আপার-প্রাইমারি টেট: এক মদনা কি মউত

দেবাশিস মহন্ত

 



কবি ও লেখক

 

 

 

২০১২ সাল। তার আগের ঘটনা। ফ্ল্যাশব্যাক:

মদন মোহন বৈরাগী। ক্লাসের বন্ধুরা শর্টকাটে ডাকত– মদনা। এই মদনা-র ইমিউনিটি পাওয়ার খুব কম। অল্পেতে সর্দি লাগে। দুপুরবেলা মশারি টাঙিয়ে ঘুমোয়। একা একা সিনেমা দেখে। খবর দেখে না…

মদনা খুব কষ্টে স্থানীয় জিলা-পরিষদে একটা গ্রুপ-সি চাকরির লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিল। একদিন ইন্টারভিউ লেটার নিয়ে গেল লোকাল নেতার বাড়ি। সকাল ৮টা। নেতা ঘুমোচ্ছিলেন। উঠলেন ১০টায়। বললেন, চেষ্টা করব। হল কাঁচকলা। নেতা পেছন দেখালেন। মদনার ভাগ্য মিসম্যাচ। ছাগলের তলদেশে ঝুলে গেল…

 

২০১২ সাল। তার পরের ঘটনা। গল্প শুরু:

২০১২ সালের নোটিফিকেশন। ভেরিফিকেশন। তাপ্পর ২০১৩। পরীক্ষা শুরু। গুরু। আপার-প্রাইমারি। টেট পরীক্ষা। তাপ্পর রেজাল্ট। তাপ্পর আবার নোটিফিকেশন। রিজিওনাল অফিস থেকে টেট পাশের সার্টিফিকেট তুলতে হবে…

একদিন শীতের সকালে  মদনা চাপল স্টেটবাসে। সঙ্গে বাবার চাদর। কত কত টাকা খরচ করে মদনা পৌঁছল রিজিওনাল আপিস। তারপর তো থ। কী ভীড় মাইরি। কী লাইন, কী লাইন। এত ভীড়ে কী তুলবে মদনা! না, সে তুলবে টেট সার্টিফিকেট। ভ্যালিডিটি ৩ বছর। ব্যস। ঝোলাও গলায়। অমনি আবার ঝুলে গেল ছাগলের তলদেশে…

 

২০১৪ সাল। অন-লাইন:

ভেরিফিকেশন। ভেরিফাই করাও। আবারও টাকা দাও। বাব্বা! দু-দুবার টাকা! একবার পরীক্ষায়। একবার নিরীক্ষায়। মদনার ভেতরে কেমন টনটন করে। এই তো– সুদিন এল বলে। চাকরি হবে, ছোঁকড়ি হবে। আপার-প্রাইমারি। সেই সুখে, মদনাও প্রায়ই মারে…

দিন যায়– দিন আসে। দিন বদলায় না। শুধু মদনার বয়স বাড়ে। সেই কবে পাশ করেছে টেট। এখনও ডাক আসে না। কেউ ডাকে না আর মদনাকে। বন্ধুরা চায়ের আসরে ডাকে না। পাড়ার ছেলেরা খেলতে ডাকে না। তার এখন ছত্রিশ। মৌসুমীর ত্রিশ। মৌসুমী মা হয়েছে। দু-দুটো ছেলেপিলে নিয়ে পার্কে যাচ্ছে। কিন্তু, মদনা! তার আর বাপ হওয়া হল না। শুধু টনটন… টনটন…

 

২০১৫ সাল।

ভ্যালিডিটি শেষ। কার! টেট সার্টিফিকেটের। মদনার।

 

২০১৬…

আন্দোলন। কোর্ট-কেস।

 

২০১৭…

মানতে হবে। মানতে হবে।
করতে হবে। করতে হবে।

 

২০১৮… প্রতিশ্রুতি:

দিতে হবে। দিতে হবে।

মদনা জমির আলপথ ধরে ঘুরে বেড়ায়। তাবিজ করে বড় হুজুরের থানে।

 

২০১৯…

আন্দোলন। ধর্না। প্রতিশ্রুতি।

লকডাউন।

মদনা বট-তলায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে। নিজের সঙ্গে কথা বলে।

অল ইজ ওয়েল… অল ইজ ওয়েল…

 

২০২০ সাল। প্রেজেন্ট ডে:

জলকামান। আন্দোলন। র‍্যাফ। কোর্টের রায়।

মদনা তার সাদা-কালো মোবাইলে দেখে— ২০২০ সাল। ডিসেম্বর এসে গেছে। শীত এসে গেছে। সুপর্ণা নাই। চাকরি নাই। বয়স নাই। আর সেই উত্তেজনা নাই। সেই যৌনতা নাই।

বিছানায় মশারি খাটিয়ে তাকিয়ে থাকে মাটির দেয়ালের দিকে। একটা জায়গায় ফাটল ধরেছে। গোল একটা দাগ। সেই দাগ থেকে থপ করে খসে পড়ে মাটি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ট্রাঙ্কে জমানো সার্টিফিকেট ভুল। আজাদি ভুল। সরকার ভুল। পরীক্ষা ভুল। তাহলে কি বেঁচে থাকাটাও ভুল!

 

দ্য এন্ড:

মদনার ইমিউনিটি পাওয়ার আরও কমে আসে। পোল্ট্রির ডিম ২৮ টাকা। মদনা ডায়রিতে কাঁপাকাঁপা হাতে লিখে রাখে– এই বৎসর আলু রেকর্ড ভাঙিয়াছে। প্রত্যেক কেজি ৫৫ টাকা।

মদনার মাথা এখন মাঝে-মধ্যেই টাল খায়। সেদিন ঠাকুর প্রণাম করতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠেছিল।

মদনা রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবে— একটা চাকরি পেতে শালা এত বছর লাগে। তারপর… সে দেখে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চাকরির নিয়োগপত্র হাতে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আচ্ছে দিন— আচ্ছে দিন। খুব কষ্ট। বুকের বাঁ-পাশে কে যেন জোরসে চেপে ধরেছে। মদনা মুখ্যমন্ত্রীর দিকে আর এগোতে পারছে না। তারপর… তারপর… অন্ধকার।

পরেরদিন। বাতাস বলল পাখিকে— মদনা নেই। ২০২০ জানাল ২০১২কে— মদনা নেই। ছাগলের তলদেশে ঝুলে থাকা মদনার প্যানেল এসএসসি বোর্ডকে জানাল– মদনা নেই।

পাশের বাড়ির পণ্ডিতজি মদনার বন্ধুদের জানাল— মদনা কি মউত হো গ্যায়া।

এক মদনা কি
মউত হো গ্যায়া…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...