অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক
একুশের বাংলায় যে কি হতে চলেছে, তা মা গঙ্গাই জানেন। আপাতত যতক্ষণ না অবধি ‘ভোটবাক্সের রিগিং তত্ত্ব’কে প্রমাণসহ তুলে ধরতে না পারছি, ততক্ষণ অবধি এটাই মেনে নিতে হবে যে মোদি-শাহের জয়রথ এখনও পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য। দুএকটি ছোট রাজ্য ব্যতীত আর প্রায় বাকি সমস্ত দেশেই মোদি-শাহের প্রভাব বিপুলভাবে পড়েছে, এবং পড়েই চলেছে। কাজেই সঠিক প্রমাণের অভাবে, কেবলমাত্র হেরে যাওয়ার বিরক্তি থেকে ‘ভোটবাক্সের রিগিং তত্ত্ব’কে মাঝেমাঝেই সামনে না এনে আমাদের দেশের বিরোধী দলগুলির বোধহয় আত্মসমীক্ষা করা উচিত। অধিকাংশ রাজ্যেই কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দল সেখানকার বিরোধীদের ছন্নছাড়া অবস্থা, তাদের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীকোন্দল, খেয়োখেয়ি এবং মাঝারি বা নীচুতলার বিরোধী নেতাদের লোভকে ব্যবহার করে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করছে। ‘ভোটবাক্সের রিগিং তত্ত্ব’ আজকাল ততটাও সামনে আসতে দেখছি না ঠিকই, কিন্তু বিরোধীদের মধ্যেও সেই সার্থক বিরোধিতা অথবা বিজেপির মতো ভয়াবহ একটি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে লড়াই করবার সামান্যতম ইচ্ছেটুকুও যেন প্রতিফলিত হতে পারছে না। আজ সংবিধানকে বাঁচাতে গেলে, ভারতবর্ষের এতদিনকার স্বাভাবিক চরিত্রটিকে বাঁচাতে গেলে, তার বহুত্ববাদকে বাঁচাতে গেলে সংবিধান-বিরোধী কেন্দ্রের শাসকদলের বিরুদ্ধে যে এককাট্টা মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে লড়াই করা প্রয়োজন সেই তাগিদটা দেশের অধিকাংশ বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যেই অনুপস্থিত। কাজেই সেই সত্যিটাকে স্বীকার করে আমাদেরকে ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে হবে। নচেৎ মোদি-শাহের একাধিপত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর দেখছি না।
এখন বিরোধীদের কথা ভুলে আসুন, শাসকপক্ষের দিকটাতে চোখ ফেরানো যাক। ছোটবেলা থেকেই আমরা সেই প্রবাদবাক্যকে মুখস্থ করে এসেছি যে, “বিপুল ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গেই আসে বিপুল দায়িত্বভার।” গত দুবারে নির্বাচিত হয়ে আসা মোদি-শাহের সরকারের উপর তাই তাঁদের সেই বিপুল ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে এই ভারতবর্ষের জনতারও বিপুল দায়িত্বভার ন্যস্ত হয়েছে। তাঁরা সেই দায়িত্বের পালন কতটুকু করেছেন বা কতখানি করতে পেরেছেন, সেই নিয়েও অবিশ্যি বিপুল বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আজ আমরা সেই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্য নিতে চেষ্টা করব। সুশাসন বলতে আমরা বুঝি যে দেশের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধার পর্যাপ্ত বিকাশ। অন্যদিকে বিজেপির ‘সুশাসন’ বলতেই যে কয়েকটি শব্দ বিজেপি-বিরোধীদের অবিন্যস্ত অগোছালো বাক্যপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে একেকটি করে হুড়মুড়িয়ে ভেসে আসতে শুরু করে সেগুলি হল, উত্তরপ্রদেশ, আইনশৃঙ্খলা, হাথরাস, লভ জিহাদ ইত্যাদি। এই শব্দগুলিকে আমরা যদি এক অর্থে দেখতে চেষ্টা করি তাহলে হয়তো মূল ইস্যুটিকে আমরা নারী নিরাপত্তা অথবা নারীকল্যাণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারব। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাহলে আমরা যদি কোনও একটি বিশেষ রাজ্য অথবা কয়েকটি বিশেষ ঘটনার দিকে না তাকিয়ে সামগ্রিক একটি চিত্রের দিকে তাকাতে চেষ্টা করি তাহলে কেমন হয়? এই বিষয়ে আমরা গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত, ভারত সরকারের নারী ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের অধীনে চালানো একটি সমীক্ষার— ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যাদির শরণাপন্ন হয়েছিলাম। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার যে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল অবধি আমাদের দেশে প্রায় আড়াই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা তাঁদের কাজ হারিয়েছেন। মার্চ ২০২০তে অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে নভেম্বর ২০২০ অবধি এর সঙ্গে আরও ৬৭ লক্ষ নাম যোগ হয়েছে। যদিও, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্ট বলছে সার্বিকভাবে মহিলাদের কাজ পাওয়ার সংখ্যাটি শেষতম সমীক্ষার ফলাফলের সাপেক্ষে সামান্য পরিমাণে হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে যে বর্তমান ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্টটি কিন্তু কেবলমাত্র অতিমারি-পূর্ববর্তী সময়ে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে। কাজেই, সেই সামান্য বৃদ্ধিটুকুও যে এই অতিমারি-পরবর্তী সময়ে আর কতটুকুই বা অবশিষ্ট আছে তার খবর এখনও অজানা। সেসব ছেড়ে আমরা বরং এই সমীক্ষা অনুযায়ী অতিমারি-পূর্ববর্তী সময়ে প্রাপ্ত তথ্যাদিসমূহের দিকেই চোখ ফেরাই।
গার্হস্থ হিংসার ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ নজির সৃষ্টি করেছে কর্নাটক। ২০১৫ সালেও যে রাজ্যে মাত্র ২০.৬ শতাংশ মহিলা গার্হস্থ হিংসার শিকার হতেন, পাঁচ বছর বাদে সেই সংখ্যাটি এখন এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪.৪ শতাংশে। অন্যান্য রাজ্যে এই শতাংশের হিসেবে খানিকটা করে উন্নতি দেখা গেলেও তা পাঁচ বছরের সময়কালের তুলনায় যৎসামান্য বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। এখনও বিহারের ৪০ শতাংশ, মণিপুরে ৩৯.৬ শতাংশ, তেলেঙ্গানায় ৩৬.৯ শতাংশ, এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ শতাংশ মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়ে চলেছেন। যেখানে, এর বিপরীতে এই একই দেশের অন্য আরেকটি রাজ্য নাগাল্যান্ডের মাত্র ৬.৪ শতাংশ মহিলা এই ধরনের অপরাধের শিকার হন বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। অর্থাৎ কিনা অনগ্রসর উত্তর-পূর্বের প্রত্যন্ত একটি রাজ্যের থেকেই আজ তাবড় সমস্ত শিল্পোন্নত রাজ্যগুলির শিক্ষা নেওয়া উচিত। মনে রাখা উচিত যে এই তথ্য লকডাউনের আগেকার সময়ের। লকডাউন এবং অতিমারি-পরবর্তীতে এই গার্হস্থ হিংসার ভবিষ্যৎ যে কী হতে চলেছে, সেই বিষয়ে বোধকরি কিছু না বলাই মঙ্গল। এর সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’য়ের সাফল্য নিয়ে অনেক ঢক্কানিনাদ শাসকদলের তরফে শোনা গেলেও বর্তমান সমীক্ষাটির ফলাফল অনুযায়ী এই প্রকল্পের বাস্তব চিত্রটি কিন্তু মোটেই আশাপ্রদ নয়। তার কারণ এই সমীক্ষা অনুযায়ী অন্তত আটটি রাজ্যের ক্ষেত্রে জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। হিমাচল প্রদেশ, যেখানে পূর্বের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি এক হাজার জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল ৯৩৭, বর্তমান সমীক্ষা অনুযায়ী সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩৫এ। গোয়াতে পূর্ববর্তী সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি হাজার জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল ৯৬৬, এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩৮এ। একই রকমের ফলাফল নজরে এসেছে কেরল (যেখানে প্রতি হাজার জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ১০৪৭ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯৫১তে), মেঘালয় (যেখানে প্রতি হাজার জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ১০০৯ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯৮৯তে), এবং মহারাষ্ট্রে (যেখানে প্রতি হাজার জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ৯২৪ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯১৩তে)। পূর্ববর্তী সমীক্ষা অনুযায়ী এই বিষয়টিতে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছিল যে দুটি রাজ্য, সেই যথাক্রমে পঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে বর্তমান সমীক্ষকদের কাছে কোনও তথ্যই এসে পৌঁছতে পারেনি। নারীকল্যাণের বিষয়ে আপাতত এইটুকুই থাকুক। হাথরাসের ভারতবর্ষে বাকিটুকু আর বলবার দরকার পড়ছে না।
২০১৯এ, লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি দাবি করেছিলেন যে দেশে বেকারত্বের অবস্থা বিগত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। নির্বাচনে সেই বক্তব্য প্রভাব ফেলেনি, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তীতে পরিসংখ্যান মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে সেই তথ্যই সরকারিভাবে উঠে এসেছে। আজ যদি বেরোজগারির কথা বলতে হয়, তাহলে দেখা যাবে যে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির রিপোর্ট অনুযায়ী মার্চ ২০২০ অবধি ভারতবর্ষে বেকারত্বের হার ৭ থেকে ৮ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে। দেশব্যাপী লকডাউনের মাঝে এপ্রিল এবং মে মাসে এই বেকারত্বের হার বেড়ে যথাক্রমে ২৪ ও ২২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর, ক্রমশ লকডাউন উঠতে শুরু করলে এবং খরিফ মরসুমে শস্য-উৎপাদন শুরু হলে পরে নভেম্বর ২০২০তে বেকারত্বের হার ৬.৫ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু এতে উল্লসিত বোধ করবার কোনও কারণ নেই। ডিসেম্বর ২০২০তে এই বেকারত্বের হার আবার ৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল অবধি, মাঝে লকডাউনের সময়টুকুকে বাদ দিলেও, বেকারত্বের হার ৭ থেকে ৯ শতাংশের মাঝে ঘোরাফেরা করেছে। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি চাকরির যে প্রতিশ্রুতি মোদি-সরকার দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গিয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির রিপোর্ট অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০১৮তে ভারতবর্ষে চাকুরিজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৯.৭ কোটির কাছাকাছি। নভেম্বর ২০২০তে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৪ কোটি আনুমানিক। মনে রাখতে হবে যে, প্রতি বছরে অন্ততপক্ষে ১২ কোটি মানুষ আমাদের দেশে চাকরির বয়সে পৌঁছয়। অর্থাৎ বিগত দুবছরে অন্তত ২৪ কোটি মানুষ চাকরির বয়সে পৌঁছলেও, মোট হিসেবে দেশে চাকুরিজীবীর সংখ্যা কমেছে। বিকাশের সঙ্গে পরিসংখ্যানকে একেবারেই মেলানো যাচ্ছে না। অথচ বোধহয় দিন দুই-তিন আগেও মাননীয় রেলমন্ত্রী আরও একটিবার কোনও একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ফাইভ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির ওয়েবসিরিজ-মার্কা রূপকথাটিকে সাড়ম্বরে উপস্থাপিত করেছেন।
যে কথা আগেও বলেছি, সুশাসন বলতে আমরা বুঝি যে দেশের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধার পর্যাপ্ত বিকাশ। এখন এই সুশাসনের মাপকাঠি হিসেবে একটি বিশ্বজোড়া সূচক হল গ্লোবাল হিউমান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স, যা কিনা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংস্থার মাধ্যমে প্রতি বছর প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বর ২০২০তে প্রকাশিত, রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সূচক-নির্দেশকারী সংস্থাটির রিপোর্ট অনুযায়ী হিউমান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের নিরিখে ২০১৮র তুলনায় ২০১৯এ আমাদের দেশ ভারতবর্ষ আরও একটি ধাপ নেমে গিয়ে ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩১তম স্থানটি অধিকার করেছে। যেখানে, সিঙ্গাপুরের স্থান ১১তে, সৌদি আরব ৪০তম স্থানে, মালয়েশিয়া ৬২তে এমনকি শ্রীলঙ্কা (৭২) ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত ১১৭তম ধাপটিতে অবস্থান করছে। এই তালিকায় আমাদের নিকটবর্তী দেশগুলির মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে ভুটান (১২৯), বাংলাদেশ (১৩৩), নেপাল (১৪২) ও পাকিস্তান (১৫৪)। গরিবির দিক থেকে এই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার ২৭.৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে এবং ১৯.৩ শতাংশ মানুষ বিপজ্জনকভাবে দারিদ্রসীমার চেয়ে সামান্যই উপরে রয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, এই তথ্যও কিন্তু অতিমারি-পূর্ববর্তী সময়ে প্রাপ্ত। অতিমারি-পরবর্তীতে ওই বিপজ্জনক সীমান্তবর্তী অবস্থানে থাকা ১৯.৩ শতাংশ মানুষের কপালে যে কি ঘটেছে বা ঘটতে পেরেছে সেই বিষয়েও কোনও মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
মোদি-জমানায় মুক্তচিন্তার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা যে কতটুকু সেটাকে মনে করিয়ে দিতে গেলেও বোধহয় কেবল একটি নামই যথেষ্ট। গৌরী লঙ্কেশ। ২০১৭তে গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়ে গেলেও আজও তাঁর হত্যাকারীদের বিচার হয়নি। এছাড়াও, এর বিপরীতে বিনা বিচারে, বিনা চার্জশিটে দিনের পর দিন অসুস্থ, বৃদ্ধ সমাজকর্মীদেরকে ভুয়ো মামলায় ফাঁসিয়ে অমানবিকভাবে জেলে আটকে রাখার মতো বিষয়েও মোদি সরকার হাত পাকিয়েছে। কাফিল খান থেকে শুরু করে ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বডে অথবা স্ট্যান স্বামীর মতো একেকজনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে বারংবার আমাদের দেশের নাম বাকস্বাধীনতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কালিমালিপ্ত হয়েছে। কাজেই ২০১৮ সালের গ্লোবাল হিউমান ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচক অনুযায়ী আমাদের দেশ যে সেই কারণে এক ধাক্কায় ১৭ ধাপ নেমে গিয়ে ১১১ নম্বর ধাপে অবস্থান করবে তাতে অন্তত আশ্চর্য হবার মতো কিছু নেই। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, এই গ্লোবাল হিউমান ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচক অনুযায়ী বলসানেরো সরকারের ব্রেজিল, মেক্সিকো, কাম্বোডিয়া, বলিভিয়া, লুকাশেঙ্কোর বেলারুশ এমনকি আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোর মতো দেশও আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। মোট ৭৬টি নির্দেশকের উপরে ভিত্তি করে এই গ্লোবাল হিউমান ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচকটিকে জানানো হয়, যার মধ্যে থাকে আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, ধর্মীয় নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা এমনকি সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। মোদি-সরকার অথবা তাঁর ভক্ত প্রচারকেরা এই সমস্ত সূচকগুলিকে বাম-মনস্ক আন্তর্জাতিক কূট-সংগঠন সমূহের অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি যে এই গ্লোবাল হিউমান ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচকটি প্রদান করে ওয়াশিংটনের কেটো ইনস্টিটিউট এবং এই কেটো ইনস্টিটিউটেরই অন্যতম গবেষক স্বামীনাথন এ আইয়ার সম্প্রতি মোদি-সরকারের আনা নতুন তিনটি কৃষি আইনেরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কাজেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গবেষকদের প্রশংসার ভাগীদার হতে গেলে তাঁদের তিরস্কারটুকুকেও যে অস্বীকার করলে চলবে না। এই গ্লোবাল হিউমান ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচকটির ভিত্তিতে, গত কয়েক বছরে ভারতবর্ষের ফলাফল যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব ২০০৮-১২ সাল অবধি ভারতবর্ষের অবস্থান ছিল ৭৫এ, ২০১৩তে তা নেমে দাঁড়ায় ৮৭তে। ২০১৫তে ১০২, ২০১৬তে ১১০, ২০১৭তে ৯৪ এবং ২০১৮ সালের শেষতম রিপোর্ট অনুযায়ী তা ১১১তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন, এই সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিভিন্ন ঘটনাগুলিকে মনে মনে একটিবার সাজিয়ে নিন। ‘বিকাশ’ তো বটেই!
আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকের মাপকাঠিতে গত বছর ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২ নম্বর স্থানে ছিল ভারত। এবছর সেই সূচক অনুযায়ী ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪তম স্থান পেয়েছে আমাদের দেশ। একে আশা করি কেউ ‘বিকাশ’ বলে অপমান করবেন না। আজ নারীকল্যাণ থেকে বেকারত্ব, সুশাসন থেকে বাকস্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা থেকে পুষ্টি— এই প্রত্যেকটি বিষয়ে জাতীয় স্তর থেকে আন্তর্জাতিক স্তর অবধি প্রকাশিত এক বা একাধিক রিপোর্টকে মানলে, সূচককে মানলে— ধারাবাহিক অবনমনের একটি সুস্পষ্ট চিত্রই কেবল প্রস্ফুটিত হতে পারছে। সংসদীয় সংখ্যার হিসেবে আজ মোদি-শাহকে অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই। অদূর ভবিষ্যতে যে তাঁরা তাঁদের বিভেদসর্বস্ব রাজনীতিকে বিসর্জন দিয়ে জনমুখী, সদর্থক উন্নয়নমুখী কর্মসূচিতে মনোনিবেশ করবেন তারও কোনও লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বিরোধীরা তাঁদের অন্তর্কলহে ব্যস্ত রয়েছেন। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের হাতে থাকছে কেবল পেন্সিলটুকুই, যতক্ষণ না অবধি এই সূচকগুলির ক্রমাগত অবনমনের ধাক্কাতে পিষ্ট হতে হতে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ রাস্তায় না নেমে আসে।
কৃষকরা পথ দেখাচ্ছেন।