প্রকৃতি ভাদুড়ি
প্রাবন্ধিক, মিডিয়া-বিশেষজ্ঞ
গুজরাটের কচ্ছ জেলার একটি নিম্ন আদালত আদানি শিল্পগোষ্ঠীর দায়ের করা একটি মানহানির মামলায় প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ঐ আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রদীপ সোনি নয়াদিল্লির নিজামুদ্দিন থানাকে একটি নির্দেশ জারি করে শ্রী গুহঠাকুরতাকে ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি)-র ৫০০ ধারায় (মানহানি) গ্রেপ্তার করতে বলেছেন। শ্রী গুহঠাকুরতা ইকনমিক অ্যান্ড পোলিটিক্যাল উইকলি (ইপিডব্লু)-র ১৪ জুন ২০১৭ সংখ্যায় একটি নিবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল: Modi Government’s Rs 500 Crore Bonanza to Adani Group Company। যার সহ-লেখক ছিলেন অদ্বৈত রাও পালেপু, শিঞ্জনি জৈন ও আবির দাশগুপ্ত। সেই নিবন্ধের সারবস্তু ছিল আদানিদের ব্যবসায়িক সুবিধা দিতে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার স্পেশাল ইকনমিক জোন বিধির ব্যতিক্রমী সংশোধন করেছে, যা গৌতম আদানির সংস্থাকে অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ইপিডব্লু-র প্রকাশক সমীক্ষা ট্রাস্টের অছিদের একটি কড়া চিঠি দেয় আদানি গোষ্ঠীর আইনজীবী ও ৫০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করার ভয় দেখায়। সেই সময় শ্রী গুহঠাকুরতা ইপিডব্লু-র সম্পাদক ছিলেন। প্রকাশক অছিদের অধিকাংশ (যেমন প্রখ্যাত বামপন্থী ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ও অর্থশাস্ত্রবিদ দীপক নায়ার) কার্যত আনত মস্তকে ১৮ জুলাই ২০১৭য় শ্রী গুহঠাকুরতাকে পত্রিকার ওয়েবসাইট থেকে ঐ নিবন্ধটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এর পেছনে পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরের অত্যুচ্চ পদে আসীন সাংবাদিকদের একাংশও (যার নেতৃত্বে ছিলেন এক আগুনখেকো নকশালপন্থী বুদ্ধিজীবী) ছিলেন। প্রকাশক (অর্থাৎ অছিদের অধিকাংশ) পত্রিকায় লিখিত বিবৃতি দেন—
The publishers of the Economic & Political Weekly wish to retract the article “Modi Government’s Rs 500 Crore Bonanza to Adani Group Company,” authored by Paranjoy Guha Thakurta, Advait Rao Palepu, Shinzani Jain and Abir Dasgupta, in EPW, Volume 52, Issue 24, 2017. The article, as published, failed to meet the standards of EPW and did not go through the EPW editorial review process. Hence, the Editor was advised to withdraw this article on 18 July 2017.
এর পিছনে এক সুপ্ত চক্রান্ত ছিল। সে বিষয়ে পরে আসছি। যাই হোক, পরঞ্জয় মাথা নোয়াতে অস্বীকার করেন ও সম্পাদক পদে ইস্তফা দিয়ে ইপিডব্লুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ ঐ নিবন্ধে যা যা লেখা হয়েছিল, তার সপক্ষে প্রয়োজনীয় প্রামাণ্য নথিপত্রের প্রত্যয়িত ফোটোকপি সহ দলিলাদি ছিল। ঐ নিবন্ধ ১৯ জুন ২০১৭য় ‘দি ওয়্যার’ ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আদানিরা তাদেরও মানহানির মামলা করার শাসানি দেয়। কিন্তু ‘দি ওয়্যার’ মাথা নত করে না। ঐ ওয়েব পোর্টালের বিরুদ্ধে আদানি পাওয়ার মহারাষ্ট্র লিমিটেড দুটি মামলা দায়ের করে। আর আদানি পেট্রোনেট পোর্ট দহেজ লিমিটেড ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করে। ওয়েব পত্রিকাটি এতে দমে না। আদানিরা ২০১৯এ লোকসভা নির্বাচনের পর মামলাগুলি তুলে নেয়।
পরঞ্জয়ের আইনজীবী আনন্দ যাজ্ঞিক সংবাদসংস্থা পিটিআইকে কচ্ছ আদালতের হুকুমনামা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে তাঁরা আদালত থেকে কোনও চিঠি/নির্দেশনামা পাননি। “এই তথ্য (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সংক্রান্ত) সংবাদমাধ্যম মারফত আমাদের কাছে এসেছে।”
তিনি এও জানান যে আদানি গোষ্ঠী ইতিপূর্বে শুধু তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধেই মামলা প্রত্যাহার করেনি, আর সকলের বিরুদ্ধে (পত্রিকা সহ) মামলা তুলে নিয়েছে। পরঞ্জয়ের আইনজীবী সেই মামলা থেকে অব্যাহতির (ডিসচার্জ) আবেদন করেছেন, যা উচ্চ আদালতের বিবেচনাধীন। গত বছর করোনা মহামারির দরুন আদালতের শুনানি ব্যাহত হয়। মামলাটি সোমবার (১৮ জানুয়ারি) আদালতে তোলা হয়েছিল এবং আদালত বলেছিল যে একটি যথাযথ আদেশ দেবে। ঠিক সেই সময় নিম্ন আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি বিস্ময়কর (হয়ত রহস্যজনকও)।
ভারতের সংবাদপত্র (দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক) সম্পাদকদের সংগঠন ‘এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া’ এক বিবৃতিতে, এই বরিষ্ঠ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপকে ‘গণমাধ্যমের তদন্ত রোধে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কর্পোরেট হাউসগুলির ভীতি প্রদর্শনের কৌশল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এবং পরঞ্জয়ের বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটির তীব্র নিন্দাজ্ঞাপন করেছে। গুজরাটের নিম্ন আদালত তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৩য় আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের জন্য এই মামলা গ্রহণ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এডিটরস গিল্ড। একটি বিবৃতিতে বলেছে, “নিয়মিত গণমাধ্যমকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরবরাহকারী উপায় ব্যবহার করে বেছে বেছে এদের শিকার হয় স্বাধীনচিত্ত ও নির্ভীক সাংবাদিকরা।” অর্থাৎ এই ফৌজদারি মামলা আসলে সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণের জন্য দেশের ক্ষমতাশালীদের অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
কমিটি ফর প্রোটেকশন অফ জার্নালিস্ট-এর বরিষ্ঠ গবেষক আলিয়া ইফতিকার বলেন, “অতিমারির সময় মানহানির শুনানিতে অংশ নিয়ে যাঁরা নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিতে চান না, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা কর্তৃপক্ষের পক্ষে আপত্তিজনক। গুজরাট কর্তৃপক্ষের পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা উচিত এবং আদানি গোষ্ঠীরও অবিলম্বে ফৌজদারি মামলা তুলে নেওয়া উচিত। সাংবাদিকদের ভয় দেখানো তারা বন্ধ করুক।”
এমনভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা— তাও গুজরাটের এক নিম্ন আদালতে— জারি করার পেছনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (তৎসহ তাঁর অত্যানুগত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্) পরোক্ষ ও প্রচ্ছন্ন মদত আছে একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় মোদিজি (তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী) আদানিদের হেলিকপ্টার ও বিমানে ভ্রমণ করতেন। আর আদানিদের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক (কর্পোরেট) উত্থান নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বের কালে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সাত সাতটি কেন্দ্রীয় সরকারের মালিকানাধীন বিমানবন্দর আদানিদের লিজ দেওয়া হয়েছে।
পরঞ্জয়কে ইপিডব্লু-র সম্পাদক পদে ইস্তফা দানের পিছনে এক মাও-ভক্ত সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর হাত ছিল। ইনি ন্যু ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী মান্থলি রিভ্যু পত্রিকায় মাঝে মাঝে লিখে থাকেন। ইনি সেই সময় ইপিডব্লু-র সম্পাদকীয় বিভাগে অত্যুচ্চপদে ছিলেন। আদানিরা সমীক্ষা ট্রাস্টকে (সম্পাদককেও) ২০১৭ সালে উকিলের চিঠি দিলে সেই আগুনখেকো বিপ্লবীর নেতৃত্বে সম্পাদকীয় বিভাগের কর্মীদের একাংশ পরঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অছিদের কাছে যৌথভাবে অভিযোগ করে। সেই যৌথ অভিযোগপত্র ইপিডব্লুর ওয়েবসাইটে পোস্ট করা হয়েছিল, যার প্রথম নাম ছিল সেই মহাবিপ্পবীর। কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যে সেই পোস্ট ওয়েবসসাইট থেকে তুলে নেওয়া হয়। ইপিডব্লু থেকে প্রস্থানের পরে সেই সব অভিযোগের প্রত্যেকটি খণ্ডন করেছিলেন পরঞ্জয়। সে আরেক কাহিনি, যা নিয়ে একাধিক অন্তর্তদন্তমূলক ফিচার লেখা যায়।