অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
চেনা মুখ, চেনা ছবি
বাড়ির উলটোদিকে হাসপাতাল চত্বরের মধ্যে একটা তালঢ্যাঙা গাছ। কাণ্ড ছাইরঙা, কোনও শাখা-প্রশাখা ছিল না তার। মগডালে, ঝাঁকড়া পল্লবের আড়ালে চিল এবং তার ছানারা থাকত, মনে হয়। একাকী খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। আমরা বলতাম তালগাছ। কারণ তিনিই তো এমন একপেয়ে! যারা একটু জ্ঞানী, তারা বলত, না না ওইটা পাম গাছ। হতেই পারে। সাহেবদের তৈরি লেডি ডাফরিন হসপিটালে কি আর দেশি তালগাছ পুঁতবে ওরা, পামগাছই হবে। তা ওই পামগাছের নামেই, আমাদের কিছু সদ্য গোঁফ গজানো বন্ধুদের উদ্যোগে যে পাঠাগারের প্রতিষ্ঠা, তার নাম হয়ে যায় পামসাইড লাইব্রেরি। ঘরটা বোধহয় এক কাঠের ব্যবসায়ী ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। দরজার শিয়রে সাদা চুনকাম করা দেওয়ালের ওপর ঘন হলুদ রঙের প্রলেপ বুলিয়ে প্রথমে আয়তাকার হলুদ জমি করে নেওয়া, তার পরে আলকাতরায় লেখা লাইব্রেরির নাম। নাম লেখায় এমন দীন আয়োজন হলেও বইয়ের সংগ্রহ কিন্তু মোটেই হেলাফেলার নয়। আমরা প্রত্যেকেই বাড়ির শ্রেষ্ঠ বইগুলি দান করে দিয়েছিলাম। আমার সংগ্রহে ছিল ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ এই তিন বছরের সন্দেশ পত্রিকা। বার্ষিক সূচি সহ বাঁধিয়ে রাখতাম। সব দিয়ে দিলাম। আর ছিল ‘মার্কসবাদী’ পত্রিকা— ডাবল ডিমাই। বোধহয় প্রথম ছয় কি সাতটি সংখ্যা ছিল বাড়িতে। দিয়ে দিলাম। এই কাজটির জন্য পরে, জ্ঞান-বুদ্ধি হলে, যে কখনওই অনুতাপ হয়নি, এমন বলা যাবে না। অবশ্য আমি একা নই, আরও অনেকেই দিয়েছিল। উচক্কা বয়েসের আবেগ তখন! একজন দিয়েছিলেন সান ইয়াৎ সেনের লেখা বই। একজন প্রেমেন্দ্র মিত্রের এক আশ্চর্য বই, যাতে উনি বিশ্বের কয়েকটি বিখ্যাত গল্পের নাম লিখেছেন, যার মধ্যে ছিল বালজাকের ‘আ প্যাশন ইন দ্য ডেজার্ট’, গ্রাহাম গ্রিনের ‘দ্য এন্ড অফ দ্য পার্টি’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘দুরাশা’। অন্য দুটি গল্প একবার পড়লেও সেই থেকে দুরাশা বহুবার পড়েছি। কী যে এক আশ্চর্য আখ্যান! দার্জিলিং পাহাড়ে পথ চলতে-চলতে একটি বাচ্চা মেয়েকে গল্প শোনাবার দায় থেকে যিনি এমন এক রচনা ফাঁদতে পারেন, তাঁকে অনুভব করলেই তো মন কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে যায়।
ওই পামগাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে আসা রেপ-সিড-তেল-রঙা রোদ্দুর যখন বাইরের ঘরের তক্তাপোশে ঝিরঝির করে একাদোক্কা খেলে, আকাশে না তাকিয়েও বলে দেওয়া যাবে এখন বিকেল। রাস্তার মোড়ের সাহজির দোকানে এখন বাদাম তক্তি তৈরি হচ্ছে, একশো ফুট দূর থেকেই গন্ধ পাবে তুমি। তার পাশের আটাকলের অর্ধেকটায় এখন ডালপুরি সেঁকা হচ্ছে। এই সহজ সত্যিটা দেখি অনেক রসিকই জানে না যে, ডালপুরি ভাজা নয়, সেঁকা হয়। হয়ত ভাজাও খেতে ভালো, কিন্তু আমাদের জিভে সেঁকাই খাঁটি, আদি ডালপুরি! কারণ ওইতেই আছে আমাদের কিশোরবেলার বিকেলের গন্ধ।
এমনই এক বিকেলের কমলা-হলুদ আলোয় স্পষ্ট দেখলাম একটা চন্দনা পাখিকে তাড়া করেছে তিনটি কাক; একটি কাক চন্দনার পুচ্ছ কামড়ে ধরল। নিশ্চয়ই চন্দনা কারও খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে উড়ান দিয়েছে, কিন্তু সে তো আর জানে না পথে-ঘাটে কত বিপদ। রাস্তা থেকে একটা ইটের টুকরো ছুড়লাম। গুলির টোক্কামার আর পিট্টু খেলার নিয়মিত অভ্যেস থাকায় উড়ন্ত অস্ত্রটি যে অন্তত একটি কাকের শরীরের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু অবাক কাণ্ড তিনটি কাকই পালাল। অবশ্য ওই আনন্দের আয়ু কুড়ি সেকেন্ড। অন্য কাকেরা মুক্ত চন্দনার পিছু নিল এবং অচিরেই তাকে ধরে ফেলল। ওরা তখন আমার ঢিলছোড়া দূরত্ব পেরিয়ে, পামগাছ ছাড়িয়ে চলে গেছে।
পরে, চাকরি করবার কালে, রাস্তা সংক্ষেপ করবার জন্য যখন প্রেমচাঁদ বড়ালের গলি পথে, যাকে হাড়কাটা গলিও বলা হত, যাতায়াত করি, একদিন দেখলাম এক যুবতীকে দুটি ক্ষয়াটে ছেলে জোর করে টেনে নিয়ে অন্ধকার সরু গলিতে ঢুকে পড়ল। দেখেই ঝলকে উঠেছিল সেই চন্দনা আর কাকের ছবি। সেদিন অবশ্য আর ঢিল ছুড়িনি। তখন যে লায়েক হয়ে গেছি!
ওইরকম বিকেলেই কামুদা খাটালে আসত। কামুদা মানে কামু মুখোপাধ্যায়, সেই ১৯৬৬-৬৮ সালে, তত পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেনি, যা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ হওয়ার পরে। বোধহয় সেইজন্যেই বিকেল চারটের সময় কামুদা, আরও অনেকের মতোই, খালি গায়ে দুধ নিতে আসতে পারত। সিনেমার সুবাদে তেমন চেনামুখ না হলেও, তখনই কামুদা ওর হাজির-জবাব আর মজার চুটকির জন্য আমাদের সবার প্রিয়। তার ওপর তখন স্কুল-কলেজ-রেশন-বাজার-কয়লা-কেরোসিনের লাইন সর্বত্র কংগ্রেসবিরোধী হাওয়া। আমরা শুনে-শুনে কংগ্রেসবিরোধী। এবং আমাদের হিরো কামুদা পাড়ার চ্যাটার্জি রেস্টুরেন্টে বসে খবরের কাগজের ওপর রংতুলি দিয়ে আমেরিকা আর কংগ্রেসবিরোধী পোস্টার লেখে— ‘এলাটিং বেলাটিং সই লো/কিসের খবর আইলো/আমেরিকা একটি বালিকা চাইলো/ রীতা ফারিয়াকে পাইলো।’ গোয়ানিজ রীতা ফারিয়া সে-বছর, মানে ১৯৬৬ সালে, বিশ্বসুন্দরী হয়েছিলেন। এর আগে বোধহয় কোনও এশিয়ান সুন্দরী এমন বিশ্বজয়ী হননি। বামেরা বলল, এর মধ্যে নিশ্চয়ই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত আছে! অতএব কামুদার পোস্টার। চালু ছড়ার প্যারডিটি ওর নিজের লেখা! ওর বাবা, আর্থারাইটিস এবং আরও কোনও হাড়ের অসুখে ভুগে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারতেন না, হাঁপানির টানে খুব কষ্ট পেতেন। তো, একদিন আমাদের রোয়াকের আড্ডায় ভুবন ধর লেন আর আমহার্স্ট স্ট্রিটের স্পর্শবিন্দুতে যে খড়কাটার কল আছে, যেখানে ঘ্যাঁস-ঘ্যাঁস-ঘস-ঘস করে দিবারাত্র খড়কাটা চলে, যার টুকরো দিয়ে গরুর খাবার হয়, তার কথা হচ্ছিল। খোকা বলল, বিয়েবাড়ি কিংবা পাইস হোটেলের সবজি কাটার জন্য এমন খড়কাটা মেশিন চালালে মন্দ হয় না। কামুদা, দুধ আনবার আগে-পরে আমাদের সঙ্গে দু-দশ মিনিট গল্প করে চলে যেত, বলল, আরে আমার বাড়িতেই তো দিনরাত খড়কাটা মেশিন চলে। মানে! কেন? ওই যে আমাদের বাড়ির বুড়ো…। শুনেই আমরা হইহই করে হাসলাম। বুঝলাম, ওর বাবার কথা বলছে। সত্যজিৎ রায় মশাইও, পড়লাম, ওঁর বইতে কামুদা আর কোনও অভিনেতা সম্পর্কে ওর বলা এই খড়কাটা কলের উপমার কথা লিখেছেন।
সেদিনও দেখছি কামুদা আসছে। খালি গা, নাভির কিছু ওপরে কষি বাঁধার ফলে কটকি লুঙ্গির নিচের প্রান্ত গোড়ালির অন্তত আট ইঞ্চি ওপরে, বাঁ হাতে দুধ আনার পাত্র দোল খাচ্ছে, ডান কোলে ধরা ধবধবে সাদা এক বেড়াল! ভাজা কাজুবাদামের মতো গায়ের রং কামুদার, পশ্চিমের রোদ্দুর ঠিকরে পড়ছে ওর মসৃণ চামড়ায়। টাক মাথার দু-প্রান্তে যে কয়েক গাছা চুল আছে, কুচকুচে কালো, ইয়া গালপাট্টা— ঘন কালো। ঠোঁট দুটি জর্দা পানের রসে টুকটুকে লাল, শুধু ঠোঁটের চামড়ার ভাঁজের কাছে কিঞ্চিৎ মেরুন। কামুদা আসছে। যথারীতি পশ্চিমদিকে মুখ, কোনাকুনি আকাশের দিকে দৃষ্টি, আমরা যে রোয়াকে বসে ভ্রূক্ষেপ নেই, রোয়াকের থেকে যখন পাঁচ-পা দূরে, সিধু বলল, ‘কামুদা… বেড়াল… পুষলেন নাকি?’
কামুদা তাকাল না। আমাদের পেরিয়ে যেতে-যেতে ওই পশ্চিমদিকে তাকিয়েই বলল, ‘এক সায়েব দিয়েচে…’
এর পরে যে হাসবে না, তার হাসি নেই!
এমনই এক বিকেলে বাদলদা (চলতি কথায় বাদলাদা) মাথায় মেরে ডাব ফাটিয়েছিল। তার আগের সন্ধেবেলা, দুর্গাপুজোর সপ্তমী। বারোয়ারি পুজোর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু (পরিচিতি ছিল বিষ্টু নামে) ঘোষ এবং তাঁর দলবল দেখিয়েছিলেন শেকলভাঙা, ওজন তোলা ইত্যাদি পেশিশক্তির নানান কায়দা। আমরা অবাক, আমরা উদ্বুদ্ধ! পরদিন বিকেলে, ওই পুজোর প্যান্ডেলেই চলছিল আগের দিন অনুষ্ঠানের জের। বিজু বলল, কীরকম মাথায় মেরে ডাব ফাটাল! যার দিকে তাকিয়ে বলল, সে ওর নিজের দাদা, বাদলাদা। হুঁ, দাদা বলল, এইটা অবশ্য তেমন কিছু নয়, এ তো আমিও পারি…।
–অ্যাঁ!…পারো?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ…
–করে দেখাও, অত সোজা না…
তুষার ফোড়ন কাটল, যা না একটা ডাব নিয়ে আয় না…
স্কট লেন পাড়ায় বাজার উপচে পড়ে। ডাব আর কী এমন, চাইলে চমরি গাইয়ের দুধও পাওয়া যায়! কিন্তু বাজার যাওয়া-আসায় পাঁচ-সাত মিনিট লাগলেও তো সময় নষ্ট। অতএব পুজোর ঘটের একটা ডাব তুলে নেওয়া হল। বেশ পুরুষ্টু ডাব।
এইবার বাদলাদাকে করে দেখাতে হয়। দু-হাতে ডাব ধরে, সজোরে কপালে মারল। চশমাটা খুলে পড়ল রাস্তায়। একবার বাড়ি খেয়েই, ওর তেজ যেন বেড়ে গেল। আবার মারল, একবার, দুবার, তিনবার…। শ্যামবর্ণ কপাল, ডাবের চোটে বেগুনি! কিন্তু থামা নেই। ওর মাথা সত্যিই নিরেট, ছবার আছড়ানোর পর ডাব ফেটে গেল! সেই থেকে বাদলাদাও আমাদের হিরো। ও-পাড়ার সঙ্গে মারপিটের সময় কী যে ভালো সোডার বোতল ছুড়ত। রণহুঙ্কার দিয়ে ও-পাড়ার মস্তানদের দিকে ছুটে যেতে-যেতে কাছের পানের দোকান থেকে দু-চারটে বোতল তুলে নেওয়া। দু-তিনবার ঝাঁকিয়ে বোতলটি ছুঁড়ে দেওয়া শত্রুপক্ষের দুর্যোধন কী দুঃশাসনকে তাক করে। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে উঠে বোতলটি ছুটে যাবে উপবৃত্তাকার পথে। আছড়ে পড়বে শত্রুর শরীরে। যদি সে সতর্ক থাকে সরে যাবে ঠিকঠাক, বোতল পড়বে এবং ফাটবে, ছিটকে বেরুবে ভেতরের মার্বেলটি। ঠিক এই সময়েই ইলেকট্রিকের কাজ জানা ছেলেটি রাস্তার আলো নিবিয়ে দেয়। দুদ্দাড়িয়ে বন্ধ হবে গেরস্ত বাড়ির জানালা। আমাদের মতো কিছু অকালপক্ক জানলার খড়খড়ি একটু ফাঁক করে রাখবে। মারপিটটা শুরু থেকে শেষ দেখতে হবে যে! তাছাড়া আমাদের পাড়াকে মনে-মনে উৎসাহ দিতে হবে তো। বোতল রাস্তায় আছড়ে ফাটলেই প্রথমে একটা ভোঁতা আওয়াজ, তারপরেই কাঁচ ভাঙার শব্দ। ও-পাড়ার একটাকে ধরে চড়-থাপ্পড় মারতে-মারতে কাঠগোলার অন্দরমহলে বন্দি করলেই যুদ্ধ শেষ। বাকি কুরুসেনা ভয়ে পালাবে চুনাপুকুরের রাস্তায়। বোতল গায়ে লেগে আহত হওয়ার থেকে বেশি হত কাঁচের টুকরোয় পা কেটে। এ-পাড়ার কেউ আহত হলে, অন্যের কাঁধ ভর দিয়ে, খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ফিরবে রাস্তার ধার ঘেঁষে। তখন রাস্তার লাইট জ্বলে উঠছে। একটা-দুটো করে খুলে যাচ্ছে জানালা। আমরা মনে-মনে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আহত গোপাল কাকু কিংবা ছোট্টুদার পায়ে। কোনও বাংলা সিনেমায় কেন যে এই সোডার বোতল নিয়ে মারামারির দৃশ্য ধরা নেই! বোমা নিয়ে আছে, কিন্তু বোমা তো কেমিস্ট্রির ফর্মুলা! ১৯০৬-৭ সাল থেকে বাঙালি এতে হাত পাকিয়েছে। তুলনায় সোডার বোতল হস্তশিল্প, ষাটের দশকের পৈতেগাছি!
বিকেলে যে মাঝবয়েসি ফটিক মণ্ডল বঙ্গবাসী কলেজের সামনে, রাস্তায় বসে চাল বিক্রি করত, তার সঙ্গে আমাদের আলাপ ১৯৬৬-র জানুয়ারির কোনও সকালে। তখন রেশনের চাল— সাধারণ ৮৪ পয়সা কিলো, মিহি ৯৬ পয়সা আর অতি মিহি ১ টাকা ২০ পয়সা। চালপাচার, পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশের লড়াই ইস্কুল যাওয়ার মতোই নিত্যদিনের ব্যাপার। আমাদের সদর দরজা খোলাই থাকত। সেদিন রবিবার, তক্তপোশে বসে পড়ছি। বাবা খবরের কাগজে ডুবে। হঠাৎ পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে-পালাতে একজন আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ল। খোঁচা-খোঁচা, কাঁচাপাকা দাড়ি, লুঙ্গির ওপরে শার্ট। থরথর করে কাঁপছে লোকটি। বাবা চুপচাপ উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।– কোথায় থাকো?
–বেগমপুর…
–উরিবাবা, ওইখান থেকে এখানে এসেছ… হুম… তা চাল কোথায়?
লোকটি ইতস্তত করছিল। বাবা ধমক দিলেন, কোথায়?
লোকটি জামা খুলে ফেলল। ভেতরে ফতুয়ার মতো কী একটা পরেছে। ফতুয়া তো পাতলা হয়, এ বেশ মোটা। যেন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, আড়াআড়ি সেলাই করা, সমান্তরালে অনেক সেলাই। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা পা-বাঁচাতে যেমন প্যাড পরে থাকে এ তেমন, ওর বুক-পেট যেন প্যাড দিয়ে মোড়া।
বাবা মাথা নাড়লেন, হুম… দর্জিকে দিয়ে বানিয়েছ?
–হ্যাঁ বাবু…
–কত দাম এগুলোর?
–ছ-সাত টাকা…
–কত চাল ধরে এতে?
–আট-দশ কেজি…
লোকটি একটু ধাতস্থ হয়ে বাবাকে বলল, চালটা বের করে থলেতে ভরে নিয়েই চলে যাব। এইভাবে বেরুলেই পুলিশ…। কোনও উত্তর না দিয়ে বাবা জিগগেস করল, সারাদিনে কত রোজগার?
–এই পঞ্চাশ থেকে সত্তর টাকা… আসলে মহাজনেরাই তো সব নিয়ে নেয়… মারোয়াড়ি মহাজন… সব দেওয়ার পর নিজের দশ টাকাও থাকে না… বাবু চালটা থলিতে ভরে নিয়েই চলে যাচ্ছি…
বাবা চুপ। বোধহয় মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে লোকটি ওই মোটা ফতুয়া থেকে চাল বের করা শুরু করল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ক্রিকেটারদের প্যাড থেকে চাল বেরুচ্ছে!
হঠাৎ লোকটির নজর গেল আমার দিকে। ‘খোকা, তুমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসো… এইসব দেখো না… ভালো করে, মন দিয়ে পড়াশুনো করো… এইসব দেখো না বাবা…’
বাবা নীরবে আমার দিকে তাকালেন। চোখের ভাষা—-ওর কথা শোন। আমি অন্যদিকে মুখ ফেরালাম।
(ক্রমশ)
কলকাতা, নয়…-এর সমস্ত পর্বের জন্য দেখুন: কলকাতা, নয়… — অশোককুমার মুখোপাধ্যায়