থ্রিলার, যা প্রথার বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়

জন লি ক্যারে | সাহিত্যিক

বিষাণ বসু

 


গদ্যকার, প্রাবন্ধিক; পেশায় চিকিৎসক

 

 

 

একজন দর্জি। দেশ পরিচয়ে ব্রিটিশ। যে সে দর্জি নন— খাস লন্ডনের স্যাভিল রো-তে দোকান, এমন দর্জি। আপাতত বাসা বেঁধেছেন পানামায়। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁর হাতে স্যুট বানাতে পানামার তাবড় বড়লোকদের ভিড়। ভিড় রাজনীতিকদের, ক্ষমতাবানদের— এককথায় যাঁদের বলা হয় হুজ হু, পানামার তেমন মানুষদের। দর্জির অতীত অবশ্য পুরোপুরিই ধোঁয়াশা। ঘনিষ্ঠজনেদের কেউই তাঁর অতীত বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানেন না। খাস বিলেতের লন্ডন শহরের পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন গল্প জুড়ে নিজের একখানা বিশ্বাসযোগ্য অতীত নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সবই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু, ধোঁয়াশা সরিয়ে তাঁর অতীতের সুলুকসন্ধান করতে থাকেন অন্য একজন। আর ধরে ফেলতে সময় লাগে না যে, দর্জিসাহেবের গল্পটা যেমন জানা যাচ্ছে, ঠিক সেরকম নয়। সেই অতীত খুঁড়ে দর্জিকে চেপে ধরতে থাকেন তিনি। ব্ল্যাকমেইল করে পানামার সেই দর্জিকে নিয়োগ করেন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসে, কেননা স্যুট বানানোর পেশার সুবাদে উচ্চতম রাজনৈতিক মহলে তাঁর আনাগোনা।

স্পাই হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হলেও, সেই দর্জির গুপ্তচরবৃত্তির উপযুক্ত অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা কোথায়? অতএব নিজের অতীতকাহিনির মতো করেই মনগড়া গল্প ফাঁদতে থাকেন তিনি। চুক্তি অনুসারে, ১৯৯৯ সালে পানামা খালের অধিকার মার্কিনদের হাত থেকে চলে আসবে পানামা সরকারের হাতে। সে নিয়ে বিস্তর সংশয়, উত্তেজনা— রাজনৈতিক টানাপোড়েন। দর্জিমশাই গল্প ফাঁদেন, সরকারের বিরুদ্ধে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে এক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে বিশদ বিবরণ দিতে থাকেন সেই কার্যকলাপের। কিছু চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক— বাদবাকি চরিত্র বাস্তব থেকে, নিজের পরিচিত বা বন্ধুমহল থেকে আহৃত, কিন্তু তাঁর কল্পকাহিনির ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তাঁদের বিন্দুমাত্র যোগ নেই। আর তাঁর এই নির্মিত নাগরিক-বিদ্রোহের গোপন প্রস্তুতির কল্পকাহিনি পৌঁছে যেতে থাকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে। গল্পকথাকে নির্জলা সত্য বলে বিশ্বাস করে কাহিনি পৌঁছে যেতে থাকে মার্কিন সরকারের কাছে। আর ঘরের পাশে পানামায় এমন আসন্ন বিদ্রোহের কথা জেনে রণতরী সাজাতে থাকেন মার্কিন সরকার।

জন লি ক্যারে-র ‘দ্য টেলর অফ পানামা’ বই এই নিয়েই। স্পাই থ্রিলার— নাকি স্পাই থ্রিলারের আদতে পুরো ব্যবস্থাটাকেই ঠাট্টা করা? লি ক্যারে এই বই নিয়ে বলেছিলেন, “এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সে পৌঁছে বুঝি, দুনিয়াটা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে উপায় মাত্র দুটো— হয় আত্মহত্যা, নাহলে পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ে হাসাহাসি করো।”

লি ক্যারে এমনই। প্রথাগত থ্রিলারের সীমানা ভেঙে গিয়েছেন অবিরত। তাঁর গল্পের নায়ক চরিত্ররা কখনওই সুপারহিরো নন। বিপক্ষের গোলাবারুদের মধ্যে দিয়ে একাই দুশো লোককে ঘায়েল করে বেরিয়ে আসতে পারেন না তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রে, তাঁরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তো ননই, মানুষ হিসেবেও খুব একটা উচ্চস্তরের নন। আঙুলের আংটির হীরের মধ্যে চিপ লুকিয়ে বিপক্ষের গোপন তথ্যের হদিশ জেনে ফেলা একেবারেই তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে। তাঁর স্পাই-রা রক্তমাংসের মানুষ— রাষ্ট্রব্যবস্থার হয়ে কাজ করেন অবশ্যই, কিন্তু আর পাঁচটা সরকারি কর্মচারীর মতোই রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে তাঁরাও সন্দিহান। আর কাজ হয়ে গেলে ছেঁড়া পাপোশের মতো করেই তাঁর গল্পের নায়কদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে একবারের জন্যেও দোটানায় পড়ে না রাষ্ট্রশক্তি। তাই, জন লি ক্যারে থ্রিলার লেখেননি— থ্রিলারের আঙ্গিকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন অজস্র প্রশ্ন। বা বিভিন্ন আকারে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে করে গিয়েছেন একটিই প্রশ্ন। তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই অর্থে রক্ষা করে চলার জন্যে নাটবল্টু হিসেবে যাঁরা ব্যবহৃত হয়ে চলেছেন, তাঁদের দায়িত্ব ঠিক কী? বা, তাঁদের ভূমিকা কিংবা কর্তব্যটি ঠিক কী? আপাত-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই বা কী ভূমিকা তার নাগরিকদের প্রতি? বা রাষ্ট্রের কতখানি দায়িত্ব তার দ্বারা নিযুক্ত এই গুপ্তচরদের প্রতি? এই পারস্পরিক মিথোজীবী সম্পর্কের টানাপোড়েন,  নীতিবোধের দ্বন্দ্ব ও সংশয়— লি ক্যারে-র যাবতীয় লেখালিখির মধ্যেকার মূল প্রশ্ন, বা অন্তর্ঘাতের জায়গা এটাই।

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সেই বিখ্যাত বই— ‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’। না, এটি তাঁর প্রথম বই নয়। কিন্তু, এই বইই রাতারাতি লেখক হিসেবে স্বল্পপরিচিত জন লি ক্যারে-কে তুলে দেবে খ্যাতির শিখরে। সেই সময়কার স্পাই-থ্রিলারের জগৎটিকে বুঝতে হলে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ঠিক এর আগের বছরেই প্রকাশিত হয়েছে ইয়ান ফ্লেমিং-এর সেই ধুন্ধুমার বই ‘দ্য স্পাই হু লাভড মি’। নায়ক জেমস বন্ড। সে বই নিয়ে বা সেই বইয়ের নায়কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন, কেননা বইটি না-পড়লেও সিনেমাটা প্রায় সকলেই দেখেছেন— না দেখলেও নারীবেষ্টিত গ্ল্যামারাস জেমস বন্ডের চরিত্রের মূল আদলটি সবারই পরিচিত। বিপরীতে লি ক্যারে-র বইয়ের নায়ক অ্যালেক লিমাস সেই একই ব্রিটিশ সরকারেরই গুপ্তচর— চরবৃত্তিতে নেমেও, কী মুশকিল, সে ভালোবেসে ফেলে কমিউনিস্ট লিজ-কে… না, ভালোবাসার ছলনা বা ভালোবাসাকে চরবৃত্তিতে ব্যবহার করা নয়, সত্যিসত্যিই ভালোবেসে ফেলা। গুপ্তচরবৃত্তির কাজে লিমাস শেষমেশ সফল হয় না— অপারেশন ব্যর্থ হয়। কিন্তু, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমের ব্যর্থ যোদ্ধা লিমাস ও কমিউনিস্ট লিজ-এর প্রেমটুকু হারিয়ে যায় না। রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে লড়াইয়ে মানবিক সম্পর্ক জিতে যেতে পারে। তবু, সেই অর্থে জিততে পারে কি? শেষ দৃশ্যে নিজে বার্লিন ওয়াল টপকে পালানোর সুযোগ পেলেও লিজ-কে ফেলে পালিয়ে যেতে চায় না লিমাস।

লি ক্যারে-র সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র জর্জ স্মাইলি, যিনি কিনা ফিরে ফিরে এসেছেন অনেক বইয়েই, তাঁকে একটু খুঁটিয়ে দেখলেই জেমস বন্ডের সঙ্গে কন্ট্রাস্টটুকু আরো স্পষ্ট ধরা যাবে। লি ক্যারে-র নায়ক স্মাইলি পোশাকে অগোছালো, চেহারায় ঈষৎ স্থূলকায়— তাকলাগানো সুদর্শন একেবারেই নন। স্মাইলি চাকরি করেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে— লাল ফিতের ফাঁসের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিরক্তি নিয়েই তাঁকে কাজ করে যেতে হয়— অফিসে খুচরো অফিস পলিটিক্সও। জর্জ স্মাইলি বিবাহিত, তাঁর স্ত্রী তাঁকে খুব একটা ভালোবাসেন, এমনও নয়। লি ক্যারে খুব সচেতনভাবেই নিজের নায়ককে রেখেছেন জেমস বন্ডের একশো আশি ডিগ্রি বিপরীতে।

কিন্তু, তার চাইতেও বড় ফারাক অন্যত্র। গুপ্তচরবৃত্তির অন্তর্নিহিত অসত্য বা সত্যগোপন, এমনকি মিথ্যা, প্রতি মুহূর্তে ভাবাতে থাকে স্মাইলিকে। উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন, তার বিপরীতে এই বিশেষ পথটির অনিবার্য নীচতা তাঁকে নিরন্তর তাড়া করতে থাকে। গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে থাকা হিংসা বা খুনোখুনি স্মাইলি-র কাছে কোনও উত্তেজনার উপাদান নয়, বরং, এ এক গভীর নৈতিক সঙ্কট। ঠিক এইখানেই লি ক্যারে আর পাঁচজন স্পাই থ্রিলার লেখকের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের।

গত শতকের শুরুর দিকে ড্যাশিয়েল হ্যামেট ভেঙে দিয়েছিলেন গোয়েন্দা কাহিনির প্রচলিত ধারাকে। এবং তাঁর সেই কাজকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন রেমন্ড শ্যান্ডলার। শ্যান্ডলার, বিশেষত, ভাষার এক আশ্চর্য স্টাইলাইজড ব্যবহারে গোয়েন্দা কাহিনিকে তুলে দিতে পেরেছিলেন সাহিত্যের মর্যাদায়। সে স্বপ্ন আজীবন দেখেছিলেন জন লি ক্যারেও— স্বপ্ন এমন একদিনের, যখন তথাকথিত বেস্টসেলার লেখক হিসেবে খাটো চোখে দেখার পরিস্থিতি থেকে থ্রিলারের লেখকরা গণ্য হতে পারবেন সিরিয়াস সাহিত্যিকদের সমপর্যায়ভুক্ত হিসেবে। আজীবন কোনও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার তাঁর বরাতে না জুটলেও, ব্যক্তিগতভাবে লি ক্যারে অবশ্য শেষমেশ সিরিয়াস সাহিত্যিক হিসেবেই গণ্য হতেন— সে সম্মান তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু, লি ক্যারে-র কৃতিত্ব শুধু সেটুকুই নয়। হ্যামেট প্রসঙ্গে শ্যান্ডলার যেকথা বলেছিলেন— বড়লোকের ড্রয়িংরুম থেকে হ্যামেট খুনখারাপি ব্যাপারটাকে নামিয়ে এনেছিলেন অন্ধকার গলিতে, মানে যেটা তার আসল জায়গা, সেখানেই— কথাটা লি ক্যারের স্পাই থ্রিলার প্রসঙ্গেও সমান প্রযোজ্য। অর্থাৎ সুপারহিরোর সার্কাসের পর্যায় থেকে স্পাই থ্রিলার ব্যাপারটাকে রাষ্ট্রনিযুক্ত বাস্তব গুপ্তচরের আটপৌরে জীবনের ভালোখারাপের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি। আর, যেকথা আগেই বলছিলাম, লি ক্যারে সেই রক্তমাংসের মানুষটির সঙ্কট ও দ্বিধার মধ্যে দিয়ে পাঠকের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন আরও অনেক প্রশ্ন।

আগাগোড়াই লি ক্যারে ধরতে চেয়েছিলেন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপরীত্যকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। সেই সরকারই ক্ষমতা অটুট রাখতে নাগরিকদের বিরুদ্ধে যখন গুপ্তচরবৃত্তি করে চলে, সে কি গণতন্ত্রের রীতিসম্মত? রাষ্ট্র যখন নিজেকে অক্ষত রাখার নামে তারই এক নাগরিককে শত্রু-রাষ্ট্রে পাঠায় এবং বিপাকে পড়লে সেই নাগরিক বিষয়ে দায়টুকু ঝেড়ে ফেলে, তা কোন নীতিসম্মত? শত্রুদেশ বলতে তো আরেকটি দেশই— আপাত-শত্রুতা সেই দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা বা ক্ষমতাসীন শ্রেণির বিরুদ্ধে হলেও, আম নাগরিকের ক্ষেত্রে এদেশ ও ওদেশের মানুষের মধ্যে ফারাক রয়েছে কি? দেশকে রক্ষা করার ঠিক অর্থটা কী? দেশের শত্রু বলতে কারা? দেশের নিরাপত্তা বলতে ঠিক কাদের জন্যে নিরাপত্তা? সে নিরাপত্তা ছিদ্রহীন করতে দেশের নাগরিক, কিম্বা অপর দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণহানি কতখানি নৈতিক? প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সবদেশে। সবকালেই। ঠিক একারণেই আরেক জনপ্রিয় লেখক রবার্ট হ্যারিস যখন বলেন, একশো বছর বাদেও লোকে লি ক্যারে-র বই পড়বে, তখন সেটা এতটুকু অতিকথন বলে মনে হয় না।

কেমন করে তৈরি হন একজন লেখক? বাড়িতে বই পড়ার চল দেখে? একজন কল্পনাপ্রবণ শিশু থেকে জন্ম নেয় একজন কিশোর, যে কিশোর বাস্তবকে অতিক্রম করে কোনও কল্পজগত কিম্বা অতিবাস্তবের দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যায়? লেখক হওয়ার শুরুটা কি শৈশব থেকেই আগ্রাসী পাঠক হয়ে? আর যা-ই হোক, ডেভিড কর্নওয়াল হিসেবে যার জীবন শুরু, সেই শিশুর জীবনের সঙ্গে উপরোক্ত সম্ভাবনার কোনও মিলই নেই। এমন শিশু, যার বাবা গর্ব করে বলবেন, তিনি জীবনে একখানাও গল্প-উপন্যাস পুরোপুরি পড়ে উঠতে পারেননি। এমন কিশোর, যার কৈশোরে বইয়ের স্মৃতি বলতে একমাত্র উইন্ড অফ দ্য উইলোজ, যেটি তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন তাঁকে পড়ে শুনিয়েছিলেন হাসপাতালের এক নার্স। ডেভিডের বই পড়া শুরু হবে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে— আর সেই জগৎ থেকে তিনি বেরোতে পারবেন না কখনওই। পরবর্তীতে তিনি কিছুদিন ইশকুল ও কলেজে পড়ানোর পরে যোগ দেবেন ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর সংস্থায় আর সেখান থেকেই লেখালিখির জগতে প্রবেশ করবেন। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এক কর্মীর পক্ষে আচমকা বইটই প্রকাশ করে প্রচারের আলোয় চলে আসাটা তো কোনও ভালো কথা নয়— সে বই সিক্রেট সার্ভিসের গল্প নিয়ে না হলেও, দস্তুরমতো অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি চাইতে গেলে উত্তর মেলে, এমনকি ফুল-পাখি-প্রজাপতি নিয়ে লিখলেও, এই চাকরিতে থেকে বই লিখতে হলে ছদ্মনামেই লিখতে হবে। ডেভিড কর্নওয়াল থেকে জন্ম নেন জন লি ক্যারে।

সিক্রেট সার্ভিসে ঠিক কেমন ছিল তাঁর জীবন? প্রশ্নটা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা চরবৃত্তিকে ঘিরে এক আলোআঁধারির জগৎ নির্মাণ করার সুবাদেই আমরা তাঁকে চিনি। তাঁর জীবনের এই বিশেষ দিকটি ঘিরে বাড়তি আগ্রহ, অতএব, যুক্তিহীন নয়। কিন্তু, জীবনীতেই বলুন, কিম্বা আত্মজীবনী, উত্তর পাওয়া যায় না। তিনি আত্মজীবনীর শুরুতেই বলেন, এগুলো সত্যি গল্প, যা কিনা স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত আর পাঠক হয়ে আপনারা জিজ্ঞেস করতেই পারেন, কোনটা সত্যি আর কোনটা স্মৃতি!! তবু, বইয়ে কোনও অসত্য বলিনি, গল্প হয়ত লুকিয়েছি কিম্বা মুখোশের আড়ালে বলেছি, কিন্তু মিথ্যা কিম্বা বানিয়ে বলিনি। স্বাভাবিকভাবেই, এই বই থেকে কোনটা ছদ্মবেশ আর কোনটা নিপাট সত্যি, সাধারণ পাঠক হিসেবে ছেঁকে নেওয়া দুরূহ। আত্মজীবনী থেকে একটু তুলে দিই— ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের দৃশ্য—

“Mr David,” [Arafat] cries. “Why have you come to see me?”

“Mr Chairman,” I reply in the same high tone. “I have come to put my hand on the Palestinian heart!”

Have we been rehearsing this stuff? He is already guiding my right hand to the left breast of his khaki shirt. It has a button down pocket, perfectly ironed …

“Mr David, it is here!” he cries fervently, “It is here!” He repeats for the benefit of our audience.

We enter an Arab embrace. Left, right, left. The beard is not bristle, it’s silky fluff. It smells of Johnson’s baby powder.

এই লেখার কতখানি নিখাদ বাস্তব? সাক্ষাৎটুকু বাস্তব অবশ্যই। কিন্তু, এই কথোপকথন? প্রাক্তন চরমপন্থী নেতার দাড়ি থেকে ভেসে আসা বেবি পাউডারের গন্ধ? অবশ্য, বইয়ের শুরুতেই লি ক্যারে সতর্ক করে দেন, সত্যিটা যদি খুঁজতেই হয়, সত্যি যদি কোথাও আদৌ থেকে থাকে, তাহলে তা ওই কাঠখোট্টা তথ্যের মধ্যে নয়, খুঁজতে হবে বিভিন্ন আভাসে, লুকিয়ে থাকবে কথা আর বাস্তবের অতি সূক্ষ্ম তারতম্যে, আভাসে। মনে পড়ে যায়, আত্মজীবনী প্রসঙ্গে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস যেমন বলেছিলেন, আমার যাবতীয় গল্প-উপন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আমার আস্ত জীবন, আর এই আত্মজীবনী আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ফিকশন-ধর্মী লেখা। সেই একই সূত্র মেনে ব্যক্তি জন লি ক্যারে আর তাঁর সময়কে দেখতে চাইলে পথ তাঁর উপন্যাসগুলিই।

অতএব, আসুন, ফিরে দেখি তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ‘আ পার্ফেক্ট স্পাই’ বইয়ের দিকে। যে বইকে ফিলিপ রথ-এর মাপের লেখক অভিহিত করেছেন যুদ্ধপরবর্তী সময়ের ইংরেজি ভাষায় লিখিত সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি হিসেবে। যে বইয়ের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে জন লি ক্যারে-র প্রথমজীবন, তাঁর বাবার স্মৃতি, আরও অনেক কিছু। মাথায় রাখা যাক, ডেভিড কর্নওয়াল, ওরফে জন লি ক্যারে-র বাবা ছিলেন আলো-আঁধারি জগতের মানুষ— ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, চিটিংবাজ, বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত— শেষে জেলেও যেতে হয় তাঁকে, দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছানোর কারণে লি ক্যারে-কে নামীদামী ইশকুল ছেড়ে পড়তে হয় সরকারি স্কুলে। পার্ফেক্ট স্পাই-এর নায়ক ম্যাগনাস পিম-এর বাবাও তা-ই। অর্থাৎ চিটিংবাজ, গোলমেলে, নৈতিকতার বোধহীন। বাবার শেষকৃত্যের পর ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের গুপ্তচর পিম অদৃশ্য হয়ে যান। তাঁকে খুঁজতে থাকেন সকলেই— ব্রিটিশ সরকার তো বটেই, তাঁর পরিজন স্ত্রী বন্ধুরাও। আস্তে আস্তে গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাকি জীবন প্রকাশ্য হয়। জানা যায় ডাবল এজেন্ট হিসেবে তার ক্রিয়াকলাপ— এমনকি শত্রুপক্ষের হয়ে তাঁর চরবৃত্তির খবর। আর আমরা একইসঙ্গে পড়তে থাকি পিম-এর স্মৃতিচারণ। কাহিনি কখনও সামনের দিকে এগোতে থাকে, কখনও পিছিয়ে যায়। পিম-এর সঙ্গে তার বাবার সম্পর্কের জটিলতা, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সংশয়, হয়ত বাবার সূত্রে জিনের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলা নৈতিকতার বোধহীনতা— আমরা ঢুকে পড়তে থাকি এক আশ্চর্য ন্যারেটিভে। চিনতে থাকি এক অদ্ভুত মানুষ ম্যাগনাস পিম-কে, যাকে কিনা আজীবন ব্যক্তিজীবনে এবং পেশাগত কারণে এমন বিভিন্ন ভূমিকায় নিরন্তর অভিনয় করে চলতে হয়েছে, নিজের মধ্যেই সেই বিবিধ চরিত্রের টানাপোড়েন মানুষ ম্যাগনাস পিম-কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পড়তে পড়তেই মাথায় চলে আসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গঙ্গাধরের বিপদ গল্প, যেখানে অশরীরী খাঁ-সাহেবের মানবরূপ ধারণের প্রাণপণ প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। “খাঁ-সাহেব প্রাণপণে দাঁতমুখ খামুটি করে বিষম মনের জোরে তার দেহের চূর্ণায়মান অণুগুলো যথাস্থানে ধরে রাখবার জন্যে চেষ্টা করচে! কিন্তু পেরে উঠচে না…” বিভুতিভূষণের এই আশ্চর্য বর্ণনার সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায় ম্যাগনাস পিম। কিন্তু, ফারাক এই, ম্যাগনাস পিম-এর আত্মাটি যেসকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমষ্টি, তা নির্মাণ করেছে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অথচ, খাঁ-সাহেব, থুড়ি ম্যাগনাস পিম যখন এই বিপন্ন ও চূর্ণায়মান অস্তিত্বটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যেতে চাইছেন, কৃতকর্মের দায়ভার নেওয়া তো দূর, রাষ্ট্রশক্তি তাঁকে তাড়া করে চলেছে। আর হ্যাঁ, একইসঙ্গে এই বই, ‘আ পার্ফেক্ট স্পাই’, একটি পার্ফেক্ট থ্রিলারও বটে— যার পাতায় পাতায় কী-হয়-কী-হয় রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, পড়তে শুরু করলে শেষ না করে থামা মুশকিল।

তবু যে কথা বলার, তাঁর বইগুলোর পরিচিতি থ্রিলার হিসেবে হলেও লি ক্যারে-র ভাষা তরল বা লঘু নয় একেবারেই। সত্যি বলতে কি, লি ক্যারে-র লেখার ভাষা পাঠকের নিবিড় মনঃসংযোগ দাবী করে, আর একবার মন ডুবিয়ে দিতে পারলেই অনুভব করতে পারবেন যে, তাঁর ভাষাটি ভারি আশ্চর্য। কয়েকটি শব্দের আঁচড়ে তিনি নিখুঁত এঁকে ফেলতে পারেন কোনও অপরিচিত শহরের ছবি। আপাত নিস্পৃহতার আড়ালে তাঁর ভাষা ভারি কাব্যিকও বটে— আর, সামান্য দু-একটি বাক্যে, কি একটিই লম্বা বাক্যে আপনাকে পৌঁছে দিতে পারেন নতুন এক পরিবেশে। ‘স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’ থেকে একটু তুলে দিই—

…For most months, Bonn is not a place of seasons; the climate is all indoors, a climate of headaches, warm and flat like bottled water, a climate of waiting, of bitter tastes taken from the slow river, of fatigue and reluctant growth, and the air is an exhausted wind fallen on the plain, and the dusk when it comes is nothing but a darkening of the day’s mist, a lighting of tube lamps in the howling streets.

এ লেখায় কথা প্রসঙ্গে জন লি ক্যারে-র অনেকগুলো উপন্যাসই আসতে পারত। জর্জ স্মাইলি এবং কার্লা-র দ্বৈরথ বিষয়ক তিনটে বই— তাঁর সবচাইতে জনপ্রিয় ও পরিচিত ট্রিলজি— ‘টিংকার টেইলর সোলজার স্পাই’, ‘দ্য অনারেবল স্কুলবয়’ এবং ‘স্মাইলিজ পিপল’— সেদিকে তো যাওয়াই হল না। বলা হল না, তৃতীয় বিশ্বের দেশে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ড্রাগ ট্রায়ালের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সেই বই ‘দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডেনার’-এর কথাও। অথবা, খুবই জরুরি ছিল উল্লেখ করা ‘দ্য সিক্রেট পিলগ্রিম’ বইয়ের নাম, যেখানে ঠান্ডা যুদ্ধের শেষে অবসরপ্রাপ্ত জর্জ স্মাইলি কথা বলছেন এই পেশার নতুন প্রজন্মের সঙ্গে। আর জানাচ্ছেন সেই অমোঘ সত্য, ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ, দুনিয়াটা বদলে গেল— কিন্তু, আরেকদিক থেকে দেখলে, কিছুই বদলায়নি, কিছুই বদলায় না। প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, জেরার সময় কেউ মিথ্যে বললে ধরে ফেলা সহজ, কিন্তু জেরায় কেউ সত্যি কথাটা বললে সে বোঝা খুব মুশকিল (আজকের রাজনীতির দিকে তাকালে, কথাটা বড় বেশি সত্যি— তাই না?)। শিক্ষিত ব্রিটিশদের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে ঈষৎ শ্লেষের সুরেই বলছেন, “…which is why some of our best officers turn out to be our worst, and our worst, our best, and why the most difficult agent you’ll ever have to run is yourself.” আর স্মাইলির এই কথোপকথনের প্রেক্ষিতে নিজের ফেলে আসা জীবনের জয়পরাজয়ের হিসেবের খাতা মিলিয়ে দেখছেন আরেক গুপ্তচর নেড। কিন্তু, লেখাটা বড্ড দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।

কাজেই, লেখা শেষ করার আগে ফিরে দেখা যাক তাঁর শেষ দিককার উপন্যাস ‘এ লিগাসি অফ স্পাইজ’, যে বই লেখা হল তাঁর প্রথম বিখ্যাত বই ‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’-এর অনুষঙ্গে। মনে করুন, সেই বইয়ের নায়ক অ্যালেক লিমাস-কে। লিগাসি অফ স্পাইজ বইয়ে সেই লিমাসের ছেলে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে বাবার অকারণ মৃত্যুর জন্যে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবী করে। এই বইয়ের নায়ক পিটার গুইলামের বয়ানে উঠে আসে স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড বইয়ের অভিযানের প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি এবং বর্তমানের প্রেক্ষিতে সেই অভিযানের যাথার্থ্য। সত্যি বলতে কি, এমন আশ্চর্য বই জন লি ক্যারে বাদ দিয়ে আর কেউই কি ভেবে উঠতে পারতেন!! ইয়ান ম্যাকইউয়ান যাঁকে বলেন গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ লেখক, সেই লি ক্যারে-র পক্ষেই সম্ভব নিজের আজীবনের সাহিত্যকর্মের এমন আশ্চর্য উপসংহার লিখে যাওয়া।

এই বইয়ের একখানা প্রশ্ন দিয়েই এ লেখা শেষ করি—

‘So it was all for England, then?’… ‘There was a time, of course there was. But whose England? Which England?’…

এই প্রশ্নে, ইংল্যান্ডের জায়গায় নিজের দেশের নাম বসিয়ে নিন। প্রশ্নটা সমান ভ্যালিড৷ সব দেশে। সব কালেই। আর বর্তমান সময়ে তো বটেই। না, লি ক্যারে-র মধ্যে উচ্চকিত রাজনীতি পাবেন না। তাঁর চরিত্রদের মতো, লি ক্যারে-ও, সম্ভবত, কনফিউজড— বইয়ের মধ্যে প্রশ্ন যত লুকিয়ে রয়েছে, উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অবশ্য, এই গুলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, নিজের অবস্থান বিষয়ে যাঁরা বড় বেশি নিশ্চিত, তাঁদের উদ্দেশে উপযুক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারাটাই হয়ত রাজনীতির যথাযথ পাঠ। লি ক্যারে-কে পড়ুন। প্রশ্নগুলো জানার জন্য। প্রশ্নগুলো করার জন্যও।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...