পার্টি

পার্টি -- কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

আজকাল জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মারা সহজ হয়ে গেছে কারণ লোকে আর জানালার বাইরে তাকাচ্ছে না। তাকাবেই বা কেন? হাতে আছে বিশ্বের জানালা। যতক্ষণ ঘুমিয়ে না পড়ছে, বা ঘুমিয়ে না পড়ে থাকা যাচ্ছে না, ততক্ষণ দুই চোখ নীল আভায় বন্দি। চোখের মণি ডান বাঁ, ওপর নিচ, পলক। নিচ ওপর, বাঁ ডান, পলক।

পর পর তিনটে জানালায় একই দৃশ্য। আরেকটু আগে বেরোলে বৈচিত্র্য বেশি থাকে। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে হাতায় লেগে থাকা বাঁধাকপি থালায় নিক্ষেপের অধ্যবসায়। খোলা পাতায় অক্ষরের সারির প্রতি অপরিমিত অবহেলা। টিভি সিরিয়ালের অগাধ আকাটপনা।

তবু এই সময়টা, যখন ভেতর বাইরের আঁধার ঘন হয়েছে আর যাবতীয় শব্দও মরো মরো— আড়ি পাতার জন্য ইন্টারেস্টিং। ছ্যাবলারা চোখ টিপে কনুই মারে। বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে যায় আপসেই। ও সব দেখে দেখে চড়া পড়ে গেছে চোখে। দেখার মতো আছেই বা কী? দুটো লোক। কপাল ভালো হলে একজনের আধখানা মন আছে বিষয়টায়। যারা একা একা, তাদের বরং উৎসাহ বেশি।

এই হোটেলের জানালা দিয়ে ওসব দেখা যায় না। এখানে আসে মেনলি শহরের লোক, কাজের ছুতোয়। ঘরপ্রতি একজন। বিছানাপিছুও তাই। সারাদিন ধান্দায় ঘুরে বিছানায় ফিরে ঘুম। ঘুমের আগে নীল আলোর ভেতর চোখের মণি ওপর নিচ, ডান বাঁ, স্থির, পলক, ডান, বাঁ, নিচ, ওপর। আঙুল দিয়ে টুক, টুক, টকাস।

এই চোখজোড়ায় অতটুকু চলাচলও নেই। অন্তত গত কয়েকমুহূর্ত ধরে। নড়ছে না, চড়ছে না। তাকিয়ে আছে। আঙুল পর্দার ওপর উদ্যত এবং অনিশ্চয়তায় থরথরায়মান। অবশেষে আর সহ্য না করতে পেরেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেওয়া এবং…

কেলো করেছে। সতর্কতায় ঢিলে দিয়ে ফেলেছিল, মহিলার চোখজোড়া ঝটাক্‌সে জানালার বাইরে। এত আচমকা যে চোখ সরানোর সময়টুকুও পাওয়া যায়নি। একেবারে চোখে চোখ। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ শূন্যে ভাসিয়ে রাখা ছাড়া কিছু করার নেই। প্যানিক আটকাতে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া আর ছাড়া।

হইচই, হাঁকডাক, পুলিসে ফোনের ঝামেলায় না গেলেও অন্তত উঠে এসে সশব্দে পর্দা টেনে দেয় লোকে। এতটাও উদাসীনতা দেখায় না কেউ। পাঁচ নম্বর নিঃশ্বাসটা ফেলার পর সাড়াশব্দ না পেয়ে, অবশেষে আড়চোখ ফেলে।

মহিলা এখনও সোজা তাকিয়ে আছেন। কিন্তু দেখছেন না। দেখতে পাচ্ছেন তো আদৌ?

তক্ষুনি মনে না পড়লেও পরে গল্প করে বলার সময় ওর মনে পড়েছিল, ঠিক ওইরকম চোখ আগে কোথায় দেখেছে। মনে আছে, যে রাতে কীটনাশকের মাত্রা বেশি হয়ে যাওয়াতে বিলের জলে সারি সারি মৃগেল ভেসে উঠেছিল? ঠিক তাদের চোখের মতো।

***

 

এর কথাই বলছিল? ওই মহিলা? যে কালকের বানানো, আজকের গরম করা ইডলি প্লেটে নিয়ে জানালার পাশে এসে বসেছে?
এর কথাই।
বলার মতো কিছু নয় তো। মোটামতো, নাক থ্যাবড়া, রং উজ্জ্বল শ্যাম…
অতকিছু দেখতে হবে না। চোখদুটো দেখ ভালো করে।
কী করে দেখব? আরেকটু কাছে গেলে তবু। তার ওপর আবার চশমা। তবে মরা তো মনে হচ্ছে না। ওই তো যে লোকটা প্লেট হাতে যেতে যেতে থেমেছে তার সঙ্গে হেসে কথা বলছে।
হাসিটা মরা মরা ঠেকছে না? কেমন নকল। জ্যান্ত লোক অমনি করে হাসে নাকি?
তাহলে ঘরশুদ্ধু লোককে মরা বলতে হয়। এখানে কার হাসি জ্যান্ত? সবাই ঠোঁট ছ্যাতরাচ্ছে।
লোকটা চলে যেতেই মুখ থেকে হাসিটা কেমন ভুস করে উবে গেল দেখলি? ব্যাক টু রামগরুড়। অব্যর্থ প্রমাণ। হাসিটা সাজানো, গোমড়া মুখটাই আসল।
তোর মুণ্ডু। অনেকের হয় ও রকম। দাঁত বার না করে থাকলেই বুভুক্ষু বাঘের মতো দেখতে লাগে। আরবিএফ।
আরবিএফ?
রেস্টিং বিচ ফেস।
অ। তবে একটা গোলমালে আছে মনে হয়। গত সাড়ে সাত মিনিটে অন্তত সতেরো বার ফোনের দিকে তাকিয়েছে। লোকটার সঙ্গে কথা বলার সময়েও বারদুয়েক আড়চোখে…
গুরুত্বপূর্ণ খবরের অপেক্ষায় আছে বলছিস?
বা গুরুত্বপূর্ণ কারও ফোনের।
এসেছে এসেছে! ফোন এসেছে!
শশ্‌শ্‌শ্‌, কী বলছে কান খাড়া করে শোন।

হ্যালো? হ্যাঁ বল কেমন আছ?
—-
আমার সব ঠিক তোমার?
—-
না এখনও হোটেলে ব্রেকফাস্ট চলছে এই তো একটু পরে বেরোব
—-
আজ… ওই তো, বিডিও অফিস থেকে আসছে ফোকাস গ্রুপ এনুমারেটরদের সঙ্গে বসা, ব্যস

হা হা, এটাই ইউজুয়াল তোমার কী খবর? নতুন প্রোজেক্টটা শুরু হল?
___
গ্রেট ফিল্ড কবে থেকে?

বাঃ, দারুণ খবর, সত্যি
__
এই তোআজওয়েল, নাথিং স্পেশাল, অ্যাজ ইউজুয়াল
__
ওককে, টেক কেয়ার বাই

ওয়েল?
কী ওয়েল?
কথাবার্তা কীরকম কাঠকাঠ না?
বোকার মতো কথা বলিস না। যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, হয়তো তার সঙ্গে সম্পর্কটাই কেঠো। তবে একটা কিছু ব্যাপার আছে। কী একটা বলতে গিয়ে গিলে নিল, দেখলি না?
বলছি তো। গোলমাল আছে। দেখ, শুধু চা খেয়ে উঠে পড়ছে। ইডলি ছোঁয় পর্যন্ত নি।
সেটা অবশ্য বুদ্ধিমানের কাজই করেছে।

***

 

তিন-চারটে বাচ্চা, সাদানীল ইউনিফর্ম পরে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যানের অপেক্ষায়। চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছে। খানিকটা কৌতূহলে, খানিকটা রোদের আঁচে। আজকের রোদটা মারকাটারি। একঘণ্টায় চামড়ায় এক পোঁচ কালি মেরে দিতে পারে। গাড়ি থেকে নেমে বাক্যব্যয় না করে ছাতা খুলছে সবাই ফটাফট। এখানকার লোকেরা ছাতার তোয়াক্কা করে না। সকলেরই চামড়া পোড়া। কালোর বিভিন্ন শেড। কেউ গাঢ় কেউ হালকা।

আসুন, আসুন, ম্যাম। ছাতা খুলল ওস্তাদ টাইপের লোকটা।

লোকটাকে সবাই চেনে। এবং সন্দেহ করে। কারণ লোকটা যে আসলে কেমন সেটা কেউই ঠিক করে জানে না। পাঁচজনকে লোকটার সম্পর্কে জানতে চাইলে পাঁচরকম উত্তর পাওয়া যাবে। একেকজনের সঙ্গে একেকরকম সম্পর্ক বজায় রাখে। সুবিধে দিয়ে, সুবিধে নিয়ে। তাছাড়া লোকটা কী করে সেটারও নির্দিষ্ট উত্তর নেই। এই আলুর বীজের ব্যবসা, ওই রেশনকার্ডের দালালি। বছর কয়েক ধরে প্রকল্পের দালালি ধরেছে। সৌরচালিত পাম্প, ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্প প্রকল্প, সমবায় ব্যাঙ্ক প্রকল্প— নো বাছবিচার। খেপ খেলে খেলে রাজ্যসরকারি থেকে কেন্দ্রসরকারি থেকে এখন বিদেশি প্রকল্পের ঘাটে নৌকো ভিড়িয়েছে। যে রকম গদগদ ভাব, এই পার্টি নির্ঘাত হোমরাচোমরা।

এই মহিলাই নাকি? ঘিয়ে রঙের শাড়ি?
আর মহিলা দেখা যাচ্ছে কি দলে?
এইরকম অনর্থক বদমেজাজের কোনও উত্তর হয় না।

পিচরাস্তা থেকে ঢালু ধুলোপথ ধরে সবাই নেমে আসে। কয়েকজনের চটি হড়কায়। নার্ভাস হাসি। মহিলা কেজো জুতো পরে এসেছেন। হয় সর্বক্ষণই ওইরকম জুতো পরে ঘোরেন, কিংবা এ সব জায়গায় ঘুরে অভ্যেস আছে। শাড়ির আঁচল তুলে মাথা আর মুখ ঢাকছেন। চশমাটা রোদ্দুরে কালো হয়ে যাওয়া টাইপ।

দুপাশে খোপ কাটা চাষের জমি। চোখের ওপর হাত তুলে দূরে দেখছে সবাই। পথের শেষে, জমির প্রান্তে জঙ্গলের সীমা। রোদে শহুরে লোকদের ধাঁধা লাগে, জঙ্গলটা নাকি কাঁপছে মালুম হয়। রাতে হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে দেখলে যেমন নিথর অন্ধকারের মতো ঠেকে, দিনের বেলা সে রকমটা লাগে না। দিনের বেলা জঙ্গলটা প্রাণ পায়।

আসল প্রাণ অবশ্য জঙ্গল পার হয়ে। মানুষ, ভ্যানগাড়ি, রাস্তা, টিউবওয়েল, জঞ্জাল, ছাগলছানা, মুরগির ঝটপটানি, ভ্যানের হর্ন, চোঙা-মাথায় অটো।

মোড় পেরোতেই আবার শান্তি। মোড় থেকে তিনটে রাস্তা গেছে ঈশান, নৈঋত আর বায়ুর দিকে। কোনটা ধরবে মনে হয়? স্কুলবাড়ি না মণ্ডলদের দালান?

ওস্তাদ লোকটা পার্টি নিয়ে উত্তরপূর্ব দিকে এগোচ্ছে, কাজেই মণ্ডলদের দালান। দালান জুড়ে ফুলছাপ শাড়ি আর সালওয়ার কামিজ। এতক্ষণে ক্লিয়ার, কোন প্রকল্প। মনে নেই? আগের বছর পাম্পের সামনে মহিলাদের দাঁড় করিয়ে ছবিটবি তুলে খুব হুলাবিলা করে শুরু হয়েছিল?

সরকারি বাবুদের দু-চার কথার পর অবশেষে মহিলা উঠেছেন। মুখেচোখে অবশেষে খানিকটা প্রাণ ফিরেছে। এখন চোখ দেখলে মরা নয়, জ্যান্ত মৃগেল মনে পড়বে।

বক্তৃতা শেষ। কম কথায় সেরেছে কিন্তু। এবার প্রশ্ন করছে। আপনারা বলুন। আপনাদের প্রকল্প। আপনাদের কী অভিজ্ঞতা। কী চাহিদা। কী হলে সুবিধে হয়। কী হবে কথা দেওয়া সত্ত্বেও হচ্ছে না।

লাজুক মুখে তাকিয়ে আছে ওরা। হাসছে। এদিকওদিক তাকাচ্ছে। ওস্তাদ মুখ খুলতে যাচ্ছিল, মহিলা হাত তুলতেই জোঁকের মুখে নুন।

বেশ হয়েছে। ওর মুখের তোড় থামাতে পারা মুখের কথা নয়।

মিটিং-এর পর ইটিং। অনেকে বলে ওটাই মিটিং-এর আসল পার্ট। মণ্ডলরা আর যাই হোক, অতিথিবৎসল। তাছাড়া পার্টিরা যে এসে ওদের বারান্দায় বসে এটা একটা গর্বের ব্যাপার ওদের কাছে। কাজেই মণ্ডা মিঠাই শরবতের আয়োজন করে। অনেকে খায় না, অনেকে খায়। অনেকে ব্যাগ থেকে নিরাপদ জলের বোতল বার করে। দানাদারের ওপর মাছি দেখে ছিটকে যায়।

এ খাবে? না ছিটকে যাবে?
ওস্তাদকে হাত তুলে থামিয়ে দেওয়ার পর বার ভোটের পাল্লা খেয়ে নেওয়ার দিকেই ভারি।

দালানের মিটিং চলাকালীন কাঠ কাঠ আবহাওয়াটা উধাও। ঘাড় ঢেকে রাখা আঁচল কোমরে গুঁজে ফুরফুরে। শতরঞ্চি ঝাড়তে ঝাড়তে, মাদুর গোটাতে গোটাতে শরীর মনের আড় কেটে যাচ্ছে। বাড়ির সামনে একটা বাস এসে থেমেছে একগাদা অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে নিয়ে। বাসটার যাওয়ার কথা স্কুলবাড়িতে। পথ দেখাতে ওস্তাদ ছুটেছে, কাকে যেন ধমকাতে ধমকাতে।

গুমোট আরও বেড়েছে। মহিলা রুমাল বার করে ঘাম মুছছেন। হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়েছে মণ্ডলের ছোটমেয়ে। প্লেটে করে নাড়ু নিয়ে এসেছে একজন। গুড় জ্বাল দিতে দিতে সিরিয়াল দেখছিল বোধহয়, পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ও নাড়ু চিবোতে সময় লাগবে। এখন সবাই খুব কথা বলছে। প্রশ্নোত্তর হচ্ছে না বলেই বোধহয়। হাসতে হাসতে বলছে, আসলে মিটিং-এ যাওয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই হয় না। মিটিং-এ আগেও যারা যেত এখনও তারাই যায়। বর, বাবা, ভাই।

নাড়ু মুখের মধ্যে এপাশওপাশ করতে করতে মহিলা মাথা নাড়ছেন।

বসাকদের ছোটমেয়ে বলছে, আমার কলেজের পরীক্ষা চলছে, শেষ হলে আমি যাব।

গালের একপাশে নাড়ু চালান করে মহিলা বলে উঠছেন, অবশ্যই যাবে। তারপর আমাকে জানাবে তোমার যা জানানোর। মোবাইল আছে? সেভ করে রাখো আমার নম্বর।

***

 

আজ বৃষ্টি হবে। পূর্বাভাস থাকলেও হবে, না থাকলেও। হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না। একটা পাতা নড়ছে না। মহিলার ব্লাউজ পিঠে জায়গায় জায়গায় সেঁটে গেছে। রুমালটা নিংড়োলে জল বেরোবে।

এনুমারেটরের দল এসে বসে আছে স্কুলবাড়ির ঘরে। বেঞ্চিতে বসে লিখতে সুবিধে। বোর্ড থাকলে বোঝাতেও সুবিধে।

মণ্ডলবাড়ি থেকে স্কুলবাড়ি মিনিট দশেকের হাঁটাপথ। গাড়িতে আসার প্রস্তাব উঠেছিল, মহিলাই মানা করেছেন। সিদ্ধান্তটা বোকার মতো হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মহিলা চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন।

চোখভর্তি আফসোস।

এই যে একটা দিনের মধ্যে সব ঠুসে ঢোকানো, দুপুরে খাওয়ার ফাঁকটুকুও না রাখা, এগুলোর মানে হয় না। সব কাজই এস্টিমেটের থেকে বেশি সময় নেয়। জলের মতো সোজা ব্যাপার একশোবার করে বোঝাতে হয়। তারপর এমন একটা প্রশ্ন আসে যে বোঝা যায় এতক্ষণ ভস্মে ঘি ঢালা হল। কেউ কিস্যু বোঝেনি। কাজে দেবে কি না সংশয় থাকলেও মুখে রক্ত তুলে বলে যেতে হয়, হাতে কোয়েশ্চেনেয়ার থাকলেও, নিজের বুদ্ধি খাটাবে। কবার মিটিং-এ গেছে, মিটিং-এর খবর কোন সময়, কার মুখে পেয়েছে, মিটিং-এ মতামত জানিয়েছে কি না এ সবের ঠিক ঠিক উত্তর দেওয়ার পরেও আসলে গোটা প্রোজেক্টটায় মহিলাদের আসলে কতখানি উপস্থিতি, গুরুত্ব আছে সেটা বোঝা না যেতে পারে। আর সেটা না বুঝলে গোটা কর্মকাণ্ডটারই কোনও মানে থাকে না। সেটা বুঝতে হলে চাই…

গাট ফিলিং? বলে ওঠে চশমাপরা বাইশ বছর। এ অলরেডি স্থির করে ফেলেছে, নেক্সট চল্লিশ বছর কী কী করবে।
এক্স্যাক্টলি।
না ওটার জন্য কোনও প্রশ্ন নেই। ওটা নিচের এই জায়গাটায়, কমেন্টস লেখা খোপটাতে লিখবে।

কচি কচি মুখগুলোতে দ্বিধা। আরে ভীষণ সহজ। মহিলা হাততালি দিচ্ছেন। অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। লেগে পড়।

লোডশেডিং-এ ক্লাসরুমের সিলিংফ্যান স্থির। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছেন মহিলা। মোটামুটি নির্বিঘ্নেই ফুরিয়েছে। নাকি অপ্রত্যাশিত বিঘ্ন ঘাপটি মেরে আছে কিছু?

মৌটুসিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ম্যাম।
মৌটুসি? কে মৌটুসি?
ওই যে কালো স্কার্ট, নীল টপ।
লাস্ট বেঞ্চে বসে ফোন খুটখুট করছিল?
ও-ই।
পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? কোথায় যাবে? বাথরুম টাথরুম গেছে হয়তো…
আমরাও তো বাথরুম থেকেই আসছি, নেই।

জলের গ্লাস হাত থেকে নামিয়ে উঠে আসতে হয়। একই সঙ্গে আবিষ্কার করেছে অনেকেই। ক্ষেতের ভেতর দূরে নীল বিন্দু। হাত আকাশে তোলা। ভঙ্গিটা অনেকটা নীল জামাপরা কাকতাড়ুয়ার মতো। হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে সবাই, চেঁচানোর অ্যাটেম্পট নিচ্ছে না কারণ অত দূরে গলার আওয়াজ পৌঁছবে না।

মহিলা হাঁটতে শুরু করেছেন। মাটির তাত জুতোর ভেতর থেকেও স্পষ্ট।

কপালে ঝাড় আছে আজ। বেচারা নীল জামা। এখনও হুঁশ নেই। ঘাড় বেঁকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।

এই ফাঁকা মাঠে সেলফি তুলছেই বা কেন?

ন্যাচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড। সবার বাড়ির সামনে তো ক্ষেত নেই।

মেয়েটার কপাল গড়ানো, গলা ভাসানো ঘামের দিকে তাকিয়ে মহিলা থমকালেন। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে তাক করতে করতে বললেন, তাড়াতাড়ি করো, তোমার হলেই বেরোবে সবাই।

মেয়েটা সরু কব্জি সরু কোমরে রেখে, ঘাড় বেঁকিয়ে, রহস্যময়ী হেসে দাঁড়িয়েছে। ফোন ফেরত নিতে নিতে বলছে, আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলব, ম্যাম?

সবাই দেখছে এখন মাঠের মধ্যে দুটো কাকতাড়ুয়া। নীল জামাপরা রোগা কাকতাড়ুয়ার পাশে শাড়ি পরা মোটা কাকতাড়ুয়া। রোগা কাকতাড়ুয়াটা হাত আকাশের দিকে তুলে সেলফি তুলছে দুজনের।

***

 

কী রে, এরা এখনও যায়নি নাকি?
এই যাবে যাবে করছে। ছবি তোলা হলেই যাবে মনে হয়।

প্রকল্পের টিউবওয়েল ঘিরে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে, একজন মহিলাকে ধরে আনা হয়েছে, সে টিউবওয়েলের হাতল টিপবে আর উল্টোদিকে বালতির হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়াবে আরেকজন এমপাওয়ারড উওম্যান। ছবি যাবে ফাইনাল রিপোর্টে। ওস্তাদ হাঁকডাক করে বলছে, আহা অত হাসলে হবে না, বাস্তবসম্মত ছবি চাই। টিউবওয়েল টিপতে টিপতে হাসে নাকি কেউ?

আবোদার মতো কথা। টিউবওয়েল টিপতে টিপতে হাসে না বটে কেউ, কিন্তু টেপার সময় যদি পঞ্চাশজন ছেলে বুড়ো মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর দশজন ফোন বাগিয়ে ছবি তোলে তখন হাসি না পেলেই অদ্ভুত।

বাস্তবসম্মত ছবির পর গ্রুপ ফোটো তোলা হল। মহিলাকে মাঝখানে রেখে সরকারি বাবুরা, ওস্তাদ পাশ থেকে একগাল হেসে ঝুঁকে পড়েছে, সবে “রেডি?” বলে ফোনের স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াতে যাবে ফটোগ্রাফার এমন সময় একটা ছাগল ব্যা ব্যা করতে করতে দৌড়ে এসে ফ্রেমে ঢুকে পড়েছে। ছাগলটার মালিকও এসেছে পেছন পেছন ছুটে, ছাগলের গলার দড়ি ধরে টানছে, কিন্তু ছাগলটা ক্ষুর মাটিতে গেঁথে চেঁচাচ্ছে। স্কুলফেরত বাচ্চাগুলো মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।

শেষমেশ ছাগলশুদ্ধুই ছবি তোলা হল।

ফটোগ্রাফার “আরেকটা” বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একটা মৃদু ফুরফুরে, ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল, যেমন বৃষ্টি টের পেতে পেতেই বেশ খানিকটা সময় চলে যায়।

ছাগলটা সবার আগে দৌড়েছে। বাকিরাও ছত্রাকার। আশেপাশে চালা নেই। ওস্তাদ লোকটা দৌড়চ্ছে শালবনের দিকে। লোকটার বুদ্ধি আছে। এইরকম বৃষ্টিতে শালবন চমৎকার আশ্রয়। ঘন, ছড়ানো পাতার ফাঁক দিয়ে ছাঁট প্রায় গায়ে লাগে না বললেই চলে।

সবাই দাঁড়িয়ে আছে গা ঘেঁষে। শরীরের উন্মুক্ত অংশে, গালে, কপালে, হাতের পাতায় মিহি জলের ফোঁটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে মাঠের ওপর ধোঁয়ার মতো সূক্ষ্ম জলের ছাঁট। ভাসছে, নাচছে, উড়ছে। কী বড় হয়ে গেছে পৃথিবীটা। কী শান্ত। ওস্তাদ লোকটার মুখেও কথা নেই। সবারই যেন কী একটা ভীষণ ব্যক্তিগত কথা মনে পড়ে গেছে।  ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়েও একা হয়ে গেছে লোকগুলো।

খুব চুপিচুপি, যেন নিজেকেও লুকিয়ে, মহিলা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। অন্ধকার। বোতাম টিপছেন। স্ক্রিন তবুও কালো। মহিলা অস্থির হয়ে উঠেছেন। ইস, আমার জরুরি একটা ফোন আসতে পারে, চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে?

ওস্তাদ লাফিয়ে উঠেছে। নিশ্চয় ম্যাম, আরে না না সরি কীসের, বৃষ্টি তো ধরে গেছে। দিন আমাকে।

***

 

ঝুপড়ির মাথার তোবড়ানো বোর্ডে লেখা নাম ‘আপ্যায়ন’। প্রোঃ শিবু সামন্ত। পরের লাইনে ভাত, পাবদা মাছ, আলুপোস্ত, মোচার ঘণ্ট, পাঁঠার ঝোল, ডাল। এগুলো একটা আন্দাজ দেওয়ার জন্য লিখে রাখা। আজ যেমন আলুপোস্ত, মোচা, পাবদামাছ কিছুই নেই। আজ খালি পাঁচমেশালি সবজি আর মটর ডাল আর কাটাপোনার ঝোল। মাছটা টেঁকসই করার জন্য ভেজে তক্তা করে ফেলা হয়েছে। কয়েক বছর আগের চিটফান্ডজনিত একটা মনকষাকষির ফলে ওস্তাদের সঙ্গে শিবুর সম্পর্কও অমসৃণ, কাজেই যখন ওস্তাদ প্রস্তাব দিল শিবুর বউয়ের বিশ্রী রান্না খাওয়ার থেকে হোটেলে গিয়ে খাওয়াই হয়তো বেটার, তখন একবারের জন্য মহিলা সম্ভাবনাটা কনসিডার করেছিলেন। তারপর হোটেলের ভেজ মাঞ্চুরিয়ানের থকথকে গোলাপি ঝোল নয়তো বাটার চিকেনের থকথকে লাল ঝোলের তুলনায় শিবুর বউয়ের কাটাপোনার ট্যালটেলে ঝোল তাঁর একশোগুণ লোভনীয় লাগল।

খেয়ে উঠে শিবুর বউকে চা বসানোর অনুরোধ জানিয়ে, গাড়ির ভেতর চার্জে বসানো ফোন খুলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। হতাশ হবেন না নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্ক্রিনের আলো জ্বালালেন। নাথিং। নো নোটিফিকেশন, নো নিউ মেসেজ। সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনে, রাগ, বিরাগ, অনুরাগ, বিপ্লব, বিদ্রোহ, যেমন চলার চলছে।

খালি তাঁর জন্য ভো কাট্টা।

টিং টিং।

বাজনাটা থামার আগে আঙুল ঝাঁপিয়ে পড়ল স্ক্রিনে। রোদের ভেতর ঘর্মাক্ত দুই কাকতাড়ুয়ার সেলফি। মৌটুসি উইথ ম্যাম। ছবির নিচে ফোনের মডেল আর ছবির তারিখ লেখা।

জাস্ট একটা তারিখ।

কী দরকার ছিল এই বোকামোটা করার। দেখাই যাক না, নোটিফিকেশন অফ করে দিলে কারও মনে থাকে কি না। এত চেনা লোক, এত বন্ধু, এত আত্মীয়পরিজন? একজনেরও মনে থাকবে না?

কাল রাতে যে বাজিটা খেলার যোগ্য মনে হয়েছিল, আজ দিনের শেষে সন্ধের মুখে সেটা লজ্জাজনক একটা ছেলেমানুষির আকার নিয়েছে। কী বোকামি, ছি ছি। তাছাড়া এই বয়সে, সত্যিই তো, এটা জাস্ট একটা তারিখ ছাড়া আর কী? যথেষ্ট হয়েছে, আজ আর ফোনের দিকে তাকাবেন না তিনি। ফোন ব্যাগের ভেতর পুরে পেছন ফিরতে যাবেন, চোখ আটকাল।

বিলের ওপারে সূর্য পাটে বসেছে, খোঁচা খোঁচা নারকেল গাছ মাথা তুলে আছে আরও কতরকম বৃক্ষের জটলার ওপর, কালো জলের ওপর ঘন হয়ে এসেছে গোধূলি।

অবশেষে চোখাচোখি হল দু পক্ষের।

দেখছে নাকি, আমাদের?
আমরা ছাড়া আর কে আছে এখানে দেখার মতো?

সূর্য আরও বেশি করে কমলা রং ঢেলে দিল জলে, হাওয়া ছুটে এসে ঢেউ তুলে সে রং ভেঙে ছড়িয়ে দিল বিলের কানায় কানায়, বট নারকেল হেসে উঠে মাথা নাড়ল, মুচকি হেসে আকাশের কোণে ঝিকিয়ে উঠল ভয়্যার চাঁদ।

মহিলার বুকের ভেতরটা ফুলে উঠে ফেটে পড়বে যেন। ফোন তুলে তাক করলেন তিনি।

সে চিইইজ।

চরাচর হইহই করে উঠল, হ্যাপি বার্থডে!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...