সেঁজুতি দত্ত
চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক
দিল্লিতে ঘটমান বর্তমান কৃষক আন্দোলন নিয়ে এক বাক্যে সমর্থন জানিয়ে এই লেখা শুরু করছি। আর এই আন্দোলনকে নাকচ করার লক্ষ্যে শিখ সম্প্রদায়কে যেভাবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে দেগে দেওয়া হচ্ছে— কারণ এখন এটাই নিয়ম— সেটারও বিরোধিতা করে রাখতে চাই। এনআরসি, সিএএ নিয়ে আন্দোলন হলে, ছাত্ররা তাদের মতবিরোধ জানালে, নারী, দলিত, মুসলমান, এবং বিভিন্ন প্রান্তিকতায় অবস্থিত মানুষেরা বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করলে তাদের যেভাবে হয় ‘দেশদ্রোহী’ অথবা ‘পাকিস্তানি’ অথবা ‘চিনে’র দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করার গণঅভ্যাস তৈরি হয়েছে সেখানে এই আন্দোলনকে যে একই পন্থায় আক্রমণ করা হবে সেটা আর আশ্চর্য কী? তাই সমর্থন জানিয়েই শুরু করছি।
আমি এই আন্দোলন নিয়ে কোনও এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিতে চাইছি না। বরং এর সংশ্লিষ্ট একটি ধারণা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি। এই করোনাকালের শুরু থেকেই একটা জিনিস ভীষণভাবে আমাকে ভাবাচ্ছে যা এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর সেটা হচ্ছে কমিউনিটি কিচেনের ধারণা। এই বছরের মাঝামাঝি একটা বাংলা ওয়েবিনারে ‘রান্নাঘর’ নিয়ে খানিক আলোচনা করেছিলাম আর সেখান থেকেই কিছু ভাবনা ধার করে বর্তমান সময়কেও ভাবার চেষ্টা করছি।
এই বছরের শুরু থেকেই আমরা দেখেছি কমিউনিটি কিচেনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে এবং পাড়ার মানুষ, এলাকার মানুষ অনেকেই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। সেই উদ্যোগ শুধু লকডাউনের সময়েই আটকে থাকেনি। এখনও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন বাম সংগঠনগুলি সাফল্যের সঙ্গে কমিউনিটি কিচেন চালিয়ে যাচ্ছে। ভাবতে ভালো লাগে, যেটা নিতান্তই আপৎকালীন একটা ব্যবস্থা হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা এখন প্রায় স্থায়ী একটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে যখন আজকের কৃষক আন্দোলনের দিকে তাকাই তখন সেখানকার ‘লঙ্গরখানা’ যেন নেহাতই একটি সম্প্রদায়ের রীতি না হয়ে আমাদের এই সময়েরই প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।
আমাদের দৈনন্দিনতায় রান্নাঘর এমন একটা জায়গা যেখান থেকে আমাদের বেঁচে থাকার রসদ আসে। পরিবারের সমস্ত মানুষের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, ক্ষিদে, সাধ ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে নজর রেখে বাড়ির এই ঘরটি কাজ করে চলে প্রতিনিয়ত, আর তার সঙ্গে নিরলসভাবে খাটতে থাকেন সেই ঘরের কর্ত্রী, গৃহিণী এবং ঘরণীরা। পরিবারের শ্রেণিবিন্যাসে এরা কেউ হয়ত মায়ের অবস্থান থেকে, কেউ কন্যার অবস্থান থেকে, কেউ ‘বাড়ির ছেলে’র বউয়ের অবস্থান থেকে কাজ করে যান। প্রত্যেকের দায়িত্বে থাকে পরিবারের ক্ষিদে মেটানো থেকে শুরু করে খাদ্য সংক্রান্ত আহ্লাদগুলিকেও প্রশ্রয় দেওয়া। এই কাজগুলোর আদুরে নাম ‘প্রেমের শ্রম’, যাকে পিতৃতন্ত্র মাঝেমধ্যে ‘কর্তব্য’ বলেও চিহ্নিত করে থাকে।
অন্যদিকে আছে ‘কমার্শিয়াল কিচেন’, যা পরিবারের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যোগদান করে। এখানে যারা কাজ করেন তারা শ্রমিক এবং আপাতভাবে তাদের সংগঠনের অধিকার আছে তাই আট ঘণ্টা কাজের, আট ঘণ্টা আরামের, এবং আট ঘণ্টা যা খুশি করতে চাওয়ার দাবী তারা তুলতে পারেন। এই সেক্টরে যারা কাজ করেন, সংগঠিত অথবা অসংগঠিত শ্রমিকেরা, তারা ‘কর্তব্য’ অথবা ‘প্রেমের শ্রম’-এর নামে শোষিত হন না। তাদের শোষণের পেছনে কাজ করে মালিকপক্ষ এবং রাষ্ট্রের অশুভ আঁতাত। এই দুই রান্নাঘর, ব্যবসায়িক এবং পারিবারিক, একদিকে যেমন নিয়মিত শ্রমিক নির্মাণ করে চলে তেমনি তার সঙ্গে চলতে থাকে একদল শ্রমিক যাতে নিজেকে শ্রমিক হিসেবে না চিনতে পারে সেই প্রচেষ্টা, আর আরেকদলের শ্রমিককে তার শ্রমের সমপরিমাণ মূল্য থেকে বঞ্চিত করার পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র। এই দুই রান্নাঘরের মজ্জাগত শোষণ থেকে মুক্তির আলো দেখায় ‘কমিউনিটি কিচেন’ অথবা সম্মিলনী রান্নাঘর। এই রান্নাঘর দায়িত্ব নেয় কৌমসমাজের। শুধুই নিজের পরিবারভিত্তিক ক্ষুধা নিরাময়ের সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে, পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্যের অধিকারের দর্শনে ভরসা রেখে, এই রান্নাঘরগুলো কাজ করতে থাকে অবিরত।
আর তাই আমাদের দেশে চলতে থাকা এই কৃষক আন্দোলন একইসঙ্গে যেমন অধিকারের লড়াইয়ে ব্যস্ত তেমনি আমাদের শেখাচ্ছে যে খালি পেটে আন্দোলন জোরদার হয় না, তাই সেই দায়িত্বও নিতে হবে। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে লঙ্গরখানা চালানোর অভ্যাস আজকের নয়। এটা তাদের এমন এক ধর্মীয় আচার যা তাদের সামাজিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে আর তাই, যখন এরা ছয় মাসের রসদ নিয়ে রাজধানীতে বিক্ষোভ দেখাতে এসেছেন তখন দক্ষিনপন্থী গণমাধ্যম ও ‘আইটি সেল’ খানিক ঘাবড়ে যায় বৈকি। ছবি দিয়ে মিম বেরোয় যে আন্দোলনকারীরা পিকনিক করতে এসেছে। সত্যিই তো, এরা তো এতদিন বুঝে এসেছে যে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া, নিজের খাবার ভাগ করে নেওয়া তো শুধু পিকনিকেই হয়, তাও পিকনিকের সব সদস্য নিজের নিজের ভাগের টাকা দিয়ে থাকলে তবেই। যেভাবে ‘আইটি সেল’ মতাদর্শ বর্তমান সরকারের সমস্তকিছু কর্পোরেটাইজ করে দেবার পক্ষে তোতাপাখির বুলি আউরে যাচ্ছে, তাদের কাছে যে এই কমিউনিটি কিচেন পিকনিকের বাইরে আর কিছু না সেটা বোঝাই যায়। কিন্তু আমাদের যে কথা মাথায় রাখা উচিৎ সেটা হচ্ছে, এই আন্দোলন যেহেতু খাদ্যশস্য উৎপাদকের অধিকারের লড়াই তাই সেখানে উপস্থিত মানুষদের ক্ষুধা নিবারণ সমষ্টির বাইরে ভাবা সম্ভব না। একইভাবে, যেহেতু খাদ্যশস্য প্রত্যেকের অধিকার সেহেতু সেটাকে শুধুই বড় কর্পোরেটের ঝাঁ-চকচকে দোকানগুলির আধিপত্য থেকে মুক্ত করা উচিৎ। সেইসব খাদ্যশস্যের দৈনন্দিন বেচাকেনাও শুধুই ‘কিছু’ পরিবারের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে পারে না। যে শ্রমিক ভালোমন্দ রান্না করছেন, যা বিক্রি করে মালিক ফায়দা লুটবে, সেই শ্রমিকেরও অধিকার আছে ভালোমন্দ খেয়ে বেঁচে থাকার। সেখানেই আজকের কৃষক আন্দোলনের লঙ্গরখানা শুধুই খাদ্য বিতরণের জায়গা নয়, সেটিও আন্দোলনের আরেক মুখ— বড় মুখ।
আমাদের দেশের কৃষকেরা লড়ছেন। অনেকে মনে করছেন তারা শুধুই নিজেদের স্বার্থে লড়ছেন, দেশের স্বার্থ দেখছেন না। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিশ্লেষণধর্মী লেখা এবং আলোচনা হচ্ছে এবং আমরা সকলেই কমবেশি সে ব্যাপারে অবগত, তাই পক্ষে আছি’র বাইরে এই মুহূর্তে কিছু লিখছি না। কিন্তু এটুকু তো অবশ্যই বলতে চাই যে সব আন্দোলনই জীবনকে উদযাপন করে আর তাই আজকের কৃষক আন্দোলনের মাটিতে যখন দেখতে পাই যে আমার অন্নদাত্রী, আমার কৃষক ভাই-বোনেরা আন্দোলনের মুহূর্তেও খাচ্ছেন, নাচছেন এবং দাবী আদায়ের শ্লোগান তুলছেন তখন বেঁচে থাকার ইচ্ছা বাড়ে। বাসনা হয়, সবার বাড়ির রান্নাঘরের দরজা যদি উন্মুক্ত করে দেওয়া যেত তাহলে হয়ত প্রতিদিনই সংগঠিত যাপনের স্বাদ পেতাম। এই দুর্দিনের ফায়দা তুলে যখন বর্তমান সরকার চাল-ডালও আর অত্যাবশ্যক পণ্যের আওতায় রাখছে না, কৃষকের উর্বর জমিকে কর্পোরেটের বধ্যভূমিতে পরিণত করছে তখন এই কৃষক আন্দোলন আমাদের আশার আলো দেখায় এবং তার রান্নাঘরে আমাদের সন্তান দুধেভাতে থাকে।