তসলিমা নাসরিন
১৯৬২ সালে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে জন্ম। ১৩ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেছেন। ছড়া কবিতা দিয়ে শুরু। পরে গদ্যে হাত দেন। প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস। আজ অবধি ৪৪ টি বই লিখেছেন। দু'বার পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, নির্বাচিত কলাম (১৯৯২), আমার মেয়েবেলা (২০০০) বইদুটোর জন্য। ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকেও মুক্তচিন্তার জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। মুক্তচিন্তার পক্ষে তিনি একটি আন্দোলনের নাম।
কতকাল ভুগছে নারী! নারী– সে মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান হোক, ভুগতে তাকে হবেই। বাংলাদেশের হিন্দু মেয়েরা আজ মুখ ফুটে বলছে তারা বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার চায়। অনেকে জানে না যে এই অধিকার তাদের নেই। বাংলাদেশের মুসলিম আইনে কিছু পরিবর্তন-সংশোধন আনা হলেও হিন্দু আইন যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। রয়ে তো আর ইচ্ছে করে যায়নি। একে এভাবেই রয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরা যেমন মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে কোনও পরিবর্তন চায় না, বাংলাদেশের হিন্দু মৌলবাদীরাও তেমন হিন্দু পারিবারিক আইনে কোনও পরিবর্তন চায় না। মৌলবাদীদের মধ্যে, সে যে ধর্মের মৌলবাদীই হোক না কেন, মূলত কোনও পার্থক্য নেই। সব মৌলবাদীই নারী বিরোধী। তারা চায় না নারী তার স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতায় তার জন্মগত অধিকার, তা পাক।
মুসলিম নারীরা মাঝে মধ্যে তাদের পারিবারিক আইনটিকে ধর্মের ভিত্তিতে না করে বরং সমানাধিকারের ভিত্তিতে করার জন্যে আবেদন জানায়। এতে লাভ কিছু হয় না। খড়্গ উঁচিয়ে আছে নারী বিরোধীদের দল। হিন্দু নারীরা তো তাদের পারিবারিক আইন সংস্কারের জন্য আবদার আবেদন জানবার সাহসই পায় না। হিন্দু মৌলবাদীরা এই সাহস বরদাস্ত করবে না বলেই চায় না। কিন্তু সহ্যের সীমা একদিন না একদিন তো ভাঙেই। বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা লক্ষণ রেখা পার হয়ে গেছে।
তারা স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, কিন্তু অত্যাচারী স্বামীকে ডিভোর্স করতে পারছে না। প্রচুর হিন্দু মেয়ে স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে আলাদা বাস করছে, কিন্তু সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে পারছে না। মানবধিকার সংগঠনগুলো বলছে, “হিন্দু নারীদের মধ্যে স্বামী থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা বাড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার না থাকায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। বিধবা নারীদের সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও এখন উঠছে।” তা উঠবেই বৈকি।
মেয়েরা শিক্ষিত হলে, স্বনির্ভর হলে, সচেতন হলে, ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ে। দিন যত পার হচ্ছে, তত মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। তত মেয়েরা স্বনির্ভর হচ্ছে। তত মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ বাড়ছে, তত মেয়েরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। এ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবে যেটি অস্বাভাবিক, সেটি হল, পুরুষ শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু সচেতন হচ্ছে না। নারী-নির্যাতনের ঘটনা ততটা কমছে না কোথাও।
বিবিসির এক খবরে পড়লাম, ‘ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় হিন্দু এক প্রেমিক যুগল তাদের পরিবার রাজি না হলেও ঢাকঢোল বাজিয়ে শাস্ত্র মেনে বিয়ে করেছিলেন। পরে অবশ্য পরিবার মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই সংসারে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় সন্তান নেওয়া না নেওয়ায় প্রশ্নে। স্ত্রী সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় তাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে কন্যা শিশু জন্ম দেবার পরে সেই নারী স্বামীর বাড়ি ফেরত এসে আশ্রয় পাননি। সেই থেকে এক যুগেরও বেশি সময় ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় তিনি স্বামী থেকে আলাদা হয়ে কন্যা নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি বলেছেন, “আমি স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারছি না। যদিও সালিশের মাধ্যমে আলাদা হওয়ায় তিনি আমাকে ভরণপোষণের জন্য মাসে ন’হাজার টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু এটা তো জীবন নয়। আমার মেয়ে আমাকে বলে, আমার বাবা কেন সাথে থাকে না? স্কুলে বন্ধুদের সকলের বাবা আছে। মেয়ের এমন কথায় আমার খুব কষ্ট হয়।”
একবার বিয়ে হলে যেহেতু বিচ্ছেদের কোনও ব্যবস্থা নেই, তাই দ্বিতীয় বিয়ে করার কোনও অধিকার নেই মেয়েদের। কিন্তু পুরুষদের যত খুশি বিয়ে করার অধিকার আছে। পুরুষদের যখন খুশি ডিভোর্স দেওয়ারও অধিকার আছে।
মানবধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র নির্যাতিতা নারীদের আইনি সহায়তা দেয়। সংগঠনটি বলছে, তাদের অভিযোগ কেন্দ্রে এখন হিন্দু নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অভিযোগ বিভাগের প্রধান নীনা গোস্বামী বলেছেন, “হিন্দু নারীরা মূলতঃ ঘরে নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে স্বামী থেকে আলাদা থাকার আবেদন নিয়ে আসেন। তখন সালিশ-সমঝোতার মাধ্যমে ভরণপোষণের অর্থ নিয়ে তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। বিয়ের কিন্তু সমাপ্তি ঘটছে না। সেখান থেকে তাঁদের বেরুবার কোনও পথ নেই। হিন্দু নারীরা এখন বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার চাইছেন। যখন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বা জীবন আটকে যাচ্ছে, তখন অনেক নারী ধর্ম বা শাস্ত্র সবকিছু এড়িয়ে অন্তত স্বামী থেকে আলাদা থাকছেন বা থাকার চেষ্টা করছেন। প্রায় সবাই মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছেন। বন্ধনের চেয়ে জীবন টিকিয়ে রাখাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
হিন্দু নারীদের সম্পত্তির ওপর কোনও অধিকার নেই। বাবার সম্পত্তির ভাগ পুত্র পায়, কন্যা পায় না। বিয়ের পরে স্বামীর ঘরেও সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না স্ত্রীরা। বিধবা হলে আশ্রিতা হয়ে যান। সুপ্রিয়া দত্তর কথা বলি। স্বামী যখন মারা যায়, তখন তার কোলে দুই সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে তিনি ফরিদপুরে একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তবে বিধবা হবার পর থেকে তিনি যেন শ্বশুরবাড়িতে আশ্রিত আছেন, এমনটাই তাঁর মনে হয়। তিনি বলেছেন, “স্বামী মৃত্যুর পর থেকে আমি শ্বশুরবাড়িতে আছি। আমার একটি ছেলে, একটি মেয়ে। আমার ছেলে আছে বলে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারছি। কিন্তু সম্পত্তির ওপর আমার কোনও মালিকানা নেই। বাবার বাড়িতে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমার নিজের বলে কোনও সম্পত্তি নেই। শ্বশুরবাড়িতে আমি আশ্রিতা বলতে পারেন।”
ভারতে এবং নেপালে হিন্দু আইনের অনেক সংস্কার হয়েছে। হিন্দু নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন অথবা বিধবা হলে তারা ফের বিয়ে করতে পারেন, বাংলাদেশে এই আইনের কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশে শুধু নিবন্ধনের বিষয়ে একটি আইন হয়েছে ২০১২ সালে। সেটিও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তখনকার আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তির মালিকানাসহ হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনও উদ্যোগ নিলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তোলা হতে পারে, এমন ভয় সরকারের মধ্যে কাজ করে।’
হিন্দুদের অধিকারের পক্ষে সরব যেসব সংগঠন, তারাও হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। বিবাহ নিবন্ধন আইনটি বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারেও তাদের কোনও আগ্রহ নেই।
হিন্দু বৌদ্ধ ক্রিশ্চান সমিতির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, “সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদেরকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া তৈরি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনও উদ্যোগ নেই। এখনকার পরিস্থিতি হল, সংখ্যালঘুদের ওপর সামগ্রিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। তারা অস্তিত্বের সংকটে আছে। ফলে এখন অস্তিত্ব রক্ষা করবে নাকি আভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়ে কাজ করবে। এসব প্রশ্নে একটা বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেজন্য কোনও উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না।”
রানা দাশগুপ্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর সামগ্রিক নির্যাতনের অভিযোগের কথা বলে নারীদের অধিকার প্রশ্নে উদ্যোগের বিষয় এড়িয়ে গেলেন। হিন্দু নেতারা এখনও হিন্দু শাস্ত্রের বদলে সমানাধিকারের ভিত্তিতে কোনও আধুনিক আইনের বিপক্ষে রয়েছেন।
বাংলাদেশ হিন্দু আইনের সংস্কার করতে চাইলেই হিন্দু ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক বলছেন, ‘বিয়ে বা পরিবার নিয়ে ধর্মের স্বীকৃত বিধান চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। সেজন্য সংস্কারের ব্যাপারে হিন্দু সমাজে জড়তা আছে।’
ভারতের মুসলমানরা যেমন মনে করে শরিয়া আইন আল্লাহর আইন, এ পাল্টানো যাবে না। হিন্দুরাও মনে করে, শাস্ত্র পবিত্র, শাস্ত্র মেনে চলা সব হিন্দুর দায়িত্ব। বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা সচেতন হচ্ছেন বলে দাবি তুলছেন বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারের, ভারতের মুসলমান নারীরাও দাবি তুলেছেন তিন তালাক নিষিদ্ধ করার। নারীদের প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার পথে রক্ষণশীল পুরুষরাই সবচেয়ে বড় বাধা। পুরুষ কবে মানুষ হবে, কবে তারা তাদের সহযাত্রীকে সহযাত্রী বলে ভাববে, দাসী বলে নয়? এর উত্তর কারও জানা আছে?
জানা ছিলো না বাংলাদেশের এই অবস্থার কথা আর তার সাথে ভারতের এক যোগসূত্র।
আমি চাই হিন্দু নারীদের এই আইন, যেখানে নারী চাইলে ত্যাগ করতে পারবে।
আপনার লেখা কলামের শেষে যে প্রশ্নটি রেখে উত্তর চেয়েছেন, সেই উত্তর আলবৎ আছে। আমি যতটুকু জানি, বর্তমান সময়ে কোনো সুস্থ পুরুষই তার স্ত্রীকে সহযাত্রী ছাড়া দাসী ভাবে না কিংবা নির্যাতন করে না। আর যারা এখন পর্যন্ত তাদের স্ত্রীর সাথে নির্যাতন করছে, তাদের সংখ্যা খুব সীমিত। এরা দুই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে।
১। অজোঁ পাড়া গাঁয়ের অশিক্ষিত পুরুষ ( যাদের মধ্যে সভ্যতার কোনো ছোঁয়া পড়ে নি)।
২। ধণাঢ্য বাবার দুলাল ছেলে ( যারা সবসময় নেশায় আসক্ত থাকে )।
অতএব অশিক্ষিতকে শিক্ষিত ও সচেতন করার মাধ্যমে এবং নেশাগ্রস্তকে নেশামুক্ত করার মাধ্যমে এই সামান্য সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ।
আপনি কোথায় থাকেন সাদেক রাজু? আপনি যা ‘জানেন’ তা শুনে তো আপনার গ্রহে গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে মশাই!!
আমার কবিতা , গল্প ইত্যাদি পাঠাতে চাই …
কাইন্ডলি আমাদের পেজে মেসেজ করুন সুবীরবাবু…
http://www.facebook.com/4numberplatform/