চার নম্বর নিউজডেস্ক
সিমরানজিৎ সিং, বয়স তিরিশ।
জসগির সিং, বয়স বত্রিশ।
সন্দীপ সিং, বয়স তিরিশ।
মাখন সিং, বয়স বিয়াল্লিশ।
গুরপিন্দর সিং, বয়স তেইশ।
বীরেন্দর সিং, বয়স বত্রিশ।
লাখবীর সিং, বয়স পঁয়তাল্লিশ…
তালিকা। না, সিন্ডলারের না। সরকারের। তথাকথিত ‘দুষ্কৃতকারী’ কৃষকদের তালিকা। এঁরা পাঞ্জাবের বাথিন্ডা জেলার বঙ্গি নিহাল সিং গ্রামের চাষি। এঁদের মধ্যে কনিষ্ঠ যে অর্থাৎ গুরপিন্দর, আগেই বলেছি তেইশে পড়েছেন। গত তেইশে জানুয়ারি তাঁর বাবা বুটা সিং টিকরি সীমান্ত থেকে নিজের গ্রামে ফিরেছিলেন ছেলেকে ভবিষ্যতের রাস্তা দেখিয়ে। কারণ সেইদিনই ট্র্যাক্টর জমায়েতের জন্য গ্রাম ছেড়েছিলেন ছোট ছেলে গুরপিন্দর। এখন তিহারে তিনি। তিহার জেলে। প্রজাতন্ত্রের হিংসার ঘটনার পর গ্রেপ্তার আরও একশো বাইশজন কৃষকের সঙ্গে অন্ধকারে।
বুটা এবং তাঁর বড় ছেলে গুলবিন্দরের পর, অনেকটা পর ছোট ছেলে গুরপিন্দর আন্দোলনে যোগ দেন। বোঝেননি শুরুতেই রোষে পড়বেন। কোনওরকম প্ররোচনা, হিংসা ছাড়াই টানাহেঁচড়া চলবে পুলিশি সক্রিয়তার। বাকি জীবনটা দাগিয়ে দেওয়া হবে জেলফেরত বলে।
গুরপিন্দর সিং-এর মা
বঙ্গি নিহাল সিং গ্রাম থেকে সেদিন ট্র্যাক্টর র্যালিতে যোগ দিতে চার যাওয়া আটজনের সাতজনের প্রসঙ্গ আগেই বলেছি। বাকি ছিলেন রাওয়াল সিং। এই রাওয়ালই পুলিশি বর্বরতার প্রসঙ্গ ফাঁস করলেন। তাঁর বয়ান বলছে, গত ছাব্বিশে জানুয়ারি পূর্বনির্ধারিত পথে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের পর টিকরি সীমান্তে ফেরার পথে নাঙ্গলোই থানার কাছে তাঁদের আটকায় পুলিশ। ট্র্যাক্টরগুলি পাহারা দেওয়ার জন্য তিনি বাইরে থাকলেও বাকি সাতজন থানার ভেতরে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর জানানো হয় তাঁরা গ্রেপ্তার। রাওয়াল কোনওভাবে পালিয়ে এসেছিলেন বঙ্গি নিহালে। গ্রেপ্তার বন্ধুদের পরিবারে জানালেন খবর। স্রেফ কিছু অংশের উসকানি এবং বাকিটা প্রচারমাধ্যম-প্ররোচিত উসকানিতে আক্রান্ত হলেন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদরত সমগ্র কৃষকশ্রেণি। দীর্ঘদিনের এক আন্দোলনে দাগ লেগে গেল অহেতুক। অকারণ …
দিল্লি পুলিশের মতে গ্রেপ্তার কৃষকদের ধারা ১৪৭ (দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য), ধারা ১৪৮ (মারণাস্ত্র সহযোগে দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য), ধারা ১৪৯ ও ১৮৯ (সরকারি কর্মীদের কাজে বাধা দেওয়ার দায়) ইত্যাদি ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশের মতে এই গ্রেপ্তার হওয়া ১০৯ সংখ্যাটির অনেক উপরে গিয়ে কৃষক সংস্থা সংযুক্ত কিসান মোর্চা বলছে আসলে ২০০-র বেশি চাষি নিরুদ্দেশ। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায়, কোন থানার অন্ধকারে তাঁরা, খোঁজ নেই কিছুই …
বঙ্গি নিহালে অবশ্য প্রতিটা ঘরের জানলায়, গাড়িতে, দোকানে কৃষক একতার পতাকা উড়ছে। আক্রোশে, আরও, আরও বেশি উৎসাহে কাঁপছে কৃষক ভারতবর্ষ। কৃষি আইন পাশের সঙ্গে সঙ্গে সিধুপুরের ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের থেকে বঙ্গি নিহালের গ্রামের প্রধান জসগির সিং গুরুদোয়ারার মাধ্যমে বিল সংক্রান্ত ব্যাপারে কৃষকদের শিক্ষিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জসগিরের ঘরে গ্রেপ্তার হওয়া ওই সাতজন চাষির পরিবার একত্র হয়েছেন। তাঁদের কথায় লাল কেল্লায় বিক্ষোভের সমালোচনা। বিস্ময় গ্রেপ্তারের ঘটনায়। তাঁদের ছেলেরা, ভাইয়েরা তো প্রতিবাদ করলেন পূর্বনির্ধারিত রুটেই! তাহলে? কাদের আটকাতে কাদের ফাঁসাচ্ছে অপদার্থ শাসক? পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস পেয়েছেন তাঁরা। উকিলের সঙ্গে কথা বলছেন। আশা বেরোবেই। রাস্তা থাকবেই কোথাও না কোথাও।
জসগির সিং-এর পরিবার
গ্রেপ্তার হওয়া বীরেন্দরের নাম তালিকায় আগেই বলেছি। গুরুদোয়ারার জোরালো ঘোষণা সেই বীরেন্দরের পিতামহীর শেষযাত্রার। আকস্মিক মৃত্যু বৃদ্ধার। পৌত্রের উপর আকস্মিক আঘাতে? উত্তর জানেন না বঙ্গি নিহালের কেউ। গ্রেপ্তার হওয়া মাখন সিং-এর মেয়ে ক্লাস টেনে উঠেছে। ক্লাস টপার। ষে মেয়ে আইএএস হবে। স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন অবশ্য গুরপিন্দরও দেখতেন। যে শাসক তাঁকে তিহার উপহার দিল, তাঁদের উপরও বিশ্বাস হারাননি তিনি। ফৌজি হতে চেয়েছিলেন। একাধিকবার শারীরিক পরীক্ষার উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। মন খারাপ করে বসেছিলেন। কৃষিতে আসবেন ভাবেননি। বাধ্য হয়ে আসা। আর শুরুতেই এই পরিণতি। বুটা সিং ছেলেকে বীরের চোখে দেখছেন। পুরনো অ্যালবাম ঘেঁটে বুকে সাহস জোগাচ্ছেন। গ্রেপ্তার হওয়া সিমরানজিৎ সিং-এর ভাই মনদীপ বলছেন— ‘খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গি নিহাল থেকে দলে দলে লোক দিল্লি যাচ্ছেন। বন্ধুদের, পরিজনদের ভরসা জোগাতে।’ নতুন বিয়ে হওয়া সিমরানজিৎ-এর স্ত্রী স্বামীর জন্য গর্বিত— ‘তিনি কাজ করতে গেছেন, অধিকার চাইতে গেছেন, ছিনিয়েই আনবেন।’
মাখন সিং-এর বাবা মা
এসবের অনেক বাইরে থেকেও, আসলে ভীষণভাবেই জড়িত হয়ে আছে জসগির সিং-এর সাত বছরের ছেলে সুখদেবের মুখ। সে খেলছে। খেলনার ট্র্যাক্টর নিয়ে। ট্রলির মধ্যে বালি ভরছে। কখনও তার দিয়ে ট্র্যাক্টর টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আদুরে কণ্ঠে চিৎকার, ‘ওয়াহে গুরুজি দা খালসা, ওয়াহে গুরুজি দে ফতে।’ বাবা কোথায়, জানতে চাওয়ার পর তাকে বলা হয়েছে বাবা বিক্ষোভ ধর্নায়। গ্রেপ্তারি বলা হয়নি। ও জানে বাবা এখনও সীমান্তে বসে। ফতে, বিজয়, আসবেই আসবে।
সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সাতশো জন লড়ছেন বঙ্গি নিহালে। একদিন সবার উচ্চারণ, সবার কণ্ঠ, প্রার্থনা পূর্ণ হবে। ‘জো বোলে, সো নিহাল’…