অশোক মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞানকর্মী, সমাজকর্মী
দিল্লি আইআইটি-র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, দেশের একজন খ্যাতনামা প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানী, এবং একজন সত্তরোর্ধ্ব নিরলস সমাজকর্মী, ডঃ বিপিন ত্রিপাঠী এসেছিলেন কলকাতায়। দিন ছয় সাত তিনি এই শহরে থাকলেন। সেই সুযোগ আমরা কিছু লোকজন নিয়েছিলাম। আমরা মানে সেস্টাস, অনীক পত্রিকা, নিষ্পলক পত্রিকা, পিডিএসএফ-এর কতিপয় সদস্যবৃন্দ এবং আরও কিছু সমমনস্ক অ-মঞ্চ বন্ধুবান্ধব।
সুযোগ মানে হল, কলকাতার জর্জ ভবনে [মৌলালির কাছে] জড়ো হয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সীমিত সংখ্যক আসনে বসে আমরা ডঃ ত্রিপাঠীর কাছে শুনলাম তাঁর সদ্ভাব মিশনের কিছু কার্যক্রম। দেশ জুড়ে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতাবাদের প্রসারের বিরুদ্ধে তাঁদেরও দেশ জোড়া প্রচার কর্মসূচি। তিনি বললেন, তিনি একজন সাধারণ অরাজনৈতিক শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। সেদিন ভাবেননি, তাঁকেও একদিন এরকম সামাজিক কাজ করতে হবে। ব্যাগে করে প্রচারপত্র ছাপিয়ে নিয়ে দোরে দোরে ঘুরতে হবে।
কিন্তু ১৯৮২ সালের ভাগলপুর দাঙ্গার সময় যখন তিনি আমেরিকার মেরিল্যান্ডে শিক্ষকতা করছিলেন, সেই ঘটনার বীভৎসতায় মানসিকভাবে প্রচণ্ড আহত হন। পাশাপাশি বেশ কিছু শিক্ষিত লোকের সেই দাঙ্গাতে মুসলিমনিধন যজ্ঞের সমর্থনে কথা বলতে শুনে তিনি আরও বেশি বিপর্যস্ত বোধ করেন। তারপর থেকেই সামাজিক মেলামেশার মধ্য দিয়ে পরস্পরকে বোঝার প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি দেশের বুকে ক্রমউত্থীয়মান অশুভ হিন্দু মৌলবাদী শক্তিকে নিরস্ত ও পরাস্ত করার উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের দিল্লির শিখনিধন যজ্ঞে, কিংবা গুজরাতে ২০০২ সালে মুসলিম গণহত্যার কালে তিনি ছুটে গেছেন এইসব দাঙ্গাবিধ্বস্ত জায়গায়।
সভাটি পরিচালনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণপদার্থবিজ্ঞানের ভূতপূর্ব অধ্যাপক এবং বাম ঐতিহ্যমণ্ডিত মাসিক অনীক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ডঃ শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। তিনি ডঃ ত্রিপাঠীর বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তারে গৃহীত কার্যক্রমের ব্যাপারেও শ্রোতাদের অবহিত করেন। প্রসঙ্গত তিনিও জানান, ১৯৮৪ সালে দিল্লির দাঙ্গার সময় একটি পেশাগত কার্যোপলক্ষে সেখানেই ছিলেন এবং দাঙ্গাকারীদের যাবতীয় নৃশংসতা ও পুলিশ প্রশাসনের নির্বিকার নিষ্ক্রিয়তা অত্যন্ত বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
সভার সূচনায় সেস্টাসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি সেদিনের আহুত সভার পশ্চাদপট ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করি।
বিপিন ত্রিপাঠী তাঁর দীর্ঘ ভাষণে ব্যাখ্যা করেন, বিজেপি কীভাবে দেশের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে নিজের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে ধ্বংস করে দিতে চায় এবং সর্বদাই বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় ও অন্যান্য জাতি-ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষের মনোভাব জিইয়ে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। চূড়ান্ত স্বৈরাচারী মনোভাব থেকেই তারা কাশ্মিরকে টুকরো টুকরো করে ভেঙেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন শেষ করে দিয়েছে। দেশের সংবিধানের প্রতি তাদের ন্যূনতম দায়বদ্ধতাও নেই। যে কোনও ধারা সামান্য অছিলায় তারা লঙ্ঘন করতে পারে, মানুষের যে কোনও অধিকার তারা কেড়ে নিতে দুবার ভাবে না! বিচার ব্যবস্থাকে তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত গণমাধ্যমকে তারা কিনে ফেলেছে। একটা খবরের কাগজে, একটা চ্যানেলেও বিজেপি-র বক্তব্যের বাইরে অন্য কোনও বক্তব্য বা খবর দেখাচ্ছে না বা প্রচার করছে না।
প্রাক-স্বাধীনতা যুগের অবিভক্ত বাংলা এবং বর্তমান পশ্চিম বাংলার সংগ্রামী ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা পোষণ করেন। ১৯৪৬-৪৮ সালের যুক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলন, ১৯৬৭ সালের নকশালবাড়ি আন্দোলন— আসলে যে দেশের কৃষকদেরই বিক্ষোভের প্রকাশ তা তাঁকে গভীরভাবে আপ্লুত করেছে। রবীন্দ্রনাথের “একলা চলো” গানটি তাঁকে সমস্ত সময় শক্তি যোগায় এবং তিনি তা গাইতেও ভালোবাসেন। ভাষণের মধ্যে তিনি তাঁর নিজের লেখা একখানি গজল গেয়ে শোনালেন।
বিজেপি যে সারা দেশের শুভ সংস্কৃতিকে বিলোপ করেই বাড়ছে, পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় এলে তারা যে এখানকার রবীন্দ্র-নজরুল সৃষ্ট সমন্বয়ের সংস্কৃতিকেও ধ্বংস করবে— এই হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি সভাস্থ সকলকে শুভবুদ্ধি ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে এই ধ্বংসাত্মক শক্তিকে রুখবার জন্য এগিয়ে আসতে আহ্বান জানালেন।
কলকাতায় সদ্য গড়ে ওঠা এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়া “ফ্যাসিস্ট আরএসএস বিজেপি বিরোধী বাংলা” গণমঞ্চের একজন অন্যতম সংগঠক এবং অনীক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর আর একজন সদস্য ডাঃ সুমিতা দাস “বিজেপি-কে একটিও ভোট নয়” শ্লোগানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে এই সভায় বক্তব্য রাখলেন। তিনি দেখালেন, এই শ্লোগানের অর্থ হল, মানুষ কাকে বিজেপি-র বিকল্প ভেবে ভোট দেবে, তা এই মঞ্চ বলে দিতে চায় না, কেন না, মঞ্চের তরফে কোনও বিকল্প দলের প্রতি আলাদা করে সামান্যতম পক্ষপাতিত্বও নেই। কিন্তু বিজেপি-র ঘৃণা বিদ্বেষের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে এবং অন্যান্য দলের নানা রকম অসাধু জনবিরোধী কার্যকলাপের কারণে তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধা থেকে সাধারণ মানুষ, এমনকি এই সব অবিজেপি দলের সমর্থকরাও যেন বিজেপি-কে ভোট না দেয়, ডাঃ দাসের মতে, এটা সুনিশ্চিত করাই এই মঞ্চের লক্ষ্য।
নিষ্পলক পত্রিকা গোষ্ঠীর তরফে জগদীশ সর্দার সরোজ বসু এবং সাহাবুল ইসলাম গাজী দিল্লিতে গিয়েছিলেন সেখানে চলমান বিক্ষোভের উত্তাপে নিজেদের দেহমনকে সিঞ্চিত করে নিতে। তাঁদের তরফ থেকে জগদীশ সর্দার দিল্লিতে থেকে কিসান আন্দোলনের সমর্থন ব্যক্ত করে সিংঘু সীমান্তের শিবিরে কয়েক দিন পাশে পাশে থাকার অভিজ্ঞতা, পাঞ্জাবের বার্নালা লুধিয়ানা ইত্যাদি জেলায় কিছু কিছু চাষি ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপ, শহীদ ভগৎ সিং-এর ভাইপো এবং বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী জগমোহন সিং-এর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎকার— ইত্যাদির প্রেরণাদায়ক গল্প শোনালেন শ্রোতাদের।
সভায় নানা প্রাসঙ্গিক প্রশ্নে বক্তব্য রাখলেন ডাঃ মৃন্ময় সরকার, অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি অফিসার রবীন চক্রবর্তী, শিক্ষক সাহাবুল ইসলাম গাজী, প্রমুখ।
সব শেষে ডঃ ত্রিপাঠীকে সভার এবং আয়োজকদের তরফ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হল। কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যে বিজেপি-র ঘৃণার চাষের বিরুদ্ধে একটু একটু করে নানা ধরনের ও বিভিন্ন মাত্রার প্রচার আন্দোলন গড়ে উঠছে সেই দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। সভাপতির ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই সংক্ষিপ্ত, সীমিত ও মহতী সভার কাজ সেদিনের মতো সমাপ্ত হল।
অন্তত একটা ভরসা পাওয়া গেল, বিজেপি-র ফ্যাসিস্ট শিবিরের লোকেরা যতই চেষ্টা করুক, নরকুলে কংস বধের বীজ সারা দেশের বুকে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে চলেছে। দৃশ্যে এবং অদৃশ্যে। তরুণ, যুবক, ছাত্র, শিক্ষক, প্রবীণ— সমস্ত অংশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘৃণা এনাআরসি-র গণশত্রু রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন।