উর্বা চৌধুরী
শিক্ষাকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী
নতুন বছর দু-হাজার বিশ শুরু হয়েছিল উত্তাল ভারতবর্ষের ছবি সঙ্গে নিয়ে। মানকবুল আর জানকবুল লড়াই চলছে রাজধানী দিল্লিসহ গোটা দেশে। জের শুরু হয়েছিল গেল বছরের শেষভাগ থেকে। এনআরসি, সিএএ বাতিলের দাবিতে লড়াই। এর পরপরই গোটা পৃথিবী দেখল উত্তরপূর্ব দিল্লিতে এক দাঙ্গার ঘটনা। তারিখ– ফেব্রুয়ারির ২৩। হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মীয় পরিচিতির সাধারণ মানুষের জীবন জড়িয়ে পড়লেও, রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই যে এই দাঙ্গার সূচনা, বৃদ্ধি ও ধারাবাহিকতা– তা বুঝতে ভারতবাসীর অসুবিধা হয়নি। ঘটনার আগে, ঘটনা চলাকালীন মায় ছয় দিন ধরে চলা দাঙ্গার পরও ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ভূমিকা, ও কার্যক্রম, এবং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রশাসনিক ধূর্তামি সাদা চোখে দেখা গিয়েছিল– এ নিয়ে গোটা দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবাদের স্বরও শোনা গেছে বারবার।
এই দাঙ্গার ঘটনার খুঁটিনাটি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে গত ৯ই ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র পক্ষ থেকে “কমিউনাল ভায়োলেন্স ইন নর্থ ইস্ট দিল্লি, ফেব্রুয়ারি ২০২০” নামাঙ্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভি গোপালগৌড়া, প্রাক্তন মুখ্য তথ্য কমিশনার ওয়াজাহাত হাবিবুল্লা, সমাজকর্মী হর্ষ মন্দার, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র কর্মী ও পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট রীত্যনুসারে এটি প্রকাশ করেন।
বৃন্দা কারাট ও উপরোক্ত পার্টির দিল্লি রাজ্য কমিটির সম্পাদক কেএম তিওয়ারির নেতৃত্বে প্রস্তুত এই প্রতিবেদন স্পষ্টত উল্লেখ করে যে, দিল্লির দাঙ্গার সময়ে ২৬ লক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার জেলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৩৯৩ থেকে ৪ হাজার ৩৫৬ জন। প্রতিবেদনটি তৈরি করার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-কর্মীরা দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষের ঘরে ঘরে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন যে, ২৩শে ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ দাঙ্গা পরিস্থিতিতেও প্রয়োজনীয় পুলিশের দেখা পাওয়া যায়নি, উপস্থিত পুলিশবাহিনী বরং উল্টে দাঙ্গাবাজদের মদত দিয়েছে। সাধারণ মানুষের নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনাকে আড়াল করতে বারবার পুলিশের পক্ষ থেকে কেবলই আধিকারিকদের আহত হওয়ার ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
দাঙ্গার সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিতভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে পরিস্থিতিকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়ার এই মানুষমারা ঘরানা এদেশের মানুষ ২০০২ সালের গুজরাটের সাম্প্রদায়িক হিংসা ও গণহত্যার সময়ও দেখেছিল। সেসময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী আর আজকের প্রধানমন্ত্রী যে একই ব্যক্তি, এই সমাপতনটুকু অবশ্যই নজর এড়ায় না দেশবাসীর।
দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর দাঙ্গার এই নীলনকশা রূপায়ণের পরিণতিতে আহত হয়েছেন দুশোরও বেশি মানুষ, খুন হয়েছেন ৫৩ জন মানুষ– যার মধ্যে ৪০ জন মুসলমান ও ১৩ জন হিন্দু। আলোচ্য প্রতিবেদনটিতে এফআইআর ধরে ধরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখানো রয়েছে হিন্দুত্বাবাদীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কীভাবে সরকারি উদ্যোগে পুলিশ মারফত আক্রান্তদেরই হেনস্থা করা চলছে। এনআরসি-সিএএ-র বিরোধিতা করা ছাত্রদের কীভাবে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তারও নির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একের পর এক সত্যের অপলাপের উল্লেখ ও ব্যাখ্যা স্পষ্ট করে দেয় যে, এই দাঙ্গায় শাসকের ভূমিকা গোটা দেশবাসীর পক্ষে এক গুরুতর বার্তা দেয়– ভারতবাসী এই শাসকের হাতে বিপন্ন– নাগরিকের নিরাপত্তার অধিকার, বাঁচার অধিকার বা যেকোনও বুনিয়াদি অধিকার সুনিশ্চিতিকরণ তো বহুদূর, মানুষ মারার নীতি-কৌশলেই কেন্দ্রীয় শাসকদল, বিজেপি, তার রাজনৈতিক মতলব কার্যকর করতে চায়। প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, ছয়দিন ধরে চলা ভয়াবহ দাঙ্গা, হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর তাণ্ডব, সাধারণ মানুষের উপর চলা অত্যাচারের সত্যতাকে কার্যত উল্টে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অমিত শাহ, ১১ই মার্চ সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন– পুলিশ নাকি মাত্র দেড় দিনেই পরিস্থিতি একেবারে সামলে দিয়েছে। অমিত শাহের যে ভাষণের পর মিথ্যার বেসাতির প্রতিবাদে সিপিআই (এম) ও কংগ্রেসের সাংসদেরা ওয়াকয়াউট করেন। সংসদে মন্ত্রীর এহেন ভাষণ সরাসরি তদন্তের আগেই তার উপসংহারকে শাসকের পক্ষে স্থির করে দেয়।
দাঙ্গা শুরু করা হয়েছে, পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রাখছে সরকার, তদুপরি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ভারতীয় জনতা পার্টির মুখ, অনুরাগ সিং ঠাকুর, সেই সময়কালেই জনসভায় ভাষণ দিতে দিতে সংখ্যালঘু মানুষদের ইঙ্গিত করে বলছেন “গোলি মারো শালো কো”। দাঙ্গায় কেন্দ্রীয় শাসকদলের ঘৃতাহুতি করার এই দিকটির কথাও তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ আছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরভেশ ভার্মার ভাষণের কথা। এনআরসি ও সিএএ-এর প্রতিবাদে সংগঠিত সভাকে ইঙ্গিত করে ভার্মা বলেন, শাহিনবাগে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষের ঘরে ঢুকে অত্যাচার চালাবে, মা বোনেদের ধর্ষণ করবে। অমিত শাহ এসবের নিন্দায় একটি বাক্যও ব্যবহার করেননি।
সাধারণ নাগরিক হিসাবে স্পষ্টত বুঝতে পারি যে, দেশ-ধ্বংসের নীল নকশা তৈরি ও রূপায়ণের সময় পালের গোদারা সেই ধ্বংসলীলা মসৃণভাবে যাতে চলতে পারে তার বন্দোবস্ত করে, ধ্বংসলীলা থামানোর কাজ সে কেনই বা করবে! আবার সাধারণ বিবেচনায় এও বোঝা যায় যে, যেকোনও দাঙ্গা পরিস্থিতিতে ঠাকুর বা ভার্মার মতো শাসকের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এই জাতীয় নির্দেশমূলক ভাষণ অনিবার্যভাবে উস্কানিমূলক হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের উদ্দেশে বিদ্বেষমূলক এই বিষ মন্তব্য কি অপরিকল্পিত হওয়া সম্ভব! বিশেষত যে রাজনৈতিক দল শুরুর দিন থেকে ধনতন্ত্রকে পুষ্ট করতে রাজনীতিকে ব্যবহার করে চলেছে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজা উড়িয়ে!
এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় লিখতে চাই– গত আগস্টে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এই দাঙ্গা প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লিখিত রয়েছে যে, এ দেশের রাজধানী, দিল্লিতে, গত সাড়ে তিন দশকে এমন ভয়াবহ দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনও বলছে, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা, ও বিপন্ন সাহায্যপ্রার্থী সাধারণ মানুষের ডাকে পুলিশের সাড়া না দেওয়া ছিল দাঙ্গার সময়ের অন্যতম ঘটনা। অ্যামনেস্টির সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের এইরকম ধিক্কারজনক ভূমিকার সত্যতা বিবিসি-ও যাচাই করে সত্য বলে জানিয়েছে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনও কেবল পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কথা বলেনি, বলেছে– দাঙ্গা থামানোর কর্তব্য তো করেইনি, উপরন্তু পুলিশ হিন্দু দাঙ্গাকারীদের সহযোগিতা করেছে। অন্যায্যভাবে এনআরসি-সিএএ-এর প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হলেও আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। অর্থাৎ পুলিশ ফের দৃশ্যত আইন ভেঙেছে। আবার এও দেখা গেছে যে, আটকদের বেশিরভাগই মুসলমান। বিবিসি বাংলাকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতের আইনি এবং নীতিগত বিষয়ের প্রধান, মৃণাল শর্মা, বলেন– “ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোকসভায় ১১ই মার্চ বলেছিলেন যে দিল্লির দাঙ্গা থামাতে পুলিশ খুব ভালো ভূমিকা পালন করেছে, অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে তদন্ত চালিয়েছে, তাতে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে। পুলিশ যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, সেটাই আমরা জানতে পারছি।”
এই প্রতিবেদন প্রকাশের মাস খানেক বাদে, সেপ্টেম্বর মাসের শেষে, অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, ভারত সরকার তাদের সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলত, এ দেশে মানবাধিকার ও তা লঙ্ঘন সংক্রান্ত আর কোনও প্রচারমূলক বা সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক, এবং কোনও গবেষণামূলক কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এর পরিণতিতে অ্যামনেস্টির ভারতের দপ্তর বন্ধ করে দিতে হয়, ১৫০ জন কর্মী কাজ হারান। এ প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল, জুলি ভেরহার, বলেন– ভারত সরকারের এই ভয়ানক ও লজ্জাজনক কাজ আপাতত ভারতে আমাদের মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করল। যদিও মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজের প্রশ্নে আমাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও সংগ্রামকে সরকারের এই পদক্ষেপ চিরতরে শেষ করে দিতে পারবে না। ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যাতে আগামীদিনে মানবাধিকার আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা সুনিশ্চিত করার জন্য আমরা অটলভাবে কাজ করে যাব।… আমাদের আন্দোলন আমাদের ভারতের কর্মীদের নিয়ে গর্বিত। ওঁরা অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে দিল্লির দাঙ্গা ও জম্মু কাশ্মিরের লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বাতাবরণে দ্বিধাহীনভাবে, দায়িত্বের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র প্রতিবেদনে নিন্দা করে এও বলা হয়েছে যে, হিংসায ধ্বস্ত পরিবারগুলিকে ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নে দিল্লি সরকারের ব্যাপক গাফিলতি রয়েছে। প্রতিবেদনটি নির্দিষ্ট করছে– এ কোনও দাঙ্গা নয়, দাঙ্গা দ্বিপাক্ষিক হয়। এক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী বাহিনী নৃশংস আক্রমণ চালায় সাধারণ মানুষের উপর, তাতে করে নিরুপায় হয়ে আক্রান্তেরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। এ যাবৎ যেকোনও প্রতিবেদন পড়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর একপাক্ষিক আক্রমণ ছাড়া এই হারে সংখ্যালঘু মানুষ নিহত হতেন না।