স্বপন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, প্রাক্তন অধ্যাপক
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের কৃষি-রাজনীতিকে পরিষ্কার তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন কে সি সুরি[1] বা তাঁর মতো বিশ্লেষকরা। প্রথমটি উনিশশো পঞ্চাশ–ষাট দশকের কৃষিসংস্কারের যুগ। সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করা নবীন ভারতবর্ষে জওহরলাল নেহরুর সরকার কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে কৃষিজীবীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হওয়ার গুরুত্ব ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন অন্ততপক্ষে নীতিগতভাবে। কৃষিজমির পুনর্বিন্যাস, জমির খাজনার হার কমিয়ে আনা, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রভাব কমানো— উদ্দেশ্য হিসেবে এগুলো সামনে এনে ফেলার একটা পরিসর সৃষ্টি হতে পেরেছিল এই প্রথম পর্বে। বোঝা যাচ্ছিল যে কৃষি উৎপাদনের উদ্বৃত্তই শিল্পের চাকায় গতির সঞ্চার করতে পারে। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মান্ধাতার বাবার আমলের ভূত ছাড়ানো তখনও সহজ হয়নি, আজকেও পুরোপুরি নয়। ফলে অভিপ্রেত আর প্রাপ্তির ভিতরে বিরাট ফারাক ঘুচল না, কিন্তু কৃষক যে রাজনৈতিক দাবাখেলায় উপর্যুপরি গুরুত্বের বোড়ে হয়ে উঠতে পারছিল, তা কতকটা সত্য বটে। দ্বিতীয় পর্যায় নিঃসন্দেহে নরম্যান বোরলগের দেখানো পথে এম এস স্বামীনাথনের নেতৃত্বে সত্তর ও আশির দশক জুড়ে সবুজ বিপ্লব। কৃষিতে স্বয়ংচালিত যন্ত্রের ব্যবহার, উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার, সার ও কীটনাশকের প্রয়োগে জমিতে ফসলের উৎপাদন বেড়ে গেল উল্লেখযোগ্যভাবে। সেটা প্রত্যাশিত, কিন্তু সবুজ বিপ্লব গরিষ্ঠ অংশের কৃষকের জীবনে যে বৈপ্লবিক কোনও পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হল তার কারণ একাধিক। একে তো উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেল এবং বাজারের চাহিদা কৃষককে বাধ্য করল জমিকে একফসলি করে তুলতে। যেখানে ধান সেখানে সারা বছরই ধান, যেখানে গম সেখানে বছর জুড়ে গমের ফলন। কৃষকের ঋণ করা ছাড়া উপায় রইল না প্রতিযোগিতাযোগ্য ফসল উৎপাদনের হার অর্জন করার জন্য, কিন্তু প্রতিযোগিতাযোগ্য দাম সে পেল না। ফলে সবুজ বিপ্লব দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার পথে বড় পদক্ষেপ হলেও চাষির জীবনে তা বড়সড় বিপ্লব এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। কৃষি রাজনীতির তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে মনমোহন সিংহের হাত ধরে গ্লোবালাইজেশনের বেলুন ভারতে ল্যান্ড করায়। রাষ্ট্রের সান্ত্বনার হাত যতটুকু কৃষকের মাথায় ছিল আস্তে আস্তে তা সরে যেতে শুরু করল। আমদানি শিথিল হল, বিদেশের ডাল, তেল, তুলো, বীজ, সার ঢুকে পড়তে শুরু করল দেশের চাষির প্রতিযোগী হয়ে এবং অন্য দিকে আমেরিকা ইউরোপ যারা নিজেদের দেশে কৃষককে চাষে ধরে রাখতে উত্তরোত্তর ভর্তুকি বাড়িয়ে চলছিল তারা ভারতে উচ্চ হারের আমাদানি শুল্ক নিয়ে হুমকি দিতে ছাড়েনি। এর ফলে বীজ ও সারের বাজার প্রায় পুরোটাই দখল করে নিল বহুজাতিক সংস্থারা। সুতরাং বিশ্বায়নের ধাক্কা ভারতের কৃষককে যে অবস্থায় ফেলে দিল তা কতকটা অচেনা পিচে ব্যাট হাতে নামিয়ে দেওয়ার সমতুল। পশ্চিমা দেশগুলিতে জাতীয় আয় ও রোজগারের সাপেক্ষে কৃষির অবদান বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে। কৃষি থেকে বহু মানুষকে সরে আসতে হয়েছে, যারা থেকে গেছে তাদের প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে বাবা বাছা করে ধরে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু সেখানে শিল্পে উন্নতির রথে কৃষকের সামিল হতে বাধা হয়নি। চাষবাস ছেড়ে দেওয়া মানুষ শিল্পক্ষেত্রে কলে-কারখনায় কাজ পেয়েছে, একেবারে বেকার হয়ে পড়েনি। ভারতের সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না একেবারেই। এখানে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রের প্রগতি সমান্তরাল নয় বলেই কৃষকের ভবিতব্য অপরিবর্তিত থেকে গেছে প্রধানত। ইউরোপ আমেরিকায় বিশ্বায়নের প্রভাবে কৃষি সঙ্কুচিত হয়েছে ঠিক কিন্তু একই সঙ্গে চাকুরি বা শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্র কমবেশি বিকশিত হয়েছেই বলা যায়। ভারতে কৃষক কৃষিবিমুখ হতে পারেনি কারণ একে তো তার উপায় ছিল না আর দুই কৃষক বিপর্যস্ত হলেও দেশের ফসলের উপর দেশের মানুষের খাদ্যনির্ভরতা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারেই বেড়েছে, তবে তা কৃষিনির্ভর গ্রামজীবনের মানোন্নয়নে কাজে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। আজকে কৃষকের এই দুর্দশা, ফলিডল গলায় ঢেলে দেশের প্রতিটি রাজ্যে এত যে কৃষকের আত্মহত্যা এর কারণ যতটা না কৃষি থেকে প্রত্যাশা না মেটার গল্প তার চেয়ে বোধহয় বেশি শিল্পায়নে মন্থরতা। অর্থনৈতিক দিশহীনতার জন্য বিশ্বায়নের মাসুল যেভাবে ভারতের চাষিকে গুনতে হচ্ছে তার সঙ্গে ইউরোপ আমেরিকার কৃষিনীতিকে মেলাতে চাইছে যারা তাদের মনে রাখা উচিত ‘the vicious cycle of liberalised economics for farmers is the dilemma of policymakers’[2]— কৃষকের কাছে যা মুক্তকচ্ছ অর্থনীতির পেষাই কল, নীতিনির্ধারকদের কাছে সেটাই হল পথের কাঁটা। সোজা কথায় ভারতের অর্থনীতিকে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুততে যা সব সময় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হল এই কৃষিক্ষেত্র। বলবার কথা এই যে সমস্ত বিশ্ব জুড়েই, ভারতও ব্যতিক্রম নয়, ড্রয়িংরুম-লালিত মধ্যবিত্তের দুনিয়ার সমস্ত কিছুতে ঈর্ষণীয় ব্যুৎপত্তি এবং আগ্রহ থাকলেও কৃষক তার মনোযোগ কাড়তে অসমর্থ হয়েছে। মূল ধারার সংবাদমাধ্যমও তাকে বাম হাতের ফুল ছুঁড়ে দিয়েই খালাস। গত প্রায় দু মাস ধরে রাজধানীর অদূরেই যে ঘটনাটা ঘটে চলেছে তা এই আছে, চলছে, চলে যাচ্ছে গয়ংগচ্ছতার প্রতি একটা বিরাশি সিক্কা যার মূলে আছে অর্ধশতাব্দীর এই প্রেক্ষাপট।
কৃষকদের ‘অন্নদাতা’ রেটোরিক কালে কালে ধার ও ভার দুইই হারাতে বসেছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে, অন্তত সত্তর দশক পর্যন্ত, রাজনৈতিকভাবে কৃষকের যে স্বাতন্ত্র্য ছিল এবং গুরুত্ব ছিল তাতে আঞ্চলিক কৃষক দলপতিদের উপেক্ষা করে কোনও জাতীয় কৃষিনীতি নেওয়া সম্ভব ছিল না। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পরে জাতীয় রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন ঘটে তাতে গরিবির একটা গণতন্ত্রীকরণ ঘটে ঠিক, কিন্তু দরিদ্র, দলিত, পিছড়েবর্গ, সংখ্যালঘু ইত্যাদি সমভিব্যাহারে কৃষকের গরিবি তার আইডেন্টিটি হারাতে শুরু করে। ইন্দিরা গান্ধির গরিবি হটাও শ্লোগানের এর বিপরীতে একটা লাগসই ন্যারেটিভ দরকার হয়ে পড়েছিল ভারতীয় রাজনীতি ব্যবসায়ীদের এবং তারই ফলশ্রুতিতে গত শতাব্দীর উত্তরার্ধ থেকে এ দেশে হাতের ‘কমন্ডল’ ও পরিচয়ের ‘মন্ডল’ পরস্পরের প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়ালে কৃষকের কৃষক আইডেন্টিটি জাতপাতের তলায় চাপা পড়ে যায়। গরীব প্রান্তিক চাষির কবরে অতঃপর কিছু LPG (লিবারেলাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন, গ্লোবালাইজেশন) কোদালের মাটি ফেলে দেওয়ার কাজটাই বাকি ছিল যা গত ত্রিশ বছরে ভারতের কৃষককে এই অসম এবং বিকল্পহীন প্রতিযোগিতার মুখে টিনের তলোয়ার হাতে দাঁড় করিয়ে দিতে চেয়েছে।
একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে কৃষক-রাজনীতি বড় বেশি দিন ধরে নেতৃত্বহীনতার শিকার হয়েছে। একটা সম্পন্ন কৃষকশ্রেণি তৈরি হয়েছে এই সুযোগে যারা গরিষ্ঠ সংখ্যক প্রান্তিক সর্বহারা কৃষকের প্রতিনিধিত্ব করার অবকাশ পেয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। এদের ভেতর কায়েমি স্বার্থ আকাশচুম্বী, এরা সরকার ও চাষিদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে পেরেছে। ভোটের আগে লাঙল কাঁধে তুলে নেওয়া, পাগড়ি জড়ানো বা ট্র্যাক্টরে চড়ে বসা বিএমডাব্লিউ, মার্সিডিজের মালিকদের কৃষক পরিচয়ের ওজন বেড়েছে, পার্লামেন্টে তাদের পদচারণা ক্রমশ দৃপ্ত হয়েছে কিন্তু সাধারণ কৃষক যে তিমিরে ছিল সেখানেই নয় বরং গভীরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের মসৃণ শ্রেণিকরণ ঘটে গেছে অর্থ, জাত-পাত, প্রভাব এবং পার্টি লাইনের ভিত্তিতে। ভারতের মধ্যবিত্তশ্রেণি যেভাবে ভারতের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পেরেছে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে কৃষকেরা সেভাবে তা পেরেছে কি? তারা ঋণভারে জর্জরিত হতে হতে জীবনের খেলা থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেছে হাজারে হাজারে, তবু গত বিশ ত্রিশ বছরে এমন একটাও সর্বভারতীয় কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়নি যা সরকারের নীতিকে দীর্ঘমেয়াদি ঝাঁকুনি দিতে পারে। এই কারণে ঠাণ্ডা ঘরে বসা আমলা-মন্ত্রী-অমাত্য-পারিষদদের এবং ঠান্ডাতর ঘরে বসা কর্পোরেট বসদের কৃষককে ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ ভেবে নিতে কোন বাধা ছিল না।প্রশ্ন উঠতে পারে খাদ্যে স্বয়ম্ভর বা সারপ্লাস একটা দেশে কর্পোরেট কেন খাদ্যপণ্য ব্যবসায় উৎসাহী হবে। এর উত্তর আছে সারপ্লাসের লাভে রূপান্তরণে। ফসলের উদ্বৃত্ত যখন কৃষককে জলের দরে বেচতে হয় তখন সেটা তার কাছে ‘ডিস্ট্রেস সেল’— মরিয়া বিক্রি আর কর্পোরেটের কাছে সেটাই লাভের ঠিকানা। এই কোভিডকালে জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সবই যখন বিক্রি হয়েছে মসৃণভাবে স্টেকহোল্ডারদের কোনওরকম ধর্তব্যের মধ্যে না এনেই, তখন কৃষিতে অন্যরকম কোনও প্রতিক্রিয়া হবে বা হতে পারে এই কর্পোরেটবান্ধব সরকার তা ভাবতেও পারেনি। এই চলমান কৃষক আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র খোঁজার চেষ্টা করার দিন পরে পাওয়া যাবে, কিন্তু এখন সরকারকে এই ভুল পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য কুর্নিশ জানানোর সময়।
আগের কৃষক আন্দোলনগুলোর তুলনায় এবারের পাঞ্জাব হরিয়ানা সীমান্তের আন্দোলনে কিছু মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়ছে। শুধু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের জন্য বা কৃষিঋণ মকুবের জন্য আন্দোলন বলে এটাকে মনে করলে ভুল হবে। সবুজ বিপ্লবের ফলে উৎপাদনে উদ্বৃত্তের বোঝা যাতে কৃষককে একা বইতে না হয় এবং খাদ্য ঘাটতি যাতে দেশকে বিপন্ন না করতে পারে তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ব্যয় ও মূল্য সংক্রান্ত কমিশনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ শস্য-সংগ্রহ নীতি সম্পন্ন কৃষকদের আয়-নিরাপত্তা দিয়েছিল। উত্তর ভারতে-পাঞ্জাবে-হরিয়ানায় ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন, মহারাষ্ট্রে শেতকারী সংগঠন, কর্নাটকে রায়তু রাজ্য সঙ্ঘ যে আন্দোলনের ধারা বহন করে নিয়ে চলেছে এতাবৎকাল, তা মূলত এই ধনী ও মধ্যবিত্ত কৃষকের আয়-নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার আন্দোলন। প্রান্তিক চাষির মৌলিক দাবিগুলোর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পার্থক্য ছিল। ‘ডিস্ট্রেস সেল’ ছোট চাষিকে সর্বস্বান্ত করে দিলেও ধনী কৃষক এমএসপি নিশ্চিত থাকলে সুখে নিদ্রা গেছে। তার সঙ্গে এসে মিশেছিল জাত-পাত, সামন্ততান্ত্রিকতা, ক্ষেতমজুরের অসহায়তা, ফলে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশের সম্পন্ন কৃষকের আন্দোলনের থেকে প্রেরণা নেওয়ার মত কিছুই পায়নি প্রায়, বরং সময়ে সময়ে সংঘাতে জড়িয়েছে। তাহলে আজকের সিংঘু-টিকরি সীমান্তের কৃষক জমায়েতকে অন্যরকম মনে করার কোনও মৌলিক ভিত্তি আছে কি? অবশ্যই আছে এবং সেটা হল কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়ার ভয়।
মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরেই ভূমি অধিগ্রহণ বিলের বিরুদ্ধে, কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে এবং লাভজনক মূল্যের দাবিতে প্রথমবার ইস্যুভিত্তিক কৃষক ঐক্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেছিল। গঠিত হয়েছিল সারা ভারত কিসান সংঘর্ষ সমিতি। এই ঐক্যে বারুদের কাজ করেছিল প্রথম মোদি সরকারের নোটবাতিল কাণ্ড যা কৃষিপণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয় দফায় আরও বড় মেজরিটি এবং এই অতিমারি দ্বিতীয় মোদি সরকারের কর্পোরেটবান্ধব মেজাজকে টি টোয়েন্টি বাতাবরণে ব্যাটিং করতে প্রণোদিত করেছে। একটার পর একটা বিল তারা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে, বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে, রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে পাশ করিয়েছে এবং অবশেষে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভর করে এই কৃষি বিল তিনখানা। সিঙ্ঘু–টিকরিতে যারা আজ পঞ্চান্ন দিন ধরে হিমাঙ্কের কাছাকাছি তাপমান অগ্রাহ্য করে বসে রয়েছেন খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে তারা কেবল ধনী জোতদার বা তাদের রায়তরা নয়। যে কোন দিনই আন্দোলনরত কৃষকদের মধ্যে শ্রেণিগত ও রাজনৈতিক আনুগত্যভিত্তিক বিভিন্নতা চোখে পড়ছে, কিন্তু তা অবস্থানকে দুর্বল করার বদলে আরও সংহত করেছে যত দিন গিয়েছে তত। বস্তুত কর্পোরেটের বিরূদ্ধে এত ব্যাপক আন্দোলন আজ পর্যন্ত এ দেশ দেখেনি। হরিয়ানা পাঞ্জাবের বড় কৃষকেরা যেমন আছেন সিংঘু সীমান্তে তেমনই টিকরিতে দেখা যাচ্ছে মাঝারি ও ছোট কৃষকদের। পালওয়ালে এসে বসে রয়েছেন মূলত মধ্যপ্রদেশ থেকে আগত কৃষকেরা এবং মেওয়াটের মত মুসলমানপ্রধান অঞ্চল থেকে বড় সংখ্যক কৃষকেরা আছেন তাঁদের সঙ্গে। গাজিপুরে রয়েছেন উত্তর ভারত ও রাজস্থানের আখ বেল্টের কৃষকেরা আর শাহজাহানপুরে রাজস্থানের শ্রমিকেরা তো আছেনই, আরও আছেন মহারাষ্ট্র, কেরল, তামিলনাডু, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত কৃষকেরা। এই অবস্থানে মহিলা ও তরুণরা যোগদান করেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। বিল তিনটি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার তো বটেই তার সঙ্গে এমএসপি-কে আইনি সুনিশ্চয়তায় রূপান্তরিত করার দাবি ছোট চাষিকে উদ্দীপিত করেছে সন্দেহ নেই। এমএসপি-র ও নিয়ন্ত্রিত মান্ডির সুযোগ যেভাবে পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষক পায় সেভাবে বাকি দেশ পায় না কেন সে প্রশ্ন সম্পন্ন ও প্রান্তিক কৃষককে এক মঞ্চে এনে ফেলতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অতীতের কৃষক আন্দোলনগুলির মত ভারত বনাম ইন্ডিয়া, গ্রাম বনাম শহর, ধনী বনাম ক্ষুদ্র চাষির ন্যারেটিভে এ আন্দোলনকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা সচেতনভাবেই হয়েছে। খালিস্তানি তকমা মেরে পুলওয়ামা স্টাইলের একটা টুকরে টুকরে গ্যাং প্রকল্পও প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছে। নয় নয় করেও ছাব্বিশবার মোদি কৃষকদের কত ভালো হতে পারে নয়া আইন মেনে নিলে তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এগারোবার কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর আলোচনায় বসেছেন আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে— কোনও লাভ হয়নি। ফলে ঘুরিয়ে পিছু হটার রাস্তা খুঁজতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে কমিটির নিদান দিয়ে যা কার্যত কমিক রিলিফের মতই ঠাউর হল আম আদমির কাছে। শেষ পর্যন্ত দেড় দুই বছরের জন্য বিলগুলোকে ঠান্ডা ঘরে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার বরফ গলাতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্তত এখন পর্যন্ত আন্দোলনের সুর একটাই— এই কর্পোরেট মালিকানার বেসরকারি মান্ডির সমস্ত সম্ভাবনাকে মাটির তলায় পুঁতে না দিলে তাঁরা মাটি আঁকড়েই পড়ে থাকবেন। এক ধাক্কা ঔর দো-র এমত চিত্রায়ণ আজকের ভারতবর্ষে অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল। এখন চোখ কচলে দেখতেই হচ্ছে ফোলানো বেলুন কিভাবে ধাপে ধাপে চুপসে যায়।
[1] KC Suri (2006) Political Economy of Agrarian Distress in EPW
[2] Rohin Kumar (2017) https://www.dailyo.in/politics/farmer-suicides-mandsaur-agrarian-crisis-india/story/1/17772.html