চার নম্বর নিউজডেস্ক
পঞ্চাশ ক্যারেকটারের আদ্যোপান্ত নিরীহ, নির্বিষ একটা টুইট। আর তাতেই, আন্দোলনের সত্তরতম দিনে পৌঁছে আন্তর্জাতিক মহলে অস্বস্তি চাপা দিতে দিনভর নাজেহাল হতে হল বিদেশমন্ত্রককে। সিএনএন–এর একটি খবরকে উদ্ধৃত করে অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পপ-তারকা রিহানা একটি টুইট করেছিলেন। খবরের লিঙ্কটি নিজের টুইটার হ্যান্ডলে শেয়ার করে তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন মাত্র একটিই ছোট্ট বাক্য। “হোয়াই আর্ন্ট উই টকিং অ্যাবাউট দিস?” বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, “আমরা এটা নিয়ে কথা বলছি না কেন?” সেই সঙ্গে, ব্যবহার করেছিলেন একটি হ্যাশট্যাগ— #FarmersProtest। ব্যস, এটুকুই। নিজের টুইটে রিহানা কৃষকদের আন্দোলনকে সরাসরি সমর্থন করা বা কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেননি, ভারত সরকারের ভূমিকার নিন্দা বা প্রশংসা করেননি, কেবলমাত্র একটি খবরের লিঙ্ক শেয়ার করেছিলেন, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলার পদক্ষেপ হিসেবে সরকার যেভাবে দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকায় এবং হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে, তার বিবরণ।
তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে, রিহানার সেই টুইট কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভাইরাল করে দিয়েছেন তাঁর একশো মিলিয়নের বেশি ভক্তবৃন্দ (আমাদের আইটি সেল-এর কার্যকর্তারা মানুন বা না-মানুন, ভক্ত তাঁদের ছাতার বাইরের লোকজনেরও থাকে), এবং সেই টুইট দিনভর শেয়ার করে, রিটুইট করে একেবারে শোর মচিয়ে দিয়েছেন একের পর এক সেলিব্রিটি ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা। দিনের শেষে পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রককে তড়িঘড়ি আসরে নামতে হয়েছে, বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, ‘প্রকৃত তথ্য না-জেনে এ ধরনের বার্তা অনভিপ্রেত’। শুধু তা-ই নয়, বিদেশমন্ত্রক তাদের বিবৃতিতে এ কথাও জানিয়েছে যে, ‘কতিপয় স্বার্থবাহী গোষ্ঠী যেভাবে প্রতিবাদের নামে তাদের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা মানুষের ওপর জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে চাইছে, তা দুর্ভাগ্যজনক’— “Unfortunate to see vested interest groups trying to enforce their agenda on these protests, and derail them.” বলা বাহুল্য, সরকারের স্বঘোষিত তল্পিবাহক সুশ্রী কঙ্গনা রানৌত ইতিমধ্যেই রিহানার টুইটবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনরত কৃষকদের ‘টেররিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন (এতে অবশ্য নাটকীয়তার উপাদান তেমন নেই, কৃষকরা যে সন্ত্রাসবাদী সে কথা তো তিনি, আজ নয়, আন্দোলনের শুরু দিন থেকেই জানিয়ে আসছিলেন)। ইতিমধ্যেই কঙ্গনার পক্ষে ও বিপক্ষে টুইটের বন্যা বইতে শুরু করেছে। যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে কেউ-কেউ তো সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কথাও ভাসিয়ে দিয়েছেন যে, রিহানা যদি কোনওদিন ইন্ডিয়া ট্যুরে আসতে চান, তাঁকে যেন ভারতে প্রবেশের অনুমতি কোনওমতেই না-দেওয়া হয়… ইত্যাদি-প্রভৃতি। যদিও, রিহানাকে এর মধ্যেই আর্বান নকশাল বা অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না, সে বিশয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
কিন্তু, ব্যাপারটা কেবল যে রিহানার টুইটেই আটকে থেকেছে, তা নয়। ওই একই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে টুইট করেছে বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ, কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ। হয়তো অ্যাকটিভিস্ট বলেই, এবং ইতিমধ্যেই প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট শ্রী ট্রাম্পের মহড়া নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে বলেই, নিজের বক্তব্যে তিনি রিহানার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টবাদী। থুনবার্গ লিখেছেন, “আমরা ভারতের কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন করছি”— “We stand in solidarity with the farmer protests in India.”
শুধু থুনবার্গই নয়। রিহানার টুইটে সাড়া দিয়েছেন আরও অনেকেই। জনপ্রিয় কমেডিয়ান ও ইউটিউবার লিলি সিং রিহানাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের টুইটে কৃষক আন্দোলনের প্রতি নিজের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। কৃষকদের সমর্থন জানিয়ে প্রায় একই বার্তা দিয়েছেন মার্কিন পরিবেশকর্মী জেমি মার্গোলিন, কেনিয়ার পরিবেশকর্মী ও গ্রিন জেনারেশন ইনিশিয়েটিভ-এর প্রতিষ্ঠাতা এলিজাবেথ ওয়াথুতি, ব্রিটেনের পার্লামেন্ট-সদস্য ক্লদিয়া ওয়েব থেকে শুরু করে জনপ্রিয় লেখক খালেদ বেদুন প্রমুখ অনেকেই। তবে ভারত সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীরতর করেছে যে বার্তাটি, সেটি এসেছে মীনা হ্যারিস-এর কাছ থেকে। সম্পর্কে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ভাইঝি মীনার বক্তব্য, “Everyone should be outraged by India’s internet shutdowns and paramilitary violence against farmer protestors.” ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, ভারতের ঘটনাপ্রবাহ যে ক্যাপিটল হিলের নজর এড়াচ্ছে না তার প্রমাণ এই টুইট। এর জেরে দু দেশের সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ-ও রিহানার টুইটে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
এদিকে, গত দু’দিন ধরে সিংঘু, টিকরি ও গাজিপুর সীমানায় অবস্থানরত কৃষকদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়াতে একের পর এক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে দিল্লিকে প্রায় নিশ্ছিদ্র দুর্গে পরিণত করার যে চেষ্টা চলছিল, তা এদিন আরও বেড়েছে। রাস্তা কেটে গড়খাই তৈরি করে তার পেছনে সিমেন্টের বড় স্ল্যাব, কাঁটাতার, ভারী ট্রলারের সারি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পর, এবার রাস্তার ওপর লোহার গজাল পুঁতে কৃষকদের ট্র্যাক্টরবাহিনীকে রোখার পরিকল্পনা করেছে দিল্লি পুলিশ। প্রস্তুতির বহর দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে শুরু করেছে মিম— “এ যেন মশা মারতে মো-শার কামান”। এরই পাশাপাশি, স্থানীয় খবর যাতে বাইরে ছড়াতে না-পারে তা সুনিশ্চিত করতে দিল্লি-সহ হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা স্তব্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। যা দেখে কৃষক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, এবার কি সরকার তবে নিজের দেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নেমে পড়ার কথা ভাবছে?
খবর ছড়িয়ে পড়া আটকাতে, ও বাইরে থেকে অবস্থানস্থলে আসতে চাওয়া কৃষকদের রুখতে নিত্যনতুন পন্থা নিলেও, খবর কিন্তু আটকানো যাচ্ছে না। উলটে, সরকারের লড়াকু মনোভাব তাঁদের জেদকেই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে দাবি করছেন কৃষকরা। এরই মধ্যে খবর, আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি তিন ঘন্টার জন্য চাক্কা জ্যামের ডাক দিতে চলেছে আন্দোলনকারী কৃষকদের ইউনিয়ন। সে খবর সামনে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই আরও একবার সম্মুখসমরের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আতঙ্কিত দিল্লি প্রশাসন। যদিও, কৃষক নেতাদের সাফ কথা, আন্দোলন চলবে শান্তিপূর্ণ পথেই। এবং কোনও মহলের কোনও উস্কানির ফাঁদে পা দিয়ে আন্দোলন যাতে ফের একবার ভুল পথে চলে না-যায়, তা নিশ্চিত করতেও কোনও ত্রুটি রাখতে চাইছেন না তাঁরা। পাশাপাশি, সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে প্রতিদিন একের পর এক খাপ মহাপঞ্চায়েতে যেভাবে লাখো মানুষের ভিড় আছড়ে পড়ছে, সেদিকেও উদ্বিগ্ন নজর রাখছে প্রশাসন। কেবল দমনমূলক পথে যে এই আন্দোলনকে কবজা করা সম্ভব নয়, তা যতই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে, ততই দিশেহারা দেখাচ্ছে সরকারকে।