নীলাঞ্জন হাজরা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
সারা দিন প্রোগ্রাম ঠাসা। প্রথমে করাচি প্রেস ক্লাবে তারপর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ও মাস্ কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে৷
পাকিস্তানি সাংবাদিক বন্ধুদের কণ্ঠে শুনি আমারই মনের কথার প্রতিধ্বনি৷ করাচি প্রেস ক্লাবে এক আলোচনাচক্রে প্রস্তাব আসে দু তরফ থেকেই নিজ নিজ দেশের সরকারের কাছে লিখিত আর্জি জানানো হোক, অন্তত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে যেন এই শহর-বন্দি-ভিসা-প্রথা তুলে দেওয়া হয়৷ ভিসা পেলে যেন সাধারণভাবে সে দেশের যে কোনও জায়গাতেই যেতে পারি৷ ভারতেও যেন তা পারেন পাকিস্তানি সাংবাদিক৷ খচাখচ-ভরা-হুয়া হল সমর্থনের করতালি-চটচটারবে ফেটে পড়ে৷ যে কদিন পাকিস্তানে ছিলাম একজনও পাইনি যিনি একমত নন৷ আশা, দুই প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষই নিজেদের সদস্যসভায় এ প্রস্তাব পাশ করিয়ে সে আর্জি সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেবেন৷ এমন কোনও আশা নেই যে কোনও অতি নিম্নপদস্থ আমলার টেবিলে ধুলো ধরা ছাড়া তার আর কোনও ভবিষ্যৎ আছে৷
আমার পাকিস্তান সফরের করাচি পর্বটির দুটো পরত৷ একটি দলছুট পরত, কবি-সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কাটানো সময়, অন্যটি সরকারি পরত, সরকারি অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠান৷ এখন আমি সরকারি অনুষ্ঠানে বন্দি৷ আমাদের তেরো সাংবাদিকের দল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়, রাজমর্যাদায় ছুটে চলেছি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে৷
কাল রাত্রি থেকে করাচির বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে, এমনকি আজ সকালেও করাচি প্রেস ক্লাবে পাকিস্তানের অকুতোভয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনাতেও ক্রমাগত যে অভিজ্ঞতা হয়ে চলেছে, তাতে নিজেকে মনে মনে বলি— দু দেশের মধ্যের এই ঘৃণার পাঁচিল ক্ষমতালোভী রাজনীতিক, আমলা, প্রাক্তন আমলাদেরই একচেটিয়া, মানে কায়েমি স্বার্থের হাতে গড়া৷ পাকিস্তান আসার আগেও আমার নিজের মনে সে ধারণাটাই ছিল৷ প্রগতিশীল গুলতানিতে এমনটাই বলে আমরা নিজেদের এই ঘৃণার পাঁচিলের বাইরে ভারি স্বাধীন মনে করি৷ এই প্রগতিশীল গপ্পো (যার একটা খাসা ইংরেজিও আছে— construct)-টা খানিকটা এ রকম: আসলে রাজনীতিক, আমলা আর দুর্নীতি-চুবচুবে সেনা অফিসারদের কায়েমি স্বার্থই এই ভয়ঙ্কর পাঁচিলের ইট-সিমেন্ট— পলস্তারা৷ আহা! ভালোবাসার কামান দেগে ওটা ভেঙে দিতে পারলেই দু দেশের আম-আদমির মধ্যে সে কী কোলাকুলি৷ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে যেতে নিজের মনের এই তাত্ত্বিক ‘কনস্ট্রাক্ট’-টির সঙ্গে পাকিস্তান সফরের এতাবৎ বাস্তব অভিজ্ঞতা এমন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ায় মনে মনে বেশ একটা তৃপ্তি অনুভব করি৷ নিজেকে বেশ প্রাজ্ঞ মনে হয়৷
ভুল ভাঙে ঝটিতি৷ সব থেকে অপ্রত্যাশিত জায়গায়৷ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়৷ গণমাধ্যম বিভাগে আলোচনাচক্র৷ অভ্যাগতদের (মানে এই অপয়া তেরো-র দলটিকে) স্বাগত-ভাষণ দিয়ে আলোচনা শুরু করেন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক তাহির মাসুদ৷ ভাঙা ভাঙা বাংলায় ‘সোকালে উঠিয়া হামি মোনে মোনে বোলি/ সারা দিন হামি যেন্ ভাল্ হোয়ে চোলি’-র পরেই বুকে চাক্কু বিঁধিয়ে হলে পায়রা উড়ানো হাততালি৷ এর পরেই শুরু হয় খাস উর্দু জুবানে মাসুদ সাহেবের স্বাগত ভাষণ৷ বক্তব্যের সারমর্ম: ভারত থেকে এসেছেন আমাদের সম্মানীয় অতিথিরা৷ সেখানে বিশ্বের সব থেকে বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস৷ এই মহামান্য অতিথিরা এসেছেন কলকাতা থেকে৷ যে শহরে গিয়ে আমি নিজে দেখেছি মানুষে টানা রিকশার মতো কদর্য একটা যান চলছে৷ আর তাতে দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে চেপে আছে মানুষ৷ এমন যে দেশ তাদের ‘জম্হুরিয়ত’, গণতন্ত্র, নিয়ে এত বড়ফট্টাই করার মানে কী?
বিব্রত বোধ করি৷ কিন্তু ভুল তো নয়৷ আমাদের প্রগতিশীল গুলতানিতে ঠিক এই প্রশ্ন তুলেই না আমরা আমাদের প্রগতিশীলতার ছাতি ছাপান্ন ইঞ্চি ফুলিয়ে তুলি? খটকাটা লাগে পরমুহূর্তেই৷ খচাখচ ভরা হুয়া হলে কুড়ি-একুশ বছরের তরতাজা তরুণ-তরুণীর দল যে হাততালির ঝড় তোলেন তার পাশে করাচি প্রেস ক্লাবের হলের করতালি ম্লান হয়ে যায়৷ শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাচ্ছে না৷ এ তালির প্রতিটি শব্দতরঙ্গে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে হিন্দুস্তান-বিদ্বেষ৷ ভারতের প্রতি ঘৃণা৷ আলোচনাচক্রের শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে ফিরে আসে সেই হাততালির ঝড়৷ এক তরুণ ছাত্রের বেশ উত্তেজিত প্রশ্ন: ভারতীয়রা কি কিছুতেই সহজ মনে নিজেদের হার স্বীকার করতে পারেন না৷ নতুবা তাঁদের টিভি চ্যানেলগুলো কেবল জেতা ম্যাচগুলোর রিপ্লে দেখায় কেন? তেরো ভারতীয়কে সামনে পেয়ে এক হাত নেওয়ার আনন্দে নবীন শ্রোতারা আত্মহারা৷ ১৯৪৭-৪৮-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা ১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১-এর যুদ্ধের ভয়ঙ্কর সে সব দিন থেকে বহু আলোকবর্ষ দূর, হলিউডি প্যাঁচে ইংরেজি-বুদবুদ ওড়ানো একঝাঁক (অধিকাংশই উচ্চবিত্ত) তরুণ-তরুণী আজও এমন ঘৃণায় বন্দি? বুঝি, ইতিহাসের রক্তাক্ত কোনও ক্ষত নয়, সম্পূর্ণ অপরিচয়ের কারাগারে বন্দি এ নবীনদল৷
মনে পড়ে যায় আমাদের শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ঝকঝকে ‘নব্য ভারতের’ একটি বড় অংশের মধ্যে নরেন্দ্র দামোদর মোদির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন৷ যার একটি অপরিহার্য অঙ্গ ‘সন্ত্রাসবাদী’ পাকিস্তানকে সবক শিখানোর দাবি৷ কবে এই অপরিচয় আর স্টিরিওটাইপের পাঁচিল ভেঙে স্বাধীন হব আমরা? কী হতভাগ্য মহেঞ্জো দাড়োর সেই দাড়ি-বুড়ো— যাঁর ঘাড়ে আমাদের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার দায়িত্ব৷ কোন দেশের মানুষ তুমি দাদু? উত্তর মেলে না৷
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা গলায় কেমন কাঁটার মতো খচখচ করতে থাকে৷ বিমানবন্দরে নামা ইস্তক আতিথেয়তার যে রামধনু বুদ্বুদে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম তা যেন হঠাৎই ফেটে যায়৷ ফেটে যায় বুঝি নিজের সম্পর্কে নিজের এই প্রগতিশীল ধারণার স্টিরিওটাইপও যে, উগ্র জাতীয়তাবাদী খোঁচা আমাকে বিচলিত করে না৷ উগ্র দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের পরাকাষ্ঠার পরিণতি যে কী, ছাত্রাবস্থাতেই তো বিলক্ষণ তার পাঠ পেয়েছি৷ কিন্তু সেই সোনা-ঝরা সকালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা কি সত্যিই আমার ‘ভারতীয়ত্বকে’ একটুও খোঁচা দেয় না? হাঁসের পিঠে জলের ফোঁটার মতো গড়িয়ে পড়ে যায়? জোর করে এ কথা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে৷ মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে সেই সকালের আরও নানা কথা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে হুটার-চিৎকারে হু-হু করে ঢুকে পড়ে আমাদের কনভয়৷ পাশে বসা অভিজ্ঞ সাংবাদিক, আমার দাদা-স্থানীয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু শুভাশিস মৈত্র আমায় কানে কানে বলে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই হুটার লাগানো পুলিশের গাড়ি ঢুকে পড়ছে? বেশ কয়েকবারই তো মুখ্যমন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানও কভার করেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে৷ যতদূর মনে পড়ছে হুটারওয়ালারা সব সময় গেটের বাইরেই নিজেদের আটকে দেন৷’ ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন-তোলা তাহির সাহেব কি পার্থক্যটার দ্যোতনা অনুধাবন করতে পারবেন? কেন একটা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হুটার লাগানো কনভয় নিয়ে ঢোকা প্রধানমন্ত্রীর প্রোটোকলেও আটকায়, আর অন্য দেশে একদল বিদেশি সাংবাদিক সোজা ডিপার্টমেন্টের সামনে হাজির হতে পারেন হুটার লাগানো গাড়ি ছুটিয়ে? পার্থক্যটা কি তাহির সাহেব বুঝতে পারবেন?
মধ্যরাত্রি পার করে হোটেলের ঘরে বসে অফজাল সাহাব, তনবির-জি ও আজমলের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা দিতে দিতে উত্তর মিলে যায়— না, পারবেন না৷ খবরের কাগজেই জানতে পেরেছিলাম আল কায়দার যোগসাজশ খুঁজতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপা মেরেছে পুলিশ৷ আড্ডায় জানতে পারি করাচির প্রগতিশীল মহলে ইদানীং একটা ভারি হাসাহাসির বিষয় তাহির সাহেবের দাড়ি৷
দাড়ি? আমরা নিশ্চয়ই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কথা বলছি৷ তিনি তো শ্মশ্রু-গুম্ফহীন এক ঝকঝকে ভদ্রলোক৷ হাসির দমক ওঠে৷ গত পরশু অবধি ওঁর মেহেদি মাখা লম্বা একমুখ দাড়ি ছিল! ওই পুলিশি ছাপার পর থেকেই আর নেই৷ ফের হাসির দমক ওঠে৷ ভালো লাগে না৷ মেহেদি-মাখা দাড়ির সঙ্গে আল কায়দা বা ভারত-বিদ্বেষ আকারে ইঙ্গিতে যোগ করাটাও বিরক্ত লাগে৷ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তেমন কোনও যোগসূত্রের কথা বলে না৷ পরক্ষণে বুঝি ওঁরাও নেহাত ঠাট্টাই করছেন৷ ওই দাড়ি কেটে ফেলা থেকে তাঁরাও কোনও সাংঘাতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন না৷ তবে এও জানতে পারি৷ তাহির সাহেব এক সময় ঢাকায় ছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ঢাকা ছাড়েন৷ ‘সেই থেকে বরাবরই তিনি ভারত-বিদ্বেষী৷ কট্টর দক্ষিণপন্থী৷’ কিন্তু কী আশ্চর্য ঠিক একইরকমভাবে অফজাল আহমেদ সৈয়দ সাহেবও তো ঢাকায় মানুষ৷ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের কালে ঢাকা পরিত্যাগ৷ অথচ কী আকাশ-পাতাল তফাৎ দুটো মানুষের জীবনবোধে৷ বাংলাদেশের মুক্তির নিঃশর্ত সমর্থক ছিলেন অফজাল সেদিন৷ আজও তাই আছেন৷ ভারত তাঁর কাছে আরও ভালো করে জানার মতো এক দেশ৷ যেখানে বার বার ফিরে আসতে চান তিনি৷ মায় এই টানা-রিকশার কলকাতাতেও৷ সকালের গলার কাঁটা গভীর রাতে গলে মিলিয়ে যায়৷ আরে, এ তো আমাদেরই মতো৷ ভারতেরই মতো৷ দু দেশেই মানুষের দুনিয়াটা যে কিছুতেই-মেলাতে-না-পারা অদ্ভুত সব স্ববিরোধে ঠাসা৷ বুঝি, গপ্পোটা— construct-টা— ভারতীয় বা পাকিস্তানির নয়, নিখাদ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার৷ দিনে দিনে তার ঢের প্রমাণ মেলে৷ আর তাই স্টিরিওটাইপগুলো ঝনঝন করে ভেঙে পড়তে থাকে৷ ডান-বাম দুদিকেরই৷ ভারত-পাকিস্তান দু-তরফেরই৷
সকাল-দুপুরে সরকারি অনুষ্ঠান শেষ হতেই হোটেলে ফিরে ফের আমার বন্ধু করাচির বিশিষ্ট ‘আজ’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে ধাঁ৷ আগে থেকেই ঠিক করা আছে যে, আজ এক বিশিষ্ট কবির সাক্ষাৎকার নেব আমি৷ পরিচয় অবিশ্যি আগেই হয়ে গিয়েছে৷ যেমন তাঁর চেহারা— পেল্লায়৷ কথা বলে বুঝেছি মনটাও তেমনি৷ রাখঢাক করে কথা-বার্তা বলা তাঁর ধাতে সয় না৷
সুবাসিত মেহফিল, শরাব-ও-শবাব, একটি শের-এর একই পঙ্ক্তি সাড়ে তেতাল্লিশবার পুনরাবৃত্তি আর শ্রোতাদের ওয়াহ্-ওয়াহ্-কেয়াবাত-কেয়াবাত খচিত মুশায়রার বৃত্ত থেকে ছিনিয়ে এনে যে কজন কবি উর্দু কবিতাকে ১৯৭০-এর দশকে পথে নামিয়ে বিপ্লব ঘটালেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম আজরা আব্বাস৷
আমি, আজমল, অফজাল সাহেব ও তাঁর স্ত্রী তনভির অঞ্জুম এক সঙ্গে আজরা আব্বাসের বাড়ি পৌঁছই৷ পেল্লায় বাড়ি৷ যে সব বাড়িতে ঢুকতে হয় গেটের মধ্যে কাটা গেট দিয়ে, তেমন বাড়ি৷ ঢুকে পড়ি৷ দরাজ আপ্যায়ন৷ সুসজ্জিত বাইরের ঘর৷ টেবিলে তৈরি গ্লাস, বরফের কন্টেনার, চিমটে৷ প্লেটে প্লেটে নানা নমকিন৷ পাশেই সেলারে থরে থরে বোতল— হুইস্কি, ভদকা, রাম, জিন৷
বিশেষ ভূমিকা ছাড়াই পানাহার শুরু হয়ে যায়৷ আমি আজ়রাজি-কে বলি, আমরা তাহলে একটু আড়ালে গিয়ে বসি৷ অবশ্যই, অবশ্যই৷ আর একটি পেল্লায় ঘরে যাই৷ আজ়রা সঙ্গে নিজের ভদকার গ্লাসটা নিতে ভোলেন না৷ দু আঙুলে ধরা লম্বা সিগারেট৷ সবে টেপ চালু করেছি, মহিলা বলে ওঠেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও একটা ছাই ফেলার কিছু নিয়ে আসি৷ আসেন৷ বেশ দীর্ঘই হয় ইন্টারভিউ৷
আমাদের করাচির পাট প্রায় শেষ৷ কাল ইসলামাবাদের ফ্লাইট৷ হোটেলের ঘরে শুয়ে আছি, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে৷ এই মুসাফির মন নিয়ে এ দেশ সে দেশ অনেক গ্রাম, শহর, মফস্বলেই গেছি, কিন্তু কোনও শহর ছেড়ে যেতে এত মন খারাপ করেনি৷ বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে কখনওসখনও, তোর সব থেকে প্রিয় শহর কোনটা? সাধারণত আমি বলে থাকি— কাঠমান্ডু, ভেনিস, ইসফাহান আর পুরনো দিল্লি৷ এই চারটে শহরে আমি সুযোগ পেলেই ফিরে ফিরে যেতে চাই৷ কিন্তু করাচি নয়৷ করাচিতে আমি ফিরে যেতে চাই না, কারণ গেলে ফের নিজেকে ছিঁড়ে আনা বড় কঠিন৷ আমি করাচিতে থেকে যেতে চাই, কিংবা কখনও আর যেতেই চাই না৷
মনে মনে ভাবি কেন এই করাচি-প্রেম? বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক শহর৷ এখানে মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য ভয়ঙ্কর৷ দাউদ ইব্রাহিমের মতো খুনি সন্ত্রাসবাদী এই শহরেই বহুকাল আস্তানা গেড়ে ছিল৷ এই শহরের একটা বিরাট অংশ কলকাতার মতোই নোংরা, অপরিচ্ছন্ন৷ তা হলে? আসলে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমার মনে হয়েছে একটা শহর একটা মানুষের মতো৷ মানুষের শরীরের ধমনীর মতোই জটিল তার অলিগলি৷ মানুষের মনের নানা অনুভূতির মতোই পরতে পরতে বাস করে প্রতিটা শহর, যার একটা পরতের সঙ্গে অন্যটার যোগাযোগ সামান্যই৷ প্রত্যেক মানুষের মতোই প্রত্যেক শহরের আছে সুন্দর হাসি, আবার আছে মলদ্বারও! আর প্রত্যেক মানুষকেই যেমন ভালোবাসা যায় না, শহরের ক্ষেত্রেও তাই৷
করাচির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নিখাদ ভালোবাসার সম্পর্ক— তাই করাচি বিপজ্জনক, করাচি নোংরা— এ সবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না৷ আসলে করাচির সঙ্গে এমন কিছু মানুষের যোগাযোগ যাঁরা আমার গড়ে ওঠার সঙ্গেই জড়িত৷ যেমন মেহদি হাসান৷ সেই ক্লাস ফোর, হঠাৎ একটা ক্যাসেট এনে আমাদের ওয়েস্টন টেপরেকর্ডারে বাজিয়ে দিল আমার বাবা৷ তার প্রথম গান ছিল— গুলোঁ মে রঙ্গ্ ভরে বাদ-এ-নও-বাহার চলে, চলে ভি আও কে গুলশনকা কারোবার চলে! ১৯৭৬ সালের কথা৷ আজও স্মৃতিতে ঝকঝকে৷ ক্যাসেটের ওপরে লেখা ছিল— মেহদি হাসান৷ সেই থেকে আজ অবধি এমন কোনও মনখারাপের দিন যায়নি যে দিন আমি মেহদি হাসান চালিয়ে খানিকক্ষণ পরে ফের বলে উঠিনি— ছাড় তো৷ সব ঠিক হ্যায়৷ এমনই জাদু মেহদি হাসানের গলায়৷ দীর্ঘকাল ইচ্ছে ছিল মেহদি হাসানের একটা অনুষ্ঠান দেখব৷ সুযোগও এসেছিল একবার৷ আমি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ি, হিন্দু হোস্টেলে থাকি৷ শুনলাম মেহদি হাসান কলকাতায় আসছেন৷ ১৫০ টাকা টিকিট৷ ছুটতে ছুটতে গিয়ে এসপ্ল্যানেডের ক্যাফে ডি মনিকা থেকেই সম্ভবত টিকিট কেটে ফেললাম৷ তখন ১৫০ টাকা মানে বিপুল ব্যাপার আমার কাছে৷ কিন্তু মনে হল ১৫০ টাকা দিয়ে কোহিনূর কিনে ফেললাম৷ দিন গুনছি৷ হঠাৎ একদিন দেখি কাগজে বড় বড় বিজ্ঞাপন, মেহদি হাসান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রোগ্রাম বাতিল, যে যার টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে যাও৷ এত মন খারাপ হয়েছিল যে টিকিটা ফেরত দিতেও যাইনি৷
করাচিতে এসেও সেই অপূর্ণতাটা থেকেই গেল৷ ২০১২ সালে মারা গেলেন মেহদি৷ বেঁচে থাকলে যেভাবে হোক একবার দেখা করতামই৷ ভেবেছিলাম বাড়িটা অন্তত একবার দেখে আসব৷ বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই একটু সময় বার করে উঠতে পারলাম না৷ শেষ সন্ধ্যায় যখন একটু সময় বেরোল, দেখা গেল আমার বন্ধুদের, করাচির বন্ধুদের, কেউ জানে না তিনি কোথায় থাকেন৷ অনেক ফোনাফুনি হল৷ কিন্তু না ঠিকানাটা জাস্ট পাওয়া গেল না৷ অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু সত্যিই৷ অনুষ্ঠান দেখা হয়নি টিকিট কেটেও, বাড়ি দেখা হল না করাচি গিয়েও৷ পাকিস্তান সফরের এ অপূর্ণতা ভুলব না৷ এ সফরে এমনি অপূর্ণতা আরও ছিল আমার, সেটিও মেহদি হাসানের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত, কিন্তু লাহোরে৷ পরে বলব সে গল্প৷ তার আগে কাল ইসলামাবাদ৷
(ক্রমশ)