সম্প্রীতি
গবেষক, রাজনৈতিক কর্মী
গত ৫০ দিন ধরে দেশ দেখল দিল্লির হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মাঝে কাতারে কাতারে কৃষকের প্রতিস্পর্ধার আগুন। গত বর্ষাকালীন সংসদে একপেশে চাপিয়ে দেওয়া তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় অবস্থান চালাচ্ছেন দেশের কৃষকরা। দেশের অন্নদাতাদের সমাবেশ একদিকে দিল্লির মসনদে বসে থাকা ফ্যাসিস্ট শাহ-মোদির সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। অন্যদিকে, আপামর ভারতবর্ষকে ফ্যাসিবাদ ও কর্পোরেট রাজের বিরুদ্ধে সমতার স্বপ্নে ভরা এক নয়া ভারত গড়তে নেতৃত্বও দিচ্ছে। আর এই নেতৃত্বের পুরোভাগে আছেন মহিলা কৃষকরা।
মহিলারা নিজেদের গ্রামে গ্রামে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেছেন, পায় হেঁটে, ট্র্যাক্টর চালিয়ে, শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে প্রাসাদের দোরগোড়ায় পৌঁছেছেন, সারা ভারত কিসান মহাসভার মঞ্চ পরিচালনা থেকে রান্না করে প্রতিবাদরত সাথীদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ায় গুরুদায়িত্ব— সবই পালন করছেন অনায়াসে। এনআরসি, সিএএ থেকেই আজকের ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মহিলারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অথচ, দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীনরা প্রতিবাদরত নারীর কৃষক সত্তাকে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ। সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস শারদ আরভিন্দ বোবদে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রশ্ন রেখেছেন, কৃষকদের আন্দোলনে নারীদের ‘রাখা’ হয়েছে কেন! নারীর স্বাধীন ও স্বকীয় অস্তিত্বের উপর চরম আঘাত প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্য। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তিনি নারীকে আদর্শ পরিস্থিতেতে কল্পনা করেন পুরুষের হাতের পুতুল রূপে।
ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের নারী বিরোধী রাজনীতির আরও একটি প্রত্যক্ষ প্রয়োগ এই তিনটি কৃষি আইন। যেখানে মহিলা কৃষকদের ন্যায্য মজুরি, স্বীকৃতি বা কর্মক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার কোনও উল্লেখ নেই। বদলে কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ দৃঢ় করে, আম্বানির পকেট ভরতে ব্যাস্ত শাহ-মোদির সরকার।
বিজেপি চায় এমন ভারত গড়তে যেখানে নারীর অভিব্যক্তির লাগাম থাকবে ক্ষমতাশালী পুরুষের হাতে। নারীর নিজের লিঙ্গ বা সাথী বেছে নেওয়ার অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সাথে নারীর প্রতিবাদ করার, সংগঠিত হওয়ার অধিকারকেও নাকচ করতে চাইছে মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক বিজেপি আর বিজেপির দালালরা।
তাই, আজ, ১৮ই জানুয়ারি, কৃষি আইন বিরোধী গণ-আন্দোলনের মঞ্চ থেকে ডাক দেওয়া হয়েছিল সারা দেশ জুড়ে মহিলা কিসান দিবস পালন করার। শ্রমজীবী মহিলা সমিতি, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, ভারতীয় মহিলাদের জাতীয় ফেডারেশন, প্রগতিশীল মহিলা সংগঠন ছাড়াও অন্যান্য লড়াইরত নারী সংগঠনের ডাকে রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় কিসান-শ্রমিক বিধানসভা অনুষ্ঠিত করে পাস করা হল মহিলা কৃষকদের রেজোলিউশন। নয়টি রেজোলিউশন/প্রস্তাবনা জুড়ে ভারতের মনুবাদী, পিতৃতান্ত্রিক শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে আত্মঘোষণায় জ্বলে উঠলেন ভারতের মহিলা কিসানরা। বললেন, “প্রধান বিচারপতির এই কথা নারীদের প্রান্তিক ও অদৃশ্য করে রাখার এই সচেতন প্রয়াস।” প্রস্তাবনার শুরুতেই দেশের প্রধান বিচারপতির ঘোষণাকে ধিক্কার জানিয়ে শুরু হয় নারীদের কিসান-মজদুর বিধানসভা।
এই বিধানসভার প্রতিনিধিরা পরতে পরতে মনে করিয়ে দিলেন, কৃষিক্ষেত্র থেকে গৃহকোণে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নারীর শ্রমের মূল্যায়নের বদল প্রয়োজন।
মনে করিয়ে দিলেন, কৃষক পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে একজন মহিলা কৃষকের ৮-১৬ ঘন্টার আবশ্যিক শ্রম নিয়োগের হিসাব। বিনামূল্যে ‘বাড়ির কাজে’ করা থেকে অন্যের জমিতে ক্ষেত-মজুরি করতে গিয়ে মহিলা হওয়ার অপরাধে কম পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা— বিবিধভাবে নারীর পরিশ্রমের মাত্রা বেশি হলেও, তাদের পারিশ্রমিকের মূল্য ততধিক কিঞ্চিৎ।
তাঁরা দাবি করলেন “কৃষিকাজে রত নারী কৃষকের স্বীকৃতি চাই। পারিবারিক শ্রমের স্বীকৃতি চাই। লিঙ্গ নির্বিশেষে, সমকাজে সমমজুরি চাই।”
তিনটি কৃষি আইন দেশের খাদ্য ব্যবস্থায় ও আপামর জনগণের খাদ্য-সুরক্ষার ওপর কিরকম বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সতর্ক করে, এই তিনটি আইন অবিলম্বে বাতিল করে সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সার্বজনীন রেশন বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি করে মহিলা কিসান-মজদুর বিধানসভা।
কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদনে মহিলারা সর্বতোভাবে যুক্ত থাকলেও, উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ থেকে বঞ্চিত থাকেন কৃষক নারী। মাত্র ১৩ শতাংশ জমির মালিকানা নারীর হাতে। এমতাবস্থায়, কর্পোরেট পুঁজিপতির হাতে জমি বিক্রি হয়ে গেলে, নারীর শোষণ ও হেনস্থা অপরিসীম হবে বলে মনে করছেন মহিলা কৃষক-শ্রমিকরা।
মহিলাদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, তিনটি কৃষি আইন বাতিল করার পাশাপাশি, কর্মরত জমির পাট্টায় সমান হকের দাবি পাশ হয়েছে প্রস্তাবনা হিসাবে।
মাইক্রো-ফিন্যান্স কোম্পানির কাছে ধার করে জমির লিজ নিয়ে চাষ করেন অনেক মহিলা কৃষক। কিন্তু লকডাউন ও বিশেষত আমফান ঝড়ের প্রভাবে জমির প্রভূত ক্ষতি সয়ে আজ মাইক্রো-ফিন্যান্স কোম্পানিগুলির চাপানো ঋণের বোঝায় জর্জরিত ভারতের গ্রামের নারী। গত কয়েক মাস ধরে ঋণ-মুক্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়েছেন এই নারীরা। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামে, মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ভাঁওতাবাজির আড়ালে কর্পোরেট পুঁজির পকেট ভরা চলছে। তাই দেশের সরকার এই গরীব মহিলাদের ঋণমুক্তির আবেদনে কান পাততেও রাজি নয়।
আজকের মহিলা কিসান দিবস থেকে ডাক উঠেছে সমস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক মহিলাদের নেওয়া লোন মকুব করতে হবে। কাটমানি, কমিশন নিয়ে লোন নিশ্চিত করা চলবে না।
কলকাতার ধর্মতলার ওয়াই-চ্যানেলে “অন্নদাতাদের সাথে বাংলা” লাগাতার ধর্নামঞ্চে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের খেটে খাওয়া মহিলা কৃষক-শ্রমিকরা আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন দেশের সরকারকে কেন কৃষি আইনের বিরোধিতা করছেন তারা। কারণ, ভারতের অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ কৃষিকাজে যুক্ত। অথচ, কৃষক হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি, ন্যায্য মজুরি ও সম্মানীয় জীবন থেকে বঞ্চিত ভারতের লাখো নারী।
মহিলা কিসান দিবস উপলক্ষে, অখিল ভারতীয় কিসান সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি ও রাজ্যের বিভিন্ন নারী/নারীবাদী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে নারী কৃষিজীবীদের এই বিশাল জামায়াতের হয়। উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৪০টি কৃষক, মজুর ও নারী/নারীবাদী সংগঠনের নেতৃত্ব। সভা শেষে প্রায় ৫০০ মহিলা কৃষক ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ মশাল মিছিল করে যান। কৃষি-আইন, শ্রম-আইন বিরোধী স্লোগানে মেতে ওঠে কলকাতার রাজপথ।
নারী্র অভিব্যাক্তিকে দমিয়ে রাখার, অদৃশ্য করে রাখার সকল প্রচেষ্টাকে নাকচ করে এই মিছিল বলল:
কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লড়বে কে?
এই লড়াই লড়বে কে?
তুমি আমি আবার কে?