জিনাত মহল
শিক্ষক, সমাজকর্মী
এদেশের ৭০ শতাংশ মানুষের পেশা চাষাবাদ হলেও “চাষা” শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চাষি বললে মানসচক্ষে ফুটে ওঠে দরিদ্র, অনাহারক্লিষ্ট, নির্বোধ, নিরুপায় এক মানুষের ছবি। প্রতিবাদ আন্দোলনে নয়, আত্মহত্যায় সে মুক্তির পথ খোঁজে। তাই দেশ যখন কৃষক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে মানুষ অবাক হয়ে যায়। কৃষকের সন্তানের পেটানো স্বাস্থ্য, জিন্স প্যান্ট, পিজ্জা খাওয়া বা ইংরেজি বলা নিয়ে বিদ্রূপ করে। অথচ আন্দোলনরত ৪০ জন কৃষকের মৃত্যুতে বিচলিত হয় না। আন্দোলনের প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করে না। প্রশ্ন তোলে না কৃষকের স্বার্থরক্ষাই যদি উদ্দেশ্য হয় তবে কৃষক সংগঠনগুলির দাবি সরকার মানছে না কেন? নিজের দেশের রাজধানীতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হল কেন কৃষকদের? মোদিজির ভাষায় “ঐতিহাসিক বিল” করোনাকে হাতিয়ার করে এরকম চুপেচাপে পাশ করানো হল কেন?
ভারতীয় কৃষক মাত্রই সম্পন্ন নন। তবে স্বাধীনতার পর থেকে ধীরগতিতে হলেও কৃষকসমাজের একটা অংশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। নিজেদের সামাজিক গুরুত্ব এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার ফলে কৃষকরা আন্দোলন সংগঠিত করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন। সম্পন্ন কৃষক এবং ভূমিহীন ক্ষেতমজুর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ভুলে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আন্দোলনের নেতৃত্বে দেখা যাচ্ছে প্রধানত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা চাষিদের। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সম্পন্ন কৃষকের সংখ্যা বেশি। বহু উচ্চশিক্ষিত তরুণ কৃষিকাজ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা খুব সহজেই নব্য কৃষি আইনের ক্ষতিকর দিকগুলি অনুধাবন করতে পারছেন। তাছাড়া এই দুই রাজ্যে কৃষক সংগঠনগুলি মজবুত। বাকি রাজ্যগুলিতে ছোট চাষিরা এমনভাবে সংগঠিত হতে পারেননি। কিন্তু ভয়ের বিষয় নব্য কৃষি আইনে সম্পন্ন কৃষকদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এই ছোট চাষিরাই।
তাই তাঁদের আন্দোলনমুখী করা কৃষক সংগঠনগুলির আশু কর্তব্য।
কৃষক সংগঠনগুলির মূলত যে তিনটি আইনের বিরোধিতা করছে— ১. The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020। এই আইন অনুসারে কৃষক সরকার পরিচালিত এপিএমসি মার্কেটের বাইরে সরাসরি কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে তার ফসল বিক্রি করতে পারবে। সরকারের বক্তব্য এই আইনের ফলে মন্দির লাইসেন্সপ্রাপ্ত ট্রেডারদের মনোপলি ধ্বংস হবে এবং কৃষককে মন্দির কমিশন দিতে হবে না, ফলে সে তার ফসলের দাম বেশি পাবে।
যদিও সব রাজ্যে এপিএমসি মার্কেট আশানুরূপভাবে গড়ে তোলা যায়নি। সরকার পরিচালিত এপিএমসি মার্কেটগুলির কার্যপদ্ধতি কৃষকবান্ধব ছিল। কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে এপিএমসি মার্কেটে নিয়ে যাবে। সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি সেখানে মিডলম্যানের কাজ করবে। অকশনের মাধ্যমে ফসলের দাম নির্ধারণ করা হবে। কৃষক যদি সেই দামে সন্তুষ্ট না হয় তাহলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সরকারকে সে ফসল বিক্রি করতে পারবে। সরকারি ট্রেডার বিক্রেতা কৃষকের কাছে ৬ শতাংশ এবং পাইকারি ক্রেতার কাছে ৬ শতাংশ কমিশন পাবে। ১২ শতাংশ কমিশন থেকে সে ২.৫ শতাংশ মান্ডিকে ট্যাক্স দেবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল লাইসেন্সপ্রাপ্ত ট্রেডারদের মনোপলি প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তাদের দ্বারা চাষিদের প্রতারণা। স্থানীয় দালাল, মান্ডি ট্রেডার ও মজুতদারের মধ্যে অশুভ আঁতাত গড়ে উঠল। দেখা গেল কৃষকের প্রাপ্ত দামের সঙ্গে খুচরো বাজারে ফসলের দামের আকাশপাতাল ফারাক। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা দেশের মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক পেতেন। মূলত পাঞ্জাব ও হরিয়ানার। এই কারণে বহুদিন থেকেই মান্ডি ব্যবস্থা সংস্কারের সঙ্গত দাবি উঠছিল কৃষক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে।
সরকারের নতুন আইনে বলা হচ্ছে মান্ডির লাইসেন্সপ্রাপ্ত ট্রেডারদের এড়িয়ে কৃষকরা সরাসরি কর্পোরেটকে ফসল বিক্রি করবে। শুনতে ভালো। কিন্তু কৃষকরা সমস্যার আশঙ্কা করছেন। মান্ডিতে অন্তত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কর্পোরেট ক্রেতা কীভাবে ফসলের দাম নির্ধারণ করবে তার নির্দিষ্ট কোনও গাইডলাইন নেই। একজন সাধারণ চাষি কর্পোরেটের সঙ্গে দরদাম করে ফসলের ন্যায্য দাম আদায় করে আনবে তা অলীক কল্পনা। দালাল ফড়ের দাপট কমাতে গিয়ে কর্পোরেটের দাপট বহুগুণ বাড়বে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা না থাকায় চাষির বঞ্চনা আরও বেশি হবে। চাষি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পেতে এপিএমসি মার্কেটে ফেরত যেতে চাইলেও পারবে না। মার্কেটগুলি চলে ট্রেডার্সদের ট্যাক্সের টাকায়। ট্রেডার্সদের ব্যবসা কমে গেলে কয়েক বছরের মধ্যে মার্কেটগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। এইসব নিছক কাল্পনিক চিন্তাভাবনা নয়। টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে জায়গা করে দেওয়ার পর কিভাবে অবিশ্বাস্য দাম কমিয়ে ছোট কোম্পানিগুলোকে শেষ করে দিয়ে এখন মার্কেট পুরোপুরি কন্ট্রোল করছে জিও। সরকারি বিএসএনএল বন্ধ হওয়ার মুখে।
সরকারের সত্যিই কৃষকদের পরিস্থিতি উন্নত করার সদিচ্ছা থাকলে মান্ডিব্যবস্থার সংস্কার ও প্রসার করত এবং দেশের সকল চাষি অন্তত নূন্যতম সহায়ক মূল্য যেন পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করত। কর্পোরেট মনোপলি প্রতিষ্ঠা করার সুবন্দোবস্ত সরকার করত না।
দ্বিতীয় আইনটি হল The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Act 2020। এই আইন অনুসারে পেপসিকো নেসলের মতো খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী কর্পোরেট সংস্থাগুলি কৃষকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি চাষের খরচ দেবে, চাষি বাধ্য থাকবেন সংস্থার নির্দেশমতো ফসল চাষ করতে। পরাধীন ভারতের নীলকর আইনের আধুনিক মোড়ক বলা যেতে পারে। এই আইনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হল চুক্তিবদ্ধ কর্পোরেট সংস্থা ও কৃষকের মধ্যে কোনও মতান্তর ঘটলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসট্রিক্ট কালেক্টরের মাধ্যমে ফয়সালা করা হবে। একজন সাধারণ গ্রামের চাষির পক্ষে আইএএস অফিসারের কাছে পৌঁছানো কতটা কঠিন গ্রাম বা ছোট শহরের প্রতিটি সাধারণ মানুষই জানেন। কৃষক সংগঠনগুলির বক্তব্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা না থাকলে কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া ক্রীতদাসপ্রথার নামান্তর। ইতিমধ্যে পেপসিকোর লেইজ কম্পানির ভারতে আলু চাষ সংক্রান্ত বিবাদের খবর একাধিকবার শিরোনামে এসেছে। এছাড়াও কৃষিবিজ্ঞানীরা মনে করছেন চুক্তিচাষের ফলে ফসলের বৈচিত্র্য কমবে। ফলে মাটির উর্বরতা কমবে এবং কৃষক পরিবারের সন্তানদের পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেবে।
তৃতীয় যে আইনের বিরুদ্ধে কৃষক সংগঠনগুলির লড়ছে তাতে কৃষকের বিপদ তো বটেই, সাধারণ মানুষের পাতে টান পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে বেশি। আগে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের মাধ্যমে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তৈলবীজ ইত্যাদি মজুত রাখার মাত্রা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। নতুন আইন অনুযায়ী উক্ত ফসলগুলি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। আর মজুত করার পরিমাণের উর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে।
তিনটি আইনের মাধ্যমে সরকারকৃষি ক্ষেত্রকে বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি চুক্তিচাষের মাধ্যমে চাষিদের দিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো ফসল চাষ করতে বাধ্য করবে, সরকার নিয়ন্ত্রিত এপিএমসি মার্কেট উঠিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো দামে ফসল কিনবে এবং ব্যাপক হারে মজুত করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে আকাশছোঁয়া দাম ফসল বেচবে। যেহেতু চাল ডাল আলু পেঁয়াজ তেল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে সেহেতু তার দাম নিয়ন্ত্রণ করার দায় সরকারের থাকবে না। মান্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে যে ফসল সরকার চাষির কাছ থেকে কিনত, আর রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে গরীবদের বিক্রি করা হতো। মান্ডি মার্কেট উঠে গেলে রেশনে স্বল্পমূল্যে খাদ্যসামগ্রী পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সকলের পাতে টান পড়বে।
নতুন কৃষি আইন আসার পূর্বে ছোট চাষি ও ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের অবস্থা ভালো ছিল তা বললে মিথ্যে বলা হবে। তিনটি আইন বাতিল করলে কৃষকরা দারুণ থাকবেন এমনও নয়। কিন্তু নব্য কৃষি আইন তাদের দুরবস্থা আরও ত্বরান্বিত করবে। প্রথম দুটি আইনের দ্বারা কৃষকরা সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তৃতীয় আইন দ্বারা প্রত্যেক দেশবাসীকে শোষণ করার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে।
কৃষকরা সাহস দেখিয়েছেন পুঁজিপতিদের দালাল ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার। কিন্তু এ লড়াই শুধু কৃষকদের লড়াই নয়, প্রত্যেক দেশবাসীর লড়াই। সরকারের পোষা প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো আন্দোলনের খবর এড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের জনগণকে ভুল ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে মৌখিক আশ্বাসবাণী ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। কৃষকরা কয়েক মাসের রসদ নিয়ে রাজধানীতে পৌঁছেছেন। তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত অন্দোলন ছাড়বেন না জানিয়েছেন। পুঁজিবাদের দালাল সরকার এত চাপের মুখেও পুঁজিপতিদের সুরক্ষিত রাখার আইন ফেরত নেওয়ার কথা ভাবছে না। এখন আমাদের মতো মানুষদেরও সময় এসেছে কৃষকদের পক্ষ নেওয়ায়। নিজেদের স্বার্থেই আপামর দেশবাসীকে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সরকার না দমলেও আন্দোলনের ফলে কিছু ইতিবাচক দিক উঠে এসেছে। দেশবাসীর একাংশ কৃষকদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। সর্বদা অবহেলিত কৃষিক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সাহিত্য ক্রীড়া ও জ্ঞানবিজ্ঞান জগতের ব্যক্তিত্বরা প্রতিবাদস্বরূপ সরকারি পদক ফেরাচ্ছেন। দেশের সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসীরাও কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল বের করেছেন। কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যান আলোচিত হচ্ছে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে শুধুমাত্র চাষের খরচের দেড়গুণ দাম কেন হবে, তার সঙ্গে স্বাস্থ্য ভাতা মহার্ঘভাতা কেন যোগ করা হবে না— এ প্রশ্নও উঠছে। অকৃষক গণসংগঠনগুলি— ছাত্রযুব, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী ইত্যাদি কৃষক আন্দোলনের পক্ষে পথে নেমেছে।
যে কোনও ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় একটি স্ফুলিঙ্গের। মানুষের বুকে জমতে থাকা ক্ষোভের বারুদে আগুন জ্বালাতে সেই স্ফুলিঙ্গ নিয়ে হয়তো হাজির হয়েছেন আমাদের দেশের কৃষকসমাজ। কৃষকদের হাত ধরেই আসবে আমাদের মুক্তি।