দেবব্রত শ্যামরায়
লেখক রাজনৈতিক ভাষ্যকার
আবার কাফিল খান।
আমাদের দেশে যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন অথবা নিউজ পোর্টাল স্ক্রোল করেন, ওপরের নামটা তাদের কাছে মোটেই অপরিচিত নয়।
অথচ কাফিলের এমন জাতীয় (আন্তর্জাতিকও বটে) পরিচিতি পাওয়ার কথা ছিল না।
ধনী পরিবারের ছেলে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক্তারি পাশ করে আর পাঁচটা চিকিৎসক ছাত্রের মতোই নিজের শহর গোরক্ষপুরের বাবা রাঘব দাস (বিআরডি) মেডিকেল কলেজের এক জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিলেন কাফিল৷ অতিরিক্ত সময়ে নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত থেকে রোগী দেখতেন, যা অন্যান্য অনেক সরকারি ডাক্তারবাবুই করে থাকেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট তাঁর জীবনকে চিরকালের মতো বদলে যায়। সে করুণ ইতিহাস অনেকের মনে থাকবে। ইস্যুটিকে সেসময় বিস্তারিত আকারে কভার করেছিল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। তাও ঘটনাটি অল্প কথায় আরেকবার বলে নেওয়া যাক।
বাবা রাঘব দাস হাসপাতাল অক্সিজেন সরবরাহকারী বেসরকারি সংস্থা ‘পুষ্প সেলস’-এর দীর্ঘদিনের বকেয়া অর্থরাশি না মেটানোয় হাসপাতালে অক্সিজেন অমিল হয়। স্বাস্থ্যদপ্তরের কাছে প্রদেয় অর্থের জন্য একাধিক চিঠি লেখেন বিআরডি কর্তৃপক্ষ, কোনও ফল হয় না। ১০ই আগস্ট বিআরডি হাসপাতালে অক্সিজেনের স্বল্পতাহেতু কমপক্ষে ৩০ জন শিশুর মৃত্যু হয়, অবশ্য মৃতের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে নিঃসন্দেহে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বাড়তে পারত যদি না বিআরডি-র শিশুবিভাগের তরুণ চিকিৎসক কাফিল খানের একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে, খরচে ও প্রাণপণ তৎপরতায়, এমনকি তাঁর নিজের গাড়িতে করে বাইরে থেকে ২৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করা যেত। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় মিডিয়ায় উত্তরপ্রদেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হতশ্রী দশাটি বেআব্রু হয়ে পড়ে ও ডা. কাফিল খান জনমনে নায়ক হয়ে ওঠেন।
১৩ই আগস্ট উত্তরপ্রদেশ সরকার শিশুমৃত্যুর কারণ হিসেবে অক্সিজেনের অভাবের কথা অস্বীকার করে, ও এনকেফালাইটিসকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়। যোগী সরকারের ইমেজ মেরামতি করতে বলির পাঁঠা করা হয় বিআরডি-র প্রিন্সিপাল সহ একাধিক চিকিৎসককে, যার মধ্যে কাফিল অন্যতম। ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড হয়েছিলেন, সেপ্টেম্বর ২ তারিখে অজামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার হন কাফিল খান, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কর্তব্যে গাফিলতি, নার্সিং হোমের সঙ্গে যুক্ত থাকার এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন চুরির অভিযোগ ওঠে। বলাই বাহুল্য, এই প্রশ্নগুলি ধোপে টেঁকেনি যে সরকারি কাজের সময়ের বাইরে নার্সিংহোম পরিষেবা প্রদান অপরাধ হয় কী করে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিবিউশন লাইন থেকে তরল অক্সিজেন চুরি করা যায় কোন অলৌকিক প্রাযুক্তিক উপায়ে? অবশ্য দেশের ডাক্তারদের সর্ববৃহৎ সংগঠন IMA কাফিলের পক্ষে দাঁড়ায় ও তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ও তাঁকে গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ করে।
গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। গরিব ঘরের কটি কচিকাচার মৃত্যুর শোক দ্রুত মিলিয়ে গেলে ও পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বলির অন্য পাঁঠাদের সঙ্গে কাফিলও মুক্তি পেতেন, হয়তো বেশ কিছুদিনে নিজের চাকরিটাও ফেরত পেতেন। কিন্তু তা হল না। কারণ ততক্ষণে গোরক্ষপুর জেলের ভেতর এক নতুন কাফিল খানের জন্ম হয়েছিল, যিনি শুধুমাত্র দামি গাড়ি ও জামাকাপড় কেনার শৌখিন বড়লোকের হ্যাপি-গো-লাকি ছেলে কাফিল নন, বরং এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক অবিচার সম্বন্ধে হঠাৎ সচেতন হয়ে পড়া নাগরিক কাফিল খান। কাফিল সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যদি তাঁর মতো ধনী পরিবার থেকে আসা উচ্চশিক্ষিত ইংরেজি জানা ধোপদুরস্ত একজন ভারতীয় এতখানি অত্যাচারের স্বীকার হতে পারেন, তাহলে এদেশের খুঁটিহীন সাধারণ মানুষের কী হাল হতে পারে? কাফিল জানাচ্ছেন, এই বোধ তাঁর মধ্যে সহসা এক অ্যাক্টিভিজমের জন্ম দিয়েছে। আর কে না জানে, একজন সরকারবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট বা সমাজকর্মী দেশকাল নির্বিশেষে যেকোনও রাষ্ট্রের ভারী অপছন্দ, আর তার ওপর হিন্দুস্তানের এই ‘অচ্ছে দিন’-এ সমাজকর্মীটি যদি জন্মপরিচয়ে মুসলিম হন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
বস্তুত, গত তিন বছরের ঘটনাক্রমের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, কাফিল খানের সবচেয়ে বড় শত্রু অ্যাক্টিভিস্ট কাফিল নন, তাঁর প্রকৃত নেমেসিস আসলে মুসলিম নামধারী কাফিল খান।
দীর্ঘ ন মাস জেলে থাকার পর কাফিল ২০১৮-র ২৫ এপ্রিল জামিনে মুক্তি পান, কিন্তু ততদিনে তাঁর ও তাঁর পরিবারের জীবন আমূল বদলে গেছে। কাফিলের স্ত্রী এক বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে গোরক্ষপুর ছেড়ে পিতৃগৃহে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, রাস্তাঘাটে লাগাতার অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কাফিল খানের ভাইয়ের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার জোগাড়, কারণ কাফিলের পরিবারের সঙ্গে কাজ করলে স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথ অখুশি হতে পারেন— এই আশঙ্কা করছেন অনেকেই। উচ্চ রক্তচাপের রোগী কাফিল জেলের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়া সত্ত্বেও সুচিকিৎসা পাননি, যেটুকু চিকিৎসা জুটেছে তাও পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী আদালতে বিশেষ আর্জি জানানোর পর। কাফিল জেলে থাকাকালীন তাঁর ভাই ও কাকার ওপর প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে, কাফিলের চাচা গুলিতে প্রাণও হারিয়েছেন, যদিও পুলিশ একে জমিজমাসংক্রান্ত সমস্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। অবশেষে কাফিল খান বিআরডিতে শিশুমৃত্যুসংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ থেকে সসম্মানে মুক্তি পেলেন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ তারিখে। হাসপাতালের আভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট কাফিলকে ক্লিন চিট দিয়ে ঘোষণা করল, বিআরডি ঘটনায় কাফিলের গাফিলতির কোনও প্রমাণ নেই।
কিন্তু তাতে কী? প্রমাণ থাক বা না থাক, ততক্ষণে তো সাপের লেজে পা দিয়ে ফেলেছেন কাফিল। জেলে থাকাকালীন ও তার পরেও একাধিকবার গোরক্ষপুরে শিশুমৃত্যুর জন্য কাফিল সরাসরি দায়ি করেছেন সরকারি পরিকাঠামোগত ত্রুটি ও গাফিলতিকে, শিশুমৃত্যুকে তুলনা করেছেন গণহত্যার সঙ্গে। যোগী আদিত্যনাথ নিজের অ্যান্টিচেম্বারে বসে টিভির পর্দায় নিশ্চয়ই দেখেছেন সেসব। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে তাঁর।
বেচারা কাফিল আর যান কোথায়! গত বছর অর্থাৎ ২০১৯-এর ২৭ ডিসেম্বর মুম্বই থেকে আবার গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। এবার তাঁর ‘অপরাধ’ তিনি এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া একটি বক্তৃতায় হিংসায় উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন। শুধু তাই না, এবার কাফিলের বিরুদ্ধে এনএসএ বা জাতীয় সুরক্ষা আইনের ধারায় দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হল। এই এনএসএ বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট হল ফ্যাসিবাদের সেই স্বপ্নের আইন, যে আইনে যে কাউকে দেশের সরকার বিনা বিচারে বহুদিন জেলে আটকে রাখতে পারে, এবং এই সময়সীমার মধ্যে অভিযুক্তকে বিচারের জন্য এজলাসে তুলতে হবে- এমন কোনও আইনি বাধ্যবাধকতাও নেই।
এবারেও জেলে পচতে শুরু করেছিলেন কাফিল। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ আলিগড় আদালত তাঁকে জামিন দেয় কিন্তু ১৩ই ফেব্রুয়ারি আবার তাঁকে এনএসএ-তেই গ্রেফতার করা হয়। মে মাসের ১২ তারিখে তিনমাসের কারাবাসের মেয়াদ শেষ হলে আরও তিনমাসের জন্য অর্থাৎ আগস্ট ১২ পর্যন্ত এক্সটেনশন নেয় উত্তরপ্রদেশ সরকার। এমনকি অতিমারি পরিস্থিতিতে জেলগুলি ফাঁকা করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সাত বছরের কম মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত অর্থাৎ ‘বিপজ্জনক নয়’ এমন কয়েদিদের আপাতত মুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও কাফিলের ভাগ্য খোলেনি। শেষ অবধি কাফিলের মায়ের করা মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে পুনরায় মুক্ত হন কাফিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতিরা কাফিলের আলিগড় ভাষণে এমন কিছুই পাননি যা সাম্প্রদায়িক হিংসায় প্ররোচনা দিতে পারে, বরং তাঁদের মতে ভাষণে বারবার পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সহযোগিতার কথাই বলেছেন কাফিল। বিচারপতিরা প্রশ্ন তুলেছিলেন— কাফিলের ভাষণের অডিও পুরোটা না শুনে একটা-দুটো করে প্রেক্ষিতহীন লাইন তুলে এনে অভিযোগ সাজানোর উদ্দেশ্য আসলে কী?
উদ্দেশ্য যে কী, তা এতক্ষণে আমরা সকলেই বুঝতে পেরে গেছি। কারণ এরপরেও যখন উত্তরপ্রদেশ সরকার এলাহাবাদ হাইকোর্ট-এর রায় গ্রহণ না করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন, এবং একাজে কেন্দ্র সরকারকেও মামলার সহ-অভিযোগকারী পার্টি হিসেবে পাশে পান, আমাদের বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না যে এটি আদতে সামান্য কোনও প্রশাসনিক মামলা নয়, কাফিলের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বৈরথের একটা হেস্তনেস্ত দেখতে চাইছেন এক ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রশাসক। সংখ্যাগুরুর দেশে অবাধ্য উদ্ধত সংখ্যালঘুকে বোধহয় এভাবেই শিক্ষা দিতে হয়। আরও সোজা করে বললে বলতে হুয়, মুসলিমদের মাথায় চড়তে দিতে নেই, এ দেশের হিন্দুদের পায়ের তলাতেই তাদের সঠিক স্থান। ঠিক যেভাবে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়েছিল উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন। ঠিক যেমন ঠিক এই মুহূর্তে অ্যান্টি লাভ জিহাদ আইনে বেছে বেছে অথচ বিনা প্রমাণে জেলে ভরা হচ্ছে মুসলিম যুবকদের। ঠিক যেভাবে দক্ষিণ দিল্লি দাঙ্গায় শাসক-ঘনিষ্ঠ বন্দুকধারী যুবক গ্রেফতার হয় না, অথচ…
তবে কাফিলের ক্ষেত্রে আপাতত শেষরক্ষা হল না৷ এলাহাবাদ হাইকোর্ট-এর রায়ই আপাতত বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট৷ গত ১৭ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত সেই সঙ্গে একথাও ঘোষণা করল, এখনও কাফিলের বিরুদ্ধে যেকটি পুরোনো মামলা চলছে, তার সূত্র ধরে কাফিলের বিরুদ্ধে নতুনভাবে কোনও দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা যাবে না।
মুখ পুড়েছে সরকারের। উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্র, দুজনেরই। সাময়িক স্বস্তি মিলেছে কাফিলের। হৃত চাকরি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা এখনও নেই, তবু সরকার আবার তাঁকে জেলে পোরার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে তোলার আগে আপাতত কিছুদিন তিনি নিজের পরিবারের সঙ্গে, নিজের ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। তবু তিনি শান্তি পাবেন না। কারণ কাফিল খান সম্ভবত জানেন, তাঁকে বা উমর খলিদের মতো মুসলিম ‘দেশদ্রোহী’দের শায়েস্তা করতে না পারলে বৃহত্তর সংখ্যালঘু সমাজে জরুরি বার্তাটি দেওয়া যাবে না। ঠান্ডা সন্ত্রাসের এক বার্তা। বেশি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে উড়ে যাবে। আর কে না জানে, সমস্ত গণপরিসরে সন্ত্রাসের স্রোত বইয়ে দিতে না পারলে ফ্যাসিবাদ কখনও সফল ও দীর্ঘজীবী হতে পারে না।