সাতটি কবিতা
(পুরুলিয়া সিরিজ থেকে)
বড়ন্তী
যেতে যেতে রাস্তা বাঁদিকের একটা সুঁড়িপথে ঢুকে পড়ল,
ছবি আঁকা বাড়ি, আর পলাশ গাছ,
আর কিচ্ছু মনে নেই,
যেহেতু খিদে পেয়েছিল।
যেহেতু খিদে পেয়েছিল
আর খাবার টেবিলে বসতে গেলেই
তুমুল স্যানিটাইজার
আমাদের তছনছ করে দিচ্ছিল
আর ওয়াচ টাওয়ারের হাওয়া আমাদের ডাকছিল,
অত উঁচুতে থেকেও
আমরা শুনছিলাম
বাঁধাকপিটায় নুন হয়নি,
আর মাছ ভাল করে ভাজেনি!
আর আমরা যেন কিছুই শুনিনি
এইরকম ভাব করে
সামনের বড়ন্তীর জলে পাহাড়ের ত্রিভুজ ছায়া দেখছিলাম
আর সূর্যাস্তের কথা ভাবছিলাম
সূর্য ডুবল কিন্তু তা তত পছন্দ হল না,
সূর্য ডুবল কিন্তু তার মধ্যে অনেক জল মেশানো ছিল
আমরা ভেবে উঠতেই পারিনি অরণ্য,
আমরা ভেবে উঠতেই পারিনি বালিহাঁস,
আর তাই আমাদের আসতে হয় এতদূর
বহু পথ ও প্রহর পেরিয়ে বড়ন্তীতে!
তুর্গা
কেমন যেন ঘোড়া ঘোড়া গন্ধ এই নামে,
তুরঙ্গ তুরঙ্গ,
সে তো বুঝলাম
মহুয়া গাছের তলায় বসা
আইসক্রিমওলাকে দেখে।
আরবি ঘোড়ার মতো উচক্কা যুবক,
সে বোঝাতে চাইছিল
একনজর দেখেই সে মানুষকে পড়ে ফেলতে পারে,
আর আমরা সেসব পাত্তা না দিয়ে
জলের মাঝ অব্দি চলে যাওয়া ব্রিজটাকে দেখছিলাম।
যেখানে যাওয়ার চেষ্টা করলেও যাওয়া যায় না।
মার্বেল রক
এত পাথর কে আনল এখানে?
এই ছেলেমেয়েগুলো মাত্র দশ টাকা চেয়েছিল,
আমরা দিতে পারিনি,
আমাদের তোলা প্রতিটি ছবিতেই ওদের হাত উঁকি দিচ্ছে,
আমাদের তোলা প্রতিটি সেলফিতে ঘাড়ের ওপর ওদের মুখ,
আমাদের কাঁধ শক্ত কিন্তু কোনও ভার বইতে পারে না,
আমাদের পা মজবুত কিন্তু অত উঁচুতে উঠতে পারে না,
আমাদের হাত আছে, কিন্তু সে হাত কেউ দেখতে পায় না,
মার্বেল রক, তোমার এত পাথর কে আনতে পারে ভাবছি।
গড়পঞ্চকোট
ভোর স্ট্রবেরি রঙের,
আমি জাস্ট মেজাজটা বোঝাতে চাইছি,
জেজাবেল যেহেতু একটা প্রজাপতির নাম,
তাই সেই নামের ঘরে রাত্রিবাস করতে আমার ভয়ই ছিল,
মধ্যরাতে কত কী ঘটে যায়,
আমাকে শুদ্ধ নিয়ে ঘরটা কোন ফুলে গিয়ে বসল,
যেহেতু এখানে ফুল আছে বিস্তর
এবং পাথরও আছে,
আর পাথর থেকে গড়িয়ে পড়তে পড়তেও
আমি হাতে ধরে ছিলাম জেজাবেলের একটা ছেঁড়া ডানা,
নীচে যেহেতু লেমন প্যান্সি সারারাত ছটফট করছে,
তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ওপর থেকে পাওয়া যাচ্ছিল
আর আমি বাথরুমের সামনে ড্রেসারের আয়নায়
নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম
একটা প্রজাপতির ওপর আর একটা প্রজাপতি বসলেই
কি শুভ বিবাহ সচরাচর?
বামনী ফলস
আমি যতদূর নামলাম,
তারপরেও নাকি আছে,
প্রতিটি ঝর্ণায় নামার সময়
এই কথাটাই শুনে থাকি,
যার মানে হল প্রতিটি পাহাড়ি ঝর্ণায়
আমাদের মতো এলেবেলে পর্যটক ছাড়াও
একজন দুজন প্রকৃত জ্ঞানী থাকেন,
যাঁরা সবকিছুর একেবারে মূল পর্যন্ত দেখতে চান,
এবার বামনী ফলসে নামার সময়
ঠিক করলাম
আমি কোন জ্ঞানী লোকের পেছন পেছন একেবারে
নিচ অব্দি যাব।
গেলাম,
এমন জায়গা যেখানে আর কোন সিঁড়ি নেই,
তিনটে ঝর্ণার জল উড়তে উড়তে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে,
সিঁড়ি নেই,
শুধু তিনটে পাথর
আর তিনটে পাথরেই
আমার দিকে পেছন করে
কেউ চুল খুলে বসে আছে।
আমি ওদের মুখ দেখব বলে লাফাতেই
আছড়ে পড়লাম,
আর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে গেলাম
ঝর্নার জলে!
মুরুগামা
আমার মাথা থেকে তেলচিটে গামছাটা
ছোঁ মেরে তুলে নিল একটা চিল,
মুরুগামা বাঁধের ওপরে বসে সে অনেকক্ষণ আমাকে নজর রাখছিল,
সে দেখেছে ওটা পেতে আমরা লুচি মাংস খেয়েছি,
একটা কমলালেবুর মাঠ
যদিও সেখানে কোনও কমলা ছিল না,
চারদিক আশ্চর্য সুন্দর
আর কমলা আলো টাঙানো
বলেই অমন মনে হল,
খাওয়ার পর সেইটা আমি ডিকিতে রেখেছি,
তিনটে লাশ ঢাকব বলে,
একটা গামছা দিয়ে তিনটে লাশ ঢাকা কি চাড্ডিখানি কথা?
ফলত বাধ্য হয়ে আমি দেড়খানা লাশ জড়িয়ে শুলাম,
কিন্তু এত কাছ থেকেও বুঝতে পারলাম না ওগুলো কাদের!
তাই বিরক্ত হয়ে আমি গামছা নিয়ে
ঘাটে নাইতে নামলাম,
আমাকে দেখে রুই কাতলা ভেসে উঠল,
আমাকে দেখে তাদের হাঁ কপকপ করে উঠল,
তখন সেই গামছা জালের মতো বিছিয়ে
আমি ধরে ফেললাম ওদের,
ঠিক তখুনি বাঁধের মাথা থেকে চিলটা নেমে এসে
আমাকে আর গামছায় জড়ানো রুইকাতলাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল
আর স্বাভাবিকভাবেই
আমাকে ফেলে দিল,
আমি একটা হাঁসের পিঠে চড়ে বসলাম
আমি সেই হাঁসের পিঠে চড়ে অনেক দূর চলে গেলাম…
পাঞ্চেত
আমার ভেতরে খুব শুনশান
যেন মাহাতোদের পাড়া,
ছেলেরা গাড়ি গাড়ি ময়দানে গেছে
আর মেয়েরা গেছে বাঁধের জলে স্নান করতে
পেছনে ফেলে গেছে তাদের পাড়া,
মায়াময় গাছতলা,
আমি এপাশে দেখি আকাশমণি
ওপাশে ইউক্যালিপটাস,
আমার বিশ্বাস হয়
এই রাস্তাটা শুধু আমার হাঁটার জন্যে তৈরি করা হয়নি,
যেসব পাতারা ঝরে পড়ছে, তারাও যেন
হাওয়ার ধাক্কায় গড়িয়ে যেতে পারে,
শিরিশ ফুলের চূর্ণ যেন আটকে থাকতে পারে
হাত রাখার রেলিং -এ
আমি উঁকি মেরে দেখি বাঁধের ওপর থেকে
মাহাতোদের পাড়ায় নামার একটা লুকনো সিঁড়ি,
ধাপে ধাপে লক্ষ্মীর পায়ের জলছাপ…