সৌমিত্র ঘোষ
রাজনৈতিক কর্মী, পরিবেশ কর্মী ও গবেষক
জলবায়ু-সঙ্কট ও মুক্তির উপায়
মাসকয় আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সমাধা হল, ট্রাম্প হারলেন, বাইডেন জিতলেন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্বজোড়া রাষ্ট্রনায়কবৃন্দ, বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ারকুল, কলামনিস্ট ও এনজিওসকল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, যাক, পৃথিবীটা বেঁচে গেল এ যাত্রা। পৃথিবী কেনই বা মরে যাচ্ছিল, কেনই বা বাঁচল? ট্রাম্প বাইডেনের জেতা-হারার সঙ্গে পৃথিবীর মরাবাঁচার সম্পর্ক কী? তা বুঝতে হলে জলবায়ু বদল ও বিশ্ব উষ্ণায়ণ ইত্যাদি নিয়ে গত তিন দশক ধরে যে ‘বৈশ্বিক’ (মোদিজি উবাচ) সংলাপ চলছে, তাতে খানিক নজর দিতে হয়। তার আগে কিছু জানা কথা ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
জলবায়ু-বদল বিষয়ে তথ্য-সংগ্রহ ও তার ‘সমাধান’ নিয়ে কাজ করার জন্য অন্তত দুটি অন্তঃরাষ্ট্রিয় সংস্থা গঠিত হয়েছে, যথা আইপিসিসি (IPCC) বা ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, এবং ইউএনএফসিসিসি (UNFCCC) বা ইউনাইটেড নেশান ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। প্রথম সংস্থাটি জলবায়ু-বদলের প্রাকৃতিক ঘটনাটির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে, পরের সংস্থা কাজ করে জলবায়ু-পরিবর্তনের সমাধানকল্পে রচিত সন্ধি (যথা কিয়োটো কি পারি) রূপায়ণের জন্য। আইপিসিসি প্রদত্ত (আইপিসিসির বাইরেও এ নিয়ে কাজ করেছেন বহু বিজ্ঞানী, যথা আমেরিকার জেমস হানসেন) তথ্য মোতাবেক, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ক্রমশ বাড়ছে মূলত কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন সহ বিভিন্ন গ্রিন-হাউস গ্যাসের পরিমাণ (যে যে গ্যাস বায়ুমণ্ডলে জমে থেকে সূর্যের তাপকে ভূপৃষ্ঠে আটকে রাখতে সাহায্য করে, ফলে পৃথিবী হয়ে ওঠে এক উত্তপ্ত গ্রিন-হাউসের মতো)। বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ গ্যাস সেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে জমা হচ্ছে। মুক্তির উপায় কী? আইপিসিসি ও বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, বাতাসে কার্বন গ্যাস সহ সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাসের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা বজায় রাখতে হবে। কীভাবে তা সম্ভব? ১৯৯২-এ ব্রাজিলের রিও ডি জ্যানেরোর বিখ্যাত বসুন্ধরা বৈঠকে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন, রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু-বদল বিষয়ক সমিতি ইউএনএফসিসিসি-র জন্মও তখনই হয়। ঠিক হয়, গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে ছাড়ার পরিমাণ কম করতে হবে।
জলবায়ু-বাণিজ্য
কিন্তু, কীভাবে? করবেই বা কে? ১৯৯২ থেকে ঝগড়া-কাজিয়া চালিয়ে ঐকমত্য হয় না। ১৯৯৭-এ জাপানের কিয়োটোয় কিয়োটো সন্ধি সাক্ষরিত হচ্ছে, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া-সহ একাধিক দেশ এই সন্ধিতে সই করতে অস্বীকার করে। কিয়োটো সন্ধির মোদ্দা কথা ছিল যেহেতু বাতাসে বেশি কার্বন ছাড়ার জন্য শিল্পোন্নত দেশেরাই দায়ী, চুক্তি-সাক্ষরকারী ৩৮টি এইরকম দেশকে ২০০৮ থেকে ২০১২-র মধ্যে তাদের মোট গ্যাস নির্গমন গড়ে ৫.২ শতাংশ হারে (১৯৯০-এর নির্গমনমাত্রাকে বেসলাইন বা শুরুর মাত্রা ধরে) কমিয়ে ফেলতে হবে। কীভাবে এই ‘কমিয়ে ফেলাটা’ ঘটবে? কিয়োটো সন্ধি অনুযায়ী, শিল্পোন্নত দেশগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত কার্বন গ্যাস বাতাসে (কি সমুদ্রে, উদ্ভিদে) জমা করার ‘অধিকার’ পাবে। বলা হল, যেহেতু বায়ুমণ্ডল বিশ্বজনীন, পৃথিবীর সর্বত্র এই ‘কমানোর’ কাজটা করা যাবে। ইচ্ছা করলে শিল্পোন্নত দেশের শিল্পসংস্থারা নিজেদের শিল্পের বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেই (তেল-কয়লা পুড়িয়ে) নিজেদের কার্বন নির্গমন কম করতে পারবেন। তাঁরা উন্নয়নশীল বা গরিব দেশে কম-কার্বন (যথা কোনও লোহা কারখানায় এমন প্রযুক্তি বসানো যাতে বিদ্যুৎ কম লাগে) বা না-কার্বন (যথা বায়ুবিদ্যুৎ কি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন) প্রকল্প স্থাপনে পয়সা দেবেন। গরিব দেশের যে সব প্রকল্প এই পয়সা নিতে চায়, তারা কতটা কার্বন বাঁচল তার হিসাব সহ ইউএনএফসিসিসিতে আবেদনপত্র জমা দেবে। ‘বাঁচানো’ কি ‘কমানো’ কার্বনের হিসাবনিকাশ খতিয়ে দেখে প্রকল্পগুলিকে যে ‘কার্বন ঋণ’ মঞ্জুর করা হবে, তা বিশ্ববাজারে বেচে প্রকল্প করার খরচা উঠবে। অন্যদিকে যে সংস্থা ‘ঋণ’ কিনবেন, তাঁরা নিজেদের নির্দিষ্ট নির্গমনমাত্রায় কেনা ‘ঋণে’র সমানুপাতে ছাড় পাবেন। ধরা যাক, ইংল্যান্ডের আর্সেলর-মিত্তাল সংস্থাটির একটি নির্দিষ্ট কার্বন ছাড়ার পরিমাণ আছে। ভারতের বাজার থেকে উপযুক্ত পরিমাণে ‘কার্বন ঋণ’ কিনে এই পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি কার্বন ছাড়ার অধিকার তাঁদের জন্মাতে পারে। এই বাজারি ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন বাণিজ্য।
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো যে দেশ কিনা পৃথিবীর মোট কার্বন নির্গমনের সিংহভাগের জন্য দায়ী, তারা কিয়োটো চুক্তিতে সই-ই করেনি। ২০১৫-র পারি চুক্তিতে আমেরিকা সই করেছিল বটে, কিন্তু তাদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন না, ২০১৯-এর মাদ্রিদ ‘কপে’ আমেরিকা চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাইডেন এর ঘোর বিরোধী ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই আমেরিকা আবার পারি চুক্তিতে সই করবে, এমন শোনা যাচ্ছে। লোকজনের উৎসাহও সেকারণে বেশি।
কিন্তু, উৎসাহিত হবার কারণ আদৌ আছে কি? ২০০৭ নাগাদ আইপিসিসি তাদের চতুর্থ প্রতিবেদন পেশ করার পর দেখা গেল, বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেড়েই চলেছে, বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রাও। ২০১১-১২ নাগাদ পরিষ্কার বোঝা গেল, কার্বন ব্যবসার নামে খুলে আম ধাপ্পাবাজি চলছে, একই কার্বন ঋণ বিভিন্ন দালালি মানে ব্রোকারেজ কোম্পানির হাত ঘুরে দু-তিনবার বিক্রি হচ্ছে, তদুপরি জালি কনসালটেন্সি সংস্থাকে টাকা খাইয়ে, দূষণ হ্রাসের কাল্পনিক হিসেব তৈরি হচ্ছে। কার্বন ঋণ বিক্রি কমে গেল, বাজারে মন্দা। অথচ, ২০১৫-র পারি সন্ধিতে নাম বদলে সেই কার্বন বাণিজ্য ফিরে এল আবার। কিয়োটোতে ইউএনএফসিসি-র তরফে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর কার্বন/গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, পারিতে বলা হল, প্রত্যেক দেশ তার নিজের নিজের ক্ষমতা/সাধ্য অনুযায়ী কার্বন নির্গমন কমাবে। যা নির্গমন বা এমিশন হবে, সেটাকে অন্য কোনওভাবে কমিয়ে ফেলতে বা ‘অফসেট’ করতে হবে, যাতে ছাড়াকমা কাটাকাটি হয়ে গিয়ে মোট নির্গমন দাঁড়ায় ‘নেট জিরো’ বা নিট শূন্যে। ২৪-তম কপ সম্মেলনে এ বিষয়ে নিয়মকানুন তৈরি হবে, এমন ভাবা হচ্ছিল, হয়নি।
বায়ুমণ্ডলে ঠিক কত লক্ষ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস জমা হলে পৃথিবীর উত্তাপ ক ডিগ্রি বাড়বে, ডিগ্রিপিছু উষ্ণায়নের ধাক্কায় পৃথিবীর জলবায়ু ঠিক কতটা বদলাবে, সে হিসেবে ঢুকব না। এ বিষয়ে প্রচুর লেখাপত্র আছে, আগ্রহীরা ইচ্ছে করলেই পড়তে পারেন। দুই, নিছক বিজ্ঞান এবং সংখ্যাতত্ব দিয়ে জলবায়ু সঙ্কটকে বুঝে ফেলা যাবে না। উল্টে তথ্য/সংখ্যার কচকচানিতে মনে হতে পারে যে ব্যাপারটা সাধারণের বুদ্ধির অগম্য। গুটিকয় মুনাফাবাজ ক্ষমতাধর লোক/গোষ্ঠী এটাই চায়— লোকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় যথাক্রমে জীবিকাচ্যুত, উদ্বাস্তু, দরিদ্রতর ও নিশ্চিহ্ন হবে, অথচ কী হচ্ছে কেন হচ্ছে তা জানার উপায়টি থাকবে না।
মোদ্দা, জলবায়ু বিজ্ঞান নয়, রাজনীতি। বিদেশে, বিশেষ য়ুরোপে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে চর্চা হচ্ছে, সেখানে রাজনীতির বিষয়টা ঢুকেই পড়েছে। এমনকি স্কুলপড়ুয়াদের ডাকে যে ২০১৯ সালে যে বিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘট হল, তারও অন্যতম স্লোগান, ব্যবস্থাটা বদলাও, কার্বন পুঁজিবাদ খতম করো। জলবায়ু সঙ্কটের হাত থেকে বাঁচতে হলে, সঙ্কটের কারণগুলোকে তলিয়ে দেখা যে আগে দরকার, সে কথা উঠে আসছে বারবার। এ সময়ের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, ব্যবস্থাটাকে জায়গামতো রাখতে গেলে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণব্যবস্থা যে বিপন্ন হয়ে পড়বেই, এটা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অবিশ্যি, এই সব স্বীকার-অস্বীকার, জানা-বোঝার সবটাই আন্দোলনরত ও বিপদাপন্ন আমজনতার, পুঁজিব্যবস্থার মাথায় যাঁরা বসে থাকেন, সেই রাষ্ট্রনেতা ও কর্পোরেট কর্তাদের নয়। জলবায়ু রাজনীতি বলতে তাঁরা যা বোঝেন, তাতে ব্যবস্থাটা অক্ষুন্ন থাকে, এমন কি মুনাফা ও আধিপত্য বাড়ানোর নতুন তারিকা আমদানি হয়।
জলবায়ু-রাজনীতি, ভারতবর্ষ, উন্নয়ন
দেশের কথায় আসি। জলবায়ু-রাজনীতির একটা দিকে কার্বন ব্যাপার, অন্যদিকে দূষণের অধিকার কিম্বা ‘কমন বাট ডিফরেনশিয়েটেড’ দায়িত্ব। অর্থাৎ, ভারত সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, যেহেতু উন্নত দেশগুলির শিল্পটিল্প থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস বেরিয়ে বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে হয়ে এই বিপদ তৈরি করেছে, দায়টা সবচাইতে বেশি ওদেরই নিতে হবে। জলবায়ু-পরিবর্তন আমাদের “উন্নয়নের”, বা শিল্পায়নের পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। অতএব কোনও নির্দিষ্ট এবং বাধ্যতামূলক নির্গমন হ্রাসমাত্রা দেশ গ্রহণ করতে পারে না। ২০১৫-র পারি চুক্তিতে ভারতবর্ষ রাজি হয়েছে কেন না ওই চুক্তিতে কোনও আপত্তিকর ‘বাধ্যতামূলক নির্গমন হ্রাসমাত্রা’র কথা বলা নেই। দেশীয় কর্পোরেটকুল, বড় এনজিও, দেশের সংবাদমাধ্যমের মুখ্য অংশ, এবং বড় ছোট বামপন্থী দলও এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক।
ভারত সরকার প্রতিদিন নতুন কয়লা খনি খুলছেন, কয়লা উৎপাদনের জন্য নিয়ম করে বনজঙ্গল সাফ হচ্ছে। ২০১৯-এর গোড়ার দিকের সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দেশের কয়লা উৎপাদন ১৯৭০-এর গোড়ায় ৭ কোটি টন, ২০১৭-১৮ নাগাদ ৬৭ কোটি। ২০১৮-১৯, উৎপাদন বাড়ছে ৭.৯ শতাংশ। ভারতবর্ষের কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ২০১৮-র শেষাশেষি ইউএনএফসিসিকে দেওয়া সরকারি তথ্য মোতাবেক, ২০১০ নাগাদ ভারতের মোট কার্বন নির্গমন ২০০.১ কোটি টন, ২০১৪-য় তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২০০.৬ কোটি। ২০১৫-র সরকারি হিসেব বলছে, ভারতবর্ষের মাটির তলায় নিদেনপক্ষে ৩০০০ কোটি টন কয়লার ভাঁড়ার মজুত।
কয়লা থেকে না-কয়লা। ‘পরিচ্ছন্ন শক্তি’ বা ‘সবুজ শক্তি’ বলতে আপাতত বৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি, বা আরও বেশি ক্ষতিকর পরমাণুবিদ্যুৎ, নিদেনপক্ষে দৈত্যাকার হাওয়াকল, সৌরবিদ্যুৎ-এর কাঁচের ঘেরাটোপ। কোনওটাই বিস্তর মানুষকে বাস্তুচ্যুত (জমি, পশুচারণভূমি, বন দখল হতে থাকে) ও জীবিকাচ্যুত না করে সম্ভব নয়। এহ বাহ্য। জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য বাঁধ দেওয়া হয়, সেখানে জমা জল থেকে নিরন্তর মিথেন বেরোতে থাকে। জৈববিদ্যুৎ তৈরি করতে গিয়ে যথেচ্ছ দূষণ ছড়ানো হয়। সৌরবিদ্যুতের কাচের প্যানেল চালু রাখতে গেলে, চাষের কি দৈনন্দিন ব্যবহারের জলে টান পড়ে। দূষণের জন্য কুখ্যাত কর্পোরেটদের দখলে না-কয়লা না-তেল পুনর্নবীকরণযোগ্য প্রকল্পের বেশিরভাগ। যে আদানি কোম্পানির রোজগারের অধিকাংশ আসে খোলামুখ কয়লাখনি আর তাপবিদ্যুৎ থেকে, তারাই দেশের সবচাইতে বড় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদক। সুজলন, যারা হাওয়াবিদ্যুৎ উৎপাদনে পৃথিবীতে একনম্বর, দেশের নানান জায়গায়, স্থানীয় মানুষজনের জমিজিরেত ছলছুতোয় হাতিয়ে হাওয়াকল বসায়, টাটা, বাজাজ ইত্যাদি কর্পোরেটদের বেচে থাকে। সুজলন, আদানি, টাটা, আম্বানি, বিড়লা আদি মশহুর কর্পোরেটেরা কিয়োটো-পরবর্তী সময়ে জলবায়ু-সঙ্কটের সমাধানকল্পে দেদার সিডিএম (ক্লিন ডেভলপমেন্ট মেকানিজম) প্রকল্প করে কার্বন ঋণ কামিয়েছে ও বেচেছে।
জলবায়ু সঙ্কটের ভারতীয় রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রধান সমাধান, কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ। দ্বিতীয় সমাধান, কর্পোরেট মালিকানাধীন ‘সাফ’ শক্তির চাষ। বাকি থাকল বনজঙ্গল, যা নিয়ে খাসা ব্যাবসা হয়। ভারত সরকারের বক্তব্য, ভারতবর্ষের বন হচ্ছে ‘নেট কার্বন সিঙ্ক’, যেখানে কার্বন জমা হয়, জমা থাকে। সরকার উবাচ, ২০১৪-র যে কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ ২০০.৬ কোটি টন, তন্মধ্যে ভূমি-ব্যবহার, ভূমি-ব্যবহারের পরিবর্তন ও বন-সংক্রান্ত কাজ (Land Use, Land-Use Change and Forestry–LULUCF) থেকে গ্যাস বেরোনোর হিসেব ছিল না। কারণ ওই ক্ষেত্র (LULUCF) থেকে যা কার্বন বেরিয়েছে, জমা হয়েছে তার চাইতে বেশি। খরচের চেয়ে জমা বেশি, অর্থাৎ ‘নেট সিঙ্ক’। কেমন সিঙ্ক? কয়লা/তেল পুড়ে যে কার্বন বায়ুমণ্ডলে জমা হয়েছে, তার নিদেনপক্ষে ১২ ভাগ টেনে নিয়েছে দেশের বন, গাছপালা। কী কল! ২০১০-১৪ সময়পর্বে ভারতের কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ বাড়ছে ১৮ শতাংশ। তার মধ্যে ১২ শতাংশই যদি বনরূপী সিঙ্ক শুষে নেয়, রইল বাকি ছয়। এটা ২০১৪-র হিসেব। পরবর্তী হিসেবে দেখা যাবে কার্বন জমা ও খরচ বরাব্বর, নেট জিরো, অর্থাৎ যেটুকু কার্বন গ্যাস ভারত ছেড়ে থাকত, তাও ছাড়ছে না, অথচ উন্নয়ন বাবদ কয়লা/তেল পুড়ছে। ভারতের বনে কার্বন জমা হওয়ার মিথ্যা গল্প বিষয়ে বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতেরা হিসেব কষে দেখিয়েছেন, যে পদ্ধতিক্রম/তথ্যভিত্তি অনুসরণে বনে কার্বন জমা পড়ার ও জমা থাকার অঙ্ক, তাতে বিস্তর ভুল আছে। কোন ধরনের বন কী প্রাকৃতিক পরিবেশে/অবস্থায় কতটা কার্বন ধারণ করতে পারে, তার সর্বজনগ্রাহ্য ফরমুলা নেই। দেশজুড়ে বনধ্বংস চলছে, কিন্তু কতটা কার্বন বায়ুমণ্ডলে জমা পড়ছে, হিসেব নেই। রাষ্ট্র-অনুমোদিত বনধ্বংসের প্রক্রিয়ায় ১৯৮০ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ১৫ লক্ষ হেক্টর (১৫ হাজার বর্গকিমি) জঙ্গল পরিষ্কার, তন্মধ্যে ৫ লক্ষ খনিখাদানের জন্য। হিসেব ভারত সরকারের। ২০১৫ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ২০ হাজার হেক্টরেরও বেশি ঘন প্রাকৃতিক জঙ্গল সাফাই-এর জন্য সরকারি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন গ্যাসের পরিমাণ বাড়তেই থাকে— সাম্প্রতিক এক হিসেবে (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসেব), ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীর কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ বেড়েছে ২০ শতাংশ মতো। উষ্ণায়ণ বাড়ছে, জলবায়ু ওলটপালট। সরকারের চাঁইদেরও বলতে হচ্ছে, ক্লাইমেট চেঞ্জ হে বাপুসকল, কিচ্ছু করার নেই। উত্তরপ্রদেশে-মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ ছাড়িয়ে তেলেঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশ-তামিলনাড, খরা চলছে তো চলছেই। খরার পিঠে পিঠে বন্যা, অতিবৃষ্টি, ধস, ভূমিক্ষয়। গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, কেরালা। কেরলে পরপর দুবার বিধ্বংসী বন্যা। কত মানুষের ঘরবাড়ি জমিজিরেত ধুয়েমুছে গেল, বন্যা ও খরার ধাক্কায় কত মানুষ ঘর ছাড়ছেন, সঠিক হিসেব নেই। জর্মনওয়চ নামের এক সংস্থা প্রকাশিত ২০১৯-এর এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, খরা, তাপপ্রবাহ, বন্যা, অতিবৃষ্টি ও ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মারা গিয়েছেন ৭৩,২১২ জন, বছরপিছু গড়ে ৩,৬৬০ জন করে।
জলবায়ু-ধর্মঘট, প্রতিবাদের রাজনীতি
জলবায়ু-ন্যায় বা ক্লাইমেট জাস্টিস-এর দাবিতে গত তিন দশক ধরে পৃথিবীতে অসংখ্য প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। য়ুরোপে, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে প্রধান বামঘেঁষা রাজনৈতিক দলেদের অধিকাংশ ও গ্রিন পার্টির লোকজন মিছিলে হেঁটেছেন। বহু সামাজিক আন্দোলন ও ছোটবড় এনজিও ও সামাজিক সংস্থা সামিল হয়েছেন। সুইডেনের স্কুলপড়ুয়া গ্রেটা থুনবার্গ-এর আহ্বান, ২০১৮ থেকে শুরু করে হালের জলবায়ু-ধর্মঘট, মোটামুটি এই পরম্পরায়। যা ঘটেছে, একরকমের নয়। কিছু সরাসরি রাস্তার লড়াই, কয়লাখনি বা তেলখনির, এক দেশ থেকে অন্য দেশে তেল নিয়ে যাওয়ার জন্য বানানো পাইপলাইনের, প্রাকৃতিক বন/ঘাসজমি নষ্ট করে কার্বন জমা করবার জন্য দ্রুত-বাড়ের গাছ লাগানোর প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কপ ও শীর্ষবৈঠক কেন্দ্রিক প্রতিবাদের বেশিরভাগের উদ্যোক্তা এনজিও-রা, যদিও বেশ কিছু জায়গায় সামাজিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়নেরা অংশ নেন। সরকারি নীতি বদলের লক্ষ্যে কাজ করেছেন প্রধানত গ্রিন দলের লোকেরা।
পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার খানিক ফেরবদল করে, স্রেফ টাকা দিয়েই জলবায়ু-সঙ্কটের সমাধান হবে, এ কথা বলে যাচ্ছেন অনেকেই। যদিও হালের জলবায়ু-ধর্মঘটে কার্বন-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে, এ প্রশ্নের উত্তর নেই, কার্বন পুঁজির জায়গায় না-কার্বন পুঁজি হলে কি ফারাকটা হত? পুঁজির বা রাষ্ট্রের পক্ষে, রাষ্ট্রপুঁজির পক্ষে পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা কি আদৌ, কদাচ সম্ভব? আরও যা গুরুতর, দাবি উঠছেই, জলবায়ু জরুরি অবস্থা জারি করো। কে করবে? না রাষ্ট্রসঙ্ঘ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ কী? না বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলির মিলিত একটা পাঁচমিশেলি সংস্থা, বস্তুত যে ক্ষমতাহীন, সামরিক শক্তিধর জাতিরাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে কোন রাষ্ট্র কতটা কয়লা আর তেল তুলছে বা পোড়াচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য বা সামর্থ্য তার নেই। নেই কেননা জাতিরাষ্ট্রের পুরো ধারণা ও প্রকল্পটাই সামরিক, সামরিক ক্ষমতার মাধ্যমে পুঁজিবাদী স্থিতাবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখা তার প্রধান কাজ। না জাতিরাষ্ট্র না রাষ্ট্রসঙ্ঘ কারুর সাধ্য নেই পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা, ও প্রকৃতি লুঠের পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যকে ধাক্কা দেবার।
জলবায়ু-সঙ্কট নিয়ে রাস্তায় নেমে ক্ষমতাধর কোম্পানি ও সামরিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন যে আন্দোলনরত মানুষ, তারা এই ধাক্কাটাই দিচ্ছেন। ধাক্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সামরিক জাতিরাষ্ট্রের চৌহদ্দিতে আটকে ফেলার বিরুদ্ধে। ধাক্কা পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিকরণের প্রক্রিয়ায়, যেখানে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলি মুনাফাবৃদ্ধির কল। ধাক্কা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, যদ্বারা আদিবাসীদের, কৃষকদের, মৎস্যজীবীদের, হস্তশিল্পীদের উচ্ছেদ হতে হয় তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সম্বৃদ্ধির প্রয়োজনে। রাষ্ট্র ও পুঁজির আধিপত্যকে প্রশ্ন না করা গেলে জলবায়ু-সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও পুঁজির প্রভাবের আওতা থেকে না বেরোতে পারলে, প্রশ্ন করাও যাবে না।