অপর্ণা ঘোষ
এক আপাত নিরীহ পরিসংখ্যান—
২০১১-র সেন্সাস বলে ৪২.৭% ভারতীয় মুসলমান নিরক্ষর। এই নিরক্ষরতার হার তফসিলি জাতিদের নিরক্ষরতার হারের থেকে ৪০.৯% বেশি। যদি লিঙ্গের নিরিখে বিশ্লেষণকরা যায়, ভারতীয় মুসলিম নারীদের ৪৮ শতাংশ নিরক্ষর, যা জাতীয় নিরক্ষরতার ৪৪শতাংশ হারকে টেক্কা দেয়। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে স্কুলশিক্ষায় মুসলিম মেয়েদের এনরোলমেন্ট (কত শতাংশ অন্তত মাধ্যমিক স্তর অবধিও পড়াশুনা অব্যাহত রাখছে তার হিসেব এটা নয়) উচ্চবর্ণ হিন্দু মেয়েদের তুলনায় ৪০.৬% কম, আর উচ্চশিক্ষায় ভারতীয় মুসলিম জনগণের যোগদান সমগ্র অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের ৪.৪%।
চাকুরি ক্ষেত্রে ২০১১-র সেন্সাস অনুযায়ী মুসলিম মেয়েদের যোগদান ১৪.৮%। অবশ্য সমগ্র ভারতীয় মহিলাদের যোগদান সেখানে ২৭%।
পরিসংখ্যান হয়তো কিছুই বলে না। তবুও যে লেখাটি নির্মিত হতে যাচ্ছে তার তলায় তলায় বইতে থাকা অন্ধকারে এই পরিসংখ্যানগুলি ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। এই নির্মাণ ও সমস্ত নির্মাণকে প্রশ্ন করবে অবিরাম… হয়রান নির্মাণগুলি আরও আরও তথ্য, পরিসংখ্যান, ঘটনা ও ইতিহাসের কড়া নাড়তে থাকবে…।
১৯৮৫ : শাহবানো মামলা ও লোকসভা নির্বাচন
১৯৮৫ সালে মহম্মদ আহমেদ খান ভার্সাস শাহবানো মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। বাষট্টি বছরের বৃদ্ধা পাঁচ সন্তানের মা শাহবানোকে যখন তার উচ্চশিক্ষিত উকিল স্বামী তালাক (ইররিভোকেবল ডিভোর্স) দেন,তার আগেই অবশ্য তিনি একজন অল্পবয়স্ক মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন, তখন কোনও উপায়ান্তর না দেখে ১৯৭৮ সালে শাহবানো সুপ্রিম কোর্টে একটি ক্রিমিনাল স্যুট ফাইল করেন। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট শাহবানোর আজীবন খোরপোষ পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। খুব সহজ অঙ্কের নিয়মেই মুসলিম রাজনীতিবিদদেরবড় অংশ এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনশুরু করেন। মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার ও ধর্মীয় আইন প্রয়োগের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে হইচই বাঁধান। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটিও গভীরভাবে উঠে আসে।মুসলিম ধর্ম ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের হাতে নিরাপদ নয়, এরকম একটি প্রস্তাবনা শুধু মুসলিম সমাজ নয়, বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী অংশের মধ্যে থেকেও শোনা যেতে থাকে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে বিজেপি বা অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি অভিন্ন দেওয়ানিবিধির দাবী করতে থাকে। এবং এর বিরুদ্ধে দাওয়াই হিসেবে এক অংশের বুদ্ধিজীবীদের মতামত ছিল মুসলিম সমাজের ধর্মীয় আইন ও কুপ্রথাগুলির বিরোধিতার অধিকার ওই সমাজের শিক্ষিত অগ্রগণ্য ব্যক্তিবর্গেরই রয়েছে এবং তারা ই তা প্রয়োগ করবেন। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ‘অপরত্বে’ সিলমোহর লাগিয়ে তারা হাত ধুয়ে ফ্যালেন আর খুব সূক্ষ্মতার সঙ্গে মুসলিম নারীদের সম্মান, নিরাপত্তা, মানবাধিকারের প্রশ্নটি গৌণ করে ফেলা হয়। এখানে আরেকবার মনে করিয়ে দিই শাহবানো কিন্তু তার স্বামীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল ল স্যুট ফাইল করেছিলেন।
যাই হোক, সে বছর লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজেছে। ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়ে ভীত কংগ্রেস পার্লামেন্টে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের অনুজ্ঞাটিকে প্রায় খারিজই করে দেয়। সেই আইনে বলা হয় (শরীয়ার সমর্থন প্রাপ্ত) তালাকপ্রাপ্তা নারী তার ঈদাত (৯০ দিন) পর্যায় পর্যন্ত খোরপোষ পাওয়ার অধিকারী, এবং খোরপোষের পরিমাণ নির্ধারণের অধিকারও হাস্যকরভাবে স্বামীর হাতেই থেকে যায় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে। ‘ঈদাত’হল বৈধব্য ও তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীদের পুনর্বিবাহের জন্য অপেক্ষার সময়। তালাকপ্রাপ্ত মহিলা যদি পুনর্বিবাহ নাও করেন, ওই ৯০ দিনই তিনি খোরপোষ পাবেন। এর পরেও কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ড্যানিয়েল লতিফি কেস এবং শামিমা ফারুকি ভার্সাস শাহিদ খান কেসেও শাহবানো মামলার রায়ই জারি রাখে।
ঠিক এই জায়গায় এসে পরিসংখ্যানের হাত ধরে আরেকটি পরিসংখ্যান উঠে আসতে চায়। কেমন ছিল ১৯৮৫ সালে ভারতীয় মুসলমান নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের চিত্রটি। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া গেল না। নিজে ব্যাখ্যায় না গিয়ে ২০০১-এর সেন্সাস রিপোর্ট স্টেটমেন্ট তুলে ধরছি সরাসরি। এটা সাক্ষরতার হার মাত্র। মূলধারার শিক্ষায় অংশগ্রহণ ও উচ্চশিক্ষায় যোগদানের হার দিতে পারলাম না ইন্টারনেট ব্যবহারে অদক্ষতার কারণে। পাঠক একটু খুঁজে দেখে নিতে পারেন।
মুসলিম পুরুষ— ৬৫.৬%, অর্থাৎ নিরক্ষর ৩৫.৪%।
মুসলিম নারী— ৫০.১%, অর্থাৎ নিরক্ষর ৪৯.৯%।
এবার পাঠককে অনুরোধ, লেখার শুরুতে ভারতীয় মুসলমান নারীর নিরক্ষরতার যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছিল, সেটা একবার মিলিয়ে দেখুন। সরকারি হিসেবই বলছে ২০০১ থেকে ২০১১, এই দশ বছরে নিরক্ষরতা কমেছে ১.৯%! অভূতপূর্ব অগ্রগতি নয় কি?
আর WPR (Work Participation Rate)?
হিন্দু মহিলা— ২৭% (সমস্ত ভারতীয় মহিলা নন)।
মুসলিম মহিলা— ১৪.১%।
দশ বছরে বৃদ্ধি ০.৭%!
ধান ভানতে শিবের গীত মনে হচ্ছে বারবার? কিন্তু শিক্ষার চিত্র সচেতনতার সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে না কি? সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির হার, নারীর অধিকার সচেতনতা এবং তাতে সামাজিক সমর্থন… কীভাবে সম্ভবপর হবে? আইনি অধিকার অর্জন এবং সমাজে তার প্রয়োগ, এ দুয়ের মাঝখানের অন্ধকারে এই পরিসংখ্যানগুলি ক্রমাগত ঘুরে বেড়ায় আর প্রশ্ন করে… ঘাই মারে গুরুভোজনের পর চোঁয়াঢেঁকুরের মতো…
কাট টু ২০১৭
তিন তালাক বা তালাক-এ-বিদ্দত অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। মুসলিম সমাজের সকল অংশে এর ব্যবহার নেই। তবুও বড় একটি অংশে, বিশেষত অনগ্রসর সমাজে এই রায় অবশ্যই সদর্থক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। শায়রা বানো, আফরিন রহমান, ইশরাত জাহান, গুলশন পারভীন, আতিয়া সাবরি সহ অসংখ্য মুসলিম নারীর মর্মযন্ত্রণায় একটা প্রলেপ অবশ্যই; অবশ্যই এ নারীসমাজের আইনি জয়। মুসলিম নারীর সম্মান ও নিরাপত্তার প্রশ্নে এক পা এগোনো। অন্যদিকে এই জয়কে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদী দলগুলি ভারতবর্ষের গভীর বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গলা টিপে ধরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি গেলাতে চায়। আবারও ১৯৮৫-র মতোই গৌণ হয়ে যাচ্ছে নারীর মানবাধিকারের প্রশ্ন, সম্মান ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। উপরিতলে আইনি পরিভাষা জ্বলজ্বল করছে, আবার গভীর স্তরে মাথা কুটে মরছে ধর্ম ও জাতি নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার অধিকার, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়গুলি।
পরের অংশে যাওয়ার আগে দু একটি প্রয়োজনীয় কথা। ভারতবর্ষের মুসলিম জনসমাজ কখনওই একটি একরৈখিক ধর্মভিত্তিক আইডেন্টিটি নন। তারা নিজেরাও কখনও এমন সরলীকরণে বিশ্বাস করেননি। এই বৈচিত্রকে অস্বীকার করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকই তাদের অন্যান্য সমস্ত পরিচয়কে ছলে বলে কৌশলে অবদমন করে ধর্মভিত্তিক পরিচয়টিকে বড় করে তোলে। নবোত্থিত জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরে গোড়াতেই কোপ দেওয়ার তাড়নায়। অসুবিধেও হয়নি। কারণ সেই নবোত্থিত জাতীয়তাবাদের চিত্রনাট্যে লেখা হল হিন্দু গৌরবগাথা শিবাজী উৎসব, রামরাজ্য, সন্তানদল, আনন্দমঠ ইত্যাদি। তবু এই লেখায় বারবার ‘ভারতীয় মুসলমান সমাজ’ কথাটিকে ব্যবহার করতে হচ্ছে আলোচনার পরিসরটিকে আঁটোসাঁটো করার জন্য, তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে চিহ্নিত করতে নয়।
ঔপনিবেশিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগকে দীর্ঘকাল প্রতিহত করেছিলেন মুসলিম সমাজ। যার ফলশ্রুতি হল, শিক্ষিত হিন্দু সমাজ বিবাহ বিচ্ছেদ বা খোরপোষ সংক্রান্ত সমস্যায় হিন্দু আইনের দ্বারস্থ হন না, সিভিল কোড এই সমস্যার সমাধান করে। (আর অনগ্রসর হিন্দু নিম্নবর্গ?? তাদের অবস্থা সম্ভবত মুসলমান হিন্দু সব জায়গাতেই এক, বা উনিশবিশ তারতম্য)। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে তো অসবর্ণ বিবাহ রেজিস্ট্রেশনও করা যায় না। কিন্তু মুসলমান সমাজেরবিরাট অংশ ‘শরিয়া’ এবং মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের আইনি ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যার উপর আস্থা রাখেন। কিন্তু পরিসংখ্যানই দেখাচ্ছে শিক্ষার চেহারা। অধিকাংশ মুসলিম মহিলা জানেনই না নিকাহ্ একটি লীগ্যাল এগ্রিমেন্ট, শরিয়া সেই নিকাহ্নামায় (Legal agreement of marriage) খুল্লা নেওয়া থাকলে মেয়েদের তালাক দেওয়ার অধিকার স্বীকার করে। উল্লেখ্য, পিটিশনে নিকাহ্ হালালারউল্লেখ থাকলেও সে সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট নীরব। অথচ এই প্রথাটি অনগ্রসর মুসলিম সমাজে নারী পাচার ও নারীর প্রতি সংগঠিত আরও নানা অপরাধের মাধ্যম।
একটু যদি পিছিয়ে যাই উনবিংশ শতকের দিকে, দেখতে পাব নারীর অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলি বিধিবদ্ধ করার জন্য তথাকথিত সমাজ সংস্কারকদের ধর্মীয় শাস্ত্রের মধ্যে তার সমর্থন খুঁজতে হয়েছিল। এ নিয়ে বিদ্যাসাগরের আক্ষেপ কম ছিল না। আর বিধবা বিবাহ দিতে গিয়ে তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন আইন করে সমাজ সংস্কার করা কি ভজঘট ব্যাপার। যার জন্য পরের দিকে আইনি লড়াইতে তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে আজ ২০১৭তে দাঁড়িয়েও সুপ্রিম কোর্টকে তাৎক্ষণিক তালাক অসাংবিধানিক ঘোষণা করার জন্য শরিয়ার সমর্থন খুঁজতে হয়। নারীর মানুষহিসেবে অধিকারের প্রশ্নটি বারবার গৌণ হয়ে পড়ে। আইন ও সমাজ পরস্পরকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন, তা দু-একটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়। শিশুশ্রম বিরোধী আইনের প্রাথমিক চেহারাটি ব্রিটিশ আমলে রূপ পায়। তারপর তার নানা বিবর্তন সকলেরই জানা। তবুও প্রাতঃভ্রমণ সেরে যে চায়ের দোকানে পিপাসার্ত হয়ে গিয়ে বসি, সেখানে একটি বছর বারোর বালক হাত ঘুমজড়ানো চোখ রগড়াতে রগড়াতে চায়ের ভাঁড় ধরিয়ে দেয়। ১৮২৯ সালে রদ হয়েছিল সতীদাহ প্রথা। আর ১৯৮৭ সালে আমরা রূপ কানোয়ারকে স্বামীর চিতায় জ্বলে যেতে দেখি, নাকি স্বেচ্ছায়…স্বেচ্ছা হলে তো আরও মারাত্মক। ২০১৬ সালে রাজস্থান গিয়ে দেখি সতীমাতা রূপ কানোয়ারের নামে গড়ে উঠেছে মন্দির (দেওরালার সতীস্থলে গ্রামবাসীদের প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও সরকার চক্ষুলজ্জার খাতিরে মন্দির বানাতে দেয়নি তবে পুজো চলে)… মেয়েরা সেখানে ভক্তি ভরে পুজো দেয়। আইন দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো। আইন ও সমাজের মাঝখানের এই যোজন শূন্যতার মধ্যে শুধু পরিসংখ্যানগুলোই ঘুরে মরে… প্রশ্ন করে….।
কোনও ধর্মই নারীর জন্য মানুষের জীবন নির্দিষ্ট করেনি (পুরুষের জন্যও করেছে কি?)। হিন্দু শাস্ত্রে নারী ও শূদ্রকে (নারী পুরুষ নির্বিশেষে) কুকুরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম শাস্ত্রে যৌন অনিচ্ছার জন্য বরাদ্দ হয়েছে স্বামীর প্রহার (যদিও একে অনেকে অপব্যাখ্যা বলেন)। আসলে ধর্মাচরণ কোনও দিনই ব্যক্তি পরিসরে আবদ্ধ থাকেনি। অথচ প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলির অধিকাংশেরই উত্থান ঘটেছে নিপীড়িত সামাজিক বর্গের হাত ধরে। ক্রমে তা তৈরি করেছে ক্ষমতার পিরামিড। প্রান্তিক মানুষগুলিকে ক্রমাগত ঠেলে দিয়েছে আরও আরও প্রান্তিকতার দিকে। ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞা ও পাঠ গ্রহণ করেছে ভারত রাষ্ট্র, তা আসলে ধর্মেরই অন্য পিঠ। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ছোট ছোট জনজাতির ওপর তীব্র সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং তাদের আত্মপরিচয়কে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা অবশ্য এখন একটি আন্তর্জাতিক লক্ষ্মণ। ভারতের বিচিত্র সংস্কৃতি ও বহুস্তরীয় জীবনচর্যার আবহমান প্রবাহকে সংখ্যাগুরুর ধর্মে লুপ্ত করে দেওয়ার এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা (এটা বিজেপির আমলেই শুরু হয়েছে এমন নয়) অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবেও এক সুগভীর হনন প্রকল্প। কাজেই তিন তালাক নিয়ে বিজেপির নাচানাচি ও তাতে মোহিত হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অনুরোধ করি এই রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে একটু তলিয়ে বোঝার জন্য। যতদিন নারী বা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলিকে মানবাধিকার বলে স্বীকৃতি না দিয়ে ধর্মশাস্ত্রে তার সমর্থন খোঁজা হবে, ততদিন (আইনি লড়াই করা মানুষগুলির যন্ত্রণা ও সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায় মাথা নত করেই বলছি) মূল লড়াইয়ের ধারেকাছেও আমরা পৌঁছতে পারব না।
এ লেখার বিষয় কোনও গণ্ডিতে আবদ্ধ হতে চায় না। নিজেই ছুটে মরতে চায়, ধাক্কা দিতে চায় কারাগারের সবকটা দেওয়ালে। এড়িয়ে যেতে পারে না পিতৃতন্ত্র আর আইনের টানাপোড়েনটিকে। ‘পিতৃতন্ত্র’শব্দটি থেকে প্রত্যক্ষভাবে পিছলে পড়তে থাকে ‘পিতৃতন্ত্র বনাম নারী’ ধারণাটির একরৈখিক অভিক্ষেপ, যার বোধহয় আরেকটু প্রসারিত দৃষ্টিকোণ প্রয়োজন। পিতৃতন্ত্র আসলে একটি ক্ষমতা কাঠামো। যার পরিসর থেকে, পীড়ন থেকে নারী বা পুরুষ কারওই কোনও এসকেপ রুট নেই। খুব ক্লিশে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একটি পুত্রসন্তান যখন তার কোনও সিদ্ধান্তে মায়ের যৌক্তিক সমর্থন পেয়েও বাড়ির কর্তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে পারে না তখন সেও সরাসরি পিতৃতন্ত্রেরই শিকার হয়। পাশাপাশি তার ভেতরে চারিয়ে যেতে থাকে এর শিকড়, পুরুষ হিসেবে সমাজ থেকে সুবিধা পাওয়ার, আধিপত্য বিস্তারের জোর। এবং একই সঙ্গে মানুষ থেকে খণ্ডিত পুরুষে পরিণত হওয়ার ট্র্যাজেডি সে বহন করতে শুরু করে। আইনও একই প্রক্রিয়ায় পুরুষ হয়ে ওঠে। ধর্ম, পিতৃতান্ত্রিকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রান্তিকতা বিচ্ছিন্ন কিছু ধারণা নয়। অর্থনৈতিক শোষণ পীড়নের কাঠামোর ওপরে যুক্ত হতে থাকে এক অসহ সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক চাপ… প্রতিনিয়ত নারী পুরুষ নির্বিশেষে তার অস্তিত্বের পরিচয় মুছে, তার সমস্ত ইউনিকনেস ও আততিকে ভেঙেচুরে একটি রাষ্ট্রীয় সমতলে পরিণত করতে থাকে সেই চাপ।আর তার মধ্যেই নষ্ট হতে থাকে সে, যাকে আমরা উত্তরণ বলি।
সমাজ ও আইনের কথা তো হল, এবার আইন ও রাজনীতিরআন্তঃসম্পর্ক নিয়ে দু চার কথা। নির্দিষ্ট করে বললে রাজনৈতিক দলগুলির। সামাজিক ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ আইন প্রবর্তিত হলে বা ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত কোনও আইন প্রবর্তিত বা সংশোধিত হলে সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির দায়িত্ব প্রধানত রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিদের ওপরে বর্তায়। পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজেরও একটি ভূমিকা থাকার কথা। বর্তমান সময়ের ছবিটা বড় ধূসর। রাজনৈতিক পরিচয় যেভাবে ব্যক্তি ও নাগরিকের অন্যান্য পরিচয় গিলে নিচ্ছে, তাতে সাধারণ ইস্যুতে মতামত রাখতে গেলেও মানুষ কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের লোক বলে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। নাগরিক স্বরের অভাবজনিত শূন্যতায় মিলে মিশে খিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি ও অধিকার সচেতনতার মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়। সদর্থে প্রণীত একটি রায়কে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃতহওয়ারজায়গাটা নাগরিক সমাজকেই রুখতে হবে যে করে হোক। নয়তো কোনও এক সরকারের অধীনে একটি আইন প্রণীত হবে, আবার অন্য একটি সরকারেরসময়কালে তা খারিজ হবে, পুরোটাই রাজনৈতিক, বলা ভালো গদিতে থাকার স্বার্থে পরিচালিত হবে। মনে রাখাদরকার তিন তালাক সম্পর্কিত রায়নিয়ে যখন আমরা বেশ খুশি তারই কাছাকাছি সময়ে বিচারব্যবস্থায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এক, দিল্লী হাইকোর্টে কেন্দ্র হলফনামা দিচ্ছে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বললে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানই নাকি প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবে! এবং অন্যটি হল, সুপ্রিম কোর্ট বলছেন ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক অধিকার (যদিও তা অবাধ নয়)। প্রথম প্রস্তাবনাটি বৈবাহিক ধর্ষণকে ডিক্রিমিনালাইজ করা হল। এবং তার সাথে সাথে গৃহহিংসা প্রতিরোধ আইনটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ল। বৈবাহিক ধর্ষণ কি গৃহহিংসা নয়?? আর দ্বিতীয় রায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অনেকটাই সদর্থক। অথচ দিল্লী হাইকোর্ট যখন সমকামিতাকে ডিক্রিমিনালাইজ করেছিল তা এই সুপ্রিম কোর্টেরকাছে ধোপে টেকেনি। তারা কিন্তু ২০১৪তে সমকামিতা বিষয়ক পুরনো আইনটিকেই বলবৎ রাখে। আজ যখন গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে যৌন আচরণও গণ্য হচ্ছে, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষরা আবার আশার আলো দেখছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে তারা এক অদ্ভুত সংশয় এবং সংকটের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন। আইন তাদের কবার স্বাভাবিক বলবে আর কবার অস্বাভাবিক অপরাধী বলে চিহ্নিত করবে এই দোলাচল থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা কে দেবে তাদের? জনসংখ্যার ছোট অংশ হওয়ায় এদেরকে নির্ভর করতে হবে বৃহত্তর জনসমাজের ওপরে, ভোটসর্বস্ব দলগুলি এদের কথা বলার প্রয়োজন বোধ করবে না আর চেষ্টা চালাবে বৃহত্তর সমাজের অধিকার সচেতনতাকে ক্ষুদ্র দাবি আদায়ের লড়াইয়ে পরিণত করতে। নানা সংঘাতের মধ্য থেকে যদি নাগরিক সমাজের দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ চেহারাটা একটুও বিকাশ লাভ না করে তবে অচিরেই এক দুরারোগ্য সংকট তৈরি হবে।
নানা রাস্তা ঘুরে, নানা প্রস্তাবনা ও বিশ্লেষণের গলি ও বাঁকে গোত্তা খেতে খেতে এই লেখাটা কোনও নির্মাণ সৌন্দর্য অর্জন করতে পারে না। এর যাত্রাপথের তলায় তলায় অন্ধকারে জানা অজানা চেনা আধোচেনা অথবা একেবারে অদেখা পরিসংখ্যানেরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের মধ্যে অনেককেই হয়তো সমীক্ষার জালে ফেলে তুলে আনা যায়নি। তাদের প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্নের কোনও উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য এ লেখার নেই। শিক্ষার দাবি, শিক্ষার অধিকার অর্জনের লড়াই, সচেতনতার জন্য লড়াই জারি থাক। নয়তো ইসরাত জাহানের প্রতিবেশীরা, আত্মীয়েরা তার লড়াইয়ের মর্যাদা দেবে না… তাকে একঘরে করে দেবে…তার বাচ্চারা বছরের পর বছর স্কুলে যাবে না… তাকে ভয় দেখানো হবে… হুমকি দেওয়া হবে… এবং লড়াই জিতেও সে আইনি সাহায্য পাবে না… থানা তার অভিযোগ নেবে না… সে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দেবে… নারী মুখ্যমন্ত্রী তার এই জয়ে অভিনন্দন জানাবেন না… আশ্চর্য নীরবতায় চুপ করে থাকবে গোটা শাসনতন্ত্র… এরকম আরও কত কিছু তার সাথে চলতে থাকবে… চলতেই থাকবে…
লেখাটা খুব সুন্দর, আসল কথা হল আইন করে সমাজ সংস্কার করা সম্ভব নয়, সমাজ থেকে মনন থেকে উঠে আসতে হবে। আমি যতখানি ধর্মঘন্থ পড়েছি ইসলাম এবং উপনিষদ তাতে ওপরের অনেক কিছুই নেই। এ সবই হিন্দু এবং মুসলিম মৌলবাদীর চাপানো, যেটা কেবল শিক্ষা আর মানসিক উন্নতি দারাই সম্ভব।
Khub suchintito ebong tathyo nirvor lekha.samaj sanskar a aean (law) er proyojon nei eta byaktigoto vabe amar mone hoy na kintu pashapasi etao mone hoy je sei aean (law) er grahan jogyota ba swarthakata manush er jibone adou thakbe kina seta ek matro nirdharito hote pare sikha r madhyome -r sei sikha amader vote bank er dike takiye thaka rajnitik ra je kono din e pete debe na swadhinatar 70 bachor pore o uporer porisankhan guloi tar praman.