হোয়াইট হাউসের মাথার উপর ট্রাম্পের ফেলে যাওয়া ছাতা

স্বপন ভট্টাচার্য

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

এ লেখা লিখতে শুরু করেছিলাম নভেম্বর মাসে আমেরিকার নির্বাচনের পরে পরেই। নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করা তখন বেশ বিপজ্জনক ঠেকছিল। নিজের পার্লামেন্টে কামান দাগার ডাক দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নাটককে প্রত্যাশিত ক্লাইম্যাক্সে তুলে দিতে সমর্থও হয়েছিল বেশ। তবে আশু পরিণতি তার পক্ষে আশানুরূপ হয়নি। কিন্তু সে যে কালো ছাতা হোয়াইট হাউস আর ক্যাপিটাল হিলের উপর মেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে  তা হল ট্রাম্পের সিগনেচার প্রতিফলন। দুনিয়া একে ট্রাম্পিয়ানা বলে চিনতে ভুল করবে না অতঃপর, তা সে নাই বা থাকল চেয়ারে আর! রাষ্ট্রনায়ক চেয়ার ছাড়ার পরিস্থিতিতে নিজেই যখন ক্যুদেতা ঘটায় তখন সে সাধারণত সামিল করে সেনাবাহিনীকে। এখানে ট্রাম্প সামিল করতে পেরেছিল বর্ণবাদী, বন্দুকবাজ, সাধারণ, সাদা আমেরিকানকে। তার কথামত এরাও বিশ্বাস করেছে যে হাতেকলমে প্রমাণ নেই ঠিকই কিন্তু নির্বাচনে রিগিং করে হারানো হয়েছে তাকে। যতই টুইটার ফেসবুক তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিক, যতই বাকি বিশ্ব লোকটাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক না কেন, আমেরিকার মধ্যে এই আমেরিকা একদম রিয়েল। বাইডেন আসার পরে সে আমেরিকা একবার নিজের দিকে ফিরে তাকিয়ে লজ্জা পাবে এ নেহাতই দুরাশা। এখানে বলার কথা এই যে ট্রাম্পের চলে যাওয়া আর জো বাইডেনের হোয়াইট হাউসে আসা— এই দুটো ঘটনাকে একেবারে  একটা আর একটার প্রতিপূরক মনে করা যাবে না। এ পুরো কালো আর ও পুরো সাদা, এভাবে রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা কাজ করলে তো কথাই ছিল না।

ট্রাম্পিয়ানার দুটো মন্ত্র— ইউনিল্যাটারালিজম এবং কনফ্রন্টেশনালিজম— একবগ্গা গোঁয়ার্তুমি এবং দ্বান্দ্বিকতা। ২০১৬-তে তার নির্বাচনী প্রচারে তার স্লোগান ছিল ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। তখনই সে পরিষ্কার করে দিয়েছিল— ট্রাম্পের আমেরিকা কোনও দেশ বা প্রতিষ্ঠানের নিঃশর্ত বন্ধু হবে না। তার একবারে নিকটতম প্রতিবেশী দুটি দেশ— কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে বহুদিন ধরে চলে আসা বাণিজ্যচুক্তি Nafta সে নির্বাচিত হয়েই বাতিল ঘোষণা করেছিল। মেক্সিকোর সঙ্গে ৭২২ মাইল সীমান্তের পুরোটাই সে পাঁচিল তুলে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল এবং ৪৪৫ মাইলের জন্য অর্থও অনুমোদন করিয়ে নিতে পেরেছিল সে এই চার বছরে। রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি থেকে অভিবাসন বন্ধ করে দিল সে। যার ফলে অগণিত শিশু তাদের পরিবার, বাপ, মা বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘেটোর মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ল মেক্সিকো-হন্ডুরাস সীমান্তে। হোয়াইট হাউসে আসার তিন দিনের মধ্যেই সে বাতিল করেছিল Trans Pacific Partnership (TPP), যা হল বারোটা দেশ ও আমেরিকার মধ্যে একটা সহযোগিতার চুক্তি। আমেরিকা ব্যতীত দেশগুলি ছিল জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বাহারিন, ব্রুনেই, পেরু, চিলি এবং ভিয়েতনাম। ২০১৫ সালে গৃহীত এই সিদ্ধান্ত চুক্তি হিসাবে কার্যকর হয়েছিল বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন। এর বিপরীতে চিনের নেতৃত্বে  RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership) নামের একটা মুক্ত বাণিজ্য সম্ভাবনা এই কুড়িকুড়ির পনেরই নভেম্বরেই সই হয়েছে। তখনও যে ট্রাম্প খুব বেশি হইচই করেছে তা নয়। ভাবখানা এমন, করছে করুক না, আমি বাণিজ্যে বাড়তি শুল্ক পেলেই হল। তাকে আনপ্রেডিক্টেবল বলা হয় বটে, কিন্তু চিন রাশিয়া নিয়ে যতটা সে গর্জেছে, বর্ষেছে তার তুলনায় ছিটেফোঁটা। বরং সেদিন বিবিসিতে এক রাশিয়ান প্রতিবেদক বললেন, ট্রাম্প ছিল অতিমাত্রায় প্রেডিক্টেবল— অনুমানযোগ্য। সে কী করবে তার হদিশ পেতে কোনও ধাঁধা ভাঙতে হয় না। বাইডেনকে দু বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখে তেমন মনে হয়নি তাদের। রাশিয়া তেল রপ্তানির জন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্য দিয়ে পাইপলাইন পাততে চাইলে ট্রাম্প বাধা দেবে বা নিষেধাজ্ঞা আনতে চাইবে সেটা জানা কথাই, কিন্তু জো বাইডেন তা বিনা বাধায় হতে দেবে তেমনও কি অনুমান করা যায়?

পৃথিবীর বাণিজ্যের অভিকেন্দ্র এই এশিয়ার দিকে সরে আসা, এও কিন্তু ট্রাম্পের সময়েই বেশ একটা পাকাপোক্ত রূপ পাচ্ছিল। দুনিয়ার বাণিজ্যে আমেরিকার মুষ্টি ক্রমশ আলগা হয়ে আসার অবশ্যম্ভাবী ফল হল চিনের উত্থান এবং ট্রাম্পের একলা চলো রে নীতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল সেটা। ট্রাম্পের যাওয়া আর বাইডেনের আসার মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়ার সমস্যাটা বাকি বিশ্বের কাছে  প্রিজনারস ডিলেমা। কারণ পুরনো জোটগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের না থাকাটা এই দেশগুলোর সবার কাছে কাম্য তো নয়ই, বরং তারা হয়তো পুনরায় নেতৃত্বের ব্যাটন আমেরিকার হাতেই দেখতে চায় কিন্তু তা ঠিক কতটা খবরদারির বিনিময়ে তা অনিশ্চিত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) দেশগুলির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের দিন দিন অবনতি হয়েছে। ন্যাটোতে আমেরিকার ভূমিকা বরাবরই বিগ ব্রাদারের। EU-ভুক্ত দেশগুলোও এ কারণে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধে পেয়ে আসছিল। ট্রাম্পের আমলে আর্জেন্টিনার অ্যালুমিনিয়ামের জন্য বা ব্রাজিল কলম্বিয়ার কফির জন্য যেমন নতুন শুল্কহার চালু হল তেমনই হল  ফরাসি ওয়াইনের জন্য বা বেলজিয়ামের চকলেটের জন্য। ন্যাটোভুক্ত বলে তাদের আলাদা রেয়াত তো করেইনি বরং ন্যাটো সদস্যদের খরচ বাড়াতে বলে নিজের খরচ কমিয়ে আনতে চেয়েছে সে। নিজে গোছাও, অন্যে কী করছে তা দেখার দরকার নেই— এই ছিল ট্রাম্পিয়ানার আরেকটা সিগনেচার। চিনের সঙ্গে নতুন শুল্কচুক্তি করার ফলে ৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি সীমান্ত কর আদায় করেছে আমেরিকা এবং এই প্রথমবার তাদের বাণিজ্যে আমদানি ও রপ্তানিশুল্কের মধ্যে ঘাটতি কমে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। ফলে ওয়াল স্ট্রিটে নতুন রক্তসঞ্চার হচ্ছিল এবং করোনা অতিমারির বছরখানেক আগেও কেউ তার দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পথে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করছিল না। কোভিডের অভিঘাতকে সে ট্রাম্পিয়ানা দিয়েই সামলে দেবে ভেবেছিল। তার সমর্থকদেরও সেভাবে ভাবাতে পেরেছিল। নির্বাচন প্রমাণ করল তাতেই তার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেছে।

ট্রাম্পিয়ানার আর একটা লক্ষণ হল ডিইন্সটিউলাইজেশন অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেওয়া। ট্রাম্প তার রাজত্বকালে কোন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা সঙ্ঘ থেকে বেরিয়ে এসেছে তা দেখে নিলে বিষয়টা প্রাঞ্জল হতে পারে। ২০১৮তে সে বেরিয়ে এল UNESCO থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রধানত আমেরিকার উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘের এই সংস্কৃতি ও সৌধরক্ষা সংক্রান্ত কমিটি। এটুকু বললে অবশ্য UNESCO সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। যাই হোক, ২০১১তে রাষ্ট্রসংঘ প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এবং ইজরায়েল একতরফাভাবে পূর্ব জেরুজালেমকে তার রাজধানী ঘোষণা করার পর রাষ্ট্রসংঘে তা নিন্দিত হয়। ওবামার সময়েই আমেরিকা ও ইজরায়েল তাতে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় আর ট্রাম্প আসার পর ২০১৭ সালেই নোটিস দেয় রাষ্ট্রসংঘকে যে তারা বেরিয়ে যাবে এবং ২০১৮ থেকে তারা আর ইউনেস্কোতে নেই, নেই ইজরায়েলও। বিতর্কিত জেরুজালেমে নিজেদের হাইকমিশন সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাম্পের আমেরিকা প্যালেস্টাইনকে উত্তরোত্তর বিপন্ন করেছে। ট্রাম্প বেরিয়ে গেছে ইরান নিউক্লিয়ার ডিল থেকে। এই চুক্তি, Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) যার ভালো নাম, সেটি আসলে আমেরিকা ইরান ছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে একটা সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ  চুক্তি। এটাও স্বাক্ষরিত হয়েছিল ওবামার কালে ২০১৫তে এবং এর মর্মার্থ ছিল ইরানকে কেবল অসামরিক কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করতে দেওয়া। ২০১৮তে নিরাপত্তা পরিষদে যখন ইরানের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর জন্য অ-নিউক্লিয়ার অস্ত্র কেনার সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব ১১-২ ভোটে গৃহীত হয়, তখনই ট্রাম্প এই চুক্তির অংশীদারিত্ব অস্বীকার করে বেরিয়ে যায় এবং তার নেভি সিল বাহিনী ড্রোন আক্রমণে ইরানের ভিতরে ঢুকে সেখানকার দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব সুলেমেনিকে হত্যা করে আসে। এর পর যে উত্তেজনা এই দু দেশের সম্পর্কে তৈরি হয়েছে তা বাইডেন এলে রাতারাতি মিটে যাবে এ আশা এখনই করা যায় না, কিন্তু ভারত বা তার মত যেসব দেশ ইরানের তেলের উপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল তাদের ভিতরে ইরান থেকে বাড়তি তেল আমদানি করার অনুমতি পাবে এবার— এমন একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। হেজবোল্লাহ, হামাস বা প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ আমেরিকায় নিষিদ্ধ এবং ইজরায়েল আমেরিকা সমীকরণে যেমন বাইডেন এলেও পরিবর্তন হবে না তেমনই ইরানের উপর যে প্রায় সর্বগ্রাসী নিষেধাজ্ঞা জারি আছে তা সহজে উঠে যাবে বলে মনে হয় না।

ট্রাম্প বাতিল করেছে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি INF (Intermediate Range Nuclear Forces Treaty)। এটা হল রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ১৯৮৮ সালে সই হওয়া একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। রোনাল্ড রেগন ও মিখাইল গোর্বাচভ-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মূল কথা হল ভূমি থেকে ভূমিতে বা আকাশে ছোড়ার মত স্বল্প ও মধ্য-দূর পাল্লার পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালাস্টিক বা ক্রুইজ মিসাইল তারা নিজেরাই ধংস করে ফেলবে এবং ধংসের পরেও দশ বছর ধরে একে অন্যের অন-সাইট নিরীক্ষণের সুযোগ রেখে দেবে। ১৯৯১এর মে মাসে মধ্যেই উভয় দেশ মিলে ২৬৯২টি এমন ক্ষেপণাস্ত্র সত্যিই ধংস করে। এই নিষেধাজ্ঞা সমুদ্রে স্থিত ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য প্রযুক্ত ছিল না। ২০১৮তে ট্রাম্প যুক্তি দিল  চিনের ক্ষেপণাস্ত্র সংখায় ও পাল্লাইয়— দুই দিকেই বাড়ছে, সাউথ চায়না সি-তে চিনের প্রাধান্য মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে, ফলে নিজেদের নিরাপত্তার কারণেই এই চুক্তি থেকে আমেরিকার বেরিয়ে আসা দরকার। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে এই বিচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়ার কথা।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে দুটো সিদ্ধান্ত আলাদাভাবে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিন্দিত হয়েছে তার প্রথমটি হল প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা আর দ্বিতীয়টি হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। প্যারিস চুক্তি হল বিশ্বের তাপমান নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৯৫টি দেশের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি যার মূল নীতি হল কার্বন জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে শিল্প-বিপ্লবের পূর্ববর্তী বিশ্বের তাপমাত্রার থেকে বড়জোর ২ ডিগ্রি বৃদ্ধির সীমায় বেঁধে রাখা। ট্রাম্প তার ২০১৬-র নির্বাচনী প্রচারেই বলেছিল কার্বন জ্বালানি ব্যবহারে বাড়তি সুবিধে পাচ্ছে চিন বা ভারতের মত দেশগুলো। চুক্তি নতুন করলে ভালো, নয়ত তারা এটা মানবে না। আমেরিকার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একদিন পরেই, অর্থাৎ এই কুড়িকুড়ি নভেম্বরের চার তারিখে আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারিস পরিবেশ-চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। জো বাইডেনের অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে অবশ্য অবস্থান খুব স্পষ্ট, তিনি গ্রিন এনার্জির কথা বলে প্রচুর সমর্থন পেয়েছেন সন্দেহ নেই। বাইডেন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার পরে সম্ভবত প্রথম কাজ তার হবে প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসা। আর সবশেষে WHO। প্রথম দিকে যখন চিনে, দক্ষিণ কোরিয়াতে এবং তার পরপরই ইরানে ও ইওরোপে করোনার থাবা চেপে বসছে তখন ট্রাম্প মানতেই চায়নি এটাকে অতিমারি আখ্যা দেবার কোনও যুক্তি সত্যিই থাকতে পারে। লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, ব্যবসা বন্ধ এমন কি মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকেও সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। তার সাদা রিপাবলিকান সমর্থকদল যত হেলাফেলা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতাগুলো অমান্য করে গেছে তত কোভিড আমেরিকায় জাঁকিয়ে বসেছে। কী না বলেছে সে? ব্লিচিং পাউডার খেতে বলেছে মানুষকে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মহৌষধিপ্রমাণ গুণ ব্যাখ্যা করেছে, স্টেডিয়ামে লোক ডেকে জনসভা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত করোনাকে চিনা ভাইরাস বলে অভিহিত করে হু-কে দায়ী করেছে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির এজেন্ট হয়ে কাজ করার অভিযোগে। আমেরিকা ছিল হু-তে সবথেকে বড় অনুদান দেওয়া দেশ। তারা সেই অনুদান বন্ধ করার কথা ঘোষণা করে জানাল সমভাবাপন্ন দেশগুলোকে নিয়ে বরং একটা বিকল্প প্রকল্পের কথা ভাববে, কিন্তু হু-তে তারা আর থাকবে না। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হল বিশ্বব্যাপী এবং তার দেশেও যে প্রতিক্রিয়া কম হয়নি এই কুড়িকুড়ি ভোটের ফলাফল তা দেখিয়ে দিচ্ছে। এই বিচ্ছেদের নোটিস হয়েছে গত জুলাইতে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি আমেরিকার পাকাপাকিভাবে হু থেকে বেরিয়ে আসা সম্পন্ন হওয়ার কথা। বাইডেন এই সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে ফিরিয়ে নেবেন। বাইডেনের ভোটে জেতাই হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে। অতিমারিকালে মানুষদের বাড়ি থেকে মেইলে বা ৩রা নভেম্বর ভোটের দিনের আগে অন্য দিনগুলোয় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ফাঁকায় ফাঁকায় বুথে এসে (ওদেশে এমন নিয়ম আছে) ভোট দেওয়ার ডাক দিয়ে বাজিমাত করেছেন বাইডেন। গণনায় দেখা গেল ভোটের দিনের ভোটে ট্রাম্প পঞ্চাশটার মধ্যে ঊনপঞ্চাশটা স্টেটেই জিতে ছিল, কিন্তু পোস্টাল ব্যালটে বাইডেনের জয় ঠিক তত সংখ্যক স্টেটেই এবং সেটাই নির্ণায়ক পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

ট্রাম্পিয়ানা নামক অসুখটির সবচাইতে বড় রোগলক্ষণ হল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রায় অবলুপ্তি। সে ঘোষিত বর্ণবাদী। ট্রাম্পের আমেরিকান হল খোলাখুলিভাবেই সাদা বর্ণবাদী আমেরিকান যে সমানাধিকার এবং গণতান্ত্রিক নৈতিকতার ধার ধারে না। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকে সে সমাজবিরোধী আখ্যা দিতে পারে অবলীলায়। সে এই দফায় জিতলে নির্বাচিতের রাষ্ট্রপতিত্বকালের সময়সীমা দু দফায় আট বছরে সীমাবদ্ধ রাখার যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা তাকেই হয়ত বদলে দেবার উদ্যোগ নিত। এর ফল হয়েছে যেটা, তা হল সারা বিশ্বেই যে সমস্ত রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে একনায়কতন্ত্রী ভাবনা ছাইচাপা আগুনের মত ধিক ধিক করে জ্বলছিল তাতে বেশ হাওয়া লেগে গেছে। ব্রাজিলে জাইরে বোলসেনারো, ফিলিপিনসে রড্রিগো ডুটেরটে, হাঙ্গেরিতে ভিক্তর ওরবান, ইতালিতে মাতেও স্যালভিনি— এদের সবারই ট্রাম্পের অনুপ্রেরণায় ভোট-টোট এড়িয়ে রাজত্বকাল বাড়ানোর অভিপ্রায় আছে। নরেন্দ্র মোদির ভাবনাতেও কি রাষ্ট্রপতিপ্রধান শাসনতন্ত্রের ভাবনা নেই? আমেরিকার মুক্তবিশ্ব-ভাবনায় ভারতের অবস্থান মোটের উপর নরমে গরমে ভালোই ছিল। ওবামার সময়ও শুল্ক নিয়ে, মেধাস্বত্ব নিয়ে, কাশ্মির নিয়ে কিছু ঠেলাঠেলি ছিলই কিন্তু একই সঙ্গে আমেরিকা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের, শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীদের সমাদরে গ্রহণ করেছে তারা যার জন্য আজ ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান জনগোষ্ঠী এত প্রভাবশালী। ট্রাম্প সহজ ভিসায় অর্গল পরিয়েছে, স্বজনের পরিচয়ে ভিসা পাওয়াও আজ সহজ নয়, ভেবে দেখলে অবাক হতে হবে হাউডি মোদি করে মোদির লাভটা কী হয়েছে? লাভ এই যে মসৃণভাবে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে গেছে, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রনীতির অভিযোগ পকিস্তান করে বটে কিন্তু তাতে আর আমেরিকা কান দেয় না। এমন কি ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর আমেরিকার কংগ্রেসের সদস্যা প্রমীলা জয়পালের সঙ্গে দেখাই করতে চাননি যখন ভদ্রমহিলা কাশ্মিরে মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা চেয়েছিলেন। মনে হয় কি এসব ওবামার আমলে বা ট্রাম্প না হয়ে  হিলারি ক্লিন্টন যদি ২০১৬ নির্বাচন জিততেন তাহলে এত সহজে হতে পারত? তবে এই যে এভাবে ভাবা— ও থাকলে আমেরিকা অন্যরকম আর এ থাকলে আর একরকম— এও কি এক প্রিজনার্স ডিলেমা নয়? আমেরিকার যে গ্লোবাল একটা নজরদারি ছিল তা ট্রাম্প নিজের জমানায় শিথিল করে এনেছে। এইসব নেতাদের পক্ষে ট্রাম্পের পরাজয় যে সুখবর নয় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তা হলেও, দেখা গেল আমেরিকার উদারনৈতিকতার খোলস এখনও অতটা আলগা হয়ে যায়নি যে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকেই তারা প্রহসনে পরিণত হতে দেবে। ফলে ইলেকটোরাল কলেজ রায় দিয়েছে এবং জানুয়ারির কুড়ি তারিখে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট হলেও ট্রাম্পিয়ানার যে অবসান হবে না, বরং তা যে আরও কুৎসিতভাবে সে দেশে প্রতিভাস হবে তা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়। ট্রাম্প মোট ভোটসংখ্যার নিরিখে এবং সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী ইলেক্টোরাল কলেজের সিটপ্রাপ্তির নিরিখে— দুভাবেই বাইডেনের থেকে নীচে শেষ করেছে বটে কিন্তু সে ভোট পেয়েছে গতবারের তুলনায় আশি লক্ষ বেশি। সেনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আগেই ছিল, হাউসে ছিল না। জর্জিয়ার দুটি খালি আসনে জিতে তারা দুটো কক্ষেই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা কিছুটা স্বস্তি দেবে বাইডেনকে, না হলে তাকে পণবন্দির রাজ্যপাট চালাতে হত। কিন্তু যেটা তাকে স্বস্তিতে রাখবে না তা হল ওই ট্রাম্পিয়ানা। দুনিয়ার পলিটিক্যাল ভোকাবুলারিতে অন্তত আগামী বেশ কিছুদিনের জন্য স্থায়ী সংযোজন হয়ে থাকবে ট্রাম্পিজম।

ট্রাম্প গত চার বছরে খুব সফলভাবে যেটা করতে পেরেছে সেটা হল আমেরিকা নামক দেশটার মধ্যেকার প্রায় সমস্ত চোরা ফাটল উন্মুক্ত করে দেওয়া। আমেরিকার ৬৫ শতাংশ মানুষ সাদা। তাদের মধ্যে যে বেকার, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বর্ণবাদী গোষ্ঠীটাই ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল তা কিন্তু কেবল ট্রাম্পের চার বছরের শাসনকালের ফল নয়। ওবামার সময় থেকেই উঁচু মাইনের চাকুরি করা, শিক্ষিত মধ্যপন্থী বা উদারনৈতিক আমেরিকানদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। ট্রাম্পের রিপাবলিকান ভোটব্যাঙ্ক হয়ে উঠল এই নীচুতলার আমেরিকা। যাদের থাকার কথা ছিল লিবারেলদের সঙ্গে তারা হয়ে উঠল দক্ষিণপন্থীদের ভোটব্যাঙ্ক। এ অসুখ বস্তুত এখন সারা পৃথিবীর, ভারতও ব্যতিক্রম নয়। এদেশেও দলিত আদিবাসী মতুয়ারা এখন বিজেপির শক্ত ভোটব্যাঙ্ক। বাইডেন ট্রাম্পের তুলনায় বিজ্ঞানমনষ্ক কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের লিবারেল মুখোশের আড়ালে যে মুখ, সেটা পরিষ্কার নয় আদপেই। ডেমোক্র্যাট ওবামা সরকারের আট বছরের খতিয়ান দেখলে এটাও তো ভুলে যাওয়া যাবে না যে তারা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া প্রমুখ সাতটা দেশে আক্রমণ চালিয়েছে, গদ্দাফিকে লিবিয়াতে ঢুকে মেরে এসেছে, ভেনেজুয়েলাতে, হন্ডুরাসে, বলিভিয়াতে, ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে মদত দিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে জো বাইডেন এলে আমেরিকার চিন পলিসি বা ইওরোপ পলিসির রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে যাবে তা মনে হয় না। তবে সে সব তো বাইরের কথা। সব চেয়ে বড় কথা হল তাদের দেশের অন্দরের কথা। আগামী চার বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্ণবাদী ট্রাম্প সমর্থক আমেরিকানদের একটা বড় অংশকে দরদি আমেরিকানে রূপান্তরিত করার কাজটা তারা কীভাবে করবে সেটা দেখার। প্রায়শই যেটা হয় তোষণের রাজনীতি ফাটল বোজানোর বদলে তা আরও চওড়া করে দেয়। আমরা এখানে বা আমাদের প্রতিবেশী দেশে অহরহই তা দেখছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাদা আমেরিকানদের ডেমোক্র্যাট সমর্থক করে তোলার কাজটা করতে হবে জো বাইডেনকে, নইলে চার বছর পরে ভোটে ভরাডুবি ঘটবে। সে কাজটা কি জো বাইডেনের পক্ষে উদারনৈতিকতা দিয়ে সম্ভব? ফলে ট্রাম্পিয়ানার দীর্ঘ ছায়া ঝুলে থাকবে হোয়াইট হাউসের উপর আরও অনেকদিন ধরেই। মোটের উপর ট্রাম্প যেটা করতে পেরেছে গত চার বছরে তা হল তাদের সমাজের ফাটলগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়া। সে ফাটল বোজাতে পারাটাই জো বাইডেনের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাকি কথা তার পরে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...