কৃষক আন্দোলন: নয়া-উদারবাদ এবং হিন্দুত্বের রাজনীতির কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ

বিক্রম সিং

 



সারা ভারত ক্ষেতমজদুর ইউনিয়নের সহসম্পাদক

 

 

 

 

 

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। উত্তর ভারতের এক শীতল দিন। লোকজন খোলা আকাশের নিচে স্নান করছেন। বৃদ্ধেরা দলে দলে বসে আছেন এদিকসেদিক। গল্প করছেন। গান গাইছেন। একদল মানুষ রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত। না, কোনও সাধারণ ভারতীয় গ্রামের কথা বলছি না। গত একমাস ধরে দিল্লির সিংঘু সীমান্তে এটাই কৃষকদের সাধারণ জীবনযাত্রা। এই সড়ক ভারতের একটা ব্যস্ততম জাতীয় সড়ক (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড)। দিল্লির সঙ্গে হরিয়ানা-পাঞ্জাব এবং জম্মু-কাশ্মিরের যোগসূত্র এই সড়ক। যে রাস্তাতে পুলিশ কোনও গাড়িকে ৫ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে দেয় না, সেই সড়কই গত একমাস ধরে কৃষকদের বাড়িঘর হয়ে উঠেছে। আর তাঁরা তাঁদের গ্রামের রুটিন জীবনযাত্রা এখানেও চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদস্তুর। শুধু এটাই নয়। আরও যে পাঁচটি জাতীয় সড়ক দিল্লিকে অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, সেগুলোরও একই অবস্থা। সিংঘু সীমান্ত ছাড়া কৃষকরা বসে আছেন টিকরি সীমান্তে। যে সীমান্ত দিল্লিকে রোহটাক এবং পাটিয়ালার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। দিল্লি-মীরাট সংযোগরক্ষাকারী গাজীপুর সীমান্তে। দিল্লি-মথুরা সংযোগরক্ষাকারী পালওয়াল সীমান্তে। পরের দিকে কৃষকরা দিল্লি-জয়পুর জাতীয় সড়কের শাহজাহানপুর সীমান্তেও অবস্থান শুরু করেছেন।

একটা বিষয় প্রথমেই স্পষ্ট করে দেওয়া যাক, কৃষকেরা কিন্তু স্বেচ্ছায় দিল্লি অবরোধ করেননি বা জাতীয় সড়কে ধর্নায় বসেননি; বিজেপি-শাসিত কেন্দ্র সরকারই তাঁদের এইভাবে খোলা আকাশের নিচে শীতে রাত কাটাতে বাধ্য করেছে। কৃষকেরা রাজধানীতে আসছিলেন দেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে। বধির সরকারকে জানাতে আসছিলেন তাঁদের দুর্দশার কথা। জানাতে আসছিলেন যে এই তিনটি কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল ২০২০ চাষিদের জীবনে কী ভয়াবহ সঙ্কট নামিয়ে আনবে৷ তাঁরা সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এই অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত ‘উপহার’ (অবশ্যই কর্পোরেটদের বহু-আকাঙ্খিত) ফিরিয়ে দিতে আসছিলেন। কৃষকরা দেশবাসীর সামনে শাসকের আসল মুখটা উন্মোচিত করতে চাইছিলেন— যে সরকার বাজার ও তার কর্পোরেট প্রভুদের আজ্ঞা মেনে দেশের বিপুল সংখ্যক কৃষিজীবী ও সাধারণ মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলতে দ্বিধাবোধ করে না। গণতন্ত্রে, সাধারণ মানুষের অধিকার আছে তাদের সমস্যা ও দাবিদাওয়ার কথা নির্বাচিত সরকারের কাছে তুলে ধরার, এবং সরকারের দায়িত্ব সেইসব অভাব-অভিযোগের কথা শোনা৷ কয়েক লক্ষ চাষি দিল্লিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, কোভিড-১৯ অতিমারি ও নিয়ন্ত্রিত পরিবহনের জন্য অনেকেই সেখানে পৌঁছতে পারেননি, কিন্তু সারা দেশের কোটি কোটি কৃষক নিজের নিজের রাজ্যে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

অভূতপূর্ব সংগ্রাম

এই আন্দোলন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বৃহত্তম গণ-আন্দোলন। লক্ষ-লক্ষ কৃষক তাঁদের জীবন-জীবিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে সামিল হয়েছেন। সমস্তরকম প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাঁরা তাঁদের প্রতিজ্ঞায় অটল, এবং উদ্দেশ্যে অবিচল। প্রবল শীতের মধ্যেও তাঁদের দৃঢ় অবস্থান, দৃপ্ত পদক্ষেপে ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়া, পূর্ণ উদ্যমে স্লোগান, এবং সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস ইতিমধ্যেই সারা দেশের মানুষকে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু আরও বেশি অনুপ্রেরণার বিষয় কৃষকদের অসীম ধৈর্য ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দেশের যুবসমাজ কৃষি ও জমির সমস্যার বিষয়ে পারতপক্ষে আগ্রহী নয়— এই প্রচলিত মিথ ভেঙে বিশাল সংখ্যক যুবকরা আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, এবং সুধু সামিলই না, যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, তাঁরা যথেষ্টই দায়িত্ববান, দেশের কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমত ওয়াকিবহাল, এবং কৃষকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। আরও যে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ— প্রতিবাদকারীরা সরকারি নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের ক্রোধ ও উষ্মাপ্রকাশে সোচ্চার হলেও, পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক প্ররোচনা সত্ত্বেও একবারের জন্যও হিংসার আশ্রয় নেননি। তাঁদের লড়াই প্রতিদিন আরও গতিসঞ্চয় করছে, শক্তিশালী হয়ে উঠছে, প্রতিদিনই আরও কৃষক আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র থেকে প্রায় তেরোশো কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হাজার-হাজার কৃষক হরিয়ানার সীমানায় এসে পৌঁছেছেন। দিল্লির আশেপাশের প্রায় শ খানেক গ্রামের মানুষ কৃষকদের সহায়তায় যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাতেই আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। অবস্থানরত কৃষকদের জন্য শাবসবজি, দুধ, আটা, জ্বালানি কাঠ, গরম জামাকাপড় সমেত সবরকম প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করছেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। এরই পাশাপাশি, ছাত্র-যুব-মহিলা-চাকুরিজীবী-কারিগর-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-ডাক্তার-উকিল-আইনজীবী সমেত সমাজের সমস্ত অংশের মানুষ কৃষকদের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

কৃষকসমাজের মৃত্যুঘণ্টা

চাষিদের উপর তিনটি কৃষিবিলের প্রভাব নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে৷ তাই আবার তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। খুব সংক্ষেপে এটুকু বলে দেওয়া যাক— পুরো কৃষিক্ষেত্রই আজ আক্রমণের মুখে। শুধুমাত্র কর্পোরেটের লাভের কথা চিন্তা করে তাকে এমন একটা নতুন আকার দেওয়ার চেষ্টা চলছে যাতে চাষিরা পুরোপুরি বাজারের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন৷ আইনগুলি চাষিদের কৃষিব্যবসায়ী, বৃহৎ খুচরোব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারীদের মুখাপেক্ষী করে তুলবে। এই আইনগুলি কৃষিবাণিজ্যে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের উপর থেকে সব নিয়ন্ত্রণ তুলে নিচ্ছে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরেও এই আইনগুলি সরাসরি আঘাত করছে। কৃষি রাজ্যের বিষয়, কিন্তু এখানে রাজ্য সরকারগুলিকে গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না।

বেশিরভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যম প্রচার করছে এই আইনগুলি নাকি চাষিদের ‘স্বাধীনতা’ এনে দিল যার সাহায্যে তাঁরা যে কোনও উৎপাদিত পণ্য যেকোনও জায়গায় বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে, এই আইনগুলি আসলে কর্পোরেটদের ‘স্বাধীনতা’ দিল যে তারা চাষির যে কোনও উৎপাদন যে কোনও মূল্যে ও যে কোনও জায়গা থেকেই কিনে নিতে পারবে। গোটা ব্যবস্থাটা এমনভাবেই কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী বানানো হচ্ছে যে কৃষকেরা পণ্য বিক্রি করে উপযুক্ত দাম পাবেন না। সর্বোপরি, এই আইনে কোথাও লেখা নেই যে এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কম দামে কৃষিজ পণ্য কেনা যাবে না। চুক্তিচাষে কৃষিজ পণ্যের ওপর কর্পোরেট সংস্থার মনোপলি জারি হবে। দেশের কৃষকদের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে চুক্তির শর্তগুলি সর্বার্থে স্পনসরকে সুবিধা দেবে। দেশের বেশিরভাগ চাষিই ভূমিহীন ও প্রান্তিক। এই আইনে তাঁদের অসহায়তা বাড়বে। এই নিয়ে সিভিল কোর্টে কোনওরকম মামলাও করা যাবে না। অর্থাৎ কোনও দিক দিয়েই এই আইন স্পনসরদের সুবিধে দিতে কসুর করবে না। শেষমেশ, এই আইনগুলি কৃষকদের চিরকালের মতো দাসে পরিণত করবে। কৃষকদের ফসল ফলাতে হবে কৃষি-ব্যবসায়ীদের চাহিদা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী। আর সেগুলি নিশ্চিতভাবেই রপ্তানিযোগ্য ফসল হবে, কারণ তাতেই কর্পোরেটদের সর্বোচ্চ মুনাফা হতে পারে।

তাছাড়া অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের (ECA)-র সংস্কার খাদ্যশস্য, ডাল, তেল, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদিকে অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে খাদ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে সঙ্কট তৈরি হবে শুধু তাই না, বরং এই আইনের বলে ব্যবসায়ী ও কৃষি-বণিকদের চাষির থেকে সরাসরি অঢেল পণ্য কিনে নিতে ও মজুত করতেও সাহায্য করবে। এমনকি সঙ্কটময় কোনও অবস্থাতেও।

কৃষিশ্রমিক এবং ভাগচাষিদের ওপর প্রভাব

এই কৃষি আইন তিনটি কিন্তু শুধু কৃষকদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কৃষিশ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। এটা পরিষ্কার যে এই আইনগুলি কার্যকর হলে কৃষিক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা আরও কমে যাবে। বীজ, সার, কীটনাশকের মতো কৃষি-উপকরণগুলিতে কৃষকরা আর সরকারের সহায়তা পাবে না। সরকার আরও বেশি জোর দেবে চুক্তিচাষের ওপর। চুক্তিচাষ সাধারণভাবে বড় কৃষকদের জন্য উপযোগী। কিন্তু সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকলে ক্রমশ মাঝারি বা গরীব কৃষকদের ওপর চাপ বাড়তে থাকবে, তাঁদের অল্পস্বল্প জমিগুলিও চুক্তিচাষে দিয়ে দেওয়ার জন্য। এর প্রভাব পড়বে সরাসরি কৃষিশ্রমিকদের ওপর। কৃষিতে যত কর্পোরেট অনুপ্রবেশ ঘটবে, তত যান্ত্রিকীকরণও ঘটতে থাকবে, যার ফলশ্রুতি হিসেবে কৃষিশ্রমিকদের কর্মদিবস অনেক কমে যাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চুক্তিচাষে প্রাইভেট কোম্পানি বা কর্পোরেটের লক্ষ্য থাকবে নিজেদের মুনাফা বাড়ানো। আর এই মুনাফা বাড়ানোর সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হল শ্রমের পেছনে খরচ কমানো। ফলে, বড় বড় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। কর্মহীন হতে থাকবেন কৃষিশ্রমিকরা।

কৃষকপরিবার থেকে আসা ভাগচাষিরাও বিপদে পড়বেন, কারণ চুক্তিচাষ শুরু হলে তাঁরা চাষের জমি পাবেন না। বড় কর্পোরেটগুলি একচেটিয়া চাষ করবে এবং তারাই জমিমালিক ও চাষিদের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করে নেবে।

স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাবিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি  হল উৎপাদনের সার্বিক খরচ। C2+50 পদ্ধতিতে তা পরিমাপ করা হয়, মজুরদের পারিশ্রমিক ধরে। এই হিসেব করার সময় সরকারকে অবশ্যই ক্ষেতমজুরদের মজুরিকে হিসেবে ধরতে হবে, এবং সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির হিসেবে৷ এখনও পর্যন্ত, যখন কৃষকরা নিজেরাই ন্যুনতম সহায়ক মূল্য পাচ্ছেন না এবং মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সবারই অবস্থা দুর্বিষহ, তখন তাঁদের পক্ষে মজুরদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার উলটো দাবি করলেও বর্তমান আইনে এমএসপি-র কোনও আশ্বাস নেই। এই আইন কৃষির বাজারকে চিরকালের জন্য বদলে দেবে। এমএসপি-তে ফসল সংগ্রহ আরও কমে আসবে। বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। সুতরাং এমএসপি পাওয়ার জন্য চাষিদের লড়াই, এমএসপি-তে ফসল সংগ্রহের অধিকার নিয়ে আন্দোলন আর ন্যুনতম মজুরির আন্দোলন আলাদা নয়। তার ফলে চাষি ও কৃষকদের বর্তমান কৃষি আন্দোলন ইস্যুভিত্তিক শক্তি পাচ্ছে৷

গণবণ্টন ব্যবস্থা এবং খাদ্য-নিরাপত্তা

জমির মালিকানা না-থাকার এবং রোজগারের রাস্তা অতি সীমিত হওয়ার কারণে গ্রামের গরিব মানুষকে প্রায়ই সমাজ-উন্নয়নমূলক সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই সরকারি প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হল গণবণ্টন বা রেশন-ব্যবস্থা। উদারনৈতিক আর্থিক নীতি প্রবর্তনের পর থেকেই এই সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি, বিশেষত গ্রামীণ মানুষের উন্নয়নে নিয়োজিত প্রকল্পগুলি ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। গত ২৫ বছরের উদারনীতির জমানায় এই নয়া আর্থিক নীতির বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করেছেন গ্রামীণ কৃষকরা। সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থাকে ইতিমধ্যেই সর্বজনীনতার আওতা থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। ফলে গ্রামের বিশাল সংখ্যক মানুষ এই পরিষেবার থেকে দূরে সরে গিয়েছেন, সেই সঙ্গে চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত হয়েছে গরিব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি-সুরক্ষার প্রশ্নটিও। ফলে, ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি-এ আইটি সেল-এর নিরন্তর অপপ্রচার সত্ত্বেও, এ-কথা বুঝতে সাধারণ মানুষের কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না যে, সরকারের খাদ্যশস্য কেনার প্রক্রিয়া নয়া কৃষি আইনের ফলে কী ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রত্যাশিতভাবেই, উদার অর্থনীতির ধ্বজাধারী নীতিপ্রণেতারা একাধিক মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ক্রমাগত নয়া কৃষি আইনের পক্ষে ওকালতি চালিয়ে যাচ্ছেন। আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, এই আইনগুলি প্রত্যাহৃত হলে সাম্প্রতিককালে কার্যকর হওয়া আরও বেশকিছু আইন এবং কর্পোরেট-গোষ্ঠীর স্বার্থবাহী সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা অন্যান্য প্রস্তাবিত বিলগুলি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যও জনসাধারণের চাপ ক্রমশ বাড়বে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, সরকার যেভাবে ক্রমে এপিএমসি আইনকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে নিজে খাদ্যশস্য না-কিনে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ফসল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করে চলেছে, তাতে অনতিদূর ভবিষ্যতে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষার ওপর বিপজ্জনক প্রভাব পড়বে এবং তা হবে গণবণ্টন ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করার সামিল।

সরকারের খাদ্যশস্য কম কেনার অর্থ তার হাতে খাদ্যশস্যের পরিমাণ কমে যাওয়া। তার ফলে নিশ্চিতভাবেই খাদ্যের বদলে সরাসরি অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য তদবির শুরু হবে। আমরা জানি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের নেতৃত্বে অনেক আন্তর্জাতিক পুঁজিপতিদের সংস্থাই ভারতের ওপর তার এই গণবণ্টন ব্যবস্থা বন্ধ করার বা তাতে ভর্তুকি কমানোর জন্য চাপ বাড়াচ্ছে। এই খাদ্যের বদলে নগদ অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা ভারতের বেশকিছু রাজ্যে ইতিমধ্যেই ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে। গ্রামীণ গরিব মানুষদের কাছে গণবণ্টন ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা সাধ্যমত দামে খাদ্যশস্য কিনতে পারেন এবং সঙ্কটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন।

আমাদের দেশে গণবণ্টন ব্যবস্থা কার্যত খাদ্যনিরাপত্তার এক সমার্থক শব্দ। ফলে একটা দুর্বল গণবণ্টন ব্যবস্থা এবং খাদ্যশস্যের বদলে অর্থ প্রকল্প আমাদের মতো দেশে যেখানে প্রতি চারটি শিশুর একজন অপুষ্টির শিকার এবং সন্তানসম্ভবা সমস্ত মহিলাদের অর্ধেকই অ্যানিমিয়া আক্রান্ত সেখানে একটা বিপর্যয় ডেকে আনবে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র ২০১৫-১৬র ডেটা অনুযায়ী ভারতের ৩৬ শতাংশ শিশুই আন্ডারওয়েট এবং ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সের ৫৮ শতাংশ শিশুই অ্যানিমিক। এই আইনগুলি পুরোদস্তুর বলবৎ হয়ে গেলে গণবণ্টন ব্যবস্থাটাই চিরতরে বদলে যাবে। ভারত, আজ যা আছে, তার চেয়েও বেশি অপুষ্টিতে ভুগতে থাকবে।

চুক্তি চাষ শুরু হলে, খাদ্যশস্যের চেয়েও অর্থকরী ফসল বা যা চাষ করলে রপ্তানির সুযোগ বেশি তেমন শস্য চাষ করার দিকে চাপ বাড়বে, কারণ তাতে মুনাফার সম্ভাবনা বেশি। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। আমাদের দেশে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় জলবায়ু অঞ্চল রয়েছে, উর্বর ও বৈচিত্রপূর্ণ মৃত্তিকা রয়েছে যা বিভিন্ন ধরনের চাষের উপযোগী, যা পশ্চিমের প্রধানত শীতল তাপমাত্রায় সম্ভব নয়। এই সমস্ত দেশগুলি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে যাতে আমাদের দেশ খাদ্যশস্যের চাষ থেকে এই জাতীয় অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চাষের দিকে সরে আসে। কৃষকদের বড় বড় স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে যে তারা এই ধরনের চাষ শুরু করলে কৃষি বিনিয়োগ থেকে অনেক বেশি মুনাফা করতে পারবেন। এগুলি শুনতে গালভরা হলেও, এই বিশ্বায়িত ভুবনে, খাদ্যশস্যের জন্য বৈদেশিক আমদানির ওপর নির্ভর করে থাকা ভারতের পক্ষে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এই পদক্ষেপ আমাদের আভ্যন্তরীণ খাদ্যসুরক্ষাকে অনিশ্চয়তার মুখে এনে দাঁড় করাবে। আমরা আবার প্রাক-সবুজ বিপ্লব যুগের ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করার তিক্ত অভিজ্ঞতার দিনগুলিতে ফিরে যাব।

খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধি

কালোবাজারি করে মজুতদারদের মুনাফা বহগুণ বাড়িয়ে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে— অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংশোধনী সেই কালোবাজারিকে একপ্রকার ছাড়পত্র দিয়ে দিল। এই আইনে বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও হাত থাকবে না, যদি না যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি বা অত্যন্ত গুরুতর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ সাধারণ অবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতেও সরকার আর কোনওরকম হস্তক্ষেপ করবে না৷ অন্য কথায় বললে, এই আইন উদ্যানজাত (হর্টিকালচারাল) পণ্যের ১০০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ও নষ্ট হবে না এমন (non-perishable) কৃষিজ পণ্যের ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিকে আইনসিদ্ধ করে দিল। অতএব অতিরিক্ত মুনাফা করার জন্য বিপুল পরিমাণ পণ্য মজুত রেখে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা ও তার ফলে উদ্ভুত মূল্যবৃদ্ধি ভবিষ্যতে জনগণের এক বিপুল অংশকে অভুক্ত রাখবে। আর আগেই বলেছি, তা থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য আর কোনও গণবণ্টন ব্যবস্থাও থাকবে না। সাধারণভাবে আগের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন চালু থাকাকালীনই আমরা দেখেছি যে মূল্যবৃদ্ধির সময় পেঁয়াজ, টমেটো, এবং ডালসহ নানা জরুরি খাদ্যবস্তুর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গরিব মানুষ মাসের পর মাস সেগুলি কিনতে পারেন না। আর আজ যখন খাদ্যদ্রব্যের গোটা বাজারটাই সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত করে দেওয়া হচ্ছে, তখন গরিবের দুরবস্থা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে অক্ষমতাই আগামী দিনে ‘নিউ নর্মাল’ হতে চলেছে।

জমির প্রশ্ন

কৃষির এই কর্পোরেটায়নের ফলে জমির প্রশ্নটি এখন আরও ভিন্ন মাত্রা নেবে। ইতিমধ্যেই কৃষকরা কর্পোরেটদের কাছে নিজেদের জমি হারানোর আশঙ্কায় রীতিমতো আশঙ্কিত। আমরা সেই আশঙ্কাকে যদি গুরুত্ব নাও দিই, তাহলেও এই যে লাখো লাখো ভূমিহীন কৃষক আজও একটুকরো জমির স্বপ্ন দেখেন, যদি কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট হাঙর-কুমিরদের ব্যাপক মাত্রায় আবির্ভাব ঘটতে থাকে তাহলে তাঁদের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। স্বাধীনতার সময় ভূমিহীন এই কৃষকদেরই জমির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের সেই জমি না দেওয়া তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার এক বড় হাতিয়ার এখনও শাসকশ্রেণির কাছে। গত ২০ বছরে আমরা ভূমিসংস্কারের এক বিপরীত প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছি। ভূমিহীন কৃষকদের (০.০১ হেক্টরও জমি নেই এমন) সংখ্যা এই সময়কালে ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৯ শতাংশ হয়ে গেছে। ৫৮ শতাংশ দলিতই এখনও ভূমিহীন— পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন। জমির দাবিতে অসংখ্য আইনি সংগ্রাম চলছে। সেইসব সংগ্রামে ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকদের সরকারি আধিকারিক, বন দপ্তরের আধিকারিক, জমির মালিক এবং জঙ্গল মাফিয়াদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু এখন কৃষিতে কর্পোরেটদের জমানা শুরু হলে এই লড়াইগুলো কর্পোরেটদের বিরুদ্ধেই হবে। এবং আরও অনেক কঠোরতা হিংস্রতা ও নৃশংসতার মোকাবিলা করতে হবে ভূমিহীন কৃষকদের।

শেষ কথা

আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যখন ভারতবর্ষে বেকার এবং ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা তীব্রগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি আমাদের বারবার সতর্ক করছে অদূর ভবিষ্যতেই প্রচুর অনাহারে মৃত্যু ঘটতে চলেছে বলে। ফলে আমাদের এখন প্রয়োজন কৃষিক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা, কৃষিক্ষেত্রের প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্য একটা ব্যাপক সরকারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, কৃষিজাত দ্রব্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা এবং ফসল কেটে নেওয়ার পর এর বর্জ্য যতসম্ভব কম হয় যেন সে ব্যাপারে পরিকাঠামো গড়ে তোলা। এতে একদিকে যেমন কৃষকদের উপার্জন বৃদ্ধি পেত তেমনি অন্যদিকে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা সুনিশ্চিত হত। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এই সঙ্কটগুলিকেই সুযোগ ঠাওরালেন। তারা কর্পোরেটদের এবং বিদেশি পুঁজিকে আমাদের কৃষিক্ষেত্রে আহ্বান করে নিয়ে আসার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন যেন তারা আরও বেশি করে আমাদের কৃষিক্ষেত্রকে শুষে ছিবড়ে করে দিতে পারে।

কৃষকদের এই আন্দোলন বিজেপি এবং তার সহযোগীদের মুখোশ একেবারেই খুলে ফেলে দিয়েছে। একইসঙ্গে এই আন্দোলন হিন্দুত্বের যে রাজনীতি— জনগণকে ধর্ম এবং জাতের ভিত্তিতে ভাগ করে রাখো— তার দিকেও একটা শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণ ধর্ম-জাত-রাজ্য-রাজনৈতিক আনুগত্য নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে। বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাও— এটাই এই সংগ্রামের সারবস্তু।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...