দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক
আমিও চাষার বেটা। আমারও শৈশব-কৈশোর কেটেছে শ্রাবণের কাদা মেখে, কার্তিকে ধানবোঝাই গরুর গাড়ির আড়াশের ওপর বসে পাকা ধানের গন্ধে ঘোর হয়ে। বহুবার পুজোর জামাপ্যান্ট কেনা হয়েছে তড়িঘড়ি আধপাকা ধান কেটে এনে। কত সন্ধে রেডিওর কৃষিকথার আসর ঘিরে আমরা দু ভাই খাতাকলম নিয়ে বসে থেকেছি। গমখেতে হারিয়ে যাওয়া সবুজ মাফলার এখনও আমার স্বপ্নে হানা দেয়। আর আজ অনেক দূরে, দিল্লির রাজপথে পাগড়িপরা দেহাতি মানুষগুলো লাঠি, শীত আর জলকামান উপেক্ষা করে যখন নির্বিকার লঙ্গর খুলে দেয় এমনকী লাঠিবাজ পুলিশদের জন্যও, তখন কেন কে জানে আমার চোখ জলে ভেসে যায়। বাবাকে মনে পড়ে খুব। আমরা পারিনি, কিন্তু কেউ তো লড়ে যাচ্ছে আমাদেরই লড়াই।
তবু চাষার বেটা হিসেবে নয়, আমাকে এই লেখা লিখতে বলা হয়েছে আমি ছেলে পড়িয়ে খাই ও দিনান্তে একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করি, এই সুবাদে। হায়, বাংলার চাষির কোনও ভাষা নেই। বাংলার চাষা আজও সেই বঙ্কিমচন্দ্রের হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত। গর্বিত হওয়ার সুযোগ থাকত, যদি এখান থেকেও কয়েক হাজার মানুষ আজ দিল্লি পাড়ি দিত। আসলে যা ঘটার ঘটে গিয়েছে আগেই— বাংলা ভারত রাষ্ট্রের কাছে পরাজিত।
দিল্লিতে ঘটে চলা কৃষকদের এই নিরস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন আমার কাছে সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কেবল এই কারণে নয় যে, ২০২০-র তিনপ্রস্থ কৃষি আইন একটি ঘৃণ্য ও দানবীয় প্রকল্প, তার বিরুদ্ধে কৃষকদের এই অবস্থান সঙ্গত ও স্বাভাবিক। না, এই আন্দোলনকে আমি কেবল কৃষকদের আন্দোলন হিসেবে দেখছিই না। এই ঘটনা আসলে দেশ ও রাষ্ট্রের দ্বৈরথ। কিন্তু ‘দ্বৈরথ’ বলে আমি দেশ ও রাষ্ট্রকে সমকক্ষ বলছি না। বলা উচিত, রাষ্ট্র দেশের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে গিয়েছিল। দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
একটু বিশদে যাওয়া যাক।
প্রথমেই বলে রাখি, রাষ্ট্রতত্ত্ব আমি বেশি জানি না। এ-বিষয়টা কোনওদিন আমার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বিষয়ও ছিল না। আমি এখানে সোজা কতকগুলো কথা বলব। পণ্ডিতজনের কূটতর্ক থেকে দূরে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষের কিছু কথা।
দেশ হল ভূমি— আসমুদ্রহিমাচল এই ভারতবর্ষ। এর মধ্যে আমরা আছি— মানুষ। আছে আমাদের স্মৃতিলোক, কল্পলোক, অজস্র কাহিনি, সুর, রং। আছে দাদির কবর, বড় ঠাকুরদার সমাধি, বুঢ়ার আবছা শরীর। আছে নদী, সাগর, পাহাড়, ঝরনা। আছে আমাদের রুটি-রুজির নানা রং, নানা আকার। আমাদের ভালোবাসা-ঈর্ষা-স্বপ্ন-স্বেদ মাখানো জীবন। আছে গাছপালা পশুপাখি পোকামাকড়ের বিরাট জগৎ। এক কথায়, দেশ একটি ভৌগোলিক সত্তা এবং সেই সঙ্গে মানসিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সত্তাও। এই দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারি, কারণ দেশকে ভালো না-বেসে উপায় নেই যে। অভিমানে কখনও কেউ বলতেও পারে— এবার কালী তোমায় খাব। কিন্তু, কে বলবে এ ভালোবাসা নয়? এই দেশ একইসঙ্গে সর্বজনীন আর ব্যক্তিগত। আমার দেশ ছড়ানো ভারতের ম্যাপ জুড়ে, ম্যাপ ছাপিয়েও। আবার, আমার দেশের কেন্দ্রটি আমারই গ্রামের বাড়ির কুয়োতলায়। আপনার ভারতবর্ষর কেন্দ্র হয়তো সাহারানপুরের একটি একতলা রেল কোয়ার্টার। তাঁর দেশের কেন্দ্র হয়তো ভাকরা-নাঙাল প্রকল্পের জলে ডুবে হারিয়ে যাওয়া একটি কুটির। দেশের তাই প্রকৃত কোনও কেন্দ্র নেই। দেশ স্বাভাবিকভাবেই বিকেন্দ্রিত।
অন্যদিকে রাষ্ট্র একটি ক্ষমতাকাঠামো যার একটি নির্দিষ্ট এলাকা আছে। তার মানে তো এই যে, ওই ক্ষমতাকাঠামোটি ওই এলাকাটুকুতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর মানে কখনওই এটা নয় যে, আমার দেশ ভারতরাষ্ট্রের অধীন। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র— প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য, পরবর্তীতে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা অনুসারে দেশের উন্নয়নের জন্য। দেশের সম্পদের একটা অংশ রাষ্ট্রের হাতে যায় এই কাজগুলোই করবার জন্য। আর এখান থেকেই শঠ রাষ্ট্রের উত্থান। এই শঠতা সম্প্রতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানদের হাতিয়ার সংবিধান নয়— সেনা, পুলিশ, কখনও বা সুযোগ-প্রত্যাশী বিচারপতিও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হচ্ছে। কারণ, দেশবাসীর একটা বড় অংশকে বোঝানো গেছে যে, রাষ্ট্রই দেশ। ফলে রাষ্ট্রের যাঁরা চালক, তাঁদের বিরোধিতা মানেই দেশবিরোধিতা। তাঁদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতিই দেশের ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতি। আর এভাবেই নির্বাচনের অ্যাজেন্ডা বদলে গেছে সুরক্ষা-উন্নয়ন-শিক্ষা-স্বাস্থ্যর জায়গায় মন্দির নির্মাণের সাফল্যে, বিধর্মী পীড়নের সাফল্যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে ধমকে দেওয়ার সাফল্যে। আর এই সব ‘সাফল্যের’ মাদকতায় জাতির একটি অংশ যখন আচ্ছন্ন, তখন একটি অতি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে দেশের সচল ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলিকে। কোভিড ও তার বাড়িয়ে তোলা আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে প্রতিবাদের সব রাস্তা। আর দুর্যোগের সুযোগে একের পর এক আইন তৈরি করা হচ্ছে দেশকে লুঠ করে ফোঁপরা করে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে। কোটিপতিদের জন্য আম ভারতবাসীকে সেবাদাস বানানোর এই চক্রান্ত আমরা বুঝতে পেরেও কোথাও কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি না।
এই পরিস্থিতিতেই কৃষি আইন ও তার প্রতিক্রিয়ায় কৃষকদের অনড় অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। কেন না, এইবার আর কোভিডের ভয়, পুলিশের লাঠি, জলকামান, কাঁদানে গ্যাস— কিছুই কাজ করছে না। কাজ করবেও না। কারণ এইবার দেশের মর্মে ঘা লেগেছে। জমি যে কৃষকের কাছে কী, রাষ্ট্র নামক নগরকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো তা ধারণা করতে পারে না। এই কিছুদিন আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কম্যুনিস্ট সরকার তা পারেনি বলেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের চোরাবালিতে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। দিল্লিতেও তেমনই ঘটবে, তার চিত্রনাট্য রচিত হয়ে উঠছে।
আজ, ভারতবর্ষ জুড়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশকে জেগে উঠতে দেখছি। প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে।