মহাশ্বেতা সমাজদার
সমাজকর্মী, গদ্যকার, ‘ভ্রমণ’ পত্রিকার সম্পাদক
দিল্লি-হরিয়ানার সিঙ্ঘু সীমানায় এখন কয়েক হাজার কৃষক তিনটি নতুন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই আন্দোলনের দাবি না মানলে যে এই আন্দোলন থামবে না, সে কথা তাঁরা বারবার বলছেন। এমনকী সরকারের সঙ্গে বৈঠকে তাঁরা মৌন অবলম্বন করে “হাঁ অউর না” লেখা প্ল্যাকার্ড দেখিয়েছেন। ইতিমধ্যে দেশজোড়া বন্ধ ডেকেছেন, সে বন্ধ দেশের নানা প্রান্তে সফল হয়েছে। এমনকী আন্তর্জাতিক মহল থেকেও কৃষক আন্দোলনের সপক্ষে নানাবিধ মন্তব্য শোনা যাচ্ছে।
এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, অর্থনীতি, কী হতে পারে, কী হতে পারত, একটু বোঝার চেষ্টা করি।
সরকারপক্ষের বক্তব্য, এই আইনগুলি কৃষকদের সুবিধা করে দেবে। কৃষকদের আরও বলীয়ান করে তুলবে। তাদের যুক্তি, কৃষি সংস্কারের প্রথম আইনের ফলে কৃষকরা রাজ্য সরকারের স্থির করে দেওয়া মান্ডির বাইরে যে কোনও লাইসেন্স হোল্ডারকে তাদের ফলন বেচতে পারবে এবং কোনও পক্ষকেই মান্ডি ট্যাক্স বহন করতে হবে না ফলে কৃষকেরও মান্ডির স্থির করা দামের থেকে বেশি দামে তার ফলন বেচার অধিকার থাকবে।
আন্দোলনকারী কৃষকদের যুক্তি, মান্ডির বাইরে বেচার সুবিধা আগেও ছিল, তবে ন্যূনতম দামের শর্তের উল্লেখ আইনে না থাকায় বড় পুঁজির সঙ্গে দরকষাকষির জায়গায় দুই পক্ষের সমান সুযোগ থাকবে না এবং ক্রমশ কৃষককে পুঁজিপতির ক্রীতদাসে পরিণত হতে হবে। আর ক্রেতা যেমন ঘুরে ঘুরে বিক্রেতা খুঁজে বিক্রেতা পছন্দ করতে পারে, চাষির পক্ষে তার মাঠের ফলন নিয়ে ঘুরে ঘুরে ক্রেতা পছন্দ করা সম্ভব হবে না। যে ক্রেতারা চাষির কাছে আসবে, চাষিকে তাদের মধ্যে থেকেই ক্রেতা পছন্দ করতে হবে। ফলে উভয়পক্ষের পছন্দের যে স্বাধীনতার কথা সরকারপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে, তা আসলে অলীক কল্পনা।
কৃষি সংস্কারের দ্বিতীয় আইনে বলা হয়েছে কৃষক ইচ্ছামত ক্রেতা পছন্দ করে তার সঙ্গে চুক্তি করে চাষ করতে পারবে। সরকারপক্ষের যুক্তি, এই চুক্তিচাষের ফলে কৃষক খাদ্যশস্যের বদলে অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষ করে বেশি দাম পাবে। ফলে, কৃষকের আয় বাড়বে।
তবে এই আইনে একথাও বলা আছে যে চুক্তিকারী দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ হলে কৃষক সরাসরি আদালতে যেতে পারবে না।
এই ক্ষেত্রেও কৃষকরা অনিশ্চয়তার ভয়ই পাচ্ছেন। ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ না করে কোনও বৃহৎ কর্পোরেটের সঙ্গে চুক্তিচাষ করা আর গলায় ফাঁসির দড়ি পরে নেওয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, বলেছেন সিঙ্ঘু সীমানায় আন্দোলনকারী এক প্রবীণ কৃষক।
তৃতীয় আইনটা যতটা না কৃষকের পক্ষে বিপদের, তার থেকে আমার আপনার পক্ষে বেশি বিপদের। কারণ এই নতুন সংস্কারের ফলে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের বলে চাল, ডাল, তেল, আলু, পিঁয়াজ ইত্যাদি যা কিছু জীবনযাপনে অত্যাবশ্যক বলে কালোবাজারির জন্য মজুত করা বেআইনি ছিল, সেই সব খাদ্যসামগ্রী মজুত করা আইনি হল।
অর্থাৎ, তিনটে আইনের মিলিত সাহায্যে বৃহৎ পুঁজিপতি— কৃষকরা এখানে আদানি-আম্বানির নাম করেই বলছেন— এখন থেকে তাদের ইচ্ছেমতো ফসল চাষ করাতে পারবে, তাদের ইচ্ছেমতো দামে কিনতে পারবে এবং সুবিধামতো মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে তাদের পছন্দমতো দামে ফসল বিক্রি করতে পারবে।
এখানে লক্ষণীয়, প্রথম দুটো আইন সরাসরি কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আর তিন নম্বর আইনটা বিপদে ফেলবে আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষকে, যারা প্রতিদিন চাল ডাল তেল, আলু খাই। কৃষকরাও যেহেতু তাদের ফলানো ফসলের বাইরে অন্যান্য খাদ্যশস্য কিনে খান, তাই তাঁরাও এই আইনে আমার আপনার মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কৃষকরা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, যতদিন না সরকার তিন কালাকানুন বাতিল করছে, ততদিন দিল্লির রাস্তা ছেড়ে তাঁরা নড়বেন না। তাঁদের সঙ্গে নিজস্ব ট্রাকটর আছে, আর আছে যথেষ্ট পরিমাণ মজুত খাদ্য। পাঞ্জাব হরিয়ানা থেকে নিয়মিত রসদ যোগানও চলছে। এমনকী রাস্তার ডিভাইডার খুঁড়ে ফেলে তাতে বেগুন ধনেপাতার বীজ ছড়িয়ে একদল কৃষক জানালেন, যদি আন্দোলন দীর্ঘ হয়, তাহলে এখানে ফসল ফলিয়ে তারা রসদের জোগান অব্যাহত রাখবেন, আর যদি সরকার চটপট মেনে নেয়, তাহলে থাকবে এই ফসল দিল্লিবাসীর জন্য।
এই অনড় আন্দোলনের সামনে সরকার স্পষ্টতই দিশাহীন, এবং কিছু বালখিল্য স্তোকবাক্য ছাড়া তাদের তরফে বলারও খুব কিছু নেই। কারণ তারা বৃহৎ পুঁজির নির্দেশ একপ্রকার শিরোধার্য করে নিয়েছে। এবং ভাঙা রেকর্ডের মতো মেজ সেজ ন-বাবুরা বলে চলেছেন, কৃষকরা বুঝছেন না যে এতে কৃষকদের ভালো হবে। তাদের কেউ প্রশ্ন করতে পারছে না, কারণ এদেশে প্রশ্ন করার পরিকাঠামো আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে, যে যাঁদের ভালো করতে চাইছেন, তাঁরা যখন চাইছেন না, তখন নাহয় তাঁদের ভালো না-ই করলেন। এবং প্রকৃতই এ-ব্যাপারে সন্দেহ জাগছে, যে ভালোটা আসলে কার করার জন্য সরকারপক্ষ এত উদগ্রীব? কৃষকের নাকি আদানি-আম্বানির? কৃষকরা তো নতুন শ্লোগান বানিয়েই ফেলেছেন, সরকার কা নঈ মজবুরি/ আদানি আম্বানি অউর জমখুরি। জমখুরি মানে মজুতদারি।
আগেই বলেছি, এই আন্দোলন দেশের নানা প্রান্তের মানুষের তো বটেই, দেশের বাইরে থেকেও সমর্থন পাচ্ছে, অথচ সেই তুলনায় বঙ্গসমাজ এই আন্দোলন সম্পর্কে অদ্ভুত উদাসীন।
বাংলায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, এ আন্দোলন ধনী কৃষকের, কোটিপতি কৃষকেরা পিজ্জা খাচ্ছেন, ম্যাসাজ নিচ্ছেন, ইংরেজি বলছেন, এঁদের সঙ্গে আমাদের স্বার্থের কোনও সম্বন্ধ নেই, তাই আমরা ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং শুভেন্দু-সৌমিত্র-সুজাতা এবংবিধ তরজা নিয়ে মজে থাকি। আর তাছাড়া এই রাজ্যে মান্ডি নেই, ফলে মান্ডির স্থির করা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের অনেক কমে আমাদের রাজ্যের কৃষক তার ফসল বেচতে বাধ্য হয়, ফলে ঐ সব বড়লোক চাষিদের বড় বড় ব্যাপার নিয়ে এই রাজ্যের মাথা না ঘামালেও চলবে। একটা কথা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ চাষি দরিদ্র প্রান্তিক। তাদের সাক্ষরতার হার কম, সচেতনতা সীমিত এবং রোজকার কৃষিকাজ, বাড়ি জমি ফেলে তাদের পক্ষে আন্দোলনে সামিল হওয়া তো দূরের কথা, আন্দোলনের খবর পাওয়াও কঠিন। কিন্তু এই রাজ্যের দীর্ঘ বাম ঐতিহ্য ছিল, কৃষকদের বাম সংগঠনগুলির পক্ষে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল। এই আন্দোলনকে হাতিয়ার করে এই রাজ্যেও মান্ডির দাবি তোলা যেত, এমএসপি-র দাবি তোলা যেত। কিন্তু তা নিয়ে কাউকেই মাথা ঘামাতে দেখা গেল না। বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনের প্রতি কয়েকটা সমর্থক স্বর শোনা গেলেও এরাজ্যের কৃষকদের মধ্যে অন্তত এখনও কোনও ঢেউ এসে দোলা দেয়নি।
তাছাড়া বিরাট সংখ্যক পশ্চিমবঙ্গবাসী আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সোনার বাংলা গড়ার দিবাস্বপ্নে মগ্ন হয়ে খেয়াল করলেন না যে কর্পোরেটবান্ধব ফ্যাসিস্ট শক্তি তাদের দিবাস্বপ্নে মজিয়ে রেখেছে, সেই অশুভ শক্তিকে ছুড়ে ফেলে দিতে দেশের অন্নদাতারা বদ্ধপরিকর।