সুপ্রিয় চৌধুরী
কথাকার, ঔপন্যাসিক
আমাদের অন্নদাতারা,
এগারো ডিগ্রি তাপমাত্রার এই শীতরাতে রেঁধেবেড়ে বা সুইগি-জোম্যাটো থেকে আনিয়ে একপেট চর্বচোষ্য ভালোমন্দ খেয়েদেয়ে যখন আমি অথবা আমার মত অনেক আমরা লেপকম্বলের নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকতে যাচ্ছি ঠিক তখনই এখান থেকে অনেক অনেক কিলোমিটার দুরে দিল্লি-পাঞ্জাব, দিল্লি-হরিয়ানা আর দিল্লি-উত্তরপ্রদেশের সীমান্তগুলোয় এই আপনারা মানে আমাদের অন্নদাতা কৃষকরা এক ভীষণ নাছোড়বান্দা জেদ নিয়ে বসে আছেন। গায়ে হুল ফোটাচ্ছে উত্তর ভারতের হিমাঙ্কের নীচে নেমে যাওয়া শীতলহর। চারদিক ঘিরে রয়েছে রাষ্ট্রের জলপাই ছোপ উর্দির র্যাফ, সশস্ত্র বাহিনি, তাদের হাতের বন্দুক, বেয়নেট, কাঁদানে গ্যাসের সেল, সার সার কালো ভ্যান, সাঁজোয়া গাড়ি, জলকামানের বজ্রযান। সীমান্তর পর সীমান্ত, মাইলের পর মাইল আপনাদের ঘিরে রেখেছে কাঁটাতারের বর্ডার আর নখদাঁত উঁচিয়ে থাকা গজাল পেরেকের পাটাতন। ঘিরে রেখেছে শাসকের রক্তচোখ আর তাদের পিশাচ নজরদারি। সীমানার ওপারে দিল্লি। যেন আরেকটা দেশ। সেই দেশের নাগরিক শুধুমাত্র শাসক আর তার পেটোয়া স্তাবক-বিদূষকরা। আর আপনারা সব্বাই দেশদ্রোহী। সব্বাই নকশালি মাওবাদী, উগ্রপন্থী খলিস্তানি, পাকিস্তান থেকে আসা আল-কায়দা আর লস্কর-ই-তইবা, নিদেনপক্ষে জেএনইউ ক্যাম্পাসের টুকরে টুকরে গ্যাং। আপনারা সব্বাই উমর খালিদ, ভারভারা রাও, কাফিল খান, সুধা গ্যাডগিল, গৌতম নাভলাখা, এমনকি দাভালকার, পানেসার, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশও। আর আপনাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ আপনারা আদানি আম্বানি সহ আরও একাধিক সব একচেটিয়া পুঁজি আর লুটেরা বহুজাতিক কর্পোরেটগুলোর হাতে গোটা কৃষিক্ষেত্রটাকেই ভেট হিসেবে তুলে দেওয়ার এই সরকারি ‘উন্নয়নের’ প্যাকেজ থুড়ি আইনটার বিরুদ্ধেই সর্বাত্মক বিদ্রোহে নেমে পড়েছেন। তাই সাক্ষী মহারাজ, সাধ্বী প্রজ্ঞাদের প্রবেশাধিকার থাকলেও আপনাদের জন্য দিল্লির দরজায় ‘নো এন্ট্রি’ নোটিসবোর্ড লটকানো। কারণ ওই যে বললাম আপনারা সবাই দেশদ্রোহী, খলিস্তানি, পাকিস্তানি, মাওবাদী নয়তো টুকরে টুকরে গ্যাং। তাই তো বলছে রোজ সরকারি টুইটার হ্যান্ডেল আর গোদি মিডিয়া চ্যানেলগুলো— প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে একটি বিশেষ চ্যানেলে চোখ আর ঘুষি পাকিয়ে কামোন্মাদ ষণ্ডের মত গর্জন ছাড়ছেন স্বঘোষিত সেই ভারতমাতার আগমার্কা সন্তান থুড়ি সঞ্চালক। যিনি পারলে প্রায় নিজেই কাঁধে একে ফরটি সেভেন নিয়ে কাশ্মির সীমান্তে পাকসৈন্য মারতে চলে যান অথবা একাহাতেই সেই সিংহের মামা ভোম্বলদাসের মত বাঘের বদলে গন্ডাদশেক কাশ্মিরি জঙ্গিকে মেরে পাট পাট করতে পারেন। যার একান্ত ইচ্ছা জেএনইউ ক্যাম্পাসের বুকে ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেওয়া যাতে ক্যাম্পাসের ছাত্র নামের দেশদ্রোহী লেনিন মাওয়ের বাচ্চা নকশালগুলো ঝাড়েগুষ্টিতে নিকেশ হয়। এহেন মহান দেশভক্তকে প্রতি সন্ধ্যায় ঘিরে থাকছেন প্রচুর গোনুসন্তান স্তাবক। এরা সবাই অনেকটা সেই কবীর সুমনের গানের ‘তালে তাল দিয়ে যায় হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সং’-দের মত। এদের হুক্কাহুয়া আর ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যায় ক্ষীণ কিছু বিরোধীকণ্ঠ। শুধু এই গোনুমানের দলই নয়, গৈরিক গোনুতালে আপনাদের বিরুদ্ধে তালে তাল মেলাচ্ছেন আমাদের ক্রিকেট ঈশ্বর আর সঙ্গীত ঈশ্বরীও। কারণ গ্রেটা থুনবার্গের মত আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত পরিবেশবিদ আর রিহানার মত পপস্টার, সঙ্গীতের এই বিশেষ ধারায় যার খ্যাতিও জগতজোড়া, পাশে দাঁড়িয়েছেন আপনাদের এবং সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছেন আদ্যন্ত কৃষকবিরোধী এই তথাকথিত ‘কৃষি’ আইনের। দুই ঈশ্বর-ঈশ্বরীর মতে মন্তব্যকারীরা সবাই বিদেশের নাগরিক। সুতরাং এদের অন্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার কোনও অধিকারই নেই, অন্যদিকে একধাপ এগিয়ে সরকারি ট্যুইটার হ্যান্ডেল বলছে এই বিদেশিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ তো আজব গেরো! তাহলে তো সদ্যপ্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট শ্রী ডোনাল্ড ট্রাম্প মহাশয়ের অলৌকিক সব কার্যকলাপ, ব্রাজিলের বোলসেনারো সায়েবের আমাজন নিধন বা মায়নামারের নোবেলজয়ী রাষ্ট্রপ্রধান আং সান সু কি-কে সেনাবাহিনি দ্বারা বলপূর্বক উচ্ছেদ, এসব কোনওকিছুর বিরুদ্ধেই কিছু বলা যাবে না। বললেই সেটা অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হবে! আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া (পড়ুন জেলে পোরা) হবে প্রতিবাদকারীদের সব্বাইকে?! প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
যাকগে, অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা হল আমেরিকা, ব্রাজিল, মায়ানামার, আবার ফিরি সিঙ্ঘু আর হরিয়ানা সীমান্তে ‘হেঁই সামাল হো ধান হো’ বলে জান বাজি রেখে বসে থাকা সেই আপনাদের কাছে। হাতে, ভাতে, মিথ্যা প্রচারে প্রতিদিন মেরে ফেলার প্রচেষ্টা চলছে আপনাদের। ইতিমধ্যেই শহীদ হয়েছেন আপনাদের বহু সহযোদ্ধা। কিন্ত কী আশ্চর্য! দমনপীড়ন যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে জেদও বাড়ছে আপনাদের। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছেন প্রতিদিন প্রত্যেকে! এই তো সেদিন, ২৬শে জানুয়ারি, সব বাধার ব্যারিকেড ভেঙে ‘যো বোলে সো নিহাল’ হাঁকতে হাঁকতে আর হাসতে হাসতে পৌঁছে গেলেন লালকেল্লায়। শাসকের হুমকি আর নৃশংস অত্যাচারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে। গাড়ি গাড়ি বাহিনি নামিয়েও আপনাদের রুখতে পারল না রাষ্ট্র। সত্যি বলতে কি আপনাদের দেখে জোর ভরসা জাগছে আবার। তেভাগা-তেলেঙ্গানা-কাকদ্বীপ সফল হয়নি, হয়নি চন্দনপিঁড়ি গ্রামে অহল্যা মায়ের আত্মবলিদান। চুয়ার-ফকির-সন্নাসী বিদ্রোহ, সিদো কানহোর হুল, বিরসা ভগবানের উলগুলান, দুদুমিয়াঁ তীতুমিরের লড়াই চলে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে, খাদ্য আন্দোলন আর নুরুল, আনন্দ প্রায় মুছে যাওয়া কিছু অক্ষরমালা এখন, আগুন নিভে গেছে কবেই। ফের আগুন জ্বালিয়েছিল তরাইয়ের প্রান্তে সেই ছোট ছোট গ্রাম, প্রসাদুজোত, হাতিবিঘা, খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি! গ্যালন গ্যালন সন্ত্রাসের শান্তিজল ঢেলে সে আগুনও নিভিয়েছে রাষ্ট্র। ফের এক ছিটে স্ফুলিঙ্গ! সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম! সেই ভাঙাবেড়া ব্রীজ। যেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন শেখ সেলিম, ভরত মণ্ডল। সেই নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের এক নেতার এখন বিশাল জাহাজ ডিজাইন বাড়ি, তেখালি সোনাচূড়ার মাঠে দাঁড়িয়ে দু লাখ কুড়ি সংখ্যাগুরু, আর সত্তর হাজার সংখ্যালঘু ভোটের বিভাজনের গা ঘিনঘিনে নোংরা হিসেব কষছেন সদ্য গেরুয়া শিবিরে ঝাঁপ দেওয়া আরেক ধূর্ত নেতা। তাপসী মালিকের সিঙ্গুরে ফের টাটা আর ন্যানোকে ফিরিয়ে আনার আকুল প্রার্থনা— সব মিলিয়ে স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার বারবার। তবুও ফের ভরসা জাগছে আপনাদের দেখে। ফিরে ফিরে আসছে স্বপ্নগুলো। সেই ৭০-এর দশক! বাতাসে বোমা-বারুদের গন্ধ! দেওয়ালে লেখা— ‘সশস্ত্র কৃষিবিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!’ সরু গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিত ছেলেগুলো। ‘লালকিল্লে পর লাল নিশান/ মাঙ্গ রহা হায় হিন্দোস্তান!” সেদিন সদ্য ক্লাস টেন, এই ছেলেটাও ছিল সেই দলে। ছেলেগুলো পারেনি। কিন্তু আপনারা! এই তো সেদিন, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে হাসতে হাসতে গিয়ে লালকেল্লার মাথায় চড়ে টাঙিয়ে দিয়ে এলেন স্বাধীন কৃষক নিশান! সালাম, আদাব, প্রণাম আপনাদের। স্বপ্নগুলোকে আরেকবার ভেঙে যেতে দেবেন না দয়া করে, দোহাই আমাদের অন্নদাতারা।
ইতি,
সেদিনের সেই কিশোর ছেলেটা