এ মধুতে ‘মধু’ নেই

এ মধুতে ‘মধু’ নেই -- অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 

চব্বিশ ক্যারেটের গলানো সোনার মতো টিভির এলইডি স্ক্রিনের উপর থেকে নিচে পড়তে থাকে মধু। ঝকঝকে গ্লাসের টলটলে জলে মেশে এক চামচ সুখ। জিম করে আসা কোনও স্পনসর্ড পরী সেই সুধারস গলায় ঢালে। দুধসাদা দাঁত বলে, ‘চিনি আর কত দিন? আমার ফিটনেসের প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে এই মধুতেই।’ বেজে ওঠে আনন্দ ফিউশন।

অমুক কোম্পানি বলে, চিনির থেকে ১৫ শতাংশ কম ক্যালরি আছে আমাদের মধুতে। আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্টস। আছে মিনারেলস। আছে ইমিউনিটি বাড়িয়ে, বয়স কমিয়ে দেওয়ার জাদু রেসিপি। অন্য সংস্থা বলে, আমার মধুর গুণে তরতাজা ত্বক আছে। বলিরেখাহীন চামড়া আছে। জিভে এক ফোঁটা পড়লে আছে অমরত্বের আহ্লাদ।

দিব্যি তো সব চলছিল। আমরা বিজ্ঞাপন গিলছিলাম। স্ক্রিন দেখে মধু-র হাসি হাসছিলাম। যেমন করে থাকি আর কি। প্রেমালাপে ক্রস কানেকশানের মতো হঠাৎ করে উদয় হল একটা খবর। দেশের সিএসই, অর্থাৎ সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বলে দিল, ভারতের ১৩টা বড় বড় ব্র্যান্ডের মধুর মধ্যে, মধুর আড়ালে মেশানো আছে ভেজাল। খাদ। পরাণ যাহা চায় জপতে জপতে দুটো কড়কড়ে দুশো টাকার নোট দিয়ে যে ১ কেজি মধু বাড়িতে নিয়ে এসেছি এত দিন, তার অন্তরে কালি লেপে থাকার খবর জানতে পেরে আশ্চর্য হয়েছি। মধুর শিশিতে বারকোডের প্রতিটা দাগ কেমন যেন বিস্ময়বোধক চিহ্নের মতো মনে হচ্ছে আজকাল। ভেজালটা আসলে সুগার সিরাপ। চিনির বিকল্প হিসেবে যা বরণ করে নিচ্ছিলাম ক্রমশ, জানতে পারলাম তা আসলে চিনির এক ছদ্ম-অবতার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই করোনাকালে সিএসই-র বোধোদয় কেন হল জানি না, তারা জানিয়ে দিল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যত মধুর নমুনা তারা পরীক্ষা করিয়েছে, তার মধ্যে ৭৭ শতাংশের মধ্যেই পাওয়া দিয়েছে সুগার সিরাপ। দেশের তাবড় তাবড় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি স্থানীয়, ছোট ব্র্যান্ডের মধুর নমুনাও পরীক্ষা করে হয়েছে। মোট ২২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে মাত্র ৫ জন। এই তথ্য জানার পরে কেউ যেন ঘাড় ধরে মধুর মাধুর্য ফিকে করে দেয়। মধুর ধ্বনি বাজে না আর।

জানা গিয়েছে, প্রথমে এনডিডিবি অর্থাৎ জাতীয় ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ডে এই মধুর নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হলে প্রায় প্রতিটিই ক্লিনচিট পেয়ে যায়। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা শিক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়ার আগে হেড এগজামিনার শিক্ষকদের বলেন, নম্বর কাটবেন না। যতটা পারবেন, বেশি করে নম্বর দেবেন। অনুমান করা যায়, এটাই সরকারি নির্দেশ। পাশের হার বেশি করে দেখানোর এক সুপ্ত ইচ্ছে। ওই হারের বাৎসরিক গ্রাফ জানান দেয়, দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি। ঠিক এমনই সুপ্ত ইচ্ছে হয়তো এ ধরনের নমুনা পরীক্ষা করানোর সময়ও জারি থাকে, সরকারি আদেশে। এই করোনাকালে সিএসই-র কেন ইচ্ছে জেগেছিল জানি না, সংস্থার কর্তারা ভেবেছিলেন, একবার দেশজ মধুর বিশ্বমানের পরীক্ষা করিয়ে দেখা যাক। এনএমআর অর্থাৎ নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স পরীক্ষাকে মধুর উৎকর্ষতার গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়। আমি রসায়নবিদ নই। তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না, চিরাচরিত পরীক্ষাগুলোর থেকে আরও অনেকটা গভীরে গিয়ে কোনও নমুনার গুণাগুণ যাচাই করতে পারে এই এনএমআর মাপকাঠি। নমুনা পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হল জার্মানির কেতাদুরস্ত ল্যাবে। টুকে পাশ করাই রীতি ছিল যে পরীক্ষার্থীদের, হঠাৎ করে এক কড়া পরিদর্শক হাজির হওয়াতে তারা পড়ে গেল ঘোর বিপদে। খাতা বাজোয়াপ্ত করা হল। মার্কশিটে পড়ল লাল দাগ। টেলিভিশনে যাদের বিজ্ঞাপন দেখে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছে মধুর গুণাগুণ, তাদের অধিকাংশই মুখ থুবড়ে পড়ল এমন পরীক্ষায়। আরশোলা উল্টে দেওয়ার পরে ওরা পা ছোঁড়ে যেমন, তেমন যুক্তির পর যুক্তি আসতে শুরু করল বিভিন্ন সংস্থার বোর্ডরুমের ঠান্ডা ঘর থেকে। তবে কোনও যুক্তিই ক্রেতার মনে আশার প্রলেপ দেয় না। সিএসই-র এক কর্তা অমিত খুরানা সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা যা বুঝতে পারলাম তা আমাদের বিচলিত করার পক্ষে যথেষ্ট। এটা দেখায়, খাবারে ভেজাল মেশানোর ব্যবসা এতটাই উন্নত হয়েছে যা আমাদের দেশজ পরীক্ষার মাপকাঠি ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। যে মধু খাচ্ছি তাতে ভেজাল রয়েছে এটা যত না বেশি চিন্তার, তার থেকে অনেক বেশি চিন্তার কারণ হল ভেজালটা আমরা ধরতে পারছি না।’ তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, এমন করে এই সুগার সিরাপ বানানো হয়েছে, যা আমাদের দেশের পরীক্ষা করার বেড়াজাল আরামে টপকে যেতে পারে।

গোড়াতেই যে লুকিয়ে রয়েছে এত বড় গলদ, তা জানার পরে সিএসই-র কর্তারা আরও অনুসন্ধান চালালেন। যত গভীরে যাওয়া হল, প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে শুরু করল তত বেশি। চিনা দ্রব্য বয়কট করা নিয়ে, ভারতকে আত্মনির্ভর করার জন্য বেশ কয়েক মাস ধরে আহ্বান করছেন দেশের শীর্ষমন্ত্রী। কিন্তু মধুর নমুনা বিদেশি লেন্সের নীচে পড়তেই পর পর উঠে এল বেশ কিছু চিনা সংস্থার নাম। দেখা গেল, এই সিরাপ আসলে আসছে চিন থেকে। সিএসই-র প্রশ্নের উত্তরে চিনা সংস্থার কর্তারা অকপট জানিয়ে দিয়েছেন, ফ্রুক্টোজ সিরাপ নামের এক মুখোশ পরিয়ে এই সিরাপ তারা ভারতে রপ্তানি করে আসছে গত কয়েক বছর ধরেই। গত চার বছরে ১১ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ফ্রুক্টোজ সিরাপ আমদানি করেছে ভারত। এই হাজার হাজার মেট্রিক টন সিরাপ আসলে যাচ্ছে কোথায়? প্রশ্নের উত্তর পেতে কষ্টা হয় না। চিনা সংস্থাগুলোর দাবি, কোনও মধুর ৫০-৮০ শতাংশও যদি আসলে এই সিরাপজাত হয়ে থাকে, তা হলেও ভারতীয় পরীক্ষায় মাপকাঠিতে এই মধু হাসতে হাসতে পাশ করে বেরিয়ে যাবে। ইংরিজিতে যাকে বলে, সাফল্য উইথ ফ্লাইং কালার্স।

চকচকে লেবেল আঁটা, দোকানের বাহারি শেলফ-এ স্থান পাওয়া মধুর শিশি কিংবা বয়ামও তো আজকের দিনে ব্র্যান্ডেড খাবার। প্রসেসড ফুড। অন্য যে কোনও ব্র্যান্ডেড খাবারের মতোই মধুর শিশির পিছনেও লেখা থাকে এফএসএসআই লাইসেন্স নম্বর। কোনও প্রক্রিয়াজাত খাবারের গায়ে এফএসএসআইয়ের তকমার মানে হল এই খাবার খাওয়ার জন্য নিরাপদ, অন্তত সরকারিভাবে। সিএসই-র এই রিপোর্টে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে এফএসএসআই। হয়ত এর সারবত্তা নিয়েও তাদের কর্তাদের কপালে ভাঁজ পড়েছে, ভুরু কুঁচকেছে। এর জন্য অবশ্য এনএমআর-এর পরীক্ষার ‘সত্যি’টা ছোট হয়ে যায় না। সাধারণ ক্রেতা হিসেবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যে লাইসেন্স নম্বরকে খাবারের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট হিসেবে মনে মনে মান্যতা দিয়ে এসেছি এত দিন, তা কি আসলে ফাঁপা ছিল? বেকুব বনে যাই প্রক্রিয়াজাত মধুর বাজারের পরিধি দেখে। ২০১৯ সালে ভারতবর্ষে প্রক্রিয়াজাত মধুর মার্কেট সাইজ ছিল ১৭৩০ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রতি বছর এই বাজার ফুলছে ১০ শতাংশ হারে। এভাবে চললে ২০২৫ সালে ৩০০০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে প্রক্রিয়াজাত মধু। এর মধ্যে কত কোটি মিছিমিছি জবরদখল করে নিল চিনা সুগার সিরাপ? উত্তর মেলা ভার।

মধু ভেবে এতদিন ধরে যা খেয়ে এসেছি, জানতে ইচ্ছে করে, তার কত হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যেই জলে দিয়েছি আমরা, সম্মিলিতভাবে? মনে প্রশ্ন জাগে, আজ কাঠগড়ায় মধু। কাল? কাকে জিজ্ঞেস করব, ‘স্যার, মধু তো না হয় হল, অন্য খাবারদাবারের পরীক্ষায় বিশ্বমানের নিরিখে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা?’ ইওরোপ আমেরিকায় যেভাবে গুণমান পরীক্ষা করা হয় একটা বিস্কিটের, কিংবা এক প্যাকেট হলুদগুঁড়োর, সেভাবে আমাদের দেশে পরীক্ষা হবে কবে? সিঁদুরে মেঘ দেখে ভাবি, যে খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের বেবিফুড জলে গুলে সকাল সন্ধে মুখে তুলে দিচ্ছি আমার দুবছরের শিশুকে, তা নিরাপদ তো? ওর গায়েও তো বীর বিক্রমে দাঁড়িয়ে রয়েছে এফএসএসআই নম্বর, দেশলাইকাঠি দিয়ে তৈরি করা স্ট্যাচুর মতো।

খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকচিক্যের গয়নাগুলো দূরে সরিয়ে রেখে কিছুটা বদলানোর প্রয়োজন আছে আমাদেরও। যে মধু খাঁটি, তা ক্রিস্টাল হয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু আমরা তা পছন্দ করি না। খাঁটি এবং প্রক্রিয়া না করা মধুতে মিশে থাকতে পারে ফুলের পরাগের গন্ধ। দামি গ্লিসারিন সাবানের মতো স্বচ্ছ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি খাঁটি মধুতে। কিন্তু এগুলো আম আদমির না-পসন্দ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, জনগণের মন জোগানোর জন্যেও নানা জাদুর কাঠি ছোঁয়ানোর সুযোগ ও সাহস পায় সংস্থাগুলো। ক্রেতাদেরও অন্যরকম করে ভাবা প্র্যাকটিস করা জরুরি, সার্বিকভাবে ভালো থাকার জন্যই।

যে সংস্থাগুলোর মধুর গুণমান নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে, এ দেশে মধুর বাজারে তাদের সম্মিলিত শেয়ার ৯০ শতাংশেরও বেশি। একটা ক্লাসের সবাই যদি ফেল করে, তা হলে ‘প্রশ্ন বড়ই কঠিন ছিল’ ধরে নিয়ে সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়াই নিয়ম। না হলে উপরের ক্লাস যে ফাঁকা যায়! এ ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হবে।

হয়তো কেন, হবে। সময় বড় বলবান। এ খবরের রেশ বেশিদিন থাকে না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...