আপনা জমিন, আপনি আজাদি

শুভদীপ চক্রবর্তী

 




কমিউনিটি মিডিয়া ওয়ার্কার, গদ্যকার

 

 

 

মাস কয়েক আগে আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হওয়ার পরে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে দেখা গিয়েছিল আমাদের দেশের একটি বিশেষ শ্রেণির জনগণকে। কারণটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং অনুমেয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে একটা অশনিসঙ্কেত টের পাওয়া উচিত ছিল, সেটা না দেখে অবাকও কম কিছু লাগেনি। কারণ ট্রাম্প পরাজিত হলেও পাশে পেয়েছিলেন বিপুল সংখ্যক মার্কিন জনগণকে। যারা বর্ণবিদ্বেষী, হিংস্র এবং যুক্তি দিয়ে নিজেদের এই ঘৃণা অথবা হিংস্রতাকে সামনে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন।

কৃষি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রসঙ্গ তুলে আনার কারণ আছে। আছে, কারণ, বর্তমানে সারা ভারতের নজর যেদিকে, সেই কৃষক আন্দোলনের দিকে চোখ রাখলেও এই একই রকম অশনিসঙ্কেত অনুভূত হচ্ছে মনে মনে। যতই সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা চাষিদের সঙ্গে থাকার বা পাশে থাকার কথা ফলাও করে লিখি না কেন, একটি বড় জনগোষ্ঠীকেও কিন্তু খোলাখুলি দেখা যাচ্ছে চাষিদের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধতা করতে। এই জনগোষ্ঠী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষিক্ষেত্রকেও এক প্রকার বেসরকারিকরণের পক্ষপাতী। শপিং মলে সস্তায় কেজি দরে আলু-পেঁয়াজ-ফুলকপি পাওয়া যাবে— এই স্বপ্নে বিভোর। তাই ওডিশায় শহরের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বিহার থেকে আসা সহকর্মীকে যখন জানাই গতকাল আরও দুজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে দিল্লির অসম্ভব ঠান্ডায়, তখন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তার বক্তব্য তালা ধরিয়ে দেয় কানে: “আরে সে তো গ্রামে থাকলেও মরতে পারত!”

অথচ চূড়ান্ত অটোক্রেসির মাধ্যমে বিরুদ্ধতার মুখ যখন ক্রমাগত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের দেশে, লাঠি-গুলি চলছে ইউনিভার্সিটির ভিতর অথবা শাহিনবাগের জনসমাবেশে, তখন এই কৃষক সম্প্রদায় বারংবার অভূতপূর্ব আন্দোলনে চমকে দিয়েছেন আমাদের। মহারাষ্ট্রের সেই লংমার্চ। ‘হাল’ না ছাড়ার অঙ্গীকারে পায়ের ছাল উঠে যাওয়া বৃদ্ধা। রাস্তার একপাশ দিয়ে সারে সারে এগিয়ে যাওয়া লাল পতাকা। ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা কষ্ট দাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সুমনের গানের মতো, ‘জানি না সুমন তুমি কৃষিকাজ কেন যে জানো না…’

কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ভিতরেও ঘুরেফিরে আসে ব্যক্তিগত কিছু কথা। বছরে বেশ কয়েকটা দিন লাগাতার যাতায়াতে কেটে যায় কলকাতার বাইরে থাকার জন্য। এবং সেই যাতায়াতের বেশিরভাগ সময়টাই দৃশ্য জুড়ে থাকে জানলার বাইরের মাঠের পর মাঠ ধরে ছড়িয়ে থাকা ফসলের ক্ষেত। কখনও শস্যে ভরপুর। কখনও ফসল কেটে ফেলার পর বিধবার ফাঁকা সিঁথির মতো শূন্যতা। এবং প্রতিবারই একটা নির্দিষ্ট প্রশ্ন জেগে ওঠে মনের ভিতর একনাগাড়ে বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে— কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকরা কখনওই প্রথম শ্রেণির নাগরিক হয়ে উঠতে পেরেছেন কি? এই যে মাঠের পর মাঠ বিঘে বিঘে ফসল, তাও কেন এই দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে থাকতে হয় অভুক্ত অবস্থায়? কেন প্রত্যেকবার নির্বাচনের আগে কৃষকদের আত্মহত্যা উঠে আসে অন্যতম জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবে? সে সময়ই হ্যাঁচকা টান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রেন। এক ঝলকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় মানভূমে। রাঢ় বাংলা। নোটবাতিল পর্বের পর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। মাঠে-ঘাটে চাষ করা সরল-সিধা মানুষগুলো চায়ের দোকানে চা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে টাকা না দিয়ে। দোকানদার দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “সবাই বিনা পয়সায় চা খেয়ে গেলে তোমার চলবে কী করে?” কয়লায় খোঁচা দিতে দিতে লোকটা উত্তর দিল, “কেউ তো ফসল তুলতে পারল না মাঠ থেকে। লোকই লাগাতে পারল না! টাকাই তো নেই। বিকোতে গেলেও একই অবস্থা!”

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনও অ্যানালিসিস চলে না তাই। অসহ্য লাগে ‘মন কি বাত’। সীমাহীন ঔদ্ধত্যের মতোই মনে হয়। শহরের বুকে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ চাষিদের প্রতিবাদকে ‘পিকনিক’ বলে দাগিয়ে দিলে কেউ, গনগন করে ওঠে মাথা। এই ফাঁকে বলতে দ্বিধা নেই, দুটো গরুর কাঁধে জোয়াল লাগিয়ে লাঙল টানতে দেখেছি আমার বাবাকেও। ভিতরে ভিতরে কোথাও ‘চাষার ব্যাটা’ বললেও মন্দ লাগে না নিজের। এবং সেভাবেই ভীষণ ইচ্ছে হয় যদি কোনওভাবে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যেত সেই সব মানুষগুলোর, যাদের ঘর বলতে ট্রাক্টর; উষ্ণতা বলতে রাতে জ্বালানো আগুন! যারা মার খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বারবার। নীলকরদের বিরুদ্ধে, জমিদারদের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে। শুখা মাটিতে মেরেছে কোদাল-গাঁইতির ঘা। ঋণের ফাঁদের অসহায়তায় ঝাঁপ দিয়েছে কুয়োয়। যাদের সামনে ‘উন্নততর বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি মডেল’-এর ধাঁধা চাপিয়ে দিয়ে, সরিয়ে রাখা হয়েছে প্রয়োজনীয় সত্যি থেকে। ধ্বংস হয়ে গেছে চিরন্তন প্রাচীন কৃষিজ্ঞান। লাগামহীন কীটনাশক, কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা ক্ষতি করেছে জমির, কমিয়ে দিয়েছে মাটির নীচের জলস্তর। এক সময় কৃষকদের হয়ে কলম ধরেছিলেন হরিশ মুখুজ্যের মতো প্রকৃত দেশভক্ত। সাংবাদিকতার জ্বলন্ত সংজ্ঞা তৈরি করেছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজের সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ সংবাদপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু এখন কোথায় তেমন কলজে? কোথায় তেমন প্রতিবাদ সংবাদমাধ্যমে? বরং দায়িত্ব তুলে নিয়েছে কৃষকরাই। এবং কিছু বন্ধু। যারা নিরলসভাবে কৃষি আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক পটভূমিকার আপডেট দিয়ে যাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় মুহূর্তে মুহূর্তে। ঠান্ডা শীতের রাতে রুটি সেঁকা হচ্ছে পরদিন রোদের সকাল মেখে নতুন দিনের আশায়…

তাই কৃষি, ফসল এবং খাদ্যসুরক্ষা নিয়ে ভীষণই দরকার ছিল এই পথে নামার। শহুরে কর্পোরেট আমরা পারিনি। আগুনের আঁচ যাঁদের গায়ে লেগেছে, তাঁরা পেরেছেন ঠিক। বরাবরের মতোই পেরেছেন। কৃষকেরা জোট বাঁধলে কী হয়, তার সাক্ষী ইতিহাস। সেই পুনরাবৃত্তি দেখার অপেক্ষায় আমরা সকলেই। কিছুই করতে না পারলেও, সাক্ষী হতে চাই সেই ইতিহাসের। এবং ঠিক সেই সময়েই দেখি নিজে না পারলেও, আমাদের হয়ে পথে হাঁটছে আমাদেরই শহরের কিছু সহ নাগরিক। পথ চলছে বিপ্লবের স্লোগান দিতে দিতে। আবার সারা দেশ জুড়ে জেগে উঠছে প্রতিবাদ মুখর একটা গোষ্ঠী। যে গোষ্ঠীর একটাই ভাষা: প্রতিবাদ। ভাবতে ভালো লাগে, এই আন্দোলনের পিছনে কিছুটা হলেও অবদান থেকে গেছে বাংলার কৃষক নেতার। অকথ্য পরিশ্রম করে সকলের চোখের আড়ালে সঙ্ঘবদ্ধ করেছেন যিনি এই প্রতিরোধ। কারণ নাটুকে বক্তৃতায় ‘আচ্ছে দিন’ আসেনি রেডিওতে শোনা কথার মতো। সুদিন যদি আসার হয়, তাহলে সেটা এভাবেই। এভাবেই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...