পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নাটা দেখছিল শ্রী। ডিমের মতো কাচ। কিনারা বেয়ে রুপোর আঙুরলতা উঠে গিয়েছে। মাথায় এককুচি পাথর। দেখলেই টিপ পরতে ইচ্ছে করে। কীসের পাথর কে জানে! সত্যিকারের চুনি হলে কি আর দেড় হাজারে দিয়ে দিত লোকটা? আয়নাটা বেশ। দেখতে দেখতে মন খারাপের জ্বর কমে যায়। ফোনের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করে না।
লোকটা এসেছিল গত পরশু। ফেরিওয়ালার মতো ভারী ব্যাগ ছিল না, তাই হয়ত দারোয়ান আটকায়নি। নেহাত মনটা একটু উস্কোখুস্কো ছিল তাই, শ্রী নইলে দু’হাতা গালাগালি দিয়ে দরজা থেকেই লোকটাকে বিদেয় করত।
—পুরনো দিনের সব জিনিস, বড় কিউরিও শপেও পাবেন না। যে যার ভাগ্যে ভোগ করে, বুঝলেন না?
লোকটা ঝোলা থেকে এক এক করে বের করে শিশুকাঠের কফি টেবিলের ওপরে রাখছিল। একটা ছোট্ট ফুটফুটে শাঁখ, হাতের তেলোর মতো বড় আংটি, ধুকধুকি, রুপোর মুঠ বসানো বাঁকা ছুরি মায় একটা হাতির দাঁতের পাইপ।
ছাব্বিশে জানুয়ারির কাঁচা দুপুর। ঘুম-ভাঙা চোখে থুম হয়ে দেখছিল শ্রী। আয়নাটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। দেড় হাজার শুনে আর দরদাম করেনি। না হয় করলই নিজেকে একটু তোয়াজ, কী যায় আসে।
লোকটা বাচাল নয়। আয়না গছিয়ে নিঃশব্দে কেটে পড়েছিল। শ্রীও সটান শুয়ে পড়েছিল ফের। মাঝরাতে আলপটকা ঘুমটা ভেঙে গিয়ে তিনটে মুশকিল হল। অংশুমানের মেসেজ। ঘুম গেল চটকে। গনগনে রাগ। মাথা ধরা। এমন একটা ঘ্যানঘ্যানে মাতৃপোষ্য ধেড়ে শিশুকেই পছন্দ হতে হল তার? জোরালো খিস্তিগুলো গুলিয়ে যাচ্ছিল রাগের চোটে। আয়নাটা কোলের কাছেই ছিল। গুনগুন শব্দ পেয়ে টেনে নিতেই— যা দেখল!
ন্যাকা অংশুমানের সাথে সম্পর্কটা এমনিই হয়ে এসেছে। মাকে ছেড়ে ও আসবে না। আর মহিলার কেন ঠিক এদের উইকেন্ড ট্রিপের আগেই শরীর থুড়ি মন বিগড়োল এখন তো জলের মতো পরিষ্কার। বাইপোলার ফোলার বাজে কথা। আঁচ করেছিলেন ছেলে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে। কেঁদেকেটে প্রেশার বাড়িয়ে এখন বিছানায় শুয়ে আছেন, ছেলে কপালে জলপটি লাগাচ্ছে। এভাবে কতদিন আর চলবে?
আয়না মিথ্যে বলছে না। মহিলা তালে আছেন ছেলের গলায় অন্য মেয়ে ঝোলানোর। বাড়ির বৌ হয়ে থাকবে। সেবা টেবা করবে। ছেলেও ভেড়া। মিনমিন না করলে মায়ের নাকি হার্ট অ্যাটাক হবে। উঠেই পড়ল শ্রী। একবার ঘুরে আসা যাক। হাজার হলেও হবু শাশুড়ি। কী হয়!
শ্রীকে দেখে অংশুমানের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। শুধু আয়ার ওপরে ভরসা করে মাকে রেখে যেতে পারছিল না বেচারি। বোন কলেজে। এদিকে ট্যাঁক ভাঁড়ে মা ভবানী। ব্যাঙ্কে না গেলেই নয়। শ্রীকে রেখে হনহন করে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা দুই লাগবে।
শ্রী বসে বসে আপেল খাচ্ছিল। মহিলা ভালো মুডে থাকলে ওকে দেখে মুখ হাঁড়ি করে থাকেন। খারাপ থাকলে তো কথাই নেই। শুয়ে শুয়ে আয়াকে হুকুম করলেন দুধ ঘন করে খই ভিজিয়ে আনতে। খাবেন।
একা হতে শ্রী’ই কথাটা পাড়ল।
—রঙ চাপা বলে আমাকে বৌ করবেন না? নাকি রাক্ষস গণ বলে?
ভদ্রমহিলা চিত হয়েছিলেন। কথাটা কানে যেতে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। শ্রী উঠে এল। এক হাতে আপেল আর একটা হাত ব্যাগের মধ্যে।
—ভালো করে দেখুন তো। আমাকে কি দেখতে খারাপ? হাতে ভর দিয়ে তেড়ে আসতে পারি? এমনি করে? দেখুন তো?
ভদ্রমহিলার মুখের ওপর ঝুঁকে আয়নাটা ফিরিয়ে ধরতেই শরীরটা ধড়ফড় করে উঠল। আধফোটা গোঙানি। ঝুঁকে থেকেই আপেলে আর একটা কামড় বসাল শ্রী। ছটফটানিটা স্থায়ী হল দেড় মিনিট মতন। আয়া খই দুধ নিয়ে এসে মহিলার একদিকে বেঁকে যাওয়া মুখ আর বিস্ফারিত চোখ দেখে হাউমাউ করে উঠল যখন শ্রীর ফসিল ঘড়িতে দশ মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে। আপেলটা ধীরেসুস্থে শেষ হয়েছে।
শ্রাদ্ধশান্তি মিটতে শ্রী নিজেই এ বাড়িতে উঠে এসেছে। অংশুমান কেঁদেই চলেছে। মাতৃশোক। বোনটাও কাঁদছে, তবে বেশি নয়। মেয়ে মায়ের উত্তরাধিকারী তো বটেই । শ্রীকে দেখলেই ঘাড় বেঁকে শক্ত হয়ে যায়। যেন তাতে কিছু আটকাবে।
বিয়ের দিনক্ষণ নিয়ে ডিনার টেবিলে আলোচনাটা চেয়েছিল শ্রী। কিন্তু বোনকে হোস্টেলে গিয়ে থাকার বায়নাটা তখনই জুড়তে হবে, আর দাদাটি তাই নিয়ে তুলকালাম চেঁচামেচি করে শেষে কান্নাকাটির সিন করবে এটা বুঝতে পারেনি।
হোস্টেলে থাকবে অংশুমানের বোন? যার প্যান্টিটাও বাড়ির কাজের লোক কেচে দেয়? রাত্রে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এল শ্রী। আয়নাটা নিয়ে বসতে হবে।
আয়না মিথ্যে বলে না। শ্রী দিব্যি দেখতে পেল ভাইবোনে গুজগুজ করছে।
—দাদা, তুই আমাকে দূরে পাঠিয়ে দে। লীভ অ্যান্ড লেট লিভ।
—ভালো চান্স পেলে যাবি না হয়। এত তাড়া কীসের তোর? সত্যি বল, শ্রী তোকে কিছু বলেছে? আমাকে বল।
—না কিছু বলেনি। বলার দরকার আছে? মা মরে যাবার দিন থেকে দেখছি। চোখে মুখে যেন উল্লাস ফেটে পড়ছে। কেমন করে তাকিয়ে থাকে তোর দিকে। আমার ভালো লাগে না রে।
—দেখ ও একটু শক্ত ধাতের মেয়ে। চট করে কাঁদতে পারে না। তার জন্য এমন ভুল বুঝিস না, প্লিজ।
—তুই বুঝবি না দাদা। তুই অন্ধ। মা ঠিকই বলত। কেন ওর ভরসায় মাকে ছেড়ে গেলি তুই?
—এবার তুই বাজে বকছিস। মার হার্ট অ্যাটাক হলে ও কী করবে? কোনও ঝগড়াঝাঁটিও হয়নি। মিনুদি তো বলল।
—আমার মন মানে না রে।
—প্লিজ বোনু। এমন করিস না।
আয়নাটা উল্টে রেখে গালে হাত দিয়ে বসল শ্রী। হবু ননদ কিছু একটা আঁচ করছে। এবার ওর দান। কিস্তিমাত করতেই হবে।
শেয়ার মার্কেটের অবস্থা ভালো না। তাও চল্লিশ হাজার টাকা মুনাফা কম কথা নয়। সত্যদর্শী আয়না থাকলে যা হয়। খুশিয়াল মন নিয়ে বিকেল নাগাদ এ বাড়ি এল শ্রী। অংশুমানের ফিরতে দেরী আছে। চাবি শ্রীয়ের ব্যাগেই থাকে। ননদের ঘরের দরজা ভেজানো। লঘু পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাথরুমে জলের আওয়াজ। মালকিন কলেজ থেকে ফিরে গোসল করছেন। খাটের ওপর রাখা ঝলমলে কাঞ্জিভরম আর পিঠে দড়ি আঁটা চোলিতে মাতৃশোকের ছায়াও নেই কোথাও।
তিন মিনিটের মাথায় বেরিয়ে এল ননদ। মাথা মুছতে মুছতে শ্রীকে দেখেই থমকে গেল। মিষ্টি হেসে গুনগুন করে শ্রী বলল–
—কেমন করে তাকিয়ে থাকি বলো তো? এই তো টানা টানা চোখ আমার। দেখো মন দিয়ে। ক’খানা চোখ দেখতে পাচ্ছ?
অস্ফুট আর্তনাদ করে হাতের ডিও স্প্রের বোতলটা ছুঁড়ে মারল ঝিমলি। শ্রীর কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। এমনিই ব্যথার বোধ কম। হাসিটা আরও চওড়া করে আয়নাটা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের বেলজিয়াম গ্লাসের সামনে দাঁড়াল শ্রী। ঘরে এখন দুটো আয়না। দুটোতেই ওর ছায়া। কপালে গালে ঠোঁটে ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে আছে শুধু টানা টানা চোখ। অল্প লালচে। যেমন চেয়েছিল শ্রী। আয়না কথা শোনে।
ঝিমলি ঘর থেকে বেরিয়েই ছুটেছিল সিঁড়ির দিকে। পায়ে জল। পাথরের মেঝে। আতঙ্ক মানুষকে ফ্রিকশনের থিওরি গুলিয়ে দেয়। আছাড়টা খেল প্রথম ধাপ থেকেই। ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকা দেহটা ডিঙিয়ে বেরিয়ে গেল শ্রী। হাওয়ায় পড়ে গেল ইয়েল লকের সদর দরজা।
একটা অ্যালিবাই থাকা উচিত এবারে। বাড়ির পাশে ক্যাফে আছে একটা। ওখানেই গিয়ে বসল। অংশুমানের গাড়িটা গেলে দেখা যাবে।
শেয়ার মার্কেটের মতি বোঝা দায়। আজ কুবের তো কাল ফকিরের খেলা। শ্রী বাড়ি থেকেই কাজ করছে। অংশুমান কিছুদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন আবার অফিস যাচ্ছে। ওর বোনের আর মায়ের লাইফ ইনসিয়োরেন্স পলিসিগুলো থেকে মেলা টাকা এসেছে। শ্রী এখন সেগুলোর সদ্গতি করতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বড় উচাটন হয়। আয়নার খেলাটা আবার খেলতে ইচ্ছে করে। সেদিন দেখছিল অংশুমানের কোন বান্ধবী একটু বেশিই আদেখলামো করছে। গায়ে পিঠে হাত দিয়ে সে কী সান্ত্বনার ঘটা! খেলবে নাকি বরের পেয়ারের বান্ধবীর সাথে? হয়ে যাক আর এক দান?