গোধূলি শর্মা
“কী গো? এত দেরি হল? আমি সেই কখন থেকে বসে আছি।”
“হ্যাঁ, ট্রেনটা মিস করেছিলাম।”
“ওমা, সুটকেসটা কি ওরা দিল? কী সুন্দর গো…”
নির্মলা বলেই চলে, কিন্তু বটকৃষ্ণ কীরকম হারিয়ে আছে।
“খেতে দাও, খিদে পাচ্ছে।”
ট্রিং ট্রিং, অ্যালার্মটা বেজেই চলেছে। “কী গো, আজ আবার অ্যালার্ম বাজছে কেন? তোমার কি মাথাটা গেল নাকি? বন্ধ করো ওটাকে…!” সত্যিই তো, ঘুম-ভাঙা যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে বিছানায় উঠে বসে বটকৃষ্ণ। হঠাৎ করে মনে হয় মানুষ বোধহয় সবচেয়ে বেশি অভ্যেসেই বশ হয়। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে ঝুড়ি মাথায় সব্জি-ওয়ালা, ক্যান হাতে দুধ-ওয়ালা সবার দিন জুড়ে গতকাল সকালটা ঠিক একইভাবে আড়মোড়া ভাঙছে আজকেও, শুধু তার বর্তমানটাই কেমন যেন তাল-কাটা, খানিকটা আলসে হয়ে ফুরিয়ে গেছে। তার শরীর জুড়ে দৌড়ঝাঁপ নেই, ঘামের চপচপে গন্ধ নেই, ছাঁটাইয়ের অনিশ্চয়তা নেই, ভিড়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে যাওয়া নেই। মাথার পাশে রাখা বোতলটা থেকে গলা ভিজিয়ে নেয় খানিক। তারপর শুয়ে পড়ে আবার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুড়ো সাইকেলটার পায়ে পায়ে স্টেশন যাবার এবড়োখেবড়ো রাস্তা, গা ঘেঁষাঘেঁষি কল্যাণী লোকাল, অফিস পাড়ার রুটি-ঘুগনি, চোখ বুজে আসে তার।
দুচার দিন বেশ আয়েসে কাটছিল। ফুরফুরে, চিন্তাহীন। সেদিন রাতে খেতে বসে এ কথা সে কথা বলতে বলতে নির্মলা বলল “জানো, শ্যামলবাবু, ওই যে গো আমাদের এই গলিটার শেষের বাড়িটা, শ্যামলবাবু আজ সকালে মারা গেছেন, কে জানে কী হয়েছিল! মাঝে মাঝে আমার সাথে বাজারে দেখা হত।” আপন মনে বলতে-বলতে নির্মলা এঁটো কুড়োতে থাকে। “সত্যি মৃত্যু কী অদ্ভুত না, কার কপালে কখন যে আসে কে জানে!” বটকৃষ্ণ কেমন আটকে যায় নির্মলার শেষের কথাগুলোয়। এতগুলো বছর জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে রাখতে মৃত্যু নিয়ে সেভাবে ভাবার খুব একটা সময় সে পায়নি। পরের কয়েকটা দিন এই ছোট্ট শব্দটাই ভুরুর মাঝখানে, স্নান-ঘরে, রাত-দুপুরের নির্জনতায় ভারী হয়ে থাকে তার সত্তা জুড়ে। তারপর একদিন রাত ঘন হয়ে আসে রোজের মতো, বিছানায় শুয়ে খানিক এপাশ ওপাশের পর কিরকম যেন হতে থাকল সারা শরীর জুড়ে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, নাকি বুকের বাঁদিকটা ভারাক্রান্ত, পায়ের আঙুলগুলোও নড়ছে না কি? তাহলে কি এবার তার পালা? সত্যি সত্যিই এত বছরের তেলচিটে জটজোটগুলো খসে যাবে ঠাণ্ডা অন্ধকারে? আচ্ছা মৃত্যুর চেহারাটা ঠিক কী রকম? ভীষণ ভয়ঙ্কর? একটা আস্ত জীবনের সবটাই শেষ হয়ে যায়, নাকি বাকি পড়ে থাকে কিছুটা। শিরায় শিরায় কেমন ঠাণ্ডা আমেজ, বটকৃষ্ণের হাত টের পায় কপাল জুড়ে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ভয়। গলার নলিটা শুকিয়ে মরুভূমি। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ডাকতে চায় নির্মলাকে, পেরে ওঠে না। ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসে।
“কী গো? উঠবে না? কত বেলা হল বলো তো, চা করেছি কিন্তু…”
কেমন একটা ঘোর থেকে যেন জেগে ওঠে সে। গতরাতের ভয়-ভাবনাগুলো এখনও লেগে আছে চোখেমুখে, নতুন করে জেগে উঠছে আবার সকালের রোদ্দুরে। খুঁজতে বলছে মৃত্যুকে।
“কী গো? চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আচ্ছা শোনো না, তোমাকে যে সুটকেসটা দিল ওরা একবারও তো খুলে দেখলে না কী আছে? একটু দেখো না গো…।” নির্মলার ডাকে হুঁশ ফেরে, চোখ চলে যায় ঘরের কোণায় রাখা ঢাউস বেমানান বাক্সটার দিকে, সত্যিই তো, এই কদিনের উচাটনে খেয়ালই করেনি এই নতুন অতিথিকে।
“যাই বলো, সুটকেসটা কিন্তু বেশ বড়, এবার বেড়াতে গেলে আর কোনও অসুবিধে হবে না।”
নির্মলার ভাবখানা এমন যেন সব বেড়ানো শুধু এইখানটাতেই বাধা পড়েছিল এতদিন। যে কদিন রোজগার ছিল, যাওয়া হয়নি কোথাও। বটকৃষ্ণ চেয়েছিল, বলেওছিল অনেকবার। তবু মা হতে না পারার অক্ষমতাটা লজ্জায়, অপমানে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে নির্মলার শিরদাঁড়াটাকে, একেবারে। হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে সুটকেসটা এনে মেঝেয় খোলে, একটা সাদা শাল, একটা হালকা গেরুয়া পাঞ্জাবি, গণেশের মূর্তি, আর একটা ডাইরি-পেন।
“ওমা, কী সুন্দর গণেশটা গো, এটাকে না ঐ কাঁচের আলমারিটায় রাখব…”
ডাইরি-পেন আর পাঞ্জাবিটা বাইরে রেখে বাক্স বন্ধ করে বটকৃষ্ণ।
“আচ্ছা শোনো না, একটু বাজার যাবে, ঘরে একটাও আলু নেই, আমার আর এখন যেতে ইচ্ছে করছে না, সেইদিনের পর থেকে তো আর বেরোয়োওনি বাড়ি থেকে, একটু বেড়িয়ে এসো, দেখো ভালো লাগবে।” কথাটা মনে ধরল বটকৃষ্ণর। নতুন পাঞ্জাবিটা গায়ে গলায়, মানিব্যাগটা খুলে দেখে অফিসের আই-কার্ডটা দীর্ঘদিনের বসতিতে ছেঁড়া-দাগ ফেলে চলে গেছে, এখন শুধুই ভোটার-কার্ড একা, দুটিতে মিলে ঝগড়া আর নেই। হঠাৎ চোখ চলে যায় আলনার কোণায় একা পড়ে থাকা বাটিকের ঝোলাটায়। সেই একবারই নির্মলাকে নিয়ে সস্তার শান্তিনিকেতন, ওর জোরাজুরিতেই কিনেছিল, তবে ব্যবহার করা হয়নি। কাঁধে নিয়ে এপাশ ওপাশ আয়নায় দ্যাখে, কিন্তু ঝোলাটা যে ফাঁকা, কি পুরবে, ভাবতে ভাবতে কি মনে হল ডাইরি-পেনে ভারী করল ঝোলা, তারপর বেরিয়ে গেল রাস্তায়।
বাজারের মুখে আসতেই, “কী, বটকৃষ্ণবাবু, কোথায় চললেন?”
“এই একটু বাজারে।“
“তা আজ অফিস যাননি?”
“না আমার তো ছুটি হয়ে গেছে একেবারে।“
“ও, তাই নাকি? বেঁচে গেলেন দাদা, আমাদের যে আর কতদিন ঘষটাতে হবে কে জানে? তার মধ্যে রোজই কিছু না কিছু ঝামেলা, এই যেমন আজ শ্বশুরমশাই কেটে পড়েছেন, মানে গত হয়েছেন আর কি, এই এখন শ্মশানে চললুম।”
শেষের কথাগুলোয় বটকৃষ্ণের চোখ চকচক করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে বলে ফেলল–
“ইয়ে মানে, আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি?”
“আজ্ঞে কোথায়?”
“ওই, শ্মশানে।”
লোকটা থতমত, এ আবার কেমন কথা, বটকৃষ্ণ নির্লজ্জ–
“আমি খুব একটা অসুবিধে করব না…”
“আচ্ছা, চলুন…”
শ্মশানে এর আগে সেভাবে আসেনি বটকৃষ্ণ, মানে যেমন করে এলে আঁচড়ের দাগ রয়ে যায়। বাবা-মা যখন মারা যান, তখন সে খুব ছোট, সেভাবে মনেও নেই। আর বাকি আত্মীয়-স্বজনের সাথে তার ভাব নেই। শ্মশানে এসে বটকৃষ্ণের মনে হয় যেকোনও জায়গারই নিজস্ব একটা গন্ধ আছে, হাসপাতালে অসুখ-ওষুধ, ঝাঁ-চকচকে দোকানগুলোয় বিলাসিতার খানিকটা ঈর্ষার, এখানে বোধহয় বিষণ্ণতার, শোকের। বটকৃষ্ণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে সবকিছু। বাঁধাই করা বিরাট বারান্দা, দুটো নিষ্প্রাণকে ঘিরে বাকি প্রাণেদের তৎপরতা সান্ত্বনাগুলো তেল-ঘি-মধু মেশানো সন্তাপ গন্ধ মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আছড়ে পড়ছে, জ্বলে উঠছে গনগনিয়ে।
“চা খাবেন?”
সেই লোকটা, “এই সামনেই একটা চায়ের দোকান আছে…”
“না, না ঠিক আছে।”
“ভালই হল জানেন, যে ভাবে কষ্ট পাচ্ছিল, এমনিতেও আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরে এ রোগ বশ মানে না, যতদিন থাকে শুধুই ক্ষত বাড়ে, এর চেয়ে মুক্তি অনেক ভালো…।”
বটকৃষ্ণ যেন উত্তর খুঁজে পায়। গোটা গোটা অক্ষরে শুরু করে–
“মৃত্যু মানে মুক্তি। ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়া, বুড়ো হওয়া হাড়-অস্থি-মজ্জা-মন জুড়ে বেড়ে চলা, ভাঁজ পড়া, কুঁকড়ে যাওয়া বয়স থেকে মুক্তি। ঘরের কোণে পড়ে থাকা বাবার সেই আরামকেদারাটা, হারিয়ে যাচ্ছে পালিশ-রং নতুন হাওয়ায়, ভেতরে ভেতরে বাসা বাঁধছে উই, খেয়ে ফেলছে জিয়ন-কাঠ। তারপর একদিন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়া।”
খাতা-পেন গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরে বটকৃষ্ণ।
“কী ব্যাপার, সেই যে বেরোলে, আলু আনতে বেলা পুইয়ে গেল?” নির্মলা কেমন বিরক্ত, বটকৃষ্ণ কিছু বলে না।
দুপুর-সন্ধে গড়িয়ে রাত নামে আবার, আজকের রাত ঘন হলেও স্পষ্ট তার কাছে। বিগত কয়েকদিনের টানাপোড়ন সে পেরিয়েছে আজ, আজ মৃত্যু তার খাতাবন্দী, ঘুমে যায় শান্ত বটকৃষ্ণ।
“এই যে, সকাল সকাল উঠে পড়েছ যে? এতদিন ধরে ছাইপাঁশ যা ভাবছিলে সেটা এখন ঘুচেছে মনে হচ্ছে?” নির্মলাকে তো আর বলা যায় না, কিসের ভাবনা, কিসের খোঁজ, যাক তবু সমাধান সে করতে পেরেছে ভেবে খুশি খুশি মন নিয়ে ডাইরিটা মেলে ধরে চোখের সামনে। কিন্তু এ কি? হিসাব তো মিলছে না। যে উত্তর সে লিখেছে কাল, পুরোটাই জঞ্জাল। কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি তো তার নেই, যেটা এই লেখাগুলোকে ঠিক প্রমাণ করে এই মৃত্যুটাকেই তার কাছে এনে দিতে পারে। তাহলে কি অন্য কোনও মানে, অন্য কোনও যুক্তি, অন্য কোনও রূপ আছে মৃত্যুর? কেমন যেন মাথা ব্যথা, বুক টনটন, মনে মনে চলতে থাকে দ্বন্দ্ব-সমাস, আর প্রত্যয়। যে ভুল হয়েছে গতকাল, আজ সেটা শুধরে নিতে হবে পরিপাটি। পায়ে চটি, গায়ে সেই গেরুয়া পাঞ্জাবি, বেরিয়ে পড়ে সন্ধানে। পেছনে পড়ে থাকে নির্মলার ব্যাকুলতা– “কী গো, কোথায় যাচ্ছ? কখন ফিরবে, কী গো শুনছ?”
কিছুদূর গিয়ে মনে হল আজ কাকে খুঁজবে? কাল নয় বরাত-জোরে পেয়ে গেছিল একজনকে, কিন্তু আজ? কোথায় গেলে দেখতে পাবে মৃত্যুর ফিসফিসানি? শ্মশান? যদি এই ঘাটে আজ সে না আসে? যদি অন্য কোনও ঘাটে চলে যায়? নিশ্চিত হওয়া যায় কোথায় গেলে? ভাবতে ভাবতে মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। হাসপাতালের রোগ-ভিড় পেরিয়ে জিজ্ঞেস করল–
“দাদা, মর্গটা কোনদিকে?”
“ওই, ও পাশ দিয়ে বাঁদিকে।”
শবাগার– সাইনবোর্ডটার একটা দিক খসে ঝুলে পড়েছে, যেন এরও সময় হয়ে এসেছে বিদায় নেওয়ার। এখানটারও গন্ধ আছে একটা, তবে কালকের মতো নয়। কালকেরটা তেল-নুন-মসলা মাখানো, আজ পুরোটাই কাঁচা, অপক্ব।
বটকৃষ্ণ ডাইরি বের করে, সবকিছু নোট নিতে হবে, ঠিক করে।
“এই যে দাদা, এইদিকে আসুন।”
“আমি আর কী করব দেখে, যে বাপটাকে এত ভালবাসতাম, আজ তাকে…” বটকৃষ্ণর পাশে এসে দাঁড়ায় বাপ-মরা শোক।
“কী করবি মানে? তোর কি মনে হয় বাবা তোকে এত সহজে ছেড়ে চলে গেছে? নারে বোকা, তোর বউয়ের কোল আলো করে ফিরে এসেছে আবার, আমি এইমাত্র দেখে এলাম, তোর ছেলেকে, মুখখানা একেবারে পিসেমশাই। এটাই তো নিয়ম রে পাগল, এক যায়, অন্য আসে। চল চল…”
লেখা শুরু করে বটকৃষ্ণ–
“মৃত্যু মানে পুনর্জন্ম, ফিরে আসা, ফিরে আশা। সেই জন্ম থেকে একটা একটা জমানো মায়া-পালক যখন ফুরিয়ে যায় হাওয়ায়, তার জেগে ওঠে নতুন স্বপ্নেরা। ঠাকুমার হাতের সেই রতনচূরটা, খিলান আলগা হয়েছে মরচে-অতীতে, তবু সময়ের ফিকে রঙ বহু বছরের পরেও ঝলমলিয়ে ওঠে নাতনির হাতে।”
গুটি গুটি পায়ে অলিগলি পেরিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে বটকৃষ্ণ।
“কী হয়েছে তোমার? আমাকে কি বলার প্রয়োজন আছে? রিটায়ার করলে কোথায় লোকে সংসারকে বউকে সময় দেয়, আর সেখানে তুমি কোথায় যাচ্ছ সেটা পর্যন্ত আমাকে বলার দরকার মনে করো না, কী দেখো ডাইরিতে, তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে যাও যখন খুশি, একবারের জন্যও পেছনে তাকাও না, কী হল, বলো কিছু?” নির্মলার গলার ঝাঁঝে কেমন একটা সন্দেহ, নাকি দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, ঠিক ধরতে পারে না সে। ঘরে ঢুকে ঘেমো পাঞ্জাবিটা টাঙিয়ে রাখতে রাখতে শুনতে পায়–
“কোথায় যাও বলো তো? ছায়া তোমাকে শ্মশানে যেতে দেখেছে কাল, ব্যাপার কী? কাপালিক হবে নাকি? একটা কথা শুনে রাখো, এরকম চলতে থাকলে আমি কিন্তু সব ছেড়ে চলে যাব, তুমি সেটাই চাইছ কি?” উত্তর দেয় না সে। নাকি দিতে পারে না?
দুপুরের খাওয়া শেষে নির্মলা ঘরে ঢুকে শোনে বটকৃষ্ণের নাক মৃদু ডাকাডাকি করছে। খাটে বসে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত মানুষটার দিকে। ঘুম, মানুষের মুখে কি অদ্ভুত তৃপ্তি-স্বাদ এনে দেয়। পঁয়ত্রিশ বছরের একসাথে থাকার মধ্যে সেভাবে অশান্তি খুব একটা হয়নি। খুব ভালোভাবে থাকাটা হয়তো এই জন্মের মতো তোলা রইল, তবে নুন-পান্তার ছোট ছোট সুখদুঃখে মন্দ কাটেনি দিনগুলো। কিন্তু লোকটা রিটায়ারের পর কী যে হল, কেমন একটা টানাপোড়ন চোখ জুড়ে। প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেয়নি সে, এতদিনের চাকরি, অভ্যেস সব এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেলে মানুষ একটু অস্থির হয়ে পড়ে, তবে সেটা অশান্তি ডেকে আনলে তো মুশকিল। ওই ডাইরিটা দেখতে হবে একবার, কে জানে বয়সকালে মাথার দোষ হল কিনা, সুধা বউদিকে বলে কোনও মাদুলি-টাদুলি যদি… সাড়ে পাঁচটার সাইরেন বাজে, ভাবনায় ছেদ পড়ে। নির্মলা উঠে দাঁড়ায়, সন্ধে দিতে হবে।
রাত্রে খাওয়া সেরে আজ আর শোয় না, একেবারে পাশের ঘরে চলে যায় বটকৃষ্ণ, ডাইরি পাতে টেবিলে।
“কী হল? শুতে আসবে না? এখন আবার কী নাটক শুরু করলে?” যথারীতি নিরুত্তর বটকৃষ্ণ পাতা ওলটায়।
লাইনগুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে গোত্তা খায় সে, কুঁচকে যায় ভুরু। সেই সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কের মতো, সবকিছু করে শেষে উত্তরটা ভগ্নই থেকে যায়, পূর্ণ আর হয় না। পাতা জুড়ে যে মৃত্যু সে বন্দি করেছে, সেটা তো বেমানান তার জীবনে, সে তো নিঃসন্তান। তার মানে আবার সেই ভুল। কোথায়, কীসে, কীভাবে, ধরতে পারে না কিছুতেই। মাথার মধ্যে জট ক্রমশ বেড়েই চলছে। কেমন একটা জিলিপির প্যাঁচ আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরছে। ঠিক যেন উকুনের দল। মাথার মধ্যে একটা থেকে দুটো থেকে অগুনতি, ঘাড় বেয়ে কানের পাশ দিয়ে ছুটে ছুটে রক্ত খুঁটছে, ওষুধ, সরু চিরুনি কোনও কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। এখনই একবার বেরোলে হয় না? এবারে আর কোনও গণ্ডগোল নয়, পা টিপে টিপে শোওয়ার ঘরে ঢোকে। আলনার গায়ে এলানো পাঞ্জাবিটায় টান দিতেই–
“কী খুঁজছ?”
“ইয়ে, মানে ওই পাঞ্জাবি।”
“মানে? এত রাতে পাঞ্জাবি দিয়ে কী রাজকার্য হবে?”
বটকৃষ্ণ চুপ।
“তুমি কি এত রাতে বেরনোর ফন্দি আঁটছ?” হ্যাঁ-সূচক মৌনতায় বটকৃষ্ণ।
“তোমার আস্পর্ধা দেখে হাসব, না কাঁদব ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি এই ঘরের বাইরে তোমার পা পড়ে, তাহলে আমাকে জন্মের মতো হারাবে মনে রেখো।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে নির্মলা। তার চোখমুখে বিস্ময়-রাগ-অভিমান মিশে অদ্ভুত এক লালচে রঙ ধরেছে। বটকৃষ্ণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর শুয়ে পড়ে। নির্মলা মনে মনে ভাবে আর নয় কাল সকালে সুধাবৌদিকে ধরতেই হবে যে করেই হোক। বটকৃষ্ণ চোখ বোজে না, অপেক্ষা আর ধৈর্যের লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে তার মগজে। রাত ফুরিয়ে ভোর চোখ মেলে একটু একটু, বটকৃষ্ণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে মাথার পাশের জানলাটায়। আলোটা মৃদু থেকে স্পষ্ট হয়, খুব সন্তর্পণে বেরিয়ে যায় সদর দরজা খুলে।
এত ভোরে হাসপাতাল চত্বরে সেই গিজগিজে ভাবটা নেই। চেনা রাস্তা ধরে মর্গের দিকে পা বাড়িয়েই হেসে ওঠে মনে মনে। মৃত্যু আসছে কাঁধে করে, লোকগুলো দেহটাকে নিয়ে বাইরে টেম্পোতে তোলে। বটকৃষ্ণ পিছু নেয় তাদের। ভিড়ের মধ্যে উঠে পড়ে টেম্পোয়। গাড়ি চলতে শুরু করে, সবার পেছনে বটকৃষ্ণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শবটার দিকে, লক্ষ করে শবটা। গাড়ির তালে তালে মড়া-মুণ্ডুটা কেমন এদিকওদিক নাচছে। খুব মজা লাগে তার, জ্যান্ত প্রাণের চেয়ে জড়টাই এখন বেশি টানে তাকে। একটা আঁশটে ঠাণ্ডা ভাব সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে সবসময়, একটা শিরশিরানি গন্ধ ছোট ছোট পোকার মতো চুল থেকে নখ মরা-মরা জপে যায়। হালকা ঝাঁকুনিতে গাড়ি আর তার ভাবনা দুটোই থেমে যায়। একে একে নামতে থাকে সবাই। সেও নেমে একটু দূরে দাঁড়ায়। ভালো করে চারদিক দেখে, যদিও এটা একটা অন্য শ্মশান, খোলসটা অন্য, তবে ভেতরে সেই নোনা জলে চোবানো মৃত্যুর স্পন্দন। বটকৃষ্ণ ভিড় ছেড়ে একটু দূরে দাঁড়ায়।
“ও দাদা, দেশলাই আছে?”
না-য়ে ঘাড় নাড়ে বটকৃষ্ণ।
“সেই কোন সকালে উঠেছি, ধোঁয়া না ঢুকলে আর চলছে না, বুঝলেন তো, সবটাই কপাল, ওই যে কথায় বলে না জন্ম মৃত্যু বিয়ে কার যে কখন হবে তা হিসেব করে কেউ বলতে পারে না। এখন বৌদি বেচারি একা একা কী করবে, সন্তান-টন্তানও তো কেউ নেই যে পাশে দাঁড়াবে… যাকগে আমি এগোই বুঝলেন…”
ঝোলা থেকে ডাইরি পেন বের করে বটকৃষ্ণ, একটা গাছের নিচে গিয়ে বসে, তারপর শুরু করে—
“মৃত্যু মানে ভবিতব্য। অনেকটা অঙ্কের সমীকরণের মতো। যেখানে যা যা হওয়ার ঠিক সেটাই হবে, একটুও এদিকওদিক করার জো নেই। সেই যে লোকটা, বর্ষায় ভিজবে না ভেবে ছাতা নিয়ে চলে রোজরোজ। তারপর একদিন বেমক্কা ভুলে গিয়ে এক্কেবারে কাকস্নান। যতই বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলা, সাবধানী হয়ে থাকা, সে যদি আসে উল্টে যায় হিসেব-খাতা।”
কীরকম একটা হালকা লাগছে, যেন অনেক জন্মের চিন্তা-ভর নেমে যাচ্ছে তার শরীর-পৃথিবী থেকে। সেই ছোটবেলার মতো ইচ্ছে করছে এক আকাশ চিৎকার করতে। মনে পড়ে যাচ্ছে, ছোটবেলায় একটা বাহারি প্রজাপতি দেখেছিল তাদের বাগানে, অনেক সকাল, দুপুর ব্যয় করে এক বিকেলে বন্দি করেছিল তাকে। আজ অনেকটা সেইরকমই গুড়গুড়োচ্ছে পেটের ভেতর। নির্মলাকে বলতে হবে এই কদিনের সব তোলপাড়-ঢেউ থেমে গেছে আজ। বলতে হবে মৃত্যুকে সে পরখ করেছে তার সবটুকু জীবন দিয়ে। তাকে ঘিরে সমস্ত ধোঁয়াশা-জাল মিলিয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছতায়।
ভাবতে ভাবতে ঝোলা কাঁধে উঠে পড়ে। হনহনিয়ে এগিয়ে চলে বড় রাস্তার দিকে, পেছনে ফেলে দেয় এতদিনের গায়ে লেগে থাকা শ্মশান ঘ্রাণ। আজ আর অস্থিরতা নেই, অশান্তি নেই, চ্যাটচ্যাটে উচাটনটাও মাথার এককোণে জিরোচ্ছে। বাড়ি গিয়ে জমিয়ে এক কাপ চা। আহারে, কতদিন নির্মলার সাথে ঠিক করে কথাই হয়নি…… আচমকা একটা কানফাটা আওয়াজ আর টুকরো কিছু শব্দের ভেসে আসা…
“এই রে, স্পট ডেড মনে হচ্ছে, এ হে রে মাথাটা একেবারে থেঁৎলে গেছে, আরে ওই তো একটা ঝোলা পড়ে আছে, দেখ তো?”
“পাঞ্জাবির পকেটটা দেখ…”
“বটকৃষ্ণ বটব্যাল, বাড়ি ……”
সেই কোন ভোরে বেরিয়েছে লোকটা, কে জানে কোথায় কোথায় ঘুরছে, আজ বাড়ি ফিরলেই মাদুলিটা পরিয়ে দেবে, আর ঘর থেকে বেরোনো একদম বন্ধ। দরকার পড়লে তালা দিয়ে দেবে সদর দরজায়। মনে মনে নানা কু-ডাকে দুশ্চিন্তা। দরজাটা কড়া নাড়ল মনে হয়। এগিয়ে যায় নির্মলা। তবে এই কড়া নাড়াটা কেমন যেন অন্য, অচেনা–
“বউদি, আমি অনিল, এই পাশেই থাকি, ইয়ে মানে দাদা…”
“উনি তো নেই, বেরিয়েছেন…”
“হ্যাঁ, মানে আপনি যদি একটু আমার সাথে হাসপাতালে…”
বুক কেঁপে ওঠে নির্মলার, অসম্ভব রকমের ঠাণ্ডা গলায় বলে–
“একটু দাঁড়ান, আসছি।”
বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায় ঝড়ের মতো, যন্ত্রের মতো। বাড়িঘর ওলটপালট, নির্মলা গোছাতে বসে। আলনার জামাকাপড়ে টান মারতেই পেছনে উঁকি মারে সেই বাটিকের ঝোলাটা, আর তার ভেতরে ডাইরি-পেন। সেই যে সেদিন এনে রেখেছিল, তারপর বেমালুম ভুলে গেছে। অথচ এটা পড়ার ইচ্ছে ছিল খুব তার, কিছুদিন আগেও। ভাবতে ভাবতে চশমা এঁটে পাতা ওলটায়–
মৃত্যু মানে মুক্তি, মৃত্যু মানে…
রুল-টানা কালো অক্ষরগুলোয় এখনও তিরিশ বছরের গৃহকোণ লেগে আছে। নির্মলা তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর দীর্ঘদিনের অনভ্যাস কাঁপা কাঁপা হয়ে শুরু করে প্রতীতি–
“মৃত্যু মানে অকস্মাৎ। শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় আচমকা নিম্নচাপের মতো। চোখের পলকে মাথা থেকে পা ভিজিয়ে দেয় অপ্রস্তুত।
মৃত্যু মানে হঠাৎ করেই ভীষণ রকম বেঁচে থাকার শক্তি। বহুদিনের ভালো-মন্দ, সুখ অ-সুখ, মান-অভিমান রঙ মেশানো এক হয়ে একসাথে থাকা অভ্যেসটা যখন হঠাৎ করেই বিচ্ছিরি একলা হয়ে যায়, থমকে যায়, ঠিক তখনই পাঞ্জাবিটায় লেগে থাকা শেষ স্পর্শটুকু ছুঁয়ে ছুঁয়ে একা বেঁচে থাকাটা প্রতিদিনের সাহস বানায়। স্মৃতি হয়ে যাওয়া অতীতটা বর্তমানের হাত ধরে বেঁচে চলে আগামীতে।”
ডাইরি-পেন গুটিয়ে, বাটিকের ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়ে নির্মলা অপূর্ণ, অশেষ সন্ধানে।