বর্ণিল ভট্টাচার্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
কমেডিয়ান শেলি বার্মান তাঁর ঠাকুরদা সম্পর্কে একটি মজার গল্প বলেছিলেন। আমেরিকায় আসার আগে ঠাকুরদা শুনেছিলেন, সে দেশের রাস্তা সোনা দিয়ে বাঁধানো। আমেরিকায় আসার পর তিনি তিনটে জিনিস আবিষ্কার করলেন। এক, রাস্তা সোনা বাঁধানো নয়। দুই, রাস্তা বাঁধানোই নয়। তিন, রাস্তা বাঁধানোর কাজে তাঁকেই মজুর হিসেবে নেওয়া হল। বুধবার, জানুয়ারি ৬, যে উচ্ছৃঙ্খল, উন্মত্ত জনতা ট্রাম্পের নাম চিৎকার করতে করতে ক্যাপিটলে হানা দিল, ভাঙচুর করল, তাদের দেখতে দেখতে এ দেশে আসা ভিনদেশের মানুষদের হতাশার সেই কাহিনি মনে পড়ল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গল্প যেন সেই আশাভঙ্গেরই কাহিনি, শুধু আরও বিশাল তার আকার।
পাঁচ বছর আগে হিলারি ক্লিন্টনের অপ্রত্যাশিত পরাজয় সকলকে হতবাক করেছিল। রিয়্যালিটি টিভি-র তারকা, আমেরিকান বিলিয়নেয়র ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাজনীতিতে যাঁকে কখনও বিশেষ আমল দেয়নি বেশিরভাগ লোক। তিনিই তখন ‘আমেরিকান ড্রিম’ হয়ে দেখা দিলেন। মনে করা হল, এইবার একজন পাকা ব্যবসায়ী রাজনীতির খ্যাঁচাখেঁচির উপর উঠে আমেরিকার সব সমস্যার মোকাবিলা করবে শক্ত হাতে। বলা হল, ওই সব বুদ্ধিজীবী, আর বিশেষজ্ঞ, আর মুক্তমনা (‘লিবারাল’) লোকজনের কথায় কান দেওয়ার দরকার নেই। ট্রাম্পের ধোঁয়াটে অতীত আর সন্দেহজনক কাজকারবারের দিকেও অত নজর দেওয়ার কিছু নেই। যদি চিনকে এক হাত নিতে হয়, দেশে খুন-জখম, বেআইনি কারবার কমাতে হয়, মাদক ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে হয়, যদি ওষুধের খরচ কমাতে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভ বাড়াতে হয়, তা হলে চাই ট্রাম্পকে।
সে সব স্বপ্নের কিছুই সত্যি হল না, বরং সত্যি হল সব চাইতে বড় আশঙ্কাগুলো। গত চার বছরে ট্রাম্প আমেরিকার সংবিধানের উপর একের পর এক আক্রমণ হেনেছেন, আদালতগুলির উপরে চাপ সৃষ্টি করেছেন। অনৈতিক কারবারে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় স্তরের (ফেডারাল) সংস্থাগুলিকে প্রায় কচুকাটা করেছেন। তাঁর কাজের প্রকাশ্যে সমালোচনা যে-ই করেছে, তাঁকেই পিছন থেকে ছুরি মেরেছেন। সামরিক বাহিনির জেনারেলদের তিনি এমনভাবে বদল করেছেন, যেন পাড়ার ক্লাব ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন বদলাচ্ছে।
ট্রাম্প কখনওই রিপাবলিকান দলের তেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। কেবল ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্যই রিপাবলিকান দলকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁকে যাঁরা দীর্ঘদিন চেনেন, তাঁরা অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিকদের কাছে— আদৌ কি ট্রাম্প রক্ষণশীল মানসিকতার লোক? অথচ, অবাক হয়ে সবাই দেখল যে আব্রাহাম লিঙ্কন, থিওডর রুজভেল্ট, আইসেনহাওয়ার যে দলের নেতা ছিলেন, ১৬৭ বছরের পুরনো সেই রিপাবলিকান দল কেবল ট্রাম্পের ইচ্ছে পূরণে লেগে পড়ল। চার বছরে কতখানি পরিবর্তনই না হতে পারে! ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বরখাস্ত (ইমপি্চমেন্ট) করার উদ্যোগ নেওয়া হলে রিপাবলিকানরা তাঁকে অভিযোগ থেকে বাঁচাল। ফের নির্বাচনে দাঁড়াতেও কোনও বাধা দিল না।
নির্বাচন অবাধ এবং দুর্নীতিমুক্ত হল, ট্রাম্পের পরাজয়ে কোনও সংশয় রইল না। তা সত্ত্বেও রিপাবলিকানরা তাঁকে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব প্রচার করতে দিল, মিথ্যা তথ্য ছড়াতে দিল, একের পর এক ভিত্তিহীন মামলা করা থেকে নিবৃত্ত করল না। হাতে যখন আর উপায় নেই, তখন ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের ডাক দিলেন ক্যাপিটল দখল করার— যেখানে নির্বাচনের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার জন্য সেনেট সদস্যরা জড়ো হয়েছিলেন। ট্রাম্প ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকেও চাপ দিয়েছেন, যাতে কংগ্রেস নির্বাচনের ফলকে বৈধতা না দেয়, যদিও সেই আইনি ক্ষমতা ভাইস প্রেসিডেন্টের নেই।
চার বছরের এই দুঃস্বপ্নের শেষ পর্বে তিন ঘণ্টার জন্য ক্যাপিটল দখল করল ট্রাম্পের অনুগামীরা। যে ক্যাপিটল আমেরিকার গণতন্ত্রের স্পন্দিত হৃদয়, সেখানে তারা তুলে ধরল ‘কনফেডারেট’ পতাকা— উনিশ শতকের আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপ করে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়ার বিরোধিতা যে সব রাজ্যেরা করেছিল, সেই সব রাজ্যের নিশান। যা বস্তুত বর্ণবিদ্বেষের প্রতীক। এক বেদনার্ত অতীতকে যেন উদ্ধত স্পর্ধায় তুলে এনে স্থাপন করা হল একুশ শতকের আমেরিকাতে। পাঁচজনের প্রাণ গেল সে দিন।
ট্রাম্পের শাসনকাল সব প্রত্যাশাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, বিশ্বের কাছে মাথা নিচু হয়েছে আমেরিকার। এই সত্যটা আজ সম্পূর্ণ স্পষ্ট, কোনও বিভ্রান্তি নেই। ট্রাম্প তাঁর প্রথম নির্বাচনের প্রচারে স্লোগান তুলেছিলেন, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’— ফের মহান করব আমেরিকাকে। সেই আস্ফালন মিথ্যা হয়েছে। আমেরিকার মহত্ত্ব তো বাড়েইনি, বরং সামনের দিনগুলো বেশ আশঙ্কাজনক। কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, গোটা দেশই এক ভয়ানক স্বাস্থ্যসঙ্কটের মুখে। নানা শহরে অতি-দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে সংখ্যালঘু অ-শ্বেতাঙ্গদের সংঘর্ষ চলছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও বাড়ছে। সহজ আস্থা ও নির্ভরতার যে রাস্তা তৈরি হয়েছিল, তাকে যেন কেটে ফেলা হয়েছে। আর আমরা, যারা এই দ্বিধাবিভক্ত সমাজের নাগরিক, তাদের উপর ভার পড়েছে এই কাটা পথ ফের বাঁধিয়ে আমেরিকাকে তার আগের আশা, উৎসাহ, সততায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার।
ট্রাম্প হয়তো খুব তাড়াতাড়ি খবর থেকে সরে যাবেন। কিন্তু তাঁর মতাদর্শ, ‘ট্রাম্পইজ়ম’, দ্রুত মিলিয়ে যাবে না। আমেরিকাদের এই সত্য মেনে নিতে হবে যে দাঙ্গা যারা করছে তারা কেবল প্রান্তবাসী মানুষ নয়, তাদের সংখ্যা ও শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। আমেরিকার জনসাধারণের একটি বড় অংশ নির্বাচিত সরকারকে অবিশ্বাস করে, তাকে ভেঙে ফেলতে চায়। তারা অনেকে ফেডারাল প্রশাসনে কাজ করেছে, এবং এই উদ্দেশেই কাজ চালিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ দিন। দেশের সরকার সম্মান করবে ও সুরক্ষা দেবে নাগরিক অধিকারকে, এমনটা তারা চায় না। তারা চায়, সরকার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে যাতে ধনীরা কর না দিয়ে একটা উদ্বেগহীন, স্বপ্নের ভুবনে বাস করতে পারে।
ট্রাম্পের লাগামহীন, নিয়ম-ছাড়া শাসন দেখে আশঙ্কিত হয়েছিলেন বহু আমেরিকান। এবারের নির্বাচনে তাই এক অভিজ্ঞ ও সুস্থির নেতার হাতে প্রশাসন তুলে দিলেন তাঁরা। জো বাইডেন এলেন হোয়াইট হাউসে। কিন্তু ভিন্ন জাতি, ভিন্ন ধর্মের মানুষদেরর প্রতি যাঁদের বিদ্বেষ, সেই শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বাড়তে পারে। দেশের বাকি মানুষের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব হয়তো আরও বেশি হবে। এঁদের অনেকেই বিশ্বায়নের ফলে আজ প্রান্তবাসী। তাঁদের মধ্যেই সব চাইতে বেশি ঘুরপাক খায় ট্রাম্পের আওড়ানো ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব, আর বর্ণবিদ্বেষ। এঁদেরই একাংশ হানা দিলেন ক্যাপিটলে। এঁদের সবাইকে জেলে পোরা যায় না, আবার উপেক্ষা করাও চলে না।
প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন সতর্ক করেছিলেন, যে ঘর নিজের বিরুদ্ধে বিভাজিত, সে বেশি দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। বিভাজনের আঘাত আজ ফাটল ধরিয়েছে আমেরিকার ভিত্তিতে। আমেরিকার ইতিহাসেই রয়েছে অসহিষ্ণুতা। অথচ, গণতন্ত্রের প্রতি আমেরিকা দায়বদ্ধ। বিশ্বের মানুষের কাছে আমেরিকা নিজেকে ‘মেল্টিং পট’ বা সর্বজাতি, সর্ব ধর্মের মিলনক্ষেত্র বলে তুলে ধরতে উন্মুখ। এক দিকে অসহিষ্ণুতা, অন্য দিকে উদারতা, কী করে মীমাংসা হবে এই দ্বন্দ্বের? এই প্রশ্নের উত্তরের উপরেই নির্ভর করছে আমেরিকার ভবিষ্যৎ।