সন্দীপ পাণ্ড্যে এবং আনন্দী পাণ্ড্যে
লেখকদ্বয় সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী
চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের মধ্যেই সরকার চৌরি চৌরার ঘটনা উদযাপন করল। সেই ঘটনায় জড়িত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরিবারগুলিকে সংবর্ধনা জানাল। ঘটনাটা একটু মনে করা যাক। মহাত্মা গান্ধির অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সেই সময়েই গোরখপুরের কাছে চৌরি চৌরাতে একটি হিংসার ঘটনা ঘটে যায়। প্রথমে সমবেত প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায়, যাতে তিনজন নিহত হন। জনতা ক্ষেপে ওঠে। এবং চৌরি চৌরা থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এই অগ্নিকাণ্ডে ২২ জন পুলিশকর্মী নিহত হন। গান্ধিজি এই হিংসার ঘটনায় এতটাই আহত হয়েছিলেন যে তিনি সমগ্র আন্দোলনটাই প্রত্যাহার করে নেন। যাঁরা এই অগ্নিকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন এবং পুলিশকর্মীরা— উভয় তরফের মানসিকতা উপলব্ধি করেও এই হিংসাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। এই ঘটনায় ১৯ জনের ফাঁসি হয়েছিল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল ১১০ জনের এবং বাকিদের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড। ফলে এই ঘটনায় যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের সংবর্ধনা দিয়ে বিজেপি শুধু যে মহাত্মা গান্ধির সেদিনকার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাল তা-ই নয়, আদতে হিংসাকেই গৌরবান্বিত করল। এবার সেই বিজেপি সরকারই গত ২৬ জানুয়ারির ঘটনার বিরোধিতা করছে হিংসা-র অজুহাতে। অর্থাৎ মূল্যায়নের পদ্ধতিটি সুবিধাবাদী। আরও লক্ষণীয়, প্রান্তিক মানুষেরা জড়িত আছেন এমন ক্ষেত্রগুলিকে বেশি তুচ্ছ করে দেখানো হয়।
বিজেপির বিড়ম্বনা বস্তুত দ্বিগুণ। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী তাদের পিতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা হিন্দু মহাসভা কিন্তু সেই সময়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন করেনি। কিন্তু এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজা উড়িয়ে তারাই যে ভারতের সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষক সেটা প্রমাণ করার কোনও সুযোগই হাতছাড়া করতে বিজেপি রাজি নয়। ফলে তাদের প্রকৃত নেতা যারা সেই সাভারকার, হেডগেওয়ার বা গোলওয়ালকরদের বাধ্য হয়ে সরিয়ে রেখে তাদের মাঝেমাঝেই মহাত্মা গান্ধি, সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার প্যাটেল, বাবাসাহেব আম্বেদকর বা ভগৎ সিং-দের ফুল বেলপাতা দিতে হয়। এইভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু কৃতিত্বও যদি পাওয়া যায় আর কি! দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্বের মতাদর্শের ইতিহাস কিন্তু পুরোপুরি হিংসার ইতিহাস। মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, তার পরিণতিতে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি থেকে মুম্বাইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, আর সেখান থেকে আজকের দিনে মবলিঞ্চিং-এর পৃষ্ঠপোষকতা, গোরক্ষা নিয়ে হিংসা ছড়ানো, যেসব বুদ্ধিজীবীরা তাদের এইসব ন্যক্কারজনক কাজের বিরোধিতা করছেন তাঁদেরকে হত্যা করা, জেলে পোরা, নানারকমভাবে অপদস্থ করা…। এই পুরো হিংসাত্মক কার্যক্রমের একটাই উদ্দেশ্য— হিন্দু ভোট মেরুকরণ করা। মুসলিম, দলিত, আদিবাসী এবং মহিলাদের ওপর ঘটা বর্বরতার বিরুদ্ধে বিজেপি যে আজ পর্যন্ত কোনও দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে, তাদের ইতিহাসে তেমন কোনও নজির নেই।
কৃষক আন্দোলনের প্রতি পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ যে সমর্থন জানিয়েছেন তার বিরুদ্ধে সরকার, তাদের সমর্থকরা, এবং এমনকি তাদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যমও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই চামোলিতে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটল। হিমবাহে ধ্বস, এবং সেই সূত্রে ঋষিগঙ্গা এবং ধৌলিগঙ্গার ভয়াবহ বন্যায় জীবনহানি ঘটল অনেক, ভেসে গেল তপোবন বিষ্ণুগড় এবং ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। কোনও ভাববাদী মনে করতেই পারেন একজন পরিবেশকর্মীকে আক্রমণের বদলা নিল যেন প্রকৃতি। বলা হচ্ছে গ্রেটা ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন। তাহলে চলুন একটু প্রফেসর জি ডি আগরওয়াল— যিনি স্বামী জ্ঞান স্বরূপ সানন্দ নামেও পরিচিত ছিলেন— তাঁকে একটু স্মরণ করা যাক। গঙ্গার উচ্চ প্রবাহের সমস্ত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার দাবীতে ১১২ দিন অনশনের পর দু বছর আগে ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন প্রফেসর আগরওয়াল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এক তরুণ সহকর্মী স্বামী আত্মবোধানন্দ আবার একটা দীর্ঘ অনশন শুরু করেন। এই দুটি অনশনই হয়েছিল হরিদ্বারের মাতৃ সদনে। এই মাতৃ সদনের প্রধান তথা গঙ্গা সাফাই জাতীয় মিশনের ডিরেক্টর জেনারেল স্বামী শিবানন্দ স্বামী আত্মবোধানন্দের সঙ্গে আলোচনা করে তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের সুপারিশ করেন, যার মধ্যে একটি হল তপোবন বিষ্ণুগড়। প্রফেসর আগরওয়াল কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে অনশনে যদি তাঁর মৃত্যু হয় তবে তার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই দায়ী হবেন। মোদি তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি। তাই শেষমেশ প্রকৃতিই উদ্যোগী হয়ে সেই প্রকল্প ভাসিয়ে দিল। এ থেকে সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত— আধুনিক উন্নয়নযজ্ঞ কীভাবে পরিবেশ ধ্বংস করছে সে সম্পর্কে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশকর্মীদের কথা শোনা উচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাকে যেমন কোনও দেশের একক সমস্যা বলা যায় না, তেমনই এই কৃষক আন্দোলনকেও আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে চালানো যায় না। মানবাধিকার একটি বিশ্বজনীন বিষয়। তাই পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে যে কেউ পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সমালোচনা করতে পারেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, কৃষি বিষয়টি প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এবং প্রকৃতি দ্বারা প্রভাবিত। খড় পোড়ানো বা স্টাবল বার্নিং-কে এখন দূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এর বিকল্প খোঁজার জন্য সব মহলেই চিন্তাভাবনা চলছে। একইভাবে, এই তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন অবশ্যম্ভাবীভাবেই কৃষিতে কর্পোরেটায়ন ঘটাবে, যার অনিবার্য পরিণাম আরও কার্বন নিঃসরণ, পরিবেশকে আরও বিষাক্ত করে তোলা। এতে কৃষকরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়বেন— বিশেষ করে ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক এবং মহিলা কৃষকরা।
প্রধানমন্ত্রী এখন প্রতিবাদকারীদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে উপহাস করছেন। আবারও সেই কথাটাই বলতে হয়। তাঁর এবং তাঁর ধাত্রী সংগঠন আরএসএসের আন্দোলন সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। হয় তারা আন্দোলন থেকে দূরে সরে থেকেছে, বা যদি কখনও আন্দোলনে অংশ নিতে হয়েছে এবং গ্রেপ্তার হতে হয়েছে তো সাততাড়াতাড়ি শাসকের পায়ে পড়ে গেছে জেল থেকে বেরোনোর জন্য। না, শুধু বহু-আলোচিত সাভারকরই নন, জরুরি অবস্থার সময় যেসব আরএসএস কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছিল বা মহারাষ্ট্রে এনরন-বিরোধী আন্দোলনের সময়েও আমরা একই জিনিস দেখেছি। যখন উত্তরপ্রদেশে বিজেপির কল্যাণ সিং সরকার ক্ষমতায়, তখনই তারা অযোধ্যায় মসজিদ ভাঙল। আর তারপর আবার তাদের সরকারের আমলেই আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদির ঔদ্ধত্য এতটাই যে তিনি রাম মন্দির নির্মাণকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আসলে এ চূড়ান্ত হতাশার বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতা সংগ্রামই হোক বা সেই ধরনের সমাজ পুনর্গঠনের কোনওরকম সংগ্রামেই যে আরএসএসের কোনও ভূমিকা নেই, সেই হতাশার থেকেই এমন প্রলাপ, জাতীয় সংগ্রাম কি জাতীয় নেতাদের কোনওভাবে হাইজ্যাক করার এমন মরিয়া চেষ্টা।
কৃষকদের তো আন্দোলনজীবী বলছেন, প্রধানমন্ত্রী জানেন কি তাঁকে এবং বিজেপিকে এখন অনেক সমাজকর্মীই কর্পোরেটজীবী বলে ডাকছে!