স্টেশন মাস্টার
বেশিদিন পূর্বের কথা নহে। দিল্লি-হরিয়ানার সিংঘু সীমানায় কৃষক-আন্দোলনের দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহ যাঁহারা অনুসরণ করিতেছেন, তাঁহাদের স্মরণে থাকিবে, অবস্থানকারী কৃষকরা কিছু বিশেষ বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টারগণকে একপ্রকার বয়কট করিয়াছিলেন। কৃষকদের বক্তব্য ছিল, যে কতিপয় সংবাদমাধ্যম একেবারে শুরুর দিন হইতেই এই আন্দোলনের প্রতি কুৎসা করিয়া আসিতেছে, আন্দোলনকারীদের খলিস্তানি, মাওবাদী, দেশদ্রোহী এবং চিনের এজেন্ট বলিয়া চিহ্নিত করিয়া তাঁহাদের আন্দোলনের পশ্চাতে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনিতেছে; সরকারের তল্পিবাহক সেই সংবাদমাধ্যমগুলিকে আপনাদের বক্তব্য জানাইবার দায় অতএব কৃষকদের নাই। এই প্রত্যাখ্যানের মধ্যে, বলা বাহুল্য, একটি বিকল্পপ্রতিমা অনুসর্জনের কাহিনিও নিহিত ছিল। সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হইয়া তাঁহারা আপনাদের নিজস্ব সংবাদপত্র ‘ট্রলি টাইম্স’ প্রকাশ করা শুরু করেন। স্বল্প পুঁজি ও সামর্থ্যে প্রকাশিত সেই ট্যাবলয়েড আন্দোলনস্থলে হাতে হাতে বিতরিত হইতে থাকে ও অচিরাৎ প্রবল জনপ্রিয় হইয়া উঠে।
ঘটনাটি প্রতীকী। প্রতীকী, কেন না, ভবিষ্যতে যদি কোনওদিন ভারতীয় গণমাধ্যমের সামগ্রিক ইতিহাস রচিত হয়, উক্ত ঘটনাটি এক ঐতিহাসিক জলবিভাজিকা মুহূর্ত বলিয়া অভিহিত হইবে। অভিজ্ঞতা বলে, ইতিহাস কেবল ক্ষমতাবানের ভাষ্যই বহন করিয়া থাকে, তথাপি, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করিয়া কৃষকেরা যে ক্ষমতার চক্ষে চক্ষু রাখিয়া আপনাদের পালটা সংবাদ-পরিসর রচনা করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন, এই বাস্তবতাটি অস্বীকার করা সহজে সম্ভব হইবে না। ইতিহাসে লেখা থাকিবে, কেন, কীভাবে, কোন ঘটনাক্রমের প্রেক্ষিতে কোনও রাজনৈতিক দলের মঞ্চ ও পৃষ্ঠপোষণা ব্যতিরেকেই দেশের কৃষকরা মহাশক্তিধর কর্পোরেটের ক্রোড়লালিত মিডিয়াবাহিনির পালটা এক বিপ্লবী সংবাদ-পরিসর রচনার প্রয়োজন অনুভব করিয়াছিলেন।
কিন্তু সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক। কেবল স্মরণে রাখা যাক, মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে এত স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান স্বাধীন ভারতের গত সত্তরোর্ধ্ব বৎসরের ইতিহাসে আর কখনও করিবার সাহস কেহ দেখাইতে পারেন নাই। যে মিডিয়াকে একদা আপামর ভারতবাসী সমাজদর্পণ জ্ঞান করিতেন, তাহার বিশ্বাসযোগ্যতা অধুনা কতদূর প্রশ্নের সম্মুখীন, সৎ সাংবাদিকতার ধ্বজাধারীরা তাঁহাদের একদা-শ্রদ্ধেয় আসনখানি হইতে ইদানিং কতদূরে নির্বাসিত, এই একটি ঘটনা হইতেই তাহা সম্যক প্রতীয়মান হইয়া উঠে।
একইসঙ্গে স্মরণে রাখা যাক আরও কিছু তথ্য। গত কয়েক বৎসর ধরিয়াই আমরা দেখিতেছি নিরপেক্ষ ও তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের যে গৌরবান্বিত ঐতিহ্য স্বাধীনতার বহু পূর্ব হইতেই ভারতবর্ষের অহঙ্কার, তাহাকে সমূলে অস্বীকার করিয়া এক নূতন ধারার সংবাদ, নয়া মোড়কে পেশ করা হইতেছে। নূতন এই সাংবাদিকতায় সত্য অপেক্ষা চিৎকারের জোর বেশি, তথ্যের প্রতি নিষ্ঠা অপেক্ষা ক্ষমতাবানের সরবরাহ করা সংবাদ-বটিকার প্রতি আনুগত্য বেশি, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করিবার অপেক্ষা তাহার স্থির করিয়া দেওয়া শত্রুকেই বিনা বিচারে চাঁদমারি করিবার আগ্রহ বেশি এবং দিনশেষে সত্য উদ্ঘাটন অপেক্ষা সরকারের স্বার্থবাহী ন্যারেটিভ নির্মাণে আকুলতা বেশি। শাসক ও বণিককুলের প্রকাশ্য দহরম-মহরমের স্নেহচ্ছায়ায় লালিত এই মিডিয়া মনে করে, তাহাই সত্য যাহা সে নির্মাণ করিবে; কর্পোরেট বিশ্বাস করে, তাহাই সত্য যাহা তাহার স্বার্থরক্ষায় সহায়তা করিবে; এবং সর্বোপরি শাসক বিশ্বাস করে, তাহাই সত্য সে যাহা মিডিয়াকে বাজারজাত করিতে নির্দেশ করিবে। এ প্রকারে, গণতন্ত্রের একদা-প্রহরী ও চতুর্থ স্তম্ভ বলিয়া সুপরিচিত সংবাদমাধ্যম আজ তাহার যাবতীয় বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়াছে।
বলা বাহুল্য, দেশে-বিদেশে এ প্রবণতা নূতন নহে— মিডিয়াকে আপনার স্বার্থবাহী করিয়া তুলিতে শাসকের অভীপ্সা বহুদিনের। ইহাও স্বীকার্য যে, বণিকশ্রেণিও ঐতিহাসিকভাবেই চাহিয়াছে সংবাদমাধ্যমের উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখিতে, সহজবোধ্য কারণেই। কিন্তু একইসঙ্গে ইহাও অনস্বীকার্য যে, একটি সময় পর্যন্ত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম সেই রক্তচক্ষু ও প্রলোভনের বিপরীতে আপনার মেরুদণ্ডটি ঋজু রাখিয়া দাঁড়াইতে সক্ষম হইয়াছিল। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরিয়া, আরও সুনির্দিষ্টভাবে কালনির্ণয় করিতে গেলে জরুরি অবস্থার পরবর্তী ভারতবর্ষে সংবাদমাধ্যমের সে গৌরবের দিন গিয়াছে। যেদিন হইতে অ্যাক্সেস জার্নালিজমের সূচনা হইয়াছে, সেই দিন হইতে স্পনসর্ড সংবাদ গ্রহণযোগ্যতার পোশাক পরিয়া সত্যের সিংহাসনে বসিয়াছে। ফল হইয়াছে, এ কথা মানিয়া লইতে ইদানিং কাহারও সমস্যা হয় না যে, সংবাদ-সংগ্রাহক প্রথমে জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডাবিদ, পরে সাংবাদিক। আশ্চর্য কী যে, এই জাতীয়তাবাদের ধারণাটিও শাসকই রচনা করিয়াছে আপন স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে। কালে কালে সেই রচিত-জাতীয়তাবাদের ভূত আসিয়া মৃত অ্যালবাট্রসের ন্যায় সাংবাদিকের কণ্ঠে ঝুলিয়াছে, শীঘ্র নামিবে এমন প্রত্যয় হয় না।
এই প্রকারে মিডিয়া একদিকে যেমন সহস্রমস্তক সর্পিনীর ন্যায় গণপরিসরের ল্যাজামুড়া গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে, অন্যদিকে তেমনই গ্রস্ত হইয়াছে এক প্রবল আত্মধ্বংসী প্রবণতায়— সে এখন এমন এক সাইক্লপ যাহার একটি বই চক্ষু অবশিষ্ট নাই। সেই এক চক্ষু দিয়া সে একদেশদর্শী সংবাদ দেখিতেছে, সে সংবাদে আপনি বিশ্বাস করিতেছে, এবং পরিণামে বিস্মৃত হইতেছে যে, ন্যারেটিভ রচনা নহে, সত্য উদ্ঘাটন ও তাহার পরিবেশনই একদা তাহার পবিত্রতম কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইত। একচক্ষু দৈত্যকে কেহ বিশ্বাস করে না, সিংঘুর কৃষকেরাও করেন নাই।
কিন্তু, বিক্ষিপ্তভাবে হইলেও এর বিপরীত চিত্রটিও ক্রমে স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। পাঠকের এই প্রসঙ্গে তরুণ সাংবাদিক মনদীপ পুনিয়ার নাম সর্বাগ্রে স্মরণে আসিবে। পেশায় মুক্তভল্ল সাংবাদিক মনদীপকে সিংঘু সীমানায় ভুয়া মামলা সাজাইয়া গ্রেফতার করিয়াছিল দিল্লি পুলিশ, কিন্তু শেষাবধি হজম করিতে পারে নাই। তবে, তাহাতে উল্লাসের কারণ বিশেষ নাই— রাজদীপ সরদেশাই-সহ ছয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে মামলা লেলাইয়া দিয়া পুলিশ যে বার্তা দিতে চাহিয়াছে, তাহাকেও লঘু করিয়া দেখিবার কোনও কারণ নাই। ভুলিলে চলিবে না, সাংবাদিকতা বিশ্বের যে সব দেশে বিপজ্জনক পেশা বলিয়া পরিগণিত, ভারতের স্থান সেইসব দেশের তালিকায় একেবারে উপরের দিকে।
এমত পরিস্থিতিতে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের ফেব্রুয়ারি মাসের সংখ্যায় আমরা ভুয়া, মেকি ও স্বার্থবাহী সাংবাদিকতার বিপদ ও তাহার বিরুদ্ধে সৎ সাংবাদিকতার আপাতকুণ্ঠিত অথচ ক্রমজায়মান সাহসি পদপাতের ঘটনাক্রমটি চিহ্নিত করিতে চাহিয়াছি। আমাদের মনে হইয়াছে, রাহুগ্রাসের মধ্যেই যেমন রাহুমুক্তির ঈপ্সিত ইঙ্গিতটি লুক্কায়িত থাকে, তেমনই, মিডিয়ার এই পূর্ণগ্রাসের মধ্য হইতেই সাংবাদিকতারও রাহুমুক্তি ঘটিবে। নূতনকে জায়গা করিয়া দিবার জন্য পুরাতনকে বলপূর্বক বিদায় করিবার রীতি লোকসমাজে প্রচলিত আছে। ভাবিতে ইচ্ছা করি, পুরাণকথিত মহাসর্প যেমন নিজেই নিজেকে ভক্ষণ করিয়া আত্মনাশ করে, সংবাদমাধ্যমও তেমনই নিজেকে ক্লেদমুক্ত করিবার লক্ষ্যে আপনার আজিকার কৃষ্ণচ্ছায়াগ্রস্ত রূপটি আপনিই বর্জন করিবে। যতদিন তাহা না-হইতেছে, আমরা নিশ্চিত, সমাজ অক্লান্তভাবে আরও অসংখ্য মনদীপ পুনিয়ার জন্ম দিয়া চলিবে। ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
আলোচ্য সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি ‘মিডিয়ার গ্রাস’-এ আমরা যাঁহাদের নিবন্ধ প্রকাশ করিলাম— হিমাদ্রি ঘোষ, প্রশান্ত ভট্টাচার্য, প্রতীক, স্যমন্তক ঘোষ ও শঙ্কর রায়— ইঁহারা প্রত্যেকেই পেশায় সাংবাদিক— সংবাদ-পরিসরের আলো ও অন্ধকারগুলিকে তাঁহারা আপনাদিগের অভিজ্ঞতার আলোকে চিনিয়াছেন। আশা রাখি, নিবন্ধগুলি হইতে পাঠকের ভাবনার খোরাক জুটিবে।
এতদ্ব্যতীত, গল্প–কবিতা–ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনা–বিশেষ নিবন্ধ–প্রবন্ধ–অনুবাদ সাহিত্য–অন্যগদ্য–ফোটোফিচার–অণুগল্প–স্টিম ইঞ্জিন–ডিসট্যান্ট সিগনাল–হুইলার্স স্টল–ভালো খবর-সহ অন্যান্য প্রতিটি নিয়মিত বিভাগ যথারীতি প্রকাশিত হইল।
পরিশেষে জানাই, আর কয়েক মাসের ভিতর চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম তাহার পঞ্চম বৎসর পূর্ণ করিতে চলিয়াছে। গত পাঁচ বৎসরের এই স্বল্পায়ু অথচ উত্তেজক যাত্রায় আপনাদের সহৃদয় এবং মনোযোগী উপস্থিতি ব্যতীত আর কোনও স্থায়ী আমানত আমাদের ছিল না, আজও নাই। বস্তুত, সৎ সাংবাদিকতা লইয়া নিবন্ধ প্রকাশ করিবার জন্য যে স্পর্ধা ও নৈতিক অধিকার থাকা আবশ্যক, তাহাও আপনারাই আমাদের দিয়াছেন। আশা করিব, এ যাবৎ যেভাবে আপনারা প্রতি পদক্ষেপে আমাদের উৎসাহিত করিয়া চলিয়াছেন, ভবিষ্যতেও তেমনই করিবেন।
প্রণামান্তে…