি তোমাকে নিয়ে নিতে পারি। তুমি ভালো কাজ করছ, আমি তোমার জন্য ব্যবস্থা করছি।
হীরক আনন্দে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। একটা পার্মানেন্ট পজিশান আসছে তার জন্য? আর গ্রিন কার্ড? তুমি কি স্পনসর করবে?
–আমার হাতে পুরোটা নেই। আমাদের বোর্ড আছে এর জন্য, আমি কথা বলে তোমাকে জানাব।
ছোটবেলায় নিউমোনিয়া হয়েছিল হীরকের। বাইশ দিন বাড়িতে বন্দি ছিল। রূপা, চিনু রোজ স্কুলে যাচ্ছে আর ও বাড়িতে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে। বন্ধ জানালার ওপার থেকে বিকেলের খেলার মাঠের হুল্লোড় কানে আসত। তার জীবনে শুধু তেতো ওষুধ আর দুধ সাবু। একটু টেম্পারেচার কমলেই মাকে জিজ্ঞাসা আজকে একটু ভাত দেবে মা? বাইশ দিন পর যেদিন ভাত খেয়ে উঠোনে নাবার অনুমতি পেল, দুপুরের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল। মনে হয়েছিল জীবনে এত আলো, এত আনন্দ! স্কুল থেকে সবাই ফিরছিল তখন। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর ভাবছিল তারও ছাড়পত্র মিলে গেছে, সেও আবার ওই কলকল হাসি আর খেলার মধ্যে ফিরে যেতে পারে।
আজ রবের ঘর থেকে বেরিয়ে হীরকের মনে ঠিক সেই ফুর্তি। যেন চারদিকে আলো হাওয়া আরও বেশি বেশি হয়ে গেছে। গাছের পাতা আরও সবুজ। এই মুহূর্তে কেউ কিছু চাইলে যেন অনায়াসে রাজপাট লিখে দিতে পারে। সেই আনন্দটা বুকে নিয়ে বাড়িতে লাফাতে লাফাতে ফিরে জানাল জিনিকে।
জিনির মুখে হাসির ঝরনা। আনন্দে দুই পাক নেচেই নিল। মনেও করিয়ে দিল, দেখলে আমি বলেছিলাম। আমি না বললে তুমি এক পাও এগোতে না।
–এগোলাম তো জিনি, আমরা এবার এগিয়েই যাব। একবার গ্রিন কার্ড হাতে পেলে তুমিও চাকরি করতে পারবে। সিঁড়ির একটা ধাপ পেরোনোর জোর এখন হীরকের গলায়।
অনেকদিন বাদে ওরা আবার সুখী। এই ব্যাপারটা নিয়ে ওদের খুব টানাপড়েন চলছিল। সেই দূরত্ব পেরিয়ে জিনি ওকে জড়িয়ে ধরে একটা দীর্ঘ চুমু খেল। আমরা এবার নিশ্চিন্তে সংসার পাততে পারি, তাই না হীরু।
–পেতেছি তো, তিন বছর হতে চলল। এখনও সন্দেহ আছে?
–শুধু পাতলেই হবে, বাড়াতে হবে না? মঞ্জিনির চোখে দুষ্টু ঝিলিক। অন্তত বাড়িতে একজন তো এই দেশের সিটিজেন হোক।
পরের দিন বলল শুভঙ্করদাকে। রবের অফারটা। শুভঙ্করদা খুব খুশি হল, একটু যেন চাপা কষ্টও। যদিও শুভঙ্করদা আর রানিদির সঙ্গে ওদের এত ভালো সম্পর্ক। এখানে মঞ্জিনিকে নিয়ে এসে ওঠা অবধি কতভাবে সাহায্য করেছে ওরা। আসলে নিজের ঘরে আগুন লেগে থাকলে অন্যের আনন্দ দেখার পরিপূর্ণতা আনা একটু মুশকিল। হীরক কথা ঘোরাবার জন্য বলল, তুমি যে ইন্ডিয়ায় খোঁজ করছিলে, কারও সঙ্গে যোগাযোগ হল?
–করেছি রে, কিন্তু ফ্রাস্ট্রেটিং। আসলে ওদের আমাদের মত লোকের দরকার আছে কি আদৌ, সেটাতেই আমার সন্দেহ আছে।
–মানে?
–আসলে ওখানেও তো সাইন্টিস্টের অভাব নেই, অভাব পজিশানের। শুকনো হাসল শুভঙ্করদা। গলায় বিদ্রূপ আর হতাশা এল হাত মিলিয়ে। তোর যদি নোবেল লরিয়েট হওয়ার মত ক্যালি না থাকে ওরা তোর প্রোফাইলও দেখবে না হীরু।
এটা তোমার রাগের কথা। কটা সাইন্টিস্ট নোবেল লরিয়েট হচ্ছে? হীরক বুঝতে পারছিল না শুভঙ্করদা কী বলতে চাইছে। তাদের দেশে কেই বা নোবেল প্রাইজ পায়, সেটা নিয়ে ভাবনাই বা করবে কেন? নিজের হাহুতাশ জোর করে দেশের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে শুধু শুধু। হীরক নিজে দেশেও চাকরি পেয়ে গেছে, যদিও নিচ্ছে না। আবার এখানেও তার ব্যবস্থা পাকা হচ্ছে। রোজ যে শুভঙ্করদার সঙ্গে একসঙ্গে সিগারেট খেয়েছে, এক সপ্তাহ অন্তর রানিদির হাতের খাবার উপভোগ করেছে, কিছু কিনবার আগে ওদের পরামর্শ ছাড়া এক পা এগোয়নি; আজ হঠাত সে যেন একটা অন্য পারে পৌঁছে গেছে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি। শুভঙ্করদা পানসি কোনও পারে ভেড়াবে বুঝতে পারছে না। মাঝদরিয়ায় দিশেহারা। যে হতাশা রবের সঙ্গে কথা বলার আগেও খুব সহজে বুঝতে পারছিল, এখন ঠিক ছুঁতে পারছে না আর।
–কেন খুরানার কথা শুনিসনি? ও আমাদের মত ইন্ডিয়াতে একটা রিসার্চ পজিশান খুঁজেছে হন্যে হয়ে। শেষ অবধি ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় জয়েন করল। আর দ্যাখ ওখান থেকেই নোবেল প্রাইজ পেল। শুভঙ্করদাকে খুবই ম্রিয়মান দেখাচ্ছিল। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, তবে আমি ইন্ডাস্ট্রিতে চেষ্টা করছি। রিসার্চ না হয় নাই হল। কিন্তু অরুণের মত ফিরে যেতেও চাই না।
–কিছু হচ্ছে?
–হতে পারে। হলে তোকে বলব। তোর অবশ্য এখানেই হয়ে যাচ্ছে, তাই চিন্তা নেই।
এদেশে আসার আগে কত রঙিন গল্প শুনেছে। অতটা সোজাও নয়। মঞ্জিনিকে বলতে ও উড়িয়ে দিল। তোমার জন্য সত্যি নয়। তুমি তো পেয়েই যাচ্ছ। তুমি আমার হীরের টুকরো, নামটা কি সাধে এমন? শুভঙ্করদা আর রানিদিকে আজ অনায়াসে পাশে সরিয়ে দিতে পারল। যারা কাজের লোক তাদের চিন্তা নেই।
এরকম নিশ্চিন্ত বিশ্বাস দেখতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু শুভঙ্করদা তো কোনও অকাজের লোক নয়। ওরা তাদের এতদিন কত যত্ন করেছে। খুব চিন্তা হচ্ছিল।
এর মধ্যে শুভঙ্করদা ওদের বাড়িতে ডেকেছিল। ওরা হামেশাই ডাকে, ইদানীং একটু কম ছিল। হীরক কারণটা বুঝতে পারে।
আজ যেতেই রানিদি হাসিমুখে হীরক আর মঞ্জিনিকে ভিতরে নিয়ে গেল। আজ কি কোনও বিশেষ দিন তোমাদের? অ্যানিভারসারি?
শুভঙ্করদা মিট মিট করে হাসছিল। এতদিনের চিন্তার ছায়াটা যেন সরে গেছে মুখের উপর থেকে। আমার হয়ে গেছে রে হীরু। আমি নিউ জার্সি চলে যাচ্ছি। স্বর্গের দরজা খুলে যাওয়ার আনন্দে উচ্ছসিত রানীদিও।
–কোথায়? কোথায়? হীরক আর মঞ্জিনি একসঙ্গে বলে উঠল।
–আসলে এখন আইটির খুব ডিম্যান্ড বাড়ছে। ডিম্যান্ড আছে, সাপ্লাই নেই। ওদিকেই চেষ্টা করছিলাম। মেরিল লিঙ্কে জয়েন করছি।
–ফিনাসিয়াল ইন্সটিটিউশানে? তোমার রিসার্চের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?
–কী যায় আসে বল তো? নিজের এতদিনের কাজ, স্বপ্ন ধুলিসাৎ হওয়ার কোনও দুঃখ লেগে ছিল না শুভঙ্করের গলায়। অন্তত ভিতরে থাকলেও, কোনও এক গোপন বাক্সে বন্দি করে রাখা হয়েছে তাদের। প্রতিটা শব্দে সেই নির্লিপ্ততা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার গ্রিন কার্ড চাই। ওরা স্পন্সর করবে। আমার রিসার্চের কারণে আমি রিলেশনাল ডেটাবেসে কাজ করেছি। এটার এখন খুব ডিম্যান্ড। নতুন ফিল্ড বলে লোক খুব কম। ব্যস!
শুভঙ্করদা শ্যাম্পেন এনেছিল। সেটা খুলে সেলিব্রেট করা হল। জয়ের আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছিল বাড়িটার আনাচেকানাচে। এবার ওরা স্বপ্ন দেখতে পারে। যে স্বপ্নে হঠাৎ দাঁড়ি পরে যাবে না।
কিন্তু এক সপ্তাহ বাদে হীরকের স্বপ্নে দাঁড়ি পড়ে গেল। অন্তত সেমিকোলন।
শুক্রবারের সকালে রব বজ্রপাত ঘটাল। এক্সিকিউটিভ কমিটিতে না কি ওর কথা তুলেছিল। কিন্তু গ্রিন কার্ডের স্পনসরশিপ করতে রাজী হয়নি। হীরক হঠাৎ চারদিক অন্ধকার দেখল। কেন রব? তুমি যে বলেছিলে সব হয়ে যাবে?
রব নিজেও খুব দুঃখিত ছিল। দেখো, এমন হতে পারে ভাবিনি। কিন্তু কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসার জ্যাকাবসিন কিছুতেই রাজি হল না। জানি না তোমার সঙ্গে ওর কোনও নেগেটিভ ইন্টার্যাকশান ছিল কিনা। কিন্তু ও একেবারে নাছোড়বান্দা। তবে এখুনি এত চিন্তা কোরো না হীরক। তোমার জন্য এই চাকরিটা তো রইল, ভিসা এক্সটেন্ড হয়ে যাবে। নেক্সট ইয়ার অন্য কোনও প্রফেসার চেয়ারম্যান থাকবেন, তখন নতুন করে ভাবা যাবে।
হীরকের মাথায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। পেত না ঠিক আছে। এ তো মুখের সামনে থেকে খাবার ছিনিয়ে নেওয়া। এক লহমায় জীবনের সমস্ত আলো শুষে নিল প্রফেসার জ্যাকাবসিন। প্রাণ খুলে গালি দিতে ইচ্ছা করছিল লোকটাকে। হিতাহিত হারিয়ে ফেলল হীরক। রবের কাছ থেকে কোনওমতে বিদায় নিয়ে প্রফেসার জ্যাকাবসিনের কেবিনের দিকে পা বাড়াল। ও এক সেমিস্টারে এই লোকটার ক্লাস করেছিল। ভালোই তো করেছিল। এমন কিছু করেনি যে প্রফেসারকে তার পিছনে হাত ধুয়ে পড়ে যেতে হবে। মাথা একটু ঠান্ডা থাকলে আর একটু ভাবত হীরক, অন্তত ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু এতদিন যে চাপ মনের ভিতরে তৈরি হয়েছিল সেটা ফেটে বেরোতে চাইছে এখুনি, এই মুহূর্তে। ধীরে ধীরে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার যে সহনশীলতা এতদিন দেখিয়েছে, নিজের পথ থকে বিচ্যুত হতে পারে এমন সব কিছুকে পাশে রেখে এগিয়ে গেছে, আজ তার সব বাঁধন যেন ছিঁড়ে গেছে। স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রফেসার জ্যাকাবসিনের কেবিনে ঢুকে পড়ল, কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই।
–May I come in Paul?
পল জ্যাকাবসিন মাথা নীচু করে কিছু লিখছিলেন। বাদামী স্যুট, খয়েরী টাই, চুলহীন মাথায় চকচকে লালচে টাক। চোখ তুলে ব্যঙ্গ করলেন, ঢুকেই তো গেছ মনে হয়।
–হ্যাঁ, সেটা সত্যি। কিন্তু আমার জানার ছিল আমাকে কেন আপনি পছন্দ করেন না।
–আমি? কে বলেছে তোমায়? পলের মুখ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। মুখে দুয়েক পোঁচ অতিরিক্ত লালের আভা।
–আমি শুনেছি আপনি চান না আমি গ্রিন কার্ড পেয়ে এই দেশে থাকি।
–তোমার এইভাবে জানার কথা নয়। কিন্তু যা শুনেছ, যেখান থেকেই জেনেছ, ঠিকই সেটা। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন ভদ্রলোক। হীরকের রাগ ক্ষোভ ওর উপরে কোনও প্রভাব ফেলছে বলে মনে হল না।
–কিন্তু কেন? রাগে ফেটে পড়ল হীরক। আমার কিসের অভাব আছে, যার জন্য আমি গ্রিন কার্ড পেতে পারি না।
ততোধিক শান্ত গলায় পল বলল, পেতে পারো। কিন্তু আমি স্পন্সর করতে চাই না।
–কেন?
–মুরগি আর শুয়োরের পার্থক্য বোঝো? এক মুহূর্ত থেমে বেশ হাসিমুখেই নিজের কথার মানে বোঝাতে শুরু করল আবার। মুখে একটা মজার মৃদুমন্দ হাসি, একটু বাঁকা। মুরগি ডিম পেড়ে ভাবে, এই তো বেশ প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে দিলাম। কিন্তু শুয়োরকে দেখো, নিজেকে উজার করে দেয়। পর্ক খাও তো তুমি নাকি? সসেজ, বেকন? পুরোদস্তুর আমেরিকান ব্রেকফাস্টের জন্য আমাদের শুয়োর চাই হীরক।
জ্যাক্যাবসিনের বলার ভঙ্গিতে গা চিড়বিড় করছিল হীরকের। কিন্তু ওর থামার নাম নেই। বলার তীব্রতায় সামনে ঝুঁকে পড়েছে এমন যে ওর টাইয়ের অর্ধাংশ টেবিলের সঙ্গে সমান্তরাল। তোমরা যারা এই দেশে আসছ, শুধু পেতে আসছ। ভাবছ এই দেশটায় সব আছে আর আমি দুহাত ভরে নেব। ট্যাক্স দেবে নিশ্চয়। ব্যস ওইটুকুই। একটা দেশ গড়ে ওঠে অনেক ত্যাগে, অনেক বছরের চেষ্টায়। না হলে কী ছিল এই দেশে? আমাদের পূর্বপুরুষ এসে নিজের হাতে বানিয়েছে গোড়া থেকে। নিজেদের জীবন দিয়ে। তোমরা কী দেবে? দিচ্ছ? আমাদের বাপঠাকুরদা যে দেশটাকে এত যত্নে, এত কষ্টে বানিয়েছে, এত সহজে সেই দেশের ছাড়পত্র পেয়ে যাবে নাকি? টিটিকিরি দেবার ভঙ্গিতে বলছিল লোকটা। বলতে বলতে ওর মুখটা আরও লাল হয়ে যাচ্ছিল। আগের ব্যঙ্গের হাসির বদলে এখন শুধু বিদ্বেষ আর রাগ। উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত টেবিলে ভর দিয়ে হীরকের চোখে চোখ রাখল পল। আগে কিছু করো এই দেশের জন্য। যাও না এই দেশের হয়ে যুদ্ধে। মিলিটারিতে নাম লেখাও, সঙ্গে সঙ্গে সিটিজেনশিপ পেয়ে যাবে। পারবে যেতে?
থরথর করে কাঁপছিল হীরক। লোকটা যেন কসিয়ে এক থাপ্পড় মেরেছে গালে। দেশের কথা ভেবে মরতে নিজের চোখে শুধু অতীনদাকেই দেখেছে ও। দেশ কি এগিয়েছে তাতে? সেটা বুঝেই তো হীরক সাবধানে সব এড়িয়ে চলেছে, এগিয়ে গিয়েছে নিজের পথে। আজ যেন প্রফেসার জ্যাকাবসিন সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। অনেক কথা বলতে পারত হীরক তবুও। বলতে পারত একটা দেশ একবার গড়ে উঠেই থেমে যায় না। তাকে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে হয়। একটা বাড়ি বানাতে কেউ ভিত বসায়, কেউ দেওয়াল তোলে, ছাদ লাগায়। তাতেই শেষ নয়। তখনও লোক লাগে রঙের পোঁচ লাগাতে, পায়ের তলায় মেঝে বসাতে। এমন অনেক কথাই বলা যেত, সেটা পরে মনে হয়েছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে হীরকের মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছিল। সেই শূন্য জমিতে শুধু অতীনদার রক্তমাখা শরীরটা পড়েছিল। কিছু কিছু ছবি পাথরে খোদাই থাকে, সময় সহজে মুছতে পারে না।
হীরক ভাঙা কাঁচের উপর দিয়ে যাবার মত সাবধানে পা ফেলে ফেলে প্রফেসার জ্যাকাবসিনের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মাথার ছবিটা সরাতে সরাতে ভাবল জিনিকে এখুনি কিছু বলা ঠিক হবে না। কিছু ব্যবস্থা না হওয়া অবধি। একলা পথ পেরোনোর কষ্ট গুমরে উঠলেই শুধু তার কথা মনে পড়ে। যে কোলে কোনওদিন মাথা রাখেনি সেখানেই যেন সব শান্তি, তার আশ্রয়।
(চলবে)
সমস্ত পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি – বিশ্বদীপ চক্রবর্তী