শৈলেন সরকার
হতে পারে হতে পারে এমন একটা ভাব ছিলই। স্ট্রাইকের মতোই হল একটা। রাতে কাঁসর-ঘন্টা বাজল। বাজল মানে বাজানো হল। মোদির কথাতেই। একেবারে শ্রীকৃষ্ণের সেই শঙ্খ বাজানোর মতোই। ওই যে যুদ্ধ শুরুর আগে— মহাভারতের। এবার লকডাউন। অর্থাৎ যুদ্ধ। একেবারে বন্ধ। বন্ধ মানে সবকিছু বন্ধ। মোদিজির বলার চার ঘন্টার মধ্যেই বন্ধ করে দিতে হবে সব কিছু। দোকান-পাট, বাস-ট্রেন, প্লেন, কারখানা। মোদিজির কথায় এটি হল গিয়ে আর একটি মহাভারতের যুদ্ধ। তফাত অবশ্য আছে একটা, হাজার কয়েক বছর আগের সেই যুদ্ধ শেষ হতে সময় লেগেছিল আঠারো দিন, আর মোদিজি শেষ করতে সময় নেবেন একুশ দিন। তিনটে দিন বেশি হয়তো শ্রীকৃষ্ণ বা পাণ্ডবদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যই। হাজার হোক ওঁরা একেবারে দেবতা বলে কথা।
প্ল্যাটফর্মের অসীম দাসের মোদিজির উপর অগাধ ভক্তি। এতদিনে এক নেতা পেয়েছে ভারত, অর্জুনের মতো— একেবারে জবরদস্ত। ওঁর হাঁটা দাঁড়ানো, কথা বলা, দাড়ি। অসীম দাসের ব্যবসা শেকড়-বাকড়ের। গ্রহের ফেরে কষ্ট পেতে থাকা মানুষের মুক্তির নিদান। না, হাজার দশ-বারোর পাথর নয়, গরীব মানুষের উপকারের জন্য উনি তার পরিবর্তে দেবেন মাত্র পাঁচ-সাত টাকা মূল্যের অশ্বগন্ধা, শ্বেতচন্দন, অনন্তমূল। দূর হবে শত্রুতা, মেয়েলি রোগ, ফিরে আসবে হাতছাড়া প্রেমিক বা প্রেমিকা। শেষ যেদিন মালপত্র গুছিয়ে প্লাস্টিক পেপার চাপা দিয়ে সাড়ে দশটার আপ রানাঘাট ধরছেন ঘরে ফেরার জন্য, উনি তখন পরম বিশ্বাসে মহাভারতের একুশ দিনের কথাই মনে রেখেছিলেন। একুশটা তো মাত্র দিন। বরং মোদিজির আরেক ভক্ত ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে ফিতে-সেফটিপিন-রুমাল-ন্যপথালিন বিক্রি করা গণেশের একটু যেন অবিশ্বাস ছিল। ভাব ছিল, মাসের পর মাস যাচ্ছে আমেরিকা ইংলন্ড পারছে না, আর আমরা—। ‘আরে না রে বাবা, এ তোমার মিনমিনে মনমোহন নয়, এ হল মোদি, পাকিস্তানকে কেমন টাইট দিল দেখ, প্লেন উড়িয়ে বালাকোটে, ও একেবারে একটা মুখের কথা, যা বলবে—।’
লকডাউনের আড়াই মাসের মাথায় জুনের এক দুপুরে ওদের দুজনের দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। পলতা লেভেল ক্রসিং-এ। ‘আরে অসীমদা? কী করছ?’
–ওই হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর অক্সিজেন মাপার—, তুই?
–মাস্ক বানানোর ফ্যাক্টরিতে ঢুকেছি একটা। ফ্যাক্টরি মানে বাড়িই একজনের, কাটিং-এর কাজ একজনের, আমরা সেলাই—।
মহাভারতের যুদ্ধের কথা অবশ্য কেউই আর তুলল না। বা অর্জুনের কথা। সেই শাঁখে ফুঁ দেওয়ার কথা। হয়তো মনেই নেই বা মনে করার ইচ্ছেটাই মরে গিয়ে থাকতে পারে।
প্ল্যাটফর্ম এখন শুনশান। এক আর দু নম্বর প্ল্যাটফর্মের দোকানগুলির সবার ঝাঁপ ফেলা। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। লকডাউন শেষের পর সন্ধের দিকে চার নম্বরে কিছু মানুষের বসে থাকা। বয়স্করাই। এমনকী ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম থাকা সত্ত্বেও প্রেমিক-প্রেমিকাদের সেই জড়ো হয়ে বসে থাকা কোথায়? বয়স্ক লোকগুলি আসে বা যদিও কিন্তু কথা নেই। যেন মৃত্যুর ফিসফাস সবাইকে একেবারে চুপ করিয়ে দিয়েছে। মাঝখানে একদিন এক নম্বরের পেচ্ছাবখানার পাশে নতুন হওয়া চায়ের দোকানের শম্ভু এসে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। পা আর চলে না। লক-ডাউনের মাত্র মাসখানেক আগে বিপ্লবের কাছ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকায় কেনা দোকান। না, রেল থেকে কিনবে কেন? বিপ্লব মোবাইল সারাইয়ের দোকান দিয়েছিল বছর দেড়েক আগে। কিনেছিল দেড় লাখে। কিনেছিল মানে ইউনিয়নের হারুর কাছ থেকেই। জায়গা শুধুশুধু ফাঁকা পড়ে থাকবে কেন, হোক না পেচ্ছাবখানার পাশে। কিন্তু হারুর কাছ থেকে দোকান কিনে এখন শম্ভু কী করে। সবাই তো বলছে বেআইনি হকার আর থাকতে দেবে না প্ল্যাটফর্মে। ভাঙবে সব। আর এখন ট্রেন না-চলা প্ল্যাটফর্মে কোথায় কী ভাঙছে কে খবর তার খবর রাখবে? হাজার টাকা দিলেও কোন ইউনিয়নের নেতা—। সে নিজেই কোন ভাগারে গিয়ে নিজের পচা শরীরের গন্ধ নিচ্ছে কে জানে?
ফ্লাস্কে চা নিয়ে বেরোচ্ছে এখন শম্ভু। কিন্তু এত চা-ওয়ালা এখন! এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের সরকারি রেল স্টলের জয়ন্তদা পর্যন্ত গরম চা-ভর্তি ফ্লাস্ক নিয়ে ঘুরছে রাস্তায়। নিউ কলোনির বাচ্চুদা ঝালমুড়ি নিয়ে বেরোত কাঞ্চনজঙ্ঘায়। সপ্তাহে দুবার যাওয়া, দুবার আসা। ইউনিয়নের কার্ড। দেখতে দেখতে জীবনের বাহান্নটা বছর কেটে গেল। ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে। চলতি ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টও থামাতে পারেনি লোকটাকে। সেই বাচ্চুদা জীবনের মতোই হকারি থামিয়ে দিল একেবারে। এক ভোরভোরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। পাড়ার লোক বলল, করোনার ভয়ে—। সত্যি কি মিথ্যা কে বলবে?
পাঞ্চালির মা-র চিন্তা ছিল খুব। খাব কী? এতদিন একদল ছেলেমেয়ে এসে দল বেঁধে একেবারে বসিয়ে খাওয়াত। শুধু যে ভিখারি হলেই খাওয়াবে তা নয়, সাধু হলেও হবে। সাধু বা পাগল বা গানওয়ালা যেই হও ঠিক দুটো নাগাদ এক নম্বরের পেছন দিকে একেবারে লাইন দিয়ে দাঁড়াও। দাদা-দিদিরা ভ্যানে করে খাবার নিয়ে আসবে। এরপর মাথা গুনে গুনে—। ভাত, আলুর চোখা, ডাল। কোনও দিন সয়াবিন। কিন্তু ট্রেন বন্ধ হলে কি খাওয়াও বন্ধ। এক দিদি বলল, তা কেন হবে, আমরা একেবারে ঠিক সময়ই আসব। এক দিক থেকে লকডাউন যেন ভালই সবার পক্ষে। সবার মানে পাঞ্চালির মা, বা হারু পাগলা বা বিশ্বাসবাবু বা জগদীশ গানওয়ালাদের মতো সবার পক্ষে। এখানে বিশ্বাসবাবুর কথাটা একটু বলে নেওয়াই ভাল। রোজ পেপার পড়া ভিখিরি। কিন্তু ইংরেজি বলতে পারা লোককে কি ভিখিরি বলা যায়? কী নিয়ে ঝামেলা কে জানে, ওঁর তিন ছেলে দিয়েছে তাড়িয়ে।
ভালো কথা, লকডাউনের কিছু বাড়তি সুবিধা তৈরি হল কিন্তু। আর তা হল কদিন একেবারে তিনবেলা পেট ভরে খাবার। দুপুরের সেই দাদা-দিদিদের এতদিনকার খাবারের অতিরিক্ত সকাল ও রাতের। এমনকী দাদা-দিদিদের এতদিনকার মেনু সয়াবিন বা আলু-চোখার পরিবর্তে মাছ, কোনও দিন ডিম, এমনকী মাংসও। কোত্থেকে এত সংস্থা হঠাৎ করে জুটল কে জানে, একেবারে গরীবের উপকারের জন্য হুড়োহুড়ি। সকালে এই সংস্থা তো রাতে আর এক। দুপুরে সেই পুরনো দাদাদিদিরাই। কিন্তু এত ভাগ্য কি গরীবের কপালে সয়? দিন পনেরো-বিশ যেতে না যেতেই আবার যে কে সেই। একবেলা খাও আর তিনবেলা ঘুমোও। হ্যাঁ, তিনবেলা ঘুম ছাড়া আর কি, দুপুরে খাবে আর সকাল-বিকেল ভিক্ষে করবে সেই দিন আর কোথায়? ভিক্ষে তোমাকে দেবেটা কে? বাড়ির আশপাশে যেতেই দিচ্ছে না, কোয়ার্টার এলাকাগুলির কাছাকাছি যাওয়ামাত্রই দারোয়ান লাঠি নিয়ে আসছে। পাঞ্চালির মায়েরা নাকি রোগ নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বেকার বাইরে বেরিয়ে আর লাভ কী, তার চেয়ে প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে-বসে কাটাও। এই একটা ব্যাপারে এখন আর কেউ বাধা দিতে আসছে না তোমাকে। কোনও বেঞ্চে শুয়ে আছ আর হকার এসে মাল পাতব বলে তাড়া করবে তোমাকে সেই সিন নেই আর। অঢেল জায়গা। স্টিলের বেঞ্চ, পাকা মেঝে— যত খুশি আরাম করো শুয়ে বসে কেউ দেখতে আসছে না। খাওয়ার লাইনে কাল মঞ্জু হিজরাকে দেখে অবাক পাঞ্চালির মা। ভুকভুক করা সেই পাউডারের গন্ধ, সেন্ট সব কোথায়? কোথায় সেই আঁচল না-সামলানো শাড়ি, পাতলা ফিনফিনে ব্লাউজ, লাল টকটকে ঠোঁট। রোগা হাড় জিড়জিড়ে শরীর নিয়ে ঠিক ওর পেছনে দাঁড়ানো মঞ্জুকে দেখে পাঞ্চালির মা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কেন? মঞ্জু বলেছিল, ‘খিদে খুব, কে খেত দেবে বল আমাকে?’
মঞ্জু একবার পাঞ্চালির মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে কালুর কথা জানতে চাইল। বলল, আসে না আর? লম্বা নিশ্বাস ছাড়ল পাঞ্চালির মা। কালু কেন, প্ল্যাটফর্মের গায়ে লাগা শিবমন্দিরের সেই সমীর বা বামুন পল্টু— আসে না কেউই। আগের মতো লাস্ট ট্রেন চলে যাওয়ার পর সেই পুলিশের বাচ্চারাও খোঁচাখুঁচি করে কোথায়? এখন বরং পাঞ্চালির মা আশায় আশায় থাকে। টাকা লাগবে না, দুটো পাউরুটি হলেই নিজেকে দিয়ে দেবে। কিন্তু কোথায় কী? মুখে কাপড়ের টুকরো নাকি জড়াতেই হবে তোমাকে। মুখের কাছে মুখ নেওয়া যাবে না। সুতরাং কে আর আসবে তোমার শরীর চাইতে?
ভোর হতে না হতেই জগদীশ কীর্তনওয়ালা গান ধরবে রোজ, ‘ভোর হইল জগত জাগিল— ।’ পারুল করতাল ধরবে। ওরা স্বামী-স্ত্রী কিনা কে জানে? ওদের কীর্তনের মধ্যেই অ্যানাউন্স হবে ‘সার্স স্পেশাল আপ কৃষ্ণনগর—’ না এই ট্রেন সবার জন্য নয়, শুধু রেলের লোক। ওই পাঁচ-সাতজন। ট্রেন ঢোকার আগে পুলিশ দেখবে সবার কাগজ আছে কিনা, বা ট্রেন থেকে যারা নামল—। কিন্তু এই ট্রেনেই একেবারে পুলিশের সামনেই জগদীশ গানওয়ালারা মানে জগদীশ আর পারুল, একেবারে গান গাইতে গাইতেই দুপুরের একটা ট্রেনে—। সেই দাদাদিদিদের দেওয়া দুপুরের খাওয়ার জন্যও অপেক্ষা করল না। শুধু সেই মঞ্জু হিজরাই জানতে চেয়েছিল একবার, ‘জগদীশ গানওয়ালাদের দেখছি না তো?’
ম্যাজিক দেখিয়ে কবিরাজি তেল বিক্রি করা পারু সেদিন মার খেল খুব। কার পকেট মারতে গিয়ে নাকি—। আরে তুই কি পকেটমারি শিখেছিস কোথাও আগে, নেহাত কবিরাজি তেল বিক্রি করতি জন্য চেনে অনেকেই। কিন্তু ওর বাড়ি ছিল না শিমুরালি? ওখানে নাকি ওর বউ—। ব্যাটা দুপুরভর এত মার খেয়ে রাতে পাঞ্চালির মা-র কাছে হাজির। তার মানে টাকা হাতাতে পারেনি পাবলিক। এসে টানাটানি করছে কাকে বলো তো? পাঞ্চালির মায়ের বছর বারোর পাঞ্চালিকে। শালা তুই আমাকে নে যা খুশি কর, তাই বলে আমার কচি মেয়েটাকে—। পাঞ্চালির তো ঘুম চটে একশা, মেয়ে ভয়ে—। শেষমেশ পাঞ্চালির মা-ই সামলাল মেয়েকে। চকচকে পাঁচশো টাকার নোট একটা। পারু বলল, ‘ফেরত দিবি একশো, চারশো কিন্তু যথেষ্টই, তুই বুড়ি মাগী, টাকা দিয়ে কে তোকে—।’ আর পারুর হাতে পড়ামাত্র মেয়ের ভয় কোথায় গেল কে জানে, বলল, ‘পুরো টাকা মারবি না কিন্তু মা।’
মহাভারতের যুদ্ধ কবে শেষ হবে কে জানে? সেই কোন ছোটবেলা শোনা গল্পের সেই শ্রীকৃষ্ণ। রাজসভায় দুর্যোধনের ভাই দুঃশাসন ল্যাংটা করার জন্য দ্রৌপদীর শাড়ি টেনেই যাচ্ছে তো টেনেই যাচ্ছে। পাঞ্চালির মা মেয়ের কথা শুনেই বুঝে গেল তার পাঞ্চালি কোনও শ্রীকৃষ্ণের জন্যই আর আশা করে থাকবে না। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের যে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে পারু চাওয়ামাত্র নিজের পাতলা ছেঁড়া ফ্রকটা নিজেই খুলে রেললাইনে উড়িয়ে দেবে।