তানিয়া লস্কর
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, আইনজীবী
পাঞ্জাব মানে হলদে সবুজ মাঠ। পাঞ্জাব মানে “শর্ষ দা শাক উত্তে মক্ষে দি রোটি”। একটি পুরোদস্তুর কৃষিপ্রধান সমাজ। তাদের লোকগানে, লোককথায়, লোকউৎসবে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ধান-আখ-ভুট্টার সুবাস। পাঞ্জাবিদের জন্য শস্যক্ষেত তাঁদের আত্মসম্মানবোধের অংশ। সুতরাং এগুলোর দিকে হাত বাড়ালে পাঞ্জাবের নারীরা কৃপাণ হাতে ছুটে আসতেই পারেন। তাই এসেছেন। ৬০/৭০ বছরের মহিলারা মাইলের পর মাইল ট্রাক্টার চালিয়ে ছুটে এসেছেন টিকরি, সিংঘু, গাজিপুর, শাহজাহানপুর বর্ডারে। তাই তো টনক নড়েছে রাষ্ট্রের। মহামান্য আদালতও প্রশ্ন করেছেন এত নারী এবং শিশুরা প্রতিবাদস্থলে কী করছে?
নারীরা প্রতিবাদস্থলে কী করছে?
জল-জঙ্গল-জমির লড়াই অবশ্যই নারীদের লড়াই। কারণ এগুলো ছিনিয়ে নিলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরাই। প্রথমত গরীব ভূমিহীন হিসেবে পুঁজিবাদী শোষণের শিকার হতে হয়। দ্বিতীয়ত নারী হিসেবে তাকে নানারকমভাবে পণ্যায়ণের মুখোমুখি হতে হয়। সুতরাং ভূমিহীন পরিবারের নারীরা দ্বিমুখী শোষণের শিকার হন।
তাছাড়া পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নারীদের সুরক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি পরিবার যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হয়, তাহলে প্রথমেই সেই পরিবারের মেয়েদের আত্মসম্মানের প্রতি হুমকি আসে। নারী নিজে যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হয় তাহলেও তাকে পরিবার-সমাজ এবং রাষ্ট্র— এই তিনের দ্বারাও নানারকম অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং প্রতিবাদস্থলে নারীকে আসতেই হয়। প্রথমত তার পুরুষ সাথীদের মতো সহনাগরিক হিসেবে। দ্বিতীয়ত নারীর নিজের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের অংশ হিসেবেও বটে। সেটা পাঞ্জাবের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের নারী-কৃষকরা বুঝেছেন। সুতরাং ধর্মাবাতার যাই বলুন। নারীরা প্রতিবাদস্থলে আসবেই।
ছবির আড়ালের গল্প
ষাটোর্ধ্ব মঞ্জিত কৌর নিজে ট্রাক্টার চালিয়ে চলে আসেন টিকরি বর্ডারে। তার ছবি নেটিজানদের টাইমলাইনে টাইমলানে ঘুরছে। প্রিন্ট ব্রোডকাস্ট ওয়েব সবরকমের মিডিয়াই নারীকৃষকদের উপস্থিতি নিয়ে ভীষণ উৎসাহিত। অথচ ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় সাংবাদিক সম্মেলনে কিন্তু বসছেন পুরুষরাই৷ মিটিং ডেলিগেশনেও চিত্র একই। তাহলে কি নির্ণয় নেওয়ার ক্ষমতা এখনও পুরুষদেরই থেকে যাচ্ছে? আর মালিকানা? সেখানে নানা জট পাকানো আছে। ২০১৮ সনে ‘সেন্টার ফর লেন্ড গভর্নেন্স’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণার মতে মাত্র ১২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারীকৃষকদের শুধু জমির মালিকানা রয়েছে। এর মধ্যে পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ এই হার সবচেয়ে কম। অথচ প্রায় ৫৫-৬৬ শতাংশ ক্ষেতমজুরই নারী। এছাড়াও পাঞ্জাবে মাত্র ৩.৫ শতাংশ ভূমির অধিকার দলিত কৃষকদের রয়েছে। জমিন প্রাপ্তি সংঘর্ষ সমিতির নামে নারী কৃষকদের একটি সংগঠন প্রায় একদশক ধরে জমির অকশনে জাঠদের প্রতাপের বিরুদ্ধে লড়ছেন। এই অবস্থায় বিশেষ আশার গল্প শোনানো যাচ্ছে না।
কাকদ্বীপে মরে যারা তেলেঙ্গানায় বাঁচে
তবুও নারীরা লড়ছেন। কাকদ্বীপ থেকে তেলেঙ্গানা, নারীরাই কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। জসবীর কৌর টিকরি বর্ডারের একা হাতে সম্পূর্ণ আন্দোলনের হিসেব সামলাচ্ছেন। কোন সংগঠন কবে কত টাকা চাঁদা দিয়েছে সব তার মুখস্থ। সামাজিক কর্মকর্তা জুহেব আজাদ নিজের ফেসবুকে জানাচ্ছেন আন্দোলনরত এক বৃদ্ধা নারী কৃষক তাকে বলেছেন “আমরা যদি আজকে লড়াইয়ে না নামি আমাদের নাতিপুতিরা একদিন কৃষিকাজ ভুলে যাবে।” কোটেশনসহ মহিলার ফটো শেয়ার করেছেন তিনি। তাদের কাছে এই আন্দোলন একটি আইন বাতিলের আন্দোলন থেকে অনেক অনেক বেশি। কৃষিকাজ তাদের আত্মপরিচয়ের অংশ। কিন্তু আন্দোলন শেষে নারীর প্রাপ্তির ঘরে সেই শূন্য। তাই হয়ত ধর্মাবাতারসহ আমাদের সকলের যৌথ স্মৃতি থেকে তাঁরা মুছে যান। আমরা আবার শুরুর বিন্দুতে ফিরে যাই। আন্দোলনে নারীদের নির্ণায়ক ভূমিকার দাবী না তুলে শুধু তাদের যোগদানকেই বড় করে দেখি। তবুও আশায় বাঁচুক চাষা এবং চাষানি উভয়ই। আশা করছি এই আন্দোলন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে পাঞ্জাবের নারীরা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই তথা সামগ্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোকেও আরও জোরদারভাবে লড়বেন। এবং সহযোদ্ধা পুরুষরা বুঝবেন নারীর ক্ষমতায়ন একটি সমাজের সামগ্রিক লড়াইয়ের কতটা জরুরি।