হিন্দোল ভট্টাচার্য
কবি, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক
মন রে কৃষিকাজ জানো না
যতই বলি, কৃ ধাতুর সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু ভাষার অলঙ্কার এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলা জীবনযুদ্ধের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমরা তো নদীর দেশের লোক, কৃষির দেশের লোক। আমাদের রক্তের মধ্যে, স্নায়ুর মধ্যে, ইতিহাসের মধ্যে মিশে আছে কৃষি। সকলে যেমন কবি হতে পারেন না, তেমন সকলে কৃষকও হতে পারেন না। টবে গাছ লাগালেই, সার দিলেই, বা জল দিলেই মাঠে গিয়ে চাষ করার যে শিল্প তা অর্জন করা যায় না। এগুলি অনেকটা শখে কবিতা লেখার মতো। চাষিভাইদের জন্য আমাদের বরাদ্দ সম্মান হল, ‘চাষার ব্যাটা চাষা’। কে আর রামপ্রসাদের মতো এভাবে বলেছেন, ‘মানবজমিন পতিত হল, আবাদ করলে ফলত সোনা’। আমরা তো চাষিভাইদের জন্য অশ্রুমোচনের নাগরিক মধ্যবিত্তপনা ছাড়া আর কিছু করতেই পারি না। আমরা যে একজন চাষির মতো কৃষিকাজের খুঁটিনাটি জানি না, এ বিষয়টি স্বাভাবিক। যেমন, অনেকেই কবিতা বোঝেন না, কবিতার খুঁটিনাটি বোঝেন না, পড়েন না, জানেন না, তাঁদের জানার বোঝার চর্চা করার প্রয়োজন নেই। কারণ তাঁদের জীবনের সঙ্গে কবিতার আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। কবিতা সময় কাটানোর জিনিস নয়। তেমন, কৃষিকাজও একধরনের বিজ্ঞান, কবিতা, শিল্প, যা আয়ত্ত করতে গেলে, আমাদের চর্চার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, হয়ে উঠতে হবে দীক্ষিত কৃষক। তখন ‘তাঁরা কত দুঃখী,’ ‘তাঁরা কত চাষা’, ‘চাষার ছেলে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ে আমেরিকা গেছে, জানো তো?’— ধরনের বর্জ্যবাক্য থালায় সাজিয়ে পরিবেশন করার সংস্কৃতি আমরা নিজেরাই বর্জন করতাম। কিন্তু তা করি না, কারণ কৃষকদের আমরা মনপ্রাণ দিয়ে সহানুভূতি দিতেই ব্যস্ত থাকি। আমাদের অকারণ অহং-এর অন্তরালে তাঁদের প্রতি যে দরদ এবং সহানুভূতি থাকে, তার মধ্যে কতটা সম্মান, কতটা শ্রদ্ধা এবং কতটা বোধ থাকে, তা বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ আমাদের চোখের জলগুলিও নোনা নয়, তার মধ্যে মিশে থাকে একপ্রকার বৌদ্ধিক ঔচিত্যবোধ। প্রাণের টান নয়। অথচ তা স্বীকার করতে আমাদের খুব অসুবিধা।
এমন মানবজমিন হইল পতিত
গত সত্তর বছর ধরেই কৃষকদের অবস্থা খারাপ। কৃষিবিল তাদের প্রতি অসম্মানের এক চরম উদাহরণ। কারণ, দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ কৃষক হলেও, আমরা তাঁদের অদৃশ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাবতেই ভালবাসি। অর্থাৎ, তাঁদের তো কোনও কণ্ঠ নেই। তাঁদের প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। সেই কবে তেভাগা, তেলেঙ্গানা বা খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল, তাও, পিছনে ছুরি চালিয়ে তখনই মুড়িয়ে দেওয়া গেছে। কৃষকদের মধ্যে থেকে দেশের মূল নেতা উঠে আসবেন, তা তো ভাবাই যায় না। কারণ তাঁরা তো অশিক্ষিত। তাই দেশের এতকালের নেতারা সকলেই মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত। বিপ্লব সম্পর্কে, গণতন্ত্র সম্পর্কে, দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে কথা বলবেন কারা? কৃষকরা? অসম্ভব। তাঁরা তো শুধু মুখ বুজে চাষ করবেন। তাঁরা হলেন আমাদের পরিবারের নীরব গৃহিণীর মতো। অত্যাচার সহ্য করতে করতে সহ্য করাটাই যাঁর কাছে স্বাভাবিক। কথা না বলতে বলতে না বলাটাই যাঁর কাছে স্বাভাবিক। ভাল না থাকতে থাকতে ভাল না থাকাটাই যাঁর কাছে পবিত্র কর্ম। তাঁরা তো ত্যাগের প্রতীক। তাঁদের আবার উন্নয়ন কী! মধ্যপ্রদেশ মহারাষ্ট্রে যে এত মানুষ আত্মহত্যা করলেন, খুবই দুঃখের বিষয়, কিন্তু শহর, নগর তার জন্য কী করবে? হয়েছিল বটে একটা বিশাল মিছিল, কিন্তু তাতে কী হল? কী করতে পারে কৃষকরা? সেই জমিদারির সময় থেকে, সামন্ততন্ত্রের সময় থেকে চাষারা হলেন মূর্খ, ‘ও ব্যাটা কী বলবে?’ মনে নেই, উপেনের জমি কীভাবে নিয়ে নিলেন ধূর্ত জমিদার? মনে নেই, হীরক রাজার দেশে ছবিতে সেই কৃষকের পেটে লাথি মেরে খাজনা আদায়ের কথা। এ তো নতুন কথা নয়। এ দেশের সামন্তপ্রভুরা, হিন্দু রাজতন্ত্রের সময়কার রাজারা, তার পর মুসলিম সাম্রাজ্যবিস্তারের পর সুলতানি এবং মুঘল আমলে রাজস্বের দায় সবথেকে বেশি কাদের উপর পড়ত? কৃষকদের উপর। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘মহেশ’-এর গফুর মিয়াঁ কৃষি ছেড়ে কারখানার শ্রমিক হয়ে যায় কাদের দাপটে? কতরকমভাবেই না কৃষকদের উপর এই অত্যাচার হয়ে চলেছে এ দেশে হাজার দুহাজার বছর ধরে। আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা মেনেই নিয়েছি যে, কৃষকরা মুখ বুজে সব সহ্যই করবেন। সহ্য করাই তাঁদের ডিএনএ। এখন মুশকিল হচ্ছে এই ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক এবং পরে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা এ দেশে এখনও যায়নি, তা যতই আমরা তথাকথিতভাবে প্রযুক্তির ভরকেন্দ্রে বসবাস করি না কেন। কারণ আমাদের ডিএনএ-তে তো ঢুকে গেছে চাষিদের সহ্যশক্তি অসীম, ত্যাগ এবং নীরবতাই তাঁদের চরিত্র। তাঁদের সহিষ্ণুতাকে আমরা তাঁদের দুর্বলতা বলে মনে করি। আর তাই, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সবরকমভাবেই তাঁদের প্রতি করুণা ও শোষণ-এর যুগপৎ এক বর্ষণ ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকে না। না হলে, আমরা এতকাল সহ্য করলাম কী করে হাজার হাজার চাষিদের আত্মহত্যা? কী করে সহ্য করলাম মিডলম্যানদের দাপট? কী করে সহ্য করলাম তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সারের অস্বাভাবিক দাম? কী করে এই কেন্দ্রীয় সরকারের চাপানো অন্যায় আইনই বা সহ্য করলাম আমরা? আদৌ কি আমরা কিছু বলতাম কৃষকরা নিজেরা না গর্জে উঠলে? মিনমিন করে হয়তো বলতাম এই তো আগুন বাজার। ক্রমশ দাম বাড়ছে, বাড়বে। নিজেদের প্রেক্ষিত থেকে বলা এই সব কথায় কতটা চাষিদের জীবন সম্পর্কে আমাদের দুঃখ ঝরে পড়ত আর তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ঝরে পড়াটা স্বাভাবিকও নয়। কারণ আমাদের মধ্যেও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মান কম। করুণা বেশি।
আবাদ করলে ফলত সোনা
এইবার যদি আমরাও বদলাই নিজেদের, তাহলে আশার কথা। কারণ কৃষকরা প্রকৃতই প্রমাণ করে দিচ্ছেন, তাঁরা রুখে দাঁড়ালেও কতটা সহিষ্ণু। হয়তো কৃষিই তাঁদের শিখিয়েছে মন্থরতা, ধৈর্য এবং আত্মবিশ্বস্ত থাকাই সৃজনের প্রাথমিক শর্ত। আন্দোলনও তো একপ্রকার সৃজন। সহ্য করার ক্ষমতা যে কৃষকদের আছে, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু আধুনিক নগরসভ্যতা জানত না, সেই সহ্য করার ক্ষমতা প্রকৃতই কতটা। আত্মসম্মানবোধে প্রখর ভারতের কৃষকরা ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে সৃজনশীল ভাষা তৈরি করেছেন, তার মধ্যে কোথাও হীনম্মন্যতা নেই। ভারত সরকারের মতো একটা বিশাল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা তৈরি করেছেন এক মানব-ব্যারিকেড। গোটা দেশের মানুষ তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন গণ-আন্দোলনের রূপ সম্পর্কে। তথাকথিতভাবে পিছিয়ে থাকা বলতে আমরা যাঁদের দেগে দিই, তাঁরাই বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছেন আমাদের চেয়ে অনেক আলোকবর্ষ এগিয়ে তাঁরা। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, যাবতীয় শোষণ, অত্যাচার, নির্মমতা সত্ত্বেও, কৃষকরা আমাদের দেশের মানুষের অন্নদাতা হিসেবেই থেকেছেন। থেমে যায়নি তাঁদের কর্মের চাকা। তাঁদের কৃষিকাজের আবহমান চলার ভিতরেই এ দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের কৃতজ্ঞ থাকার বদলে, তাঁদের দিয়েছি প্রান্তিক হয়ে থাকার যন্ত্রণা। হয়তো এই প্রান্তিক এবং অবহেলিত হয়ে থাকাটাই তাঁদের শিখিয়েছে, তাঁদের আন্দোলন এ দেশের আর কেউ করে দেবে না। ফলে, রাজনীতির প্রকৃত অর্থ তাঁরা জানেন। তাঁরা সকলেরই স্বরূপ জানেন। এমনকি ধর্মের ও অর্থনীতির গোপন মারপ্যাঁচগুলি সম্পর্কেও তাঁরা অবহিত।
বর্তমান বিশ্বে যেখানে ক্ষমতা মানেই একগুচ্ছ পুঁজিপতি বা একচেটিয়া ব্যবসা করা কোম্পানির হাতের পুতুল কিছু স্বৈরাচারী শাসকের গণতান্ত্রিক মুখোশ, সেখানে, সাধারণ মানুষের রাজনীতির, আন্দোলনের এক ক্ষমতা-নিরপেক্ষ বিক্ষোভ ও আন্দোলনের নজির গড়ে তুলেছেন ভারতবর্ষের কৃষকরা। আগামী দিনের গণ-আন্দোলনগুলিকে পথ দেখাতে পারে এই আন্দোলন।
তবে, আন্দোলন সফল হবে কি হবে না, অর্থনীতি সংক্রান্ত নানা জটিল প্রশ্নের সমাধান হবে কি হবে না, কৃষকরা তাঁদের দাবিদাওয়া আদায় করতে পারবেন কি না, তার চেয়েও আমার কাছে বড় যেটি তা হল, এই আন্দোলন যদি ভারতবাসীর কাছ থেকে কৃষকদের জন্য প্রাপ্য সম্মান আদায় করে, তাও হবে এই অধুনান্তিক সময়ের এক বড় পাওনা। কারণ ফ্যাসিস্ট শাসক, তাদের নিজেদের আগুনেই, আজ হোক বা কাল, পুড়ে ভস্ম হবে। হয়তো তার আগে তারা ধ্বংস করে যাবে অনেক মানুষকে, বিকৃত করবে অনেক ইতিহাস, অনেক সভ্যতা, অনেক সংস্কৃতি, অনেক ভাষা। কিন্তু পৃথিবীর কোনও ফ্যাসিস্ট শাসকই খুব বেশিদিন টেকেনি। তাদের হয়তো ভোটে বা আন্দোলনে পরাস্ত করা যায়নি। কিন্তু তারা নিজেরাই যে গতি তৈরি করেছে, তা শেষ পর্যন্ত এক মারণাত্মক আগুনের দিকেই যায়। সুতরাং, ভারতবর্ষের এই ফ্যাসিস্ট শক্তির একদিন না একদিন পরাজয় হবেই। কিন্তু এখন তাদের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের ভিতরে, ভাল দিকগুলি হচ্ছে, মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের ভুলগুলি যদি সংশোধন করে নিতে পারি। যদি আমরাও একটু শিক্ষিত হই। আমাদের ধারণাগুলিকে, আমাদের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভাবনাগুলির পরিবর্তন করি, তবে সেটাই হবে ইতিহাসের শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথ নিজে যতই সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের মানুষ হন না কেন, তাঁর হিন্দু-মুসলমান, কালান্তর, মানুষের ধর্ম এবং লোকহিত প্রবন্ধগুলিতে এই কথাই বারেবার বলার চেষ্টা করছেন।
কৃষকরা যেহেতু জানেন তাঁদের সম্মান দেওয়ার যোগ্য কেউ নেই, তাই, তাঁরা নিজেদের আন্দোলন নিজেরাই করছেন কারও মুখের দিকে না তাকিয়েই। কৃষকদের এই গণ-আন্দোলন আজ ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান কৃষক আন্দোলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীকাল যে এই আন্দোলনই ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে, একচেটিয়া কিছু কোম্পানির ব্যবসার বিরুদ্ধে মানুষের আন্দোলনে দাঁড়িয়ে যাবে না, তার কি মানে আছে?
সেদিন টিভিতে দেখছিলাম, একজন কৃষক কী সহজ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমাদের ট্র্যাক্টর মিছিল এর চেয়েও অনেক বেশি হবে প্রজাতন্ত্র দিবসে। সরকারের প্রতি আমাদের বার্তা একটাই, শুধরে যাও। তোমরা না শুধরোলে আমাদের জিজ্ঞেস করো, কীভাবে নিজেদের পাল্টাতে হবে। আমরা বলে দেব।’ এই সহিষ্ণু, শান্ত, আত্মবিশ্বস্ত, সহজ অথচ অনড়, দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ভাষাকেই ভয় পায় সমস্ত শাসক। সন্ত্রাসকে ভয় পায় না। কারণ সন্ত্রাসকে তারা সন্ত্রাস দিয়েই দমন করে। কিন্তু কীভাবে দমন করবে এই ভাষার প্রতিবাদকে?
এই কৃষক আন্দোলন প্রতিবাদের ভাষাকেও তো বদলে দিল। রাজনীতির ভাষাকেও বদলে দিল নিশ্চিত। শস্য এবং সৃজনের ভাষার ধারণক্ষমতা যে অনেক বেশি।