অরুণপ্রকাশ রায়
দিল্লির লোদি রোড ধরে হুমায়ুন টুম্ব-এর দিকে মাইলদুয়েক হেঁটে, বাঁক নিলেই হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া-র চিল্লাগাহ্ বা খানকাহ্। একটু বেশি সন্ধের দিকে সেখানে পৌঁছে উঁচুগলায় ডাক দিলে আজও খুলে যায় তার দরজা। ভিতরের আবছা অন্ধকারে কান পাতলে শোনা যায়, এখনও সেখানে থমকে আছে সাড়ে আটশো বছরের সুফি সঙ্গীতের ইতিহাস। হজরত আমির খুসরোর কাল থেকে আজকের সুফি ও কাওয়ালি গানের ঘরানা ও তার বিবর্তনের কাহিনির সন্ধানে পথ হাঁটতে শুরু করলে কেমন দাঁড়ায় সেই যাত্রাপথের মানচিত্র? চারনম্বর প্ল্যাটফর্মে শুরু হল নতুন ধারাবাহিক, এ সফর সুফিয়ানা।
প্রথম পর্ব
দিল্লির লুটিয়েন্স বাংলো, মেহরৌলি-গুরগাওঁ রোড। ২০১৩-র মার্চ মাসের কথা। একটি বহুজাতিক ব্যাঙ্কের কর্ণধার মেহ্ফিল রেখেছিলেন তাঁর কোটিপতি বন্ধুদের জন্য। শিল্পী ছিলেন করাচির বিখ্যাত কাওয়াল ফরিদ আয়াজ। ফরিদসাব-এর সঙ্গে আমার পরিচয় ইউটিউব-এর সূত্রে, ‘কানহাইয়া, ইয়াদ হ্যায় কুছ ভি হামারি’ দিয়ে। আগে দুবার ওঁর অনুষ্ঠান শোনার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি অফিস টুর এবং অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে। এবার আর ছাড়ব না বলে হাজির হলুম বাংলোর দোরগোড়ায়। সন্ধে ছটা, অন্ধকার হয়ে আসছে। কর্মকর্তারা গলায় কার্ড ঝুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন জাঁদরেল-মতো ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, একটা কার্ড হবে? আমি একা আছি।” উনি হেসে বললেন, “মাথা খারাপ নাকি, এ মেহফিল শুধু এমডি-র পরিচিতদের জন্য।” আমি হাত জোড় করে বললাম, “আমার খাবার বা মদ কিচ্ছু লাগবে না, শুধু ফরিদসাবকে একবার সামনে বসে শুনতে চাই।” উনি হাঁ করে একবার আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “আপনি আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে বাড়ি চলে যান, অনুষ্ঠান শুরু আটটায়, আমি এমডি-র সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে আপনাকে ফোন করে দেব। তবে মনে বেশি আশা রাখবেন না, কারণ ওঁর রাজি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”
সন্ধে সাতটা চল্লিশ, মন খারাপ নিয়ে জুতো পরছিলাম জগিংয়ে বেরনোর জন্য। কোনও ফোন আসেনি এর মধ্যে। দরজা খুলে বেরোতে যাব, হঠাৎ দেখি, অচেনা নম্বর থেকে রিং। ফোন তুলে দেখি সেই ভদ্রলোক, গলায় খুশির ছোঁয়া। “কী আশ্চর্য মশায়, এমডি তো এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। আসুন আসুন, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। ফরিদ আয়াজ নটা নাগাদ স্টেজ নেবেন।” আমার তো হাতে স্বর্গ পাওয়ার অবস্থা। আর তর সইল না, কোনওমতে বেরিয়ে পড়লাম আমার গুরগাওঁয়ের বাড়ি থেকে, একখান কালো কুর্তা আর জিন্স গলিয়ে নিয়ে। আধঘন্টার ড্রাইভ, তা সে আর সময় কাটতে চায় না। ‘অকুস্থল’-এ পৌঁছে গাড়ি পার্ক করতে প্রায় আটটা দশ, সামনেই সুসজ্জিত গেট। ভদ্রলোক আমায় দেখেই প্রায় হাত ধরে টানতে-টানতে এক মধ্যবয়সী সুট-পরিহিত ভদ্রলোকের সামনে নিয়ে হাজির করলেন। আমি দেখলাম, আরে, এ চেহারা তো আমার চেনা, বিজনেস ম্যাগাজিনে আর টিভি-র বিজনেস চ্যানেলগুলোর দৌলতে। আমি হাতজোড় করলাম, উনি পাশে এসে দাঁড়ানো বেয়ারা-র হাত থেকে নিয়ে এক গেলাস ওয়াইন নিয়ে আমার দিকে তুলে ধরলেন, আমি ক্ষমা চেয়ে একটি ছোট জলের বোতল তুলে নিলাম ট্রে থেকে। উনি একটু অবাক হলেন, কিন্তু কিছু না-বলে আমাকে প্রথম সারির গদি-আঁটা সোফাগুলির দিকে ইঙ্গিত করলেন বসার জন্য। আমি আর কথা না-বাড়িয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম। সে সময় স্টেজে প্রেম জশুয়া নামে একজন শিল্পী সেতার বাজিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব-সংক্রান্ত কিছু একটা গাইছিলেন, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আমার চোখ ছিল ব্যাকস্টেজের দিকে। হঠাৎ দেখি, স্লেট-রঙা জোব্বা পরিহিত, মাথায় সিন্ধি টুপি, ফরিদসাব সটান আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। উনি আমার চেয়ে ঠিক কুড়ি বছরের বড়, গুগ্ল থেকে পরে জানতে পেরেছিলাম। আমি ওঁর সামনে নতজানু হয়ে বসে, ওঁর কড়া-পড়া আঙুলে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। সেই থেকেই শুরু আমার সুফিয়ানা কলাম নিয়ে উন্মাদনা।
ফরিদ আয়াজ নামটা শোনা-শোনা লাগছে? ইউটিউবে হাজার-হাজার গান পাবেন নাম দিয়ে সার্চ করলে, আমাজন প্রাইম বা স্পটিফাই খুললে পাবেন কয়েকশো দুষ্প্রাপ্য রেকর্ডিং। কাওয়াল বাচ্চোঁ কা ঘরানা-র গোড়াপত্তন হয়েছিল সেই আমির খুসরোর সময়। হজরত আমির তাঁর এক শিষ্য মিয়াঁ সামাত বিন ইব্রাহিমকে কাওয়ালি গাওয়ার শৈলী আচ্ছা করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। মিয়াঁ সামাত বিন ইব্রাহিম সে বিদ্যা তাঁর গোটাকতক বাচ্চা শাগির্দকে শিখিয়ে তাদের কাওয়ালি বিশারদ বানিয়ে দেন। ফরিদসাবের ভাষায়, ‘মুসলসল তারবিয়াত’ বা লাগাতার তালিম। এভাবেই সৃষ্টি হয় এই ঘরানাটির।
তানরস খাঁ সাহেব, যিনি দিল্লি ঘরানার প্রবর্তন করেন, তিনি আদতে কাওয়াল বাচ্চোঁ কা ঘরানার উত্তরসূরি। তিনি মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর-এর দরবারে গাইতেন এবং সম্রাটকে গানও শেখাতেন। তানরস খাঁর এন্তেকাল হয় ১৮৮৫-তে (মতান্তরে ১৮৯০)। এবারে বছর কুড়ি এগিয়ে আসি। ১৯১২ সালে জন্ম হয় ফরিদসাবের বাবা মুনশি রাজিউদ্দিন-এর। তিনি ছিলেন এই ঘরানার দুঁদে কাওয়াল, গান গাইতেন হায়দরাবাদের নিজাম-এর দরবারে। ১৯৪৮ সালে হায়দরাবাদের নিজামশাহির পতনের পর লোটাকম্বল নিয়ে মুনশি রাজিউদ্দিন চলে যান করাচিতে (তৎকালীন হায়দরাবাদের প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সোশ্যালাইট নাতবৌ নওরিন আমাকে ওঁদের পরিবারের করাচি গিয়ে থিতু হওয়ার পুরো কাহিনি একদিন শুনিয়েছিলেন, কিন্তু সে আরেক গল্প)। সেখানেই ১৯৫২ সালে বড় ছেলে ফরিদের জন্ম। মুনশিজি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অথরিটি ছিলেন বললেও কম বলা হয়— নিজের হাতে তালিম দিয়েছিলেন ছেলেকে, আর ভাইপো নাজমুদ্দিন, সইফুদ্দিন আর আবদুল্লাকে।
সবাইকেই চিনি, এঁরা তিনজনেই চমৎকার গান, কিন্তু ফরিদসাব তাঁর স্বকীয়তা যে কোনও মেহ্ফিলের প্রথম দু’মিনিটেই বুঝিয়ে দিতে পারেন। গলার রেঞ্জ, তা-ও মাইক ছাড়া খোলা লনে অন্তত দুশো মিটার পর্যন্ত। ওপরের দিকে বা তারসপ্তকে কখনওই বেসুরো হতে শুনিনি। আবিদা পরভিন, নুসরত ফতেহ্ আলি খান দুজনেই অসাধারণ, কিন্তু, দুরূহ সপাট তান বা তারানা বা ছোট-ছোট মুড়কি আর টপ্পার দানা কীভাবে অনায়াসে হাসিল করতে হয়, ফরিদসাবকে ভালো করে না-শুনলে বোঝা অসম্ভব। একবার দিল্লির চাণক্যপুরীতে পাক এমব্যাসি-র লনে বসে ওঁকে শুনেছিলাম ২০১৫ সাল নাগাদ, হঠাৎ পটাং করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। শ দুয়েক শ্রোতা এ ওর কানে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলেন, আমাদের লাহোর-এ আর দিল্লির ভিআইপি এরিয়াতে তো এভাবে লোডশেডিং হয় না। কোনও ষড়যন্ত্র নয় তো? সেসব শুনে আমি বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছি, ঠিক সেই সময়ই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনাটা! অন্ধকারের বুক চিরে কানে গমগম করে উঠল ফরিদসাব এর অমোঘ কাউল, আমির খুসরোর ‘মন কুন্ত মওলা’, এবং সেই সঙ্গে ফোয়ারার মতো তান আর অসম্ভব সুরে গাওয়া তারানা। মিনিট কুড়ি পরে ইলেকট্রিসিটি ফিরে এল, কিন্তু ততক্ষণ মাইক ছাড়াই অক্লেশে গেয়ে গেলেন ফরিদসাব। তার আগে দিল্লির পিএইচডি চেম্বার্স-এ হলের মেঝেয় বসে “তেরি রে ম্যায় তো চরণন লাগি” বা “গাঁঠরি ম্যায় কৌন যতন কর খোলুঁ” শুনে বুঝেছিলাম এ সুর লাগানোর ক্ষমতা ঐশ্বরিক। আর বহুবার নিজামুদ্দিন দরগার কার্পেট-এ বসে তানরস খাঁর লেখা বন্দিশ ‘অব মোরি নাইয়া পার করোগে হজরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া’ শুনে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেছি আর দেখেছি, ফরিদসাবের দু চোখও ভেজা।
সাত বছর কেটে গেছে, আর আমার সংগ্রহও চলেছে বেড়ে। আচ্ছা, কেউ কি জানেন মুশতার খৈরাবাদি বা তুরাব আলি শাহ কাকরভি বা হিলমকে? এঁরা সবাই অসাধারণ লিখতেন সুফি কলাম। শুনুন, ‘নিকি লাগত মোহে আপনি পিয়া কি, আঁখ রসিলি লাজ ভরি রে’ বা ‘এইসি দিনান বরখা ঋতু আয়ে, ঘর নাহি মোরে শ্যাম রে’, কিংবা ‘বিনতি ম্যায় কর কর বামনা সে পুছি পল পল কি খবর তিহারি, পইয়াঁ পড়ি মহাদেব সে যা কর টোনা ভি কর কে ম্যায় হারি’— এ সবই তো এঁদের লেখা। আর গেয়েছেন ফরিদসাব এবং কাওয়াল বাচ্চোঁ কা ঘরানার আরও অনেকে, বা খৈরাবাদের কোনও অনামি কাওয়াল।
এখন মাঝেমধ্যে আমার ফরিদসাবের সঙ্গে কথা হয়, গান নিয়ে। এমনই দুঃসাহস আমার, আড্ডা দিতে-দিতেই একদিন ধাঁ করে বলে বসলাম, “আপনি কি জানেন, শাহ তুরাব-এর ‘নিকি লাগত’ গানটা আপনি দু জায়গায় ভুল গান?” উনি অবাক হয়ে বললেন, “সে কী! কীরকম ভুল?” (অডিও ১)
আমি বললাম, “হ্যাঁ, ওটা কিন্তু চ্যায়ন পারত নাহি ‘টুক’ দেখে বিনা— ‘মুখ’ দেখে বিনা নয়।” উনি বারদুয়েক গুনগুন করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গেয়ে নিয়ে বললেন, “বাঃ, দেখেছ, সেই ছোটবেলা থেকে ভুল গাইছি, কেউ ধরতে পারেনি।”
একটু থেমে, জিজ্ঞেস করলেন, “আর দ্বিতীয় ভুলটা?” আমি বললাম, “আপনি গান ‘আঁখ রসিলি অর জাদু ভরি রে’, কিন্তু আসলে ওটা হবে ‘আঁখ রসিলি’, তারপর ছোট্ট একটা গ্যাপ দিয়ে ‘লাজ ভরি রে’।” শুনে উনি হাহাকার করে উঠলেন। আবার বারতিনেক লাইনটা ভেঁজে নিয়ে একগাল হেসে বললেন, “দেখেছ কী কাণ্ড! তা হলে তো মানেটাই পুরো বদলে যেত, তাই না?”
অডিও ১
আমাদের ‘সুফি সঙ্গীত’ শোনার দৌড় সাধারণত আমির খুসরোর ‘ছাপ তিলক সব ছিনি রে মোসে নায়না মিলা কে’ অবধি, বড় জোর ‘আজ রং হ্যায় এ মা রং হ্যায় রি’ পর্যন্ত। আসলে কিন্তু খুসরো লিখে গিয়েছিলেন, ‘আজ রং হ্যায় রি, মহা রং হ্যায় রি’। তা সে আর আজকাল কেই বা গায়? এটা ওঁকে বলতে উনি বললেন, “এই রে! এখানেও তো কেলেঙ্কারি! তবে কী জানো, ‘মহা রং’ গাইলে তাল বেগড়বাঁই করতে পারে”, বলে একমুখ পান নিয়ে হে হে করে খুব খানিকটা হেসে নিলেন। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের গুরু-শিষ্যের কথোপকথন। (অডিও ২)
অডিও ২
ছোটবেলায় একবার কোনও খবরের কাগজে পড়েছিলাম জনৈক প্রথিতযশা বাংলাদেশি শিল্পীর গাওয়া ‘দমাদ্দম মস্ত কলন্দর’ গানটির প্রসঙ্গে। সত্যিই বলছি, ঠিক এরকমই ছিল কাগজে লেখা। পরবর্তীকালে শাহবাজ কলন্দর-কে (সৈয়দ উসমান মরবন্দি) নিয়ে গবেষণামূলক লেখা পড়তে গিয়ে জেনেছি, আসলে ব্যাপারটা কী ছিল। সিন্ধ প্রদেশের একটি সুফি দরগাহ্, সেহ্বান শরিফ, সেখানে জাতি-ধর্ম বা লিঙ্গ-নির্বিশেষে সবাই ভালবাসার টানে চলে যেতে পারে, সেখানে এই গানটির প্রচলন হয়েছিল, আজও গাওয়া হয়। ‘দম-আ-দম’ শব্দটি আসলে শ্বাসপ্রশ্বাস বোঝানোর জন্য নেওয়া, তার সঙ্গে দমাদ্দম-এর কোনও সম্পর্কই নেই (সে তো আমরা বলি লাঠি বা গুলি চালানোর প্রসঙ্গে)! এপ্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। কয়েকবছর আগে করাচিতে একটি উগ্রপন্থী হামলায় ও ভয়ঙ্কর বোমা-বিস্ফোরণে বেশ কিছু পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়। সেখানকার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সীমা কিরমানি সে ঘটনার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যান সেহ্বানের উদ্দেশে। দরগাহ্তে ছড়িয়ে থাকা রক্ত ধুয়ে দেওয়া হয়, শুরু হয় ‘দম-আ-দম মস্ত কলন্দর’-এর সঙ্গে তুমুল নাচ, সঙ্গে জোরদার ঢোলক ও তালি-সহযোগে কলন্দরি ধামাল। সেই ধামাল নৃত্যের তালে জুটে যান কয়েকজন গন্ধর্ব, বেহোঁশের মতো তাঁরা ঘুরতে থাকেন সমাধির ঝোঁকে। ইউটিউবে এই গানের অজস্র ভিডিও ক্লিপ পাবেন, সেখানেও দেখবেন, হাজার মানুষ ভাবের ঘোরে দুলে-দুলে গেয়ে চলেছেন এই গান। কিন্তু, এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের, নিজেদের মূর্খতায় সেই ‘দম-আ-দম’কে আমরা বানিয়ে নিয়েছি দমাদ্দম। অবশ্য শুধু সুফি সঙ্গীতই বা বলি কেন, এখন তো সব শিল্পেই দমাদ্দমের যুগ চলছে দেখতে পাই!
থাক সে কথা। বরং হাতে একটু সময় থাকলে চলুন, যাই দিল্লির লোদি রোড ধরে হুমায়ুন টুম্ব-এর দিকে মাইলদুয়েক হেঁটে, বাঁক নিয়ে পৌঁছনো যাক হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া-র চিল্লাগাহ্ বা খানকাহ্-এ (দরগাহ্ নয় কিন্তু, সেটি আছে আলাদা জায়গায়)। একটু বেশি সন্ধের দিকে গিয়ে দোরগোড়ায় পৌঁছে উঁচুগলায় ডাকলে আজও খুলে যায় সেখানকার দরজা। মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে চুপটি করে আধো-অন্ধকারে বসে থাকলে দু চোখ ভেসে যায় জলে। মনের মধ্যে গুনগুন করতে থাকে পানভর্তি মুখে হোয়াটস্যাপ কল-এ শোনানো ফরিদসাবের ‘সুরতগরে নক্কাশ এ চিন, রও সুরতে যারামবিবিন, ইয়া সুরতে কাশভিচুনি, ইয়া তারক্কুন সুরতগড়ি’।
বড় খারাপ লাগে, যখন কোনও বিখ্যাত শিল্পী ‘যশন এ রেখতা’ অনুষ্ঠানে তুরস্কের কোনিয়া-তে দেখা সেমা-র অনুকরণে দরবেশের মতো ঘোরার চেষ্টা করতে-করতে তারস্বরে গেয়ে ওঠেন খুসরোর ‘তোরি সুরত কে বলহারি’-র কোনও পংক্তি। ‘মোহে পিড় পায়ো নিজামুদ্দিন আউলিয়া’। কিন্তু হায়, পিড় আর পির শব্দদুটির অর্থের মধ্যে যে আসমান-জমিন ফারাক! (অডিও ৩)
অডিও ৩
গত সপ্তাহে হঠাৎ একটি অসাধারণ সুফি কলাম পড়ে উত্তেজিত হয়ে দিল্লির এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিককে হোয়াটস্যাপ করলাম। তিনি গঙ্গা-যমুনি তহজিব নিয়ে প্রচুর বইটই লিখেছেন। তাঁকে জিগ্যেস করলাম, “বলুন তো, কে লিখেছেন এটি ‘রাত সপ্নে মে আয়ে পিয়া মোসে খেলান হোরি, কেসর পাগ সিস পর বান্ধে তা পর রং পড়ো রি, হাথ লিয়ে রং পিচকারি, আবরা কি ডালে ঝরি, দাবেহ পাগ চোরি চোরি, রাত সপ্নে মে আয়ে পিয়া মোসে খেলান হোরি।’” আধঘন্টা সব চুপচাপ। তারপরে জবাব এল, “কে, আপনি লিখেছেন?” উত্তর শুনে বেমালুম চেপে গেলাম। কবি জাভেদ আখতারের দাদামশাই কে ছিলেন তা অনেকেই জানেন, এটি তাঁরই লেখা, বহুকাল আগে। একেই দিল্লির বন্ধুমহলে ‘কর্পোরেট দরবেশ’ বলে আমার কিঞ্চিৎ বদনাম আছে, তাই সে আলোচনাটা সেখানেই অসমাপ্ত রয়ে গেল। ওঁকে জিজ্ঞেস করা যেত মুশতার খৈরাবাদির নাম শোনা আছে কিনা, কিন্তু, কী হবে বাজারে শত্রু বাড়িয়ে? (অডিও ৪)
অডিও ৪
(ক্রমশ)
হেডার সহ সমস্ত ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে