হোমেন বরগোহাঞি
তর্জমা: বাসুদেব দাস
(মূল অসমিয়া থেকে)
১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’, ’অসম বাণী’ ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্যগন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটগল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
রাত বোধহয় একটার মতো বেজেছিল। রঞ্জিতের মদের নেশা ধীরে ধীরে কেটে আসছিল। হঠাৎ তার খুব ঠান্ডা লাগতে লাগল। সামনেই পড়ে থাকা গরম কোটটা ভালো করে পরে নিল, সিগারেটের খোঁজে পকেটের ভেতর হাত ঢোকাল। ডায়েরির মতো একটা ছোট বই তার হাত স্পর্শ করল। বইটা অন্ধকারের মধ্যেই পকেট থেকে বের করে এনে একবার মেলে ধরে দেখল। একা একাই তার হেসে উঠতে ইচ্ছা হল। এটা তার কবিতার বই। সে কি কবিতার বই লিখেছিল? জীবনের কয়েকটি আশ্চর্য মুহূর্তে জীবন এবং প্রকৃতির রূপ তার মনে অনিবর্চনীয়ভাবে অনুভূত হয়েছিল। সেই রহস্য চেতনার আবেগে অভিভূত হয়ে কারও সঙ্গে সেই বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিল, আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু হৃদয়ের গভীরতম কথা নিজের বাইরে আর কার সঙ্গে তুমি বলতে পারো? সেই সময়ে ঈশ্বরও তোমায় সঙ্গ দেবে না। সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের কাছেও তোমার বক্তব্যকে তুমি নিজের শব্দের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারো। সেই কথাগুলি তুমি কেবল নিজেকেই শোনাতে পারো। জীবনের কয়েকটি মুহূর্ত প্রতিটি মানুষই কবি হয়। কবির মতো নিঃসঙ্গ আত্মা পৃ্থিবীতে আর কে আছে? রঞ্জিত তার কবিতার খাতাটা নদীর বুকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। জীবনের কয়েকটি নির্জনতম মুহূর্তে সে নিজের অস্তিত্বের ব্যথাদীর্ণ সৌ্ন্দর্যময় চেতনা নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিল। বাকি সব সময় সে পাপ করেছে, জীবনকে ঘৃণা করেছে। তার কোন জীবনটি আসলে সত্য? জীবন এবং প্রকৃ্তির নিগূঢ়তম সৌন্দর্যের বাণী অনেক সময় পাপীর হৃদয়ের মধ্য দিয়ে কীভাবে প্রকাশ পায়? পৃ্থিবী সেই মানুষদের ত্যাগ করে, কিন্তু তাদের গান মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকে। পাপাসক্ত, ব্যভিচারী গঁগা-আর তাহিতির গোপন স্বর্গে জীবনের রহস্যসন্ধানী গঁগা— কোন মানুষটি আসলে বেশি সত্য, বেশি বাস্তব? আসলে গঁগা নামের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাটিই অবাস্তব, অবান্তর। শিল্প-কলার স্রষ্টা কোনও বিশেষ মানুষ নয়,-স্রষ্টা হল জীবন। যে জীবন সৎ বা অসৎ কোনওটাই নয়— তা হল Non–moral। সেইজন্য কলা-কৃষ্টি থেকে উদ্ভূত জীবন-উপলব্ধিও Non–moral। নদীর স্রোতে ধীরে ধীরে ভেসে যাওয়া কবিতার খাতাটির দিকে রঞ্জিত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সেই কবিতাগুলি অন্য কেউ পড়তে পেলে সমাজে তার কবি বলে খ্যাতি হত। তাতেই বা তার কী লাভ হত? আসলে All expressions is vulgar— কোথাও পড়া কথাটার সে অর্থ বুঝতে না পেরে মনে মনে একবার আউড়ে নিল।
সিগারেটের জন্য রঞ্জিত এবার অন্য পকেটে হাত ঢোকাল। কিছু একটা আশ্চর্য জিনিসে তার হাত লাগল। জিনিসটা বের করে এনে সে দেখে, একটা আধখাওয়া রুটি। রুটির টুকরোটা দেখে তার সমস্ত কথা ধীরে ধীরে মনে পড়ে গেল। মনে মনে তার হাসি পেল। পরকালের পথের উপাদান সে পকেটে করে নিয়ে এসেছে। এক টুকরো রুটি মুখের ভেতর ঢুকিয়ে সে চিবোতে লাগল। তখনই সে বুঝতে পারল যে তার খুব খিদে পেয়েছে। রুটির টুকরোটা চিবোতে চিবোতে সে মনে অন্য এক ধরনের আবেগ অনুভব করল। একটা তীব্র মদির জীবনরস যেন তার শিরায় শিরায় সঞ্চা্রিত হয়ে চলেছে। অস্তিত্বের চেতনা যে নতুনত্বের রূপে প্রতিভাত করে। এক টুকরো আধখাওয়া সিগারেট খুঁজে পেতে সে এবার জ্বালিয়ে নেয়। গলাটা শুকিয়ে যাওয়া সে অনুভব করছিল। একটু মদ পেলে ভালো লাগত— সে মনে মনে ভাবল। পাহাড়ের উঁচু একটা টিলায় সে বসেছিল। পাহাড়টার ঠিক পাশ দিয়েই নদীটা বয়ে চলেছে। একটামাত্র লাফ যথেষ্ট, একটা মাত্র লাফ— জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে, চেতনা থেকে অনন্ত অন্ধকারের দিকে। অস্তিত্বের অর্থহীন জ্যোতির্ময় তলা থেকে অনন্ত অন্ধকারের দিকে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার। সামনের নদীটিও গভীরতর জলীয় অন্ধকারের বিশাল একটা প্রবাহ যেন তার মনে অনুভূত হয়েছিল। হেমন্তের গভীর রাতের ধূসর কুয়াশার আবরণে আকাশটা বিষন্ন ভাবে ম্লান করে রেখেছিল। সে যেন একটা পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ছিল এবং পাহাড়গুলি সারি সারি ভাবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়েছিল। সে যদি আজ মরে যায়, নদীর বুকে সে একফোঁটা জল হয়ে যাবে, পাহাড়ের গায়ে এক টুকরো মাটি হয়ে লেগে থাকবে অথবা আকাশে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাবে। তাই এই আকাশ, নদী পাহাড়-অস্তিত্বের বিরামহীন প্রবাহ। মাঝখান মাত্র চৈতন্যের ক্ষণিক জাগরণ— কী অদ্ভুত এবং রহস্যময়। প্রত্যেক মানুষের মনের গভীরতম বাসনা হল এই চৈতন্যহীন অস্তিত্বের সঙ্গে এক হয়ে মিশে যাওয়াটা। This living kills me— কোথাও পড়া কথাটার অর্থ না বুঝেই সে মনে মনে আওড়াল।
আসলে রঞ্জিতের মদের নেশা তখনও ভালো করে কাটেনি। মদের নেশা বেশি হলেই সে বাড়িতে না গিয়ে বাইরে ব্রহ্মপুত্রের তীরের এই নির্জন পাহাড়ে চলে আসে এবং প্রাচীন চৈনিক কবিতার ‘বেণু-বনের সপ্তর্ষির’ মতো পাহাড়টাকে মাথার বালিশ করে নিয়ে আকাশের কম্বলটা গায়ে মুড়ে নিয়ে শুয়ে শুয়ে অনন্ত জীবনের স্বপ্ন দেখে।
যে কাজটা সে প্রতিদিন করব করব বলে ভেবে আজ পর্যন্ত করতে পারেনি, তা আজ সে করে ফেলবে নাকি? বসা থেকে সে উঠে দাঁড়াল। রাত বোধহয় অনেক হয়েছে। আকাশটা ধীরে ধীরে আগের চেয়েও বেশি আলোকিত হয়ে উঠেছে। চারপাশে মৃত্যুর মতো গভীর অতল নীরবতা। উদাস দৃষ্টিতে সে চারপাশে একবার তাকাল। হঠাৎ একটা আশ্চর্য মূর্তি তার চোখ পড়ল। পাহাড়ের পাদদেশের রাস্তা দিয়ে কোনও একজন মানুষ ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে। রঞ্জিতের জীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম। লোকালয় থেকে দূরের এই নির্জন পাহাড়ে কত দিন গভীর রাতে একা একাই এসে সে শুয়েছে— তার বাইরে দ্বিতীয় কোনও মানুষ যে এভাবে এখানে আসতে পারে সে কথা কোনওদিন তার মনে হয়নি। তার মতো পাগল তাহলে সংসারে আরও আছে। একটা পাথরের আড়াল নিয়ে সে মানুষটার গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। ক্লান্ত পদক্ষেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মানুষটা একেবারে উপরে রঞ্জিতের কাছে এসে দাঁড়াল। সে তখন ভালোভাবে লক্ষ করে দেখল যে আশ্চর্য মূর্তিটি আসলে একজন মহিলার। এই গভীর রাতে মহিলাটি কেন এখানে এসেছে? এই পথ যে সহজ জীবনের অস্বীকৃতির পথ। কালো ওড়নাটা মাথা থেকে একবার সরিয়ে মহিলাটি চারপাশটা একবার দেখে নিল। রঞ্জিত এবার তার মুখটা ক্ষণিকের জন্য দেখতে পেল। ছাব্বিশ সাতাশ বছরের একটি যুবতী মেয়ে। অন্ধকারে মুখের গড়নটা ভালোভাবে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই ধূসর অস্পষ্টতার মধ্য দিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল আশ্চর্য একটি মুখ— যার তুলনা কেবল আকাশ, যে আকাশ ক্ষণে ক্ষণে, দিনে দিনে, ঋতুতে ঋতুতে রং পরিবর্তন করে। যা সবসময় স্পর্শের অতীত, অথচ যার সঙ্গে দৃষ্টির পরিচয় অনন্তকালের। রঞ্জিত সেভাবে তাকিয়ে থাকতেই মেয়েটি তার মুখ তার বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিল। এবার রঞ্জিত উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি নদীর দিকে মুখ করে টিলার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। রঞ্জিত নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেলল। সে যদি পেছন থেকে মেয়েটিকে ডাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হয় তো আসল ঘটনাটা ঘটে যাবে। একটিমাত্র লাফ— যেখান থেকে আর ফিরে আসার কোনও উপায় নেই। অত্যন্ত সন্তর্পনে সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ একবার পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে নদীর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে টেনে নিয়ে এল।
রঞ্জিত প্রথমে ভয় করেছিল যে, মেয়েটি হয়তো চমকে উঠে চিৎকার করবে। কিন্তু সে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে রইল। সে তাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটির মুখে একটি অবর্ণনীয় বিস্ময় এবং কৃত্রিম নির্লিপ্তির ভাব ফুটে উঠতে সে দেখতে পেল। সে কিছু সময় আশা করে রইল যে এবার মেয়েটি হয়তো তাকে কিছু একটা প্রশ্ন করবে। কিন্তু মেয়েটির মুখে সামান্যতম কৌতূহলের আভাসও ফুটে উঠল না।
অবশেষে সে-ই প্রথম কথা বলল; তুমি কী করতে চাইছিলে? মেয়েটি অনুত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দিল: ‘আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম।’ দুজন পরস্পরের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল। এবার মেয়েটি প্রশ্ন করল: ‘এত রাতে তুমি এখানে কী করতে এসেছিলে?’ রঞ্জিত হেসে বলল ‘আত্মহত্যা করার জন্য।’ ‘অনন্ত সময় এখন আমাদের হাতের মুঠিতে’— কিছু একটা ভেবে রঞ্জিত হঠাৎ বলল। মানুষ ইচ্ছার দাস কিন্তু আমাদের দুজনের জন্য ইচ্ছাই আমাদের দাস। একটু বসো বন্ধু। কথাবার্তা বলে দুজনে দুজনের সঙ্গে পরিচিত হই।
রঞ্জিতের কথা বলার নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা মধুর শব্দ করে মেয়েটি হেসে উঠল। তারপরে দুজনে প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে কাছাকাছি বসে পড়ল।
আমার মনে হচ্ছে, আমি কথা না বললে তুমি নিজে কথা বলবে না— কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে রঞ্জিত বলল— তুমি একটি অদ্ভুত মেয়ে। কিছুক্ষণ আগে আমি একটা কথা ভাবছিলাম। অবশ্য ধার করা কথা— লিভিং কিলস মি। আসলে তোমার ক্ষেত্রেই সেই কথাটা বেশি সত্য। তুমি কিছুতেই বিস্মিত হও না কেন, চমকিত হও না কেন, কৌতূহলী হও না কেন? এমনকি মৃত্যুও তোমার কাছে অর্থহীন, রহস্যহীন। তুমি জীবিত মানুষের চোখে মৃত্যুকে না দেখে মৃতের চোখে জীবনকে দেখেছ।
মেয়েটি নিশ্চল হয়ে বসে তার কথাগুলি চুপ করে শুনে গেল।
আমার কথা প্রথমে শোনো— রঞ্জিত বলে গেল। আমি আত্মহত্যা করার জন্য আজই প্রথম এখানে আসিনি। এর আগে অনেকবার এসেছি। আসলে গত একটা বছরে প্রায় প্রতিদিনই সেই একই উদ্দেশ্যে আমি এখানে এসেছি। কিন্তু কী আশ্চর্য কথা দেখো, আমি আজও বেঁচে আছি। বোধহয় তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্য। রঞ্জিত একা একা কিছুটা সময় হেসে নিল। আমি কেন মরতে আসি জানো? তুমি কীভাবে জানবে। আমি নিজেই জানি না। ভলতেয়ারকেও নাকি আত্মহত্যার চিন্তা সব সময় ভূতের মত তাড়িয়ে বেড়াত। তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি বিন্দুমাত্র বিশ্রাম না নিয়ে সব সময়ই কিছু না কিছু একটা কাজে লেগে থাকতেন। জীবনে কোনও একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেয়ে তিনি অবশেষে সমস্ত মানুষকে ফুলের বাগান করে তাতে লেগে থাকার জন্য উপদেশ দিয়ে গেছেন, যাতে মনে কোনও প্রশ্ন উঁকি দিতে না পারে। ফুলের বাগান করার মাপে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য এক টুকরো মাটির ব্যবস্থা করে যেতে পারলে তার উপদেশ কাজে লাগত। আমার মাটির সমস্যা ছিল না। আসল কথা কি জানো? বাগান আমার পছন্দ নয়। আমি অরণ্য ভালোবাসি। সেইজন্য আমার ভাগের জমিতে আমি অরণ্য জন্মাতে দিলাম। তাই আমার কাছে এখন কোনও কাজ নেই। কথাগুলি তুমি একেবারে আক্ষরিক অর্থে নিও না কিন্তু। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে না কি? মরতে আসা মেয়ের আবার ঘুম কিসের? আমার নিজের ক্ষেত্রে অবশ্য সবসময় সেটাই হয়েছিল। আমি দিনটা ভালো মানুষের মতোই থাকি। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা জায়গায় গিয়ে খুব করে মদ খাই। আমি খুব খারাপ মানুষ বুঝেছ? মদ খেয়ে নেশা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার নানা খারাপ কাজ করতে ইচ্ছা করে। সবচেয়ে খারাপ কাজটা হল— কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। কিছু মানুষ মদ খেয়ে কেন কবিতা লেখে জানো? সেই সময়ে হৃদয় বুদ্ধির শাসনরহিত নীতি-বিচারের ঊর্ধ্বে স্থিত বিশুদ্ধ জীবনচেতনার আবেগের মধ্যে বাস করে। Meaninglessness of beauty অথবা beauty of meaninglessness এই দুটো চেতনা মনের মধ্যে তখন সত্য রূপে প্রতিভাত হয়। কবিতা লেখা ছাড়া আমার আরও খারাপ কাজ করতে ইচ্ছা করে। আমার পাপ করতে ইচ্ছা করে। মদের নেশায় আমার যা মন চায় সব করে ফেলি। ধীরে ধীরে একটি মুহূর্ত আসে, যখন আমার গভীর অবসাদ দেখা দেয়। দেহের অবসাদ, আত্মার অবসাদ। তখন আমার খুব ঘুমোতে ইচ্ছা করে। মৃত্যুই তো একমাত্র নিদ্রা, কারণ সে নিত্য, চিরন্তন। মরার জন্য আমি তখন এখানে চলে আসি। কিন্তু এই পাথরে বসে বসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবার পরে আমার মদের নেশা কেটে যায়, বেঁচে থাকার জন্য পুনরায় লোভ হয়। কী কুৎসিত, অশ্লীল এই লোভ!
মেয়েটি মাথা নিচু করে একান্তমনে রঞ্জিতের প্রলাপসদৃশ সেই কথাগুলি শুনছিল। তাকে নীরব হতে দেখে মেয়েটি মাথা তুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। অপরাধী শিশুর মতো ভীত, ক্লান্ত অথচ সরল একটি মুখ। প্রথমে ক্ষণিকের দেখায় তাকে আধবয়সী একটি মানুষ বলে ধারণা হয়েছিল। কিন্তু আসলে সে পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সের একটি যুবক। কী দুঃখে সে মরতে এসেছিল? সে নিজেই জানে না। মেয়েটি কীভাবে জানবে? তবু একটি কথা মেয়েটির ভাবতে ইচ্ছে হল। কোনও মানুষই কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য একটা অন্তহীন প্রেরণা চাই, হৃদয়ের আশ্রয় চাই। যৌবনের প্রারম্ভ পর্যন্ত সেই আশ্রয় পেয়েছিল মা-বাবার মনের মধ্যে, নিজের পরিবারের আত্মীয়তার আবেষ্টনীর মধ্যে। একদিন সেই আশ্রয় সে পাবে একটি মহিলার, তার প্রিয়ার নিবিড় সাহচর্যের মধ্যে, নিজ সন্তানের জন্য বেঁচে থাকার মহৎ প্রেরণার মধ্যে। কিন্তু তার মাঝখানের এই সময়টুকু— মা-বাবার বুক থেকে, ঘরের বন্ধন থেকে সে বেরিয়ে এল জগতের রক্তাক্ত রাজপথে। তার নিজের কোনও ঘর নেই— যৌবনের গভীর নৈঃসঙ্গের এই আশ্চর্য সময়টুকু— মৃত্যুর আহ্বানে এখন যদি সে সায় না দেয়, তাহলে কবে দেবে? মনে মনে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা হল তার যেন খুব তাড়াতাড়ি একটি ঘর হয়। হে ঈশ্বর! পত্নীর প্রেম এবং সন্তানের মমতার মধ্যে সে যেন বেঁচে থাকার নতুন প্রেরণা খুঁজে পায়।
রঞ্জিত বোধহয় কিছুক্ষণ নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়েছিল। হঠাৎ সে তার কাঁধে মেয়েটির হাতের স্পর্শ অনুভব করে। সমগ্র দেহে সে আশ্চর্য শিহরণ অনুভব করে। তা যেন কোনও নারীর হাতের স্পর্শ নয়, তা যেন নিসর্গের নির্ভয়বাণী, মর্ত্যের মৃত্তিকায় সৃষ্টির প্রথম সূর্যের আলোকের স্পর্শ, মৃত্যুর অন্ধকারে শাশ্বত জীবনের অঞ্জলি-বদ্ধ প্রার্থনা। শ্রেয়সীর চিরন্তন আশ্বাস। সে মনে মনে প্রার্থনা করল, সেই স্পর্শ যেন তার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকে।
পকেটে সিগারেটের খোঁজে সে আবার হাত ঢুকাল। সিগারেট ছিল না, কিন্তু একটা আধাখাওয়া বিড়ি ছিল। তা জ্বালিয়ে নিয়ে সে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল ‘মরতে এসেছিলে, কিন্তু মরা তো হল না। এখন বাড়ি ফিরে যাও। ভোর পর্যন্ত তো আর আমার সঙ্গে এভাবে বসে থাকতে পারবে না।’
আমি তো এখনও মরব না বলে সিদ্ধান্ত নিইনি, আমাকে মরতেই হবে। বরং তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাও আর আমাকে শান্তিতে মরতে দাও। মেয়েটি গভীর মমতার সঙ্গে রঞ্জিতের কাঁধে হাত বোলাতে লাগল। যেন সে বয়স্ক মানুষের মনের কথা বুঝতে না পারা নির্বোধ ছোট ছেলে।
রঞ্জিত এবার কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলে উঠল: ‘না মরলেই চলে না? তোমার কী এমন কথা আছে? আমাকে বলছ না কেন?’
রঞ্জিতের বিরক্তিতে মজা পাওয়ার মতো মেয়েটি একটি ছোট্ট হাসি হাসল। আমাকে কেন মরতে হবে, তুমি জানো? তুমি একটি পঁচিশ বছরের শিশু। তোমার সামনে আমার কোনও কথা বলতে লজ্জা হয় না। শোনো, আমি একজন মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হতে পারলে খুব সুখী হব বলে ভেবেছিলাম। বিয়ের আগেই সে আমার কাছ থেকে বিবাহিত মহিলার সমস্ত অধিকার আদায় করেছিল। ফলে আমি গর্ভবতী হলাম। কিন্তু এখন সে-ই আমাকে বিয়ে করতে অসম্মত হয়েছে। এমনকি সে আমার গর্ভের সন্তানের পিতৃত্বের দায়িত্বও অস্বীকার করেছে। আমি আর কীভাবে বেঁচে থাকতে পারি?
জীবনের নতুন একটি রহস্য চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার মতো স্তব্ধ বিষয়ে রঞ্জিত মেয়েটির দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি মেয়েটির মুখে আবদ্ধ হল না। তার চোখ গেল তার উন্নত স্তন দুটির দিকে, নিটোল জঙ্ঘার তরঙ্গের বলয়ের দিকে। প্রেমিকের নভোচারী সৌন্দর্য-কল্পনার দিগন্তে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কঠিন মাটির বিস্তার, যেখানে জীবনের নতুন শস্য জন্মায়— প্রকৃতির অন্ধ তাড়নায়।
–আমি এখনও বুঝতে পারলাম না তোমাকে কেন মরতে হবে? তুমি অন্য কোনও একজনকে ভালোবাসতে পারো। তাছাড়া তোমার পেটে একটি সন্তান রয়েছে। তাকে তুমি জন্ম থেকে কেন বঞ্চিত করবে?
তুমি একটি পাগল— মেয়েটি বলে উঠল। অবৈধ সন্তানের গর্ভধারিণী একজন অসতী মহিলাকে কে বিয়ে করবে? অথবা কেউ কোনও কারণে বিয়ে করতে চাইলেও আমি তাকে ভালো নাও বাসতে পারি। প্রেমহীন যুগল শয্যা আমার কাছে নরক। তার চেয়ে মৃত্যু বেশি বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া জীবনে আমি একজন মানুষকেই চেয়েছিলাম। তার থেকে প্রেমের পরিবর্তে পেলাম প্রবঞ্চনা। বেঁচে থাকার প্রতি আমার আর কোনও আকর্ষণ নেই।
তুমি এখনও সেই মানুষটিকে ভালোবাসো? রঞ্জিত প্রশ্ন করল।
আমার মনের গভীরে তাঁর প্রতি এখনও একটি আকর্ষণ আছে। কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে একটা তীব্র ঘৃণা। ঘৃণা— তার নৈতিক কাপুরুষতার প্রতি, তার শঠতার প্রতি।
–তোমার নাম কী?
হঠাৎ এই ধরনের আকস্মিক প্রশ্নে মেয়েটির প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হল। তারপরে সে সহজ ভাবে উত্তর দিল: মাধবী।
–তুমি কতটুকু পড়াশোনা করেছ?
–বিএ পর্যন্ত।
–ভালো কথা। তুমি শিক্ষিত মেয়ে। আমার কথা বুঝতে পারবে। দেখো মাধবী, জীবনের সমস্ত ঘটনাই chance event। আজ তুমি আত্মহত্যা করতে এসে by chance আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নাহলে তুমি এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতে। জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্তে ঘটনাক্রমে তোমার সঙ্গে সেই মানুষটির দেখা হয়েছিল। তুমি তাকে ভালোবেসেছিলে। তার সঙ্গে দেখা না হয়ে অন্য কোনও একজনের সঙ্গে দেখা হলেও তাকে ভালোবাসতে, তার প্রেমের মধ্য দিয়ে তোমার হৃদয়ের জাগরণ ঘটত। আসলে প্রেমের মধ্য দিয়ে তুমি যৌবনের একটি অতীন্দ্রিয় আবেগ উপলব্ধি করতে চাও। তোমার সেই হৃদয়ের জাগরণে বিশেষ একজন মানুষ নিমিত্ত মাত্র। হয়তো তোমার পুনরায় একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, যার মধ্য দিয়ে তোমার অনিবর্চনীয় উপলব্ধি দীপ্ততর হয়ে উঠবে। তুমি প্রতীক্ষা করো, প্রার্থনা করো। জীবন একটি অন্তহীন প্রার্থনা মাত্র।
সেসব যুক্তির কথা— মেয়েটি বলে উঠল। পরিকল্পনা করে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। আমাকে কেউ কোনওদিন ভালোবাসবে বা আমি তাকে ভালোবাসব এই আশা করে পেটে একটি অবৈধ সন্তান নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকতে পারি? আমাকে মরতেই হবে।
রঞ্জিত কিছুক্ষণ সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। অন্ধকারে পৃ্থিবীর কোনও দৃশ্যকেই ভালোভাবে আন্দাজ করা যায় না। কিন্তু গভীরতম অন্ধকারে তো একমাত্র সত্য হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে আকাশ। আর সেই তারাগুলি— Desire of the moth for the star— সেই তারাগুলি যে চিরকাল মানব হৃদয়কে অজানা দেশে আহ্বান করে আসছে। সেই দেশ মহাশূন্যের বুকে হয়তো কোথাও নেই কিন্তু জীবনের সমস্ত প্রার্থনা অপ্রাপনীয়ের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। এই মেয়েটি মৃত্যুর আহ্বানে এখানে দৌড়ে আসেনি, প্রেমের আহ্বানেও নয়। কারণ জীবনের অখণ্ড রূপের পটভূমিতে যৌবনের আবেগসঞ্জাত প্রেমের তাড়না কেবল ক্ষণভঙ্গুরই নয়, অনেক সময় তা বিভ্রান্তিকরও। মেয়েটি দৌড়ে এসেছে বেঁচে থাকার প্রকৃত প্রেরণা সন্ধানে। সেই প্রেরণার উৎস চিরকাল রহস্যাবৃত। তাই সেই সন্ধানের কোনও শেষ নেই। গভীর আধ্যাত্মিক আবেগ বা সৌন্দর্যবোধ এবং কলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যারা অনিবর্চনীয়ের সঙ্গে প্রাণের অতীন্দ্রিয় সংযোগ উপলব্ধি করতে পারে, প্রেমের ক্ষেত্রে বা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। যে হৃদয়ে সেই অতীন্দ্রিয় আবেগ অনুভবই করে না তার কাছে জীবন পশুর মতো সহজ। এই মেয়েটি সেই আবেগ অনুভব করেছিল— কিন্তু সে আত্মার সেই অপরূপ কাব্য রচনার একটি মাত্র ভাষা জানে: দেহের ভাষা।
রঞ্জিত মেয়েটির দিকে ঘুরে তাকাল। হেমন্তের শেষ রাতের বিষণ্ণ জ্যোৎস্নায় মায়া-মদির হয়ে ওঠা সামনের বিশাল নদীটির মতো তার মুখেও এক অপার্থিব জ্যোতি, আত্মার গভীর বিষাদ— সেই মুখ দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করার ইচ্ছা হয় না, যেভাবে গোধুলির দিগন্তে রঙিন মেঘ দেখে তাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা করে না। সে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। জীবনের একটি আশ্চর্য লগ্নে বিশেষ একজন সামান্য মেয়ের একটি মুখও অসামান্য আবেগ এনে দেয়। হৃদয় তখন কোনও প্রশ্ন করে না, কেবল সে গান গেয়ে উঠে— ‘তব কন্ঠে মোর নাম যেই শুনি, গান গেয়ে উঠি, আছি আমি আছি।’
তোমাকে মরতেই হবে? অনেকক্ষণ পরে সে মেয়েটিকে প্রশ্ন করল।
মাধবী নিরুত্তর হয়ে রইল।
ঠিক আছে। ওঠো, উঠে দাঁড়াও। সেই পাহাড়টার উপরে দাঁড়াও, তারপরে নদীর বুকে ঝাঁপ মেরে দাও। মরতে চাইলে জলে ঝাঁপ দিয়ে মরাই সবচেয়ে ভালো। দেহ অক্ষত হয়ে থাকে, চোখের সামনে অন্ধকারের চির যবনিকা নেমে আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত আলো শেষবারের মতো দেখে নেওয়া যায়। আমি একটা কবিতা পড়ছি শোনো, যেন তোমার কানে একটা কবিতা বাজতে থাকে— একটা কবিতা, জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ শব্দ, আর সেই শব্দের সুন্দরতম সৃষ্টি কবিতা:
I was all ear,
And took in strains that might create a soul
Under the ribs of death.
রঞ্জিত পুনরায় মাধবীর দিকে তাকাল। তার গভীর চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। এই চোখ দুটিই একদিন একজন মানুষের আগমনের জন্য আতুর হয়ে তাকিয়েছিল। সেই মানুষটার স্পর্শে এই চোখ দুটি একটি অন্ধ তৃপ্তির আবেশে বুজে গিয়েছিল। ঠিক এই মুহূর্তে এই চোখজোড়ার সামনে সেই মানুষটি নিশ্চয় নেই। এখন তার সামনে রয়েছে কেবল জীবন— তার অন্তহীন বিশালতায়, অপরিমেয় রহস্যে, তার সমস্ত ধ্বনি, রং এবং গানে, তার গভীর বিষাদ এবং বেদনায়। তথাপি মেয়েটিকে মরতেই হবে। মোহভঙ্গ এবং বেদনার মধ্যে তার হীন সত্তাটা মরে না যাওয়া পর্যন্ত জীবনের আসল দান সে হাত পেতে নিতে পারবে না।
মাধবী ওঠো, দেরি করছ কেন? সে আবার ডাকল। এবার মেয়েটি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। তুমি আমাকে মরতে দেবে? সে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল— তুমিও তো মরতে এসেছিলে? তুমি তাহলে এখন মরছ না কেন?
–আমি ইতিমধ্যেই মরেছি, মাধবী। আমি এখন একটি নতুন মানুষ। আমি লেজারাস, এইমাত্র কবর থেকে উঠে এ্সেছি— একটা পরম চেতনার আহ্বানে। এর আগেও আমি অনেকবার মরেছি, প্রত্যেকবারই নতুন করে জন্ম নিয়েছি। তুমি কিন্তু একবারও মরোনি। আজ তোমাকে মরতেই হবে।
–তুমি দেখোনি। আমিও ইতিমধ্যে মরে নতুন করে জীবন লাভ করেছি। ও, না আমাকে মরতেই হবে। নতুন করে জন্ম নেওয়ার আমার কোনও অধিকার নেই।
তুমি নতুন করে জন্ম নাও মাধবী। আমি যে পথে জীবনে ফিরে যাব সেই পথে একা যেতে চাই না। তোমাকে সঙ্গে নিতে চাই। রঞ্জিত প্রথমবারের জন্য মাধবীর হাতটা স্পর্শ করল।
মাধবী ধীরে ধীরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে উত্তর দিল: কিন্তু দেখো, আমার গর্ভে একটি অবৈধ সন্তান। আমি স্বেচ্ছায় একদিন অন্য পুরুষকে দেহ দান করেছিলাম। আমার মুখে অন্য একজন পুরুষের অজস্র চুম্বনের দাগ তবু তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে?
–মাটিতে গুটি পড়লেই গাছ হয়। তা প্রকৃতির অন্ধ তাড়না। সুখাদ্যের রুচি খাবার সময় যতই তৃপ্তিকর হোক না কেন, জিহ্বায় যেমন লেগে থাকে না, অন্য একজন পুরুষের স্পর্শে পাওয়া আনন্দ দেহে লেগে থাকেনি। আমার কোনও ঈর্ষা নেই। প্রেম আমার জন্য এরকম একটি অনুভূতি যে অনুভূতি জন্মায় কবির আত্মার গভীরতম বাণী শুনে, মহান মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে, প্রকৃতির অর্থহীন সৌন্দর্য দেখে। তুমি একটা কথা জানো না মাধবী। জীবনের অর্থহীনতা সম্পর্কে গভীর চেতনা না থাকলে অথবা মনে কাব্যানুভূতি না হলে কেউ প্রেমের আসল উপলব্ধি লাভ করতে পারে না। সেইজন্যই জীবনের চেয়ে সাহিত্যেই আমরা প্রেমের প্রকৃত চেতনা বেশি করে লাভ করি। অনিবর্চনীয়ের প্রতি আমাদের যে আকাঙ্ক্ষাই প্রকৃতির সামান্য বস্তুতেও অসামান্যত্ব আরোপ করে, সেই একই আকাঙ্ক্ষা নারীর মুখেও সেই জ্যোতি দেখে, which was never on land and sea. জীবনকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে না দেখে তার অংশরূপে দেখতে পারলে আমরা সৌন্দর্য এবং প্রেমের আসল চেতনা লাভ করতে পারি।
তুমি এত বক্তৃতা দিতে পারো— মাধবী বলে উঠল। আমি এত কথা শুনতে চাই না। আমাকে কেবল তুমি একটু ভালোবাসো, তোমার মধ্যে আমাকে বেঁচে থাকতে দাও।
তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে? রঞ্জিত মজা করে হেসে জিজ্ঞেস করল।
–তুমি ভালোবাসা চাও না। তুমি কী চাও আমি জানি না। আমার কেবল তোমার কাছে বসে থাকলে মনটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। হে ঈশ্বর! আমার যে কী হচ্ছে। আমার এখন মরে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও যে মরতে চেয়েছিলাম, সেই মৃত্যু থেকে এই মৃত্যু কত আলাদা!