পশ্চিমবাংলা ২০২০: বিপর্যয়ের মধ্যে পাওয়া সুযোগ

কুমার রাণা

 



সমাজকর্মী

 

 

 

 

হাহাকার করে লাভ নেই।

বাংলার সংস্কৃতি বিপন্ন, এ আশঙ্কা খুবই বাস্তব। অনেক সময়ই পরিবর্তনকেই বিপন্নতা বলে ধরে নেওয়া হয়। যেমন, ষাটের দশকের গোড়ায় শোনা যেত, সিনেমা এসে ছেলেদের নষ্ট করে দিচ্ছে। তার কিছুদিন পর শোনা গেল হিন্দি সিনেমা সমাজের সর্বনাশ করছে, ইত্যাদি। তারপর আস্তে আস্তে লোকে সেই পরিবর্তনগুলো মেনে নিয়েছে। কিন্তু, গত কয়েক বছরে পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তার চরিত্র আলাদা। এই পরিবর্তনগুলো খুব স্বাভাবিকভাবে আসছে না, আনা হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে। যেমন রামনবমী, অথবা হনুমানজয়ন্তী। বাংলার কোনও প্রান্তেই, কোনওকালে এই প্রদর্শনটি ছিল না। কয়েক বছর ধরে ভারতীয় জনতা পার্টির সোৎসাহ উদ্যোগে এগুলিকে যুদ্ধোন্মাদের ভীতিপ্রদর্শনের ভঙ্গিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। শত শত বছর ধরে পশ্চিমবাংলায় রামের যে মূর্তিটি মানুষের মনে আঁকা হয়ে এসেছে, বিজেপির চাপিয়ে দেওয়া রাম তার সম্পূর্ণ বিপরীত। একইরকমভাবে, হনুমানের সঙ্গে বাঙালি জনতার প্রজন্মর পর প্রজন্ম ধরে মস্করার সম্পর্ক, অথচ তার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এমন এক হনুমানকে, পূজা দিয়ে যার তুষ্টি বিধান করতে হয়। সামাজিক সৌজন্যে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা নমস্কারের জায়গা নিচ্ছে জয় শ্রীরাম। এক কথায় বাংলাকে তার আপন অন্তর থেকেই উৎখাত করার চেষ্টা চলছে। সে অন্তরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একই সঙ্গে মানুষে মানুষে প্রেম ও সখ্য, এবং চিন্তার জগতে প্রখর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই বৈশিষ্ট্যই তাকে দিয়েছে এমন এক অনন্যতা যা থেকে বারংবার জন্ম নিয়েছে শাসক-সত্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাই, বিজেপি-র কাছে বাংলা দখল করার একটা বিশেষ মানে আছে— যত দিন পর্যন্ত বাংলার ওপর সাংস্কৃতিকভাবে আধিপত্য কায়েম করা যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তার ভারতমাতার কল্পনা শুধু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তাই না, বারবার প্রতিস্পর্ধার সম্মুখীন হবে। তাই বাংলার অন্তরের ওপর বিজেপির আক্রমণটা এমনভাবে নেমে আসছে যে, এর পর হয়তো হাহাকারের সুযোগটুকুও থাকবে না।

তাই, হাহাকার করে লাভ নেই। তাতে কেবল সময়ের অপচয়, এবং অযথা শক্তিক্ষয়। বরং, বিলম্বে হলেও, বহু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত, ইতিহাসের একটা বহুমূল্য শিক্ষাকে সম্বল করে এগোনো দরকার। সে অভিজ্ঞতা বলে, মহা বিপর্যয়ের ক্ষণগুলোতে কিছু বড় বড় সুযোগও আসে, যে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মানবসভ্যতা বিকাশ লাভ করতে পারে। আজ এই করোনা-কবলিত বছরে হয়তো বাংলার সামনে তেমনই সুযোগ এসেছে। মাসুল তো দিতেই হবে, কিন্তু সেই মূল্যের বিনিময়ে হয় আমরা নতুন কিছু পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি, অথবা হাহাকার এবং পরস্পরকে দোষারোপ করে যেতে পারি।

যুক্তির দাবি মানতে হলে আমাদের প্রথম পথটাই নিতে হবে, এবং ভাবতে হবে, যে শক্তি ও সময় আছে কীভাবে তার যথাযথ ব্যবহার করা যায়, এবং বাংলার অন্তরের ওপর আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। সেটা করতে গেলে অবশ্য প্রথমেই কতকগুলো অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে— কীভাবে এই পরিবর্তনটি হল? বাংলার মানুষ তার মাথার ওপর কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে দেওয়া এরকম একটা সাংস্কৃতিক প্রদর্শনকে মেনে নিল কেন? কেন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি রাজনৈতিক প্রতিপত্তি লাভের আখড়া হয়ে উঠল— বিনা প্রতিবাদে? এটা কি আকস্মিক? না কি এর ভিত্তিভূমি অনেক দিন ধরেই তৈরি হয়ে চলেছিল? আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সুযোগের অসম বিকাশ ও বৈষম্যপূর্ণ বণ্টনের প্রতিফলন কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটাতেও দূরত্ব তৈরি করেনি?

অস্বস্তিকর হলেও মানতেই হচ্ছে যে, দূরত্ব কমার বদলে বৃদ্ধি পেয়েছে। চোখ-কান খোলা রাখলে বাংলার যে কোনও প্রান্তেই— শহরে এবং গ্রামে— দেখা যাবে গভীর বৈষম্য। এবং তা নানা স্তরে। প্রথমত নগরের একটি ক্ষুদ্র অংশ, যেটি নিজেকে বাংলার নবজাগরণের উত্তরসূরি মনে করে এসেছে। বাংলা সাহিত্য, শিল্প, বিদ্যাচর্চা— সর্বক্ষেত্রে এই অংশটির আধিপত্য। সেই ধারায় বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির সঙ্গে এর যোগ। এ অংশটি প্রধানত কলকাতা-কেন্দ্রিক, বড়জোর তার কিছু প্রভাব গিয়ে পড়ে জেলা বা মফস্বলের শহরগুলোতে। বামপন্থী রাজনৈতিক ধারায় যে গণ-শিল্প ও সাহিত্য গড়ে ওঠার প্রয়াস পেয়েছিল, সেটাও, পথ হারাল নগর-কেন্দ্রিকতার চোরাগলিতে। আবার, নগর-কেন্দ্রিকতা মানে যে সকল নগরবাসী এই আলোকিত পৃথিবীর দেখা পেলেন, তা নয়। বরং, গ্রামাঞ্চলের মতোই এই কলকাতা শহরের মধ্যেও নিজের মতো করে বাস করতে লাগল এক বিপুল জনসমষ্টি যার ভাষা আলোকায়িত বাংলা জানে না, আর আলোকায়িত বাংলার ভাষা যে গোষ্ঠীর কাছে দুর্বোধ্য সাঙ্কেতিক শব্দচিহ্ন।

পাশাপাশি, সাধারণ জীবনযাত্রায় বৈষম্য কমানোর যে উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল, তার জায়গা নিল এক ধরনের নিস্পৃহতা। যে রাজনীতির দায়িত্ব ছিল সমাজ ও তার মানসকে বদলানোর, সেই রাজনীতিই সমাজের কাছে আত্মসমর্পণ করল। রাজনীতি মেনে নিল, “দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ— আর কোনও বিকল্প নেই”। সমাজ যে দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই পথেই চলতে হবে। এর ফলে, একদিকে সমাজের অভ্যন্তরে বইতে থাকা পূর্ব-শতাব্দীগুলোর ধারা অব্যাহত থাকল, যার একটি বড় প্রমাণ, আজও পশ্চিমবঙ্গে আঠারো বছরের কম বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের অনুপাত (৪২%) দেশের মধ্যে সর্বাধিক। বছরের পর বছর ধরে বাংলার সমাজে জাতির সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মনিয়োজন, ইত্যাদির নিবিড় সম্পর্ক দেখে আসা সত্ত্বেও নাগরিক বাঙালি এই বিভ্রমে বেঁচে থেকেছে যে, বাংলার সমাজে জাতি-ভেদ নেই। সে হঠাৎ দেখল, হাড়ি-বাগদি-মুসলমানের রান্না করা খাবার ব্রাহ্মণ-তেলি-সদগোপ বাড়িগুলো থেকে আসা বাচ্চাদের খেতে মানা করে দেওয়া হয়েছে। জাতি-ভেদের গরলের বিষময় ফল কেবল নিচুজাতের লোকেদেরই ভোগ করতে হচ্ছে না, করতে হচ্ছে গোটা সমাজকে— শিক্ষায়, সাহিত্যে, শিল্পে, বাংলার যে দৈন্যদশা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, তার একটা প্রধান কারণই তো এই যে, এগুলোতে বৃহত্তর জনসমষ্টির যোগদান ঘটল না, আলোকায়নের প্রক্রিয়ায় আহরিত মেধা-মননের স্রোত শুকোতে শুকোতে পড়ে আছে কেবল মরু-বালি রাশি।

অন্য আরও এক বিভ্রম বাংলার সমাজকে অন্ধ করে রেখেছে: উন্নয়নের বিভ্রম। এ কথা ঠিক যে সমাজের সব অংশের লোকেদের মধ্যে কিছু না কিছু সামর্থ্য বেড়েছে। আগে যাঁদের অনাহারে থাকতে হত, তাঁদের এখন খালি পেটে থাকতে হয় না। গ্রামে গঞ্জে মোটরবাইক, চার-চাকা গাড়ি, টেলিভিশন, মোবাইল ফোনের মতো সমৃদ্ধির নানান সূচক খুবই চোখে পড়ে। কিন্তু, এইগুলোকে উন্নয়নের প্রমাণ বলে মেনে নেওয়াটা আসলে একটা প্রবঞ্চনা— নিজেকে এবং অন্যদের। এই চাকচিক্যের আড়ালে যেটা ঘটে চলেছে তা হল জাগতিক এবং মানসিক দুই দিকে দিয়েই মানুষে মানুষে দূরত্ব-বৃদ্ধি। কিছু লোক হয়ে উঠেছে বিশেষ বিশেষ এলাকার মনসবদার, তাদের হাতে এসেছে প্রচুর ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা তারা কাজে লাগিয়েছে টাকা কামানোর কাজে, আবার সেই টাকাকে কাজে লাগিয়ে আরও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছে। অর্থই যেহেতু একমাত্র উপাস্য, সেই অর্থ উপার্জনের পথ নিয়ে বিচার-বিবেচনা বাহুল্য বলে গণ্য হতে লাগল। সমাজের অভ্যন্তর থেকে পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোর কলুষ দূর করার জন্য যে নৈতিক রাজনীতি ও সামাজিক ক্রিয়ার প্রয়োজন ছিল, সেই দায়িত্বটা বহন করা তো দূর, তাকে স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি। ফল, সেই পঙ্কিল ভূমিকে ঘোর অ-মানবিক, অর্থগৃধ্নু ও ক্ষমতালিপ্সু, এক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করা। অনেকে বিস্মিত, যে রাজনীতি বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে, রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলতে চায়, রামমোহনকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, লোকে তার প্রতিবাদে সংগঠিত না-হয়ে কেন সেই বিজেপি দলের মিছিলে যোগ দিচ্ছে! এর অন্তত একটা কারণ এই যে, এঁদের কাছে বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-রামমোহনদের পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করাই হয়নি। বিজেপি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাহায্যে গুজরাটে কত লোককে খুন করেছে, দিল্লিতে কত লোককে ঘরছাড়া করেছে, এ হিসেবগুলো এক শ্রেণির বাঙালির কাছে বেশ উল্লাসের— এ শ্রেণিটি বরাবরই মনের ভিতর মুসলমান-বিদ্বেষ পালন করে এসেছে, কেবল পরিস্থিতির চাপে খুব একটা সক্রিয় হতে পারেনি। আর অন্য একটি অংশের কাছে এ হিসেবগুলো অতি দূরের বস্তু— তাদের দিন-আনি-দিন-খাই জীবনে সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দুত্ববাদ, কর্পোরেট আগ্রাসনের মতো যে অভিধাগুলো দিয়ে বিজেপিকে পরিচিত করানো হচ্ছে সেগুলো বিমূর্ত কিছু শব্দমাত্র। সেগুলোকে তাদের প্রকৃত অর্থ-সহ মূর্ত করে তোলার জন্য যে সামাজিক-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রয়োজন ছিল, তার কণামাত্রও সংগঠিত হয়নি।

হয়নি বলে হবে না, হতে পারবে না, এমনটা ভাবার কারণ নেই। দুর্বিপাকের মধ্যে বাঙালির সামনে একটা সুযোগ এসেছে: সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু শতাব্দীপ্রাচীন অনড়তা এবং কিছু অত্যাধুনিক লোক-বিরোধী গতিশীলতা (যেন তেন প্রকারেণ টাকা কামানোই যার বৈশিষ্ট্য) সম্পর্কে সচেতন অনুসন্ধান এবং তাদের বিরুদ্ধে একটা বৃহত্তর সামাজিক জোট গড়ে তোলার। বাংলার অন্তরের একটা অন্যতর, অগ্রগামী চিন্তার ঐতিহ্যও আছে। বাঙালি এখনও সেই চিন্তার, সেই অনুসন্ধিৎসার ঐতিহ্যকে আবাহন করে, তার নিজস্বতা বজায় রাখতে পারে। বিজেপির রাজনীতিকে কেবল ভোটে হারানোটাই একমাত্র কাজ নয়, কাজটা তার চেয়ে অনেক বড়। দলটা চরিত্রগতভাবে লোকবিরোধী, তাকে পরাস্ত করবার জন্য প্রকৃতই লোকমুখী এক সামাজিক-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রয়োজন। তার আয়োজনে প্রথম ধাপ হচ্ছে, বাঙালি জনসাধারণের— গ্রামের বা নগরের, নারী বা পুরুষ, হিন্দু বা মুসলমান, উঁচু জাত বা নিচু জাত, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত— সকলের মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতি। এবং প্রত্যেকের বিকাশের জন্য সমান সুযোগের দাবিটাকে প্রধান দাবি হিসেবে তুলে আনা।

আজকের দিনে বাংলার তথাকথিত অগ্রণী সমাজের কাছে এটাই একটা বড় সুযোগ। অন্যের স্বার্থভাবনার মধ্যে দিয়েই সে নিজের স্বার্থ শুধু নয় অস্তিত্বটাকেও সুরক্ষিত রাখতে পারে।

হাহাকার করে লাভ নেই।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...