অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
লেখাটি যখন শুরু করেছি, তখন দিল্লি সীমান্তের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে হাজারে হাজারে কৃষকেরা তাঁদের ট্র্যাকটর ও ট্রলি নিয়ে মিছিল শুরু করেছেন। এ মিছিল হল ২৬ জানুয়ারি তাঁদের পূর্বঘোষিত দিল্লির বুকে ‘কিষাণ প্যারেড’এর মহড়া। তার আগে ৮ জানুয়ারি সরকারের সঙ্গে তাদের আরও এক রাউন্ড বৈঠকের কথা। যদিও প্রায় সকলেই নিশ্চিত যে এই বৈঠকও নিষ্ফল হবে। কারণ, সরকার নানা বাহানায় কৃষকদের মূল দাবিটিকে মানতে নারাজ। কিন্তু তবুও বৈঠক চলছে কেন? হয়তো কৃষকেরা এখনও আশা করছেন, বিপুল জনসমাবেশ ও দৃঢ়বদ্ধ অঙ্গীকারের ঐক্যতানে সরকার তাঁদের কথা মানতেও পারে। আর সরকার ভাবছে, এই প্রকট ঠান্ডা ও লম্বা সময় ধরে অবস্থানরত কৃষকেরা ক্লান্ত হয়ে আপাত একটা মধ্যস্থতায় রাজী হয়ে রণে ভঙ্গ দেবেন। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে, কৃষকেরা আরও উদ্দীপ্ত হয়েছেন, পরস্পরে আরও নিকটবর্তী এসেছেন, সারা দেশ জুড়ে এই আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়েছে এবং পিছু না হঠার সঙ্কল্প আরও দৃঢ়তর হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ এক অভিনব আন্দোলন। এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতি উন্মেষের আন্দোলন।
পাঁচশোর ওপর কৃষক সংগঠনের সর্বভারতীয় সমন্বয় মঞ্চের নেতৃত্বে এ আন্দোলনে এখনও কোথাও কোনও মতের চিড় ধরেনি বা দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের রণকৌশল নিয়েও কোনও বিভেদ-বিভ্রান্তির রেশটুকু পর্যন্ত দেখা যায়নি। গত সাত মাস ধরে এই আন্দোলনের পটভূমি ও প্রস্তুতি গড়ে উঠেছে এবং বর্তমান সময়ে এসে তা এক নতুন দিশা ও প্রজ্ঞায় আলোকিত হয়েছে। সেটা কী ও কেন, তা না ধরতে পারলে এই আন্দোলনের মর্মবস্তু ও অন্তরাত্মায় পৌঁছনো যাবে না।
আমাদের প্রচলিত অর্থনীতিতে শিল্প ও কৃষির যে বাণিজ্য-রীতি (বা টার্মস অফ ট্রেড) তাতে শিল্প সব সময়েই একটা আপেক্ষিক সুবিধাজনক জায়গায় থাকে। অর্থাৎ, বাজারের নিয়ম মেনে শিল্পের তরফে যখন কৃষিপণ্য ক্রয় করা হয় তখন দরকষাকষির রাশটা থাকে শিল্পের হাতে। কেনা, না-কেনা অথবা দরদাম বা বেছে বেছে কেনা— সবেতেই শিল্পের তরফে একটা ছড়ি ঘোরানোর অবকাশ থাকে, যে কারণে আমরা কৃষকের ‘ডিসট্রেস সেল’ বা ‘দায়ে পড়ে বেচে দেওয়া’ কথাটির সঙ্গে অতীব পরিচিত। চুক্তিচাষে চুক্তিমতো ফসল তুলে না দিতে পারা, ঋণ নিয়ে চাষ করে খরচ না ওঠাতে পেরে আত্মঘাতী হওয়া, বাজারে ফসলের একেবারেই দাম না পাওয়া— মূলত এইসব বিবিধ কারণে দেশের অধিকাংশ কৃষকের অবস্থা আজ খবই মর্মান্তিক। আর এর জন্য দায়ী শিল্প ও কৃষির এমন এক চলমান অসম বাণিজ্য-রীতি যা কৃষকের অবস্থাকে দরিদ্রতর করেই শিল্পের পক্ষে অতি-লাভজনক হয়ে ওঠে। এই বাণিজ্য-রীতির দুটি মাত্রা আছে: এক, সস্তায় কৃষিজাত পণ্য কিনে তাকে শিল্পপণ্যে রূপান্তরিত করে অতি-লাভ ঘরে তোলা; দুই, সাধারণভাবে কৃষিপণ্যের দামকে অতি-সস্তা রাখা যাতে শিল্প-মজুরিকে নিম্নমুখী করা যায়। এই দ্বিতীয় পন্থাটিতেই শিল্পমহল ও নীতি-নির্ধারকদের অতীব উৎসাহ। আর এই ফাঁদে নিমজ্জিত হয়েই আমাদের দেশের কৃষকদের যেন প্রায় চিরকালের মতো এক রুগ্ন প্রজাতি হিসেবে সমাজের এক কোণায় থেকে যাওয়া! আজকের এই কৃষক বিদ্রোহ ক্রমে ক্রমে, ঠিক এই জায়গাটিতেই, পালটা আঘাত করতে চেয়েছে।
আমরা জানি, পঞ্জাব ও হরিয়ানায় প্রায় ৯০ শতাংশ ধান ও গম সরকারি মান্ডিতে বিক্রি হয় এবং তার একটা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য করা থাকে, যে কারণে নতুন তিন কৃষি আইনে সরকারি মান্ডি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনায় এই দুই রাজ্যের কৃষকেরা সব থেকে জোরালো ভাবে আওয়াজ তুলেছেন। আশঙ্কা, যে দু-একটি ফসলে ন্যূনতম দাম এখনও পাওয়া যায় এবং সরকারি পরিকাঠামোতে (পঞ্জাবে দু-তিন কিলোমিটার অন্তর একটি করে মান্ডি আছে) একটা আপাত সু-ব্যবস্থা দু-একটি রাজ্যে পরিলক্ষিত, তাকে তুলে দেওয়ারই সুচতুর প্রয়াস এই তিন কৃষি আইনে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, শিল্প-কৃষি বাণিজ্য-রীতিতে শিল্পের দিকে যে ভারটা এমনিতেই প্রকট ভাবে আছে, তাকে আরও ভারযুক্ত করে কৃষিকে একেবারে পঙ্গু করে দেওয়াই কর্পোরেটদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মজুত করার অবাধ সুবিধা প্রদান ও কর্পোরেট ফড়ে বা এজেন্সি দিয়ে খোলাবাজারে কৃষিপণ্যের উদোম কেনাবেচার ব্যবস্থা করে সমগ্র কৃষকসমাজকে কর্পোরেটদের প্রায় বাঁধা-মজুরে পরিণত করার যুগল কৌশল পাকাপাকিভাবে কৃষিতে কর্পোরেটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার উদগ্র প্রয়াস। এই সার্বিক আক্রমণের বিরুদ্ধেই ধনী থেকে প্রান্তিক কৃষকেরা আজ সর্বাত্মক লড়াইয়ে সামিল।
সরকার এই লড়াইকে প্রথম দিকে খুব হাল্কাভাবে নিয়েছিল। ভেবেছিল, কয়েক দিন অবস্থানের পর এদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে ও এতগুলি সংগঠন একসঙ্গে থাকায় মতান্তরও হবে এবং ধীরে ধীরে এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে নেবে। তা তো হয়ইনি, উপরন্তু, গোটা কৃষকসমাজকে এতটাই দৃঢ়চেতা ও সন্নিবদ্ধ করেছে যে সরকার এখন পালাতে পারলে বাঁচে। পাশাপাশি, যা গোড়ায় সেভাবে উল্লিখিত ছিল না— ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রশ্নটি এই আন্দোলনে একটি অন্যতম দাবি হিসেবে উঠে এসেছে এবং এই খাতিরে আইন প্রণয়নের চাহিদাটিও একটি জোরালো মুদ্দা হিসেবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ধান বা গমের ক্ষেত্রে নয়, সমস্ত ফসলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি এখন একটি মুখ্য ইস্যু। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, কোষাগারে এত অর্থ নাকি নেই যা দিয়ে এই দাবিটিকে মর্যাদা দেওয়া যায়। কৃষকেরা পালটা বলেছেন, সেন্ট্রাল ভিস্তা করার প্রভূত অর্থ যদি থাকে তাহলে কৃষকের জীবন-জীবিকাকে সুনিশ্চিত করার অর্থও নিশ্চয়ই আছে। আসলে সরকার এই দাবিটিকে মানতে নারাজ। কারণ: এক, তাহলে কৃষির বাজারে কর্পোরেটদের দাপট ধাক্কা খাবে; দুই, কৃষিপণ্যকে অতি-সস্তায় বিকিয়ে শিল্প-মজুরিকে নিম্নমুখী রেখে কর্পোরেটদের অতি-মুনাফা অর্জনের পথও বাধাপ্রাপ্ত হবে। বোঝাই যাচ্ছে, কৃষকসমাজ রাজনৈতিক-অর্থনীতির এতদিনকার চলতি ব্যবস্থাপনাতেই এক মোক্ষম আঘাত হেনেছেন। সে অর্থে এ লড়াই সারা বিশ্বের কাছেই এক দিগদর্শনকারী আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। বহু উদারবাদী অর্থনীতিবিদদেরও বলতে শুনছি যে, যদিও তাঁরা কৃষকদের সব দাবিদাওয়ার সঙ্গে একমত নন, কিন্তু এই অসম্ভব মানবিক লড়াইয়ে সরকার যেন আরও সংবেদনশীলতার পরিচয় দেয়। ‘সব দাবির সঙ্গে একমত নন’ বলতে এ তাবৎ চলে আসা শিল্প-কৃষি বাণিজ্য-রীতির প্রশ্নটিকেই যে কৃষকেরা চ্যালেঞ্জ করেছেন সেটিকে মানতে তাঁদের বিবিধ অসুবিধা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে ৬০ জনেরও বেশি কৃষক প্রাণ দিয়েছেন। কৃষকেরা এঁদের প্রতি শহীদের মর্যাদা জ্ঞাপন করেছেন। আন্দোলনের প্রথম দফায়, যাতায়াতের অসুবিধার জন্য, দিল্লির আশপাশের পাঁচটি রাজ্য থেকে কৃষকদের সমবেত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ সারা দেশ থেকে কৃষকেরা নানা অসুবিধার মুখোমুখি হয়েও, এমনকি পায়ে হেঁটেও, দিল্লির বিভিন্ন সীমান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন এক দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের অঙ্গীকার নিয়ে। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, বিহার থেকেও যেমন দলে দলে কৃষকেরা আসছেন, সুদূর কেরল, তেলেঙ্গানা থেকেও এসে তাঁরা যোগ দিচ্ছেন। সমাজের অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষেরাও এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করছেন। এই প্রথম দেখা গেল, এক চরম স্বৈরাচারী সরকারও এই আন্দোলনের সামনে বেশ বেকায়দায় পড়েছে। ‘খালিস্তানি’, ‘নকশাল’, ‘পাকিস্তানি’, ‘ফড়ে’— এইসব নানাবিধ বিশেষণ জুড়েও এই আন্দোলনে বিন্দুমাত্র চিড় ধরানো যায়নি। আগ্রাসী কর্পোরেটতান্ত্রিক শাসনের বিপ্রতীপে এই আন্দোলন যে অর্থনীতির কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তনের দিশারী তা নির্দ্বিধায় বলাই যায়। শেষমেশ কোথায় গিয়ে তা দাঁড়ায় ও কী অর্জন করতে পারে তাই এখন বহু আশা নিয়ে অপেক্ষা করার। মনে রাখতে হবে, অর্থনীতির গ্রহণযোগ্য বয়ান অনেকাংশে লড়াইয়ের ময়দানেই নির্মিত হয়।